কেন হারিয়ে গেলেন নভেরা

উত্তরটা সংক্ষিপ্ত,কিন্তু ভয়ঙ্ক, কেন হারিয়ে গেলেন নভেরা আহমেদ!?-দুর্মর

নভেরা আহমেদ (মার্চ ২৯, ১৯৩৯–মে ৬, ২০১৫) ছিলেন একজন বাংলাদেশী ভাস্কর। তিনি বাংলাদেশের আধুনিক ভাস্কর্যশিল্পের অন্যতম অগ্রদূত এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম বাংলাদেশী আধুনিক ভাস্কর।১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে একুশে পদক প্রদান করে। তিনি প্রায় ৪৫ বছর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত প্যারিসে বসবাস করেন।

নির্বাসিত শিল্পী নভেরা আহমেদ, চিরকালের জন্য নির্বাসনে চলে গেলেন । ভাস্কর নভেরা আহমেদের মৃত্যুতে আমরা বাঙালিরা শোকাহত ।

দেশে বা প্রবাসে সবখানেই শিল্পী নভেরার মৃত্যুর শোকের চিহ্ন। কোনো মৃত্যুই কাম্য নয়। তা সে পূর্ণ বয়সের মৃত্যুও হোক না কেনো । মানুষ কখনই তার প্রিয়জনকে হারাতে চায় না। 

আর সে যদি হয় অসাধারণ প্রতিভাবান কেউ তবে তো কথাই নেই । আপনজন কেনো,
কাছের-দূরের কোনো মানুষই সেই চলে যাওয়াকে সহজভাবে মেনে নিতে পারে না।
মানুষ চায় তার স্মৃতিকে অবিস্মরনীয় করে রাখতে । 

তার চলে যাওয়াকে মেনে নিতে পারলেও, সময়ের একটা কঠিন পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় সবাইকে । একমাত্র সময়ই পারে, সব কিছুকে ভুলিয়ে দিতে । সময়ের কথায় মনে পড়ে গেলো, নভেরার জীবনের বিভিন্ন সময়ের সমসাময়িক পারিপার্শ্বিকতার কথা। আমরা নভেরা সম্পর্কে কতটুকু জানতে পেরেছি আসলে?

বাস্তবে, শিল্পী নভেরা সম্পর্কে তেমন করে জানার উপায় নেই । যেমন করে আমরা বাংলাদেশের আর যে কোনো শিল্পী বা শিল্পকলা সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ক্ষেত্রে অজানা একটা অন্ধকারে বাস করে আসছি। 

শিল্পী নভেরা আহমেদের কথা আরো বেশী রহস্যময় এবং অন্ধকারে ঘেরা। কারণটা হয়তো কারো আর অজানা নেই। তিনি ছিলেন স্বেচ্ছায় নির্বাসিত। চার দশক সময় ধরে। চল্লিশটা বছর, কম সময় নয় মহাকালের হিসাবেও। 

৮৫ বছরের দীর্ঘ জীবনের প্রায় অর্ধেকটা তিনি বাংলাদেশ থেকে দূরে। বাংলাদেশ বললে হয়তো ভুল হবে; তিনি বাংলাদেশের শিল্পী ছিলেন কি ; বা স্বাধীন বাংলাদেশ বললে হয়তো আরো সঠিক করে বলা হবে । 

তিনি তাঁর জীবদ্দশায় কখনও স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেননি। তিনি তাঁর নিজের জন্মভূমি থেকে ছিলেন স্বেচ্ছায় নির্বাসিত। 

সেই সময় যাকে সবাই ভারতীয় উপমহাদেশ বলে জানতো, পরবর্তীতে পূর্বপাকিস্থান! আমরা সেই অবস্থান থেকে আসলে তাকে কতটুকু আমাদের দেশের শিল্পী বলে দাবী করতে পারি আমার জানা নেই । 

তেমন করে তো আমরা বাংলাদেশের মাটিতে জন্মগ্রহনকারী সূচিত্রা সেনের মতো এবং আরো অনেকে আছেন তাদেরকে, আমাদের নিজেদের বলে দাবী করতে পারি। 

যিনি চল্লিশ বছর আগে আমাদেরকে পিছনে ফেলে চলে গিয়েছেন এবং ফিরে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করেননি, তাকে আমাদের বলে অধিকার করবার অধিকার আমাদের আছে কিনা জানি না। মূলত কোন কারণে তিনি দেশ ত্যাগী হলেন সেটাও আমরা জানি না। 

আমরা কেনই বা জানতে চায় ? কারণ তিনি আমাদের দেশের (?) অর্থাৎ তৎকালীন পূর্বপাকিস্থানের শিল্পী ছিলেনএবং তিনি ছিলেন একজন জনপ্রিয় মানুষ, সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষ, তাঁর সম্পর্কে আমরা, সাধারণ মানুষেরা জানতে চায়বো সেটাইতো স্বাভাবিক। 

কিন্তু আমাদের হয়তো কখনও জানা হবে না, দেশ ছেড়ে যাবার পরেও, কেনো তিনি আমাদের প্রিয় দেশ, বাংলাদেশের মাটিতে কোনোদিনো ফেরার কথা ভাবেননি। 

বাংলাদেশের জন্মের আগেই তিনি নিজের জন্মভূমি ছেড়ে বিদেশের মাটিতে পাড়ি জমিয়েছেন এবং সেই দেশকে তিনি আপন করে নিয়েছেন।

আমরা জানি, তিনি কোনো সুবিধা বঞ্চিত পরিবারের সদস্য ছিলেন না। তিনি বেশ ভাগ্যবতীও ছিলেন, যার এমন অনেক বন্ধুমহল ছিলো যারা তাঁকে, তাঁর প্রতিভার মূল্যায়ন করেছেন। তাঁর শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন। 

তাহলে তাঁর জীবনে মূলত বাধা বা প্রতিবন্ধকতাটা কোথায় ছিলো ? জীবনের প্রথমদিকে তিনি বেশ সুযোগ সুবিধা পেয়েছেন, ইংল্যান্ড ও ইউরোপে শিক্ষা লাভের সুযোগ পেয়েছেন, সে সময় অনেকের জন্য যা ছিলো শুধুই স্বপ্নের মতো। 

অনেকের জন্য এখনও সেটা স্বপ্নই বটে। তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পেয়েছেন প্রদর্শনীর সুযোগ । কিন্তু তাঁর পথচলাকে শেষ পর্যন্ত কেনো একটা পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেননি তা আমাদের আর হয়তো জানা হবে না । 

কারণ শিল্পীর কাজ বা পথচলা সম্পর্কে যদি কেউ সঠিক তথ্য দিতে পারে , সে হলো শিল্পী নিজে । 

আমাদের দেশে সেই সুযোগ অনেক ক্ষীণ । তার কারণ হিসেবে আমি বলতে পারি সহজেই; আমাদের প্রকৃত শিক্ষার এবং অভিজ্ঞতার অভাব, সর্বপরি আমাদের সততার এবং স্বচ্ছতার অভাব । 

তিনি তাঁর সেই অসাধারণ স্কুলিংকে ব্যাবহার করে তাঁর কাজকে আরো পরিশালিত করতে পারতেন এবং তাঁর অভিজ্ঞতাগুলো কে তিনি আরো অভিব্যক্তিময় করে তুলতে পারতেন ।

তাঁর কাজের প্রতিবন্ধকতা বলতে যদি অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা বলে আমরা ধরে নেই তাহলেও সেটি খুব একটি যুক্তিযুক্ত হবার কথা নয়। 

কারণ, ষাটের দশক থেকে একবিংশ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত তিনি যদি ফ্রান্সের মতো পৃথিবীর ধনী দেশ এবং প্যারিসের মতো শহরে বসবাস করতে পারেন যেটা কিনা শিল্পকলার তীর্থ স্থান । সেখানে বিভিন্ন ভাবে অর্থনৈতিক সহোযোগিতা মেলা সম্ভব। 

আর সেটাও যদি না অর্জন করা সম্ভব তাহলে আমাদের সেটাকে চিহ্নিত কার উচিৎ শিল্পী হিসেবে যে, প্রবাসে বসবাসরত শিল্পীদের কাজের ক্ষেত্রে আমরা সাধারণত কি কি ধরনের বাধা বা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখিন হই । 

এবং সেখান থেকে আমাদের মুক্তির উপায় কি হতে পারে । অথবা যদি ধরে নেই তাঁর কাজের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাগুলো ছিলো শারীরিক, তাহলে আমাদের স্পর্শকাতর একটা অবস্থান থেকে বিষয়টাকে বিচার করতে হবে। 

এবং এটাও আমাদের জানার মধ্যে রাখতে হবে যে পৃথিবীতে শিল্পী মূলত প্রতিবন্ধকতার মধ্যেই বেড়ে ওঠে । সোনার চামচ মুখে দিয়ে কেউ শিল্পী হয়ে জন্মায় না বা গোলাপের পাপড়ি বিছানো বিছানাতে শুয়েও কেউ শিল্পী হয়ে ওঠে না। 

শিল্পী হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটা কোনো ভাবেই মসৃন নয় । শিল্পীর সৃষ্টিই শুধু তার পরিচয় নয়, তার জীবন যাপনই একটি অনবদ্য শিল্পকর্ম হয়ে ওঠে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে। যেটাকে লাইফ স্টাইল বলা যায় ! 

সে ক্ষেত্রে নভেরার কথা আমরা যতদূর জানতে পারি তিনি শারীরিক ভাবে বিদ্ধস্থ ছিলেন । নানা দূর্ঘটনার কারণে তাকে শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে । 

সে ক্ষেত্রে তিনি ভাস্কর্য ব্যাতিরেকে অন্য আরো অনেক সহজ মাধ্যমেও কাজ করতে পারতেন । হয়তো করেছেনও । আমাদের সঠিক করে জানা নেই ।

আমাদের জাতীয় শহীদ মিনারে নকশাকে ঘিরে আরো যে নীলনকশার জন্ম হয়েছে, আরো যে ষড়যন্ত্র বা অন্ধকারের জন্ম হয়েছে, সেটার মীমাংসা করার দায়িত্ব তাদের ছিলো যারা এর সাথে শুরু থেকেই জড়িত ছিলেন। 

আমরা বাঙালি জাতি হিসেবে যদি সে সম্পর্কে কোনো ভুল তথ্য জানি, সে ক্ষেত্রে দোষটা আমাদের ঘাড়ে না দেয়াটাই উত্তম। আমাদেরকে ক্রমাগত ভাবে আমাদের অতীত ইতিহাসের থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।


সে কারণে আমরা ভবিষ্যত থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি জাতি হিসেবে । বর্তমান বলে তো কোনো কিছুর অস্তিত্ত্ব নেই আমাদের। সব কিছু বায়বীয় ভিত্তিহীন ।

শহীদ মিনারের নকশা নিয়ে যে টানাহেচড়া চলছে; তাতে মনে হচ্ছে আমাদের পক্ষে আর
কোনো নতুন স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা সম্ভব নয়। 

আমরা কি পারি না নতুন করে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিস্তম্ভ গড়তে ; আমাদের নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের দিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টি করতে । পুরাতন স্মৃতিস্তম্ভের পাশাপাশি নতুন করে বা পরিবর্ধিত অবস্থায় কোনো স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করতে?

শিল্পী নভেরার এই চলে যাওয়াকে ঘিরে আমাদের বাংলাদেশীদের মধ্যে যে কম্পনের সৃষ্টি হয়েছে তাতে করে আমরা আরো বেশী করে জানতে পারি ব্যক্তি নভেরা সম্পর্কে। 

আর্ন্তজালিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমাদের পরিধিটা বেশ ব্যাপ্তি পাচ্ছে দিন দিন ; বিধায় আমরা আরো বেশী করে জানতে পারছি ব্যক্তি মানুষের কথা। কিন্তু আমাদের জ্ঞানের সীমানা কোনো কোনো ক্ষেত্রে এখনও সেই সংকীর্নতায় ঘিরে আছে, আছে অন্ধকার হয়ে। 

নভেরার শিল্পকর্ম সম্পর্কে বিশ্লেষণী কোনো আলোচনা বা সমালোচনার অবকাশ নেই খুব একটা। বেশ কয়েক বছর ধরে অর্ন্তজালের সুবাদে নভেরা সম্পর্কে বেশ কিছু সমসায়িক এবং নিকট অতীতের খবর জানতে পারি । 

আর লেখক হাসনাত আবদুল হাই এর ‘নভেরা’ বইটির কথা তো মনে আছেই; যদিও বেশ কয়েক বছর আগের পড়া। সব মিলিয়ে শিল্পী নভেরার প্রতি আমাদের কোনো আগ্রহের কমতি ছিলো না কোনোদিনও । 

কিন্তু শিল্পী নভেরা কি আমাদের কথা ভেবেছেন কখনও । হয়তো ভাবতেন । তাঁর শাড়ী পরে ফরাসী স্বামীর সাথে ছবি দেখলেতো তাই মনে হতে পারে। কিন্তু তিনি কেনো নিজে থেকে আমাদের জন্য দু লাইন লিখে রেখে জাননি ? 

কেনোই বা তিনি নিজের কাজেরও তেমন কোনো বর্ণনা দিতে আগ্রহ বোধ করেনি তাঁর জন্মভূমির মানুষদের জন্য, তাঁর শুভাকাঙ্খিদের জন্য ? আমরা আমাদের অবস্থান কে সুস্পষ্ট একটা রুপ দিতে ব্যর্থ হচ্ছি বারবার। ফলে ক্রমাগতভাবে আমরা ভ্রান্তিময় একটা জগৎ সৃষ্টি করে যাচ্ছি।

তাঁর অভিমানের গভীরতায় মনে হয় তিনি গভীর ক্ষত (?) নিয়ে দেশ ত্যাগ করেছিলেন। তাঁর দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের এক ফেইসবুক পোস্ট থেকে যেটা জানান যায় তাতে করে মনে হয় খুব বালখিল্য একটা কারণে তিনি দেশ ত্যাগ করেছেন এবং পারিবারিক কারণে দেশ ত্যাগ করা আর রাজনৈতিক বা সামাজিক কারণে দেশ ত্যাগ করা ভিন্ন বিষয় । 

তিনি যদি ব্যক্তিগত কারণে দেশ ত্যাগ করে থাকেন সে ক্ষেত্রে জাতি হিসেবে আমাদের অপরাধবোধে ভোগানোর কোনো অধিকার হয়েতো নেই । তবে দেশ ত্যাগের তাঁর সেই ক্ষতটুকুই যথেষ্ট ছিলো একজন শিল্পীর শিল্পচর্চার জন্য ।


একজন শিল্পীর পথচলার জন্য । ফ্রিদা কাহলোর কথা মনে হতে পারে আমাদের । তাঁর শরীরে সে কত যন্ত্রণা বয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে । 

তারপরেও তাঁর কাজের মধ্যে সে সব যন্ত্রণাকে সে অভিব্যক্ত করতে দ্বিধা বোধ করেনি । নভেরা আহমেদের কাজের মধ্যে তাঁর জীবনবোধের যন্ত্রণার সানাইয়ের সুর বাজতো কিনা আমি জানি না । আমি দেখিনি তাঁর চিত্রকর্ম নিজ চোখে । 

হ্যা অবশ্যই অতীতের কিছু ভাস্কর্য ছাড়া ; তবে তেমন কোনো গভীর বেদনাবোধ ধরা পড়ে না তাঁর কাজে ।

শিল্পী বা ভাস্কর নভেরার কাজে ব্রিটিশ ভাস্কর হেনরী মুর এবং বারবারা হেপওয়ার্থ এর প্রভাব অত্যন্ত সুস্পষ্ট । বলাই বাহুল্য শিল্পী নভেরা পঞ্চাশের দশকে ইউরোপেই থাকতেন । 

তাঁর জন্য পৃথিবী বিখ্যাত সেই সব ভাস্করদের কাজের সান্নিধ্যে আসাটা খুব একটা কষ্ট সাধ্য বিষয় ছিলো না । যদিও বারবারা হেপওয়ার্থ কিংবা হেনরী মুরের ভাস্কর্যের ভলিউম বা ঘনত্বের সাথে নভেরার ভাস্কর্যের তেমন কোনো সাদৃশ্যতা নেই । 

সেখানে নভেরার ভাস্কর্যকে অনেক ক্ষেত্রে চ্যাপ্টা মনে হতে পারে । বেশীরভাগক্ষেত্রে তিনি ক্লোজড এবং অর্গানিক ফর্ম নিয়ে কাজ করতেন। পরিবারের প্রতি তাঁর যে একধরনের দূর্বলতা ছিলো সেটাও ফুটে ওঠে তাঁর কাজে ; যেমন হেনরী মুরের কাজেও দেখা যায় ।

শিল্পকলায় সারা পৃথিবীতে, রেনেসাঁর পরবর্তী সময়ে, ভাস্করদের থেকে চিত্রকরদের সংখ্যাই বেশী ছিলো । চিত্রকলা চর্চা ছিলো অনেক বেশী সহজ , ভাস্কর্য চর্চার থেকে । ভাস্কর্য চর্চার জন্য স্হান এবং নির্মান সরঞ্জামের যোগান একটা বিরাট চ্যালেন্জ সব সময় । সে ক্ষেত্রে ভাস্করদের সংখ্যা তুলনা মূলকভাবে কম ছিলো সারা বিশ্বে এবং নারী ভাস্করতো অবশ্যই কম । 

নভেরা আহমেদকে উপমহাদেশের প্রথম আধুনিক ভাস্কর বলা হয় । শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন স্যার যেমন উপমহাদেশের আধুনিক শিল্পকলার জনক । যার সূচনা হয় কবিগুরু রবিন্দ্রনাথের হাতে । 

কিন্তু আমাদের এই অর্জনগুলোকে আমরা সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়েছি । এমনকি পার্শ্ববর্তীদেশ ভারতও যখন এগিয়ে গিয়েছে তখন, আমরা দিনে দিনে পেছনের দিকে হেটে চলেছি … 

সেই প্ঞ্চাশ-ষাটের দশকেই নভেরার কাজে আধুনিকতার ছোয়া দেখতে পান অনেকেই ; কিন্তু তারো বহু আগে ১৯১৭ সালে ইতিমধ্যেই ফাউন্টেন নামে একটি ফাউন্ড অবজেক্টের মাধ্যমে ফরাসী শিল্পী মার্শাল ডুশ্যাঁ কন্সেপচুয়াল শিল্পকলার যাত্রা শুরু করিয়ে দিয়েছিলেন । 

সে ক্ষেত্রে শিল্পকলায় আধুনিকতার শুরু আমরা ইম্প্রেশনিজম সময় থেকেই ধরে নিতে পারি । নভেরা আহমেদ সেই সময় ইউরোপে বসবাসরত ছিলেন ; আধুনিক ভাস্কর্যের চরিত্র তাঁর কাজে আরো বিলষ্ঠ ভাবে ধরা পড়বার কথা ছিলো। 

যখন ভাস্কর্য জগৎকে আলোকিত করছিলো, হেনরী মুর, বারবারা হেপওয়ার্থ, আলেক্সান্ডার কেল্ডার, আলবার্টো জিওকোমেত্তি, কনস্টান্টিন ব্রাঙ্কুইসি এবং আরো অনেকে । ভাস্কর রঁদ্যারও তিনি ভক্ত ছিলেন, সেটা যে কোনো ভাস্কর মাত্ররই হওয়ার কথা । ২০০৮ এবং ২০০৯ এ নির্মীত কিছু ভাস্কর্যে তিনি ভাস্কর জিওকোমেত্তির মতো অমসৃন সমতল ব্যবহার করেছেন । 

একজন মানুষের প্রতিকৃতি মূর্তিতে দেখা নাক, কান বিহীন যেনো পরিচয়হীন, অনুভূতিহীন কোনো মানুষ। আবদ্ধ , বিস্মৃত । যথারীতি শিল্পী পিকাসোরও প্রভাব লক্ষ্য করা যেতে পারে তাঁর ভাস্কর্যে ।

কলোম্বিয়ান শিল্পী ডরিস সালসেদোর এর কাজেও আমরা দেখি স্বদেশ ত্যাগের যন্ত্রণার কথা। তিনিও দেশ থেকে নির্বাসিত । অনেক শিল্পীকেই দেশ থেকে নির্বাসিত হতে হয়েছে, আরমেনিয়ান শিল্পী আর্শাইল গোর্কি ; কিন্তু তাঁদের কাজে আমরা দেখি সেই যন্ত্রণার ছাপ, যা শিল্পী নভেরার কাজে বেশ অনুপস্থিত।

গোর্কির চিত্রকর্মে মা ও মাতৃভূমি ত্যাগের বেদনা সুস্পষ্ট । নভেরার প্যারিসের রেট্রোস্পেকটিভ প্রদশর্নীর চিত্রকর্মগুলোর যে অস্পষ্ট ইমেজ আমরা দেখি অর্ন্তজালে, সেখান থেকে মনে হয়; 

সেগুলোকে পরাবাস্তব বা ফভিজমের মতো করে অনেক উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার করা হয়েছে এবং পাখির ও ফুলের মতো অনেক অর্গানিক ফর্মকে ব্যবহা করা হয়েছে; শিল্পকলার বিষয় বস্তু নির্বাচনে । স্ফিংসও দেখা যায় তাদের মধ্যে । 

যেগুলোকে দেখে সুরিয়েলিস্ট শিল্পী ম্যাক্স আর্নস্ট এর চিত্রকলার অদ্ভুত সব পাখিদের ফর্মের কথা মনে হতে পারে ।

নভেরার স্বেচ্ছা নির্বাসনের সাথে ফরাসি ভাস্কর কামিল ক্লদেলের নির্বাসনের ইতিহাস যদিও মেলে না, তবুও তাদের মধ্যেকার ভাস্কর্যের প্রতি যে উন্মদনা আছে তাতে অনেক মিল পাওয়া যায় । তাদের জেদের মধ্যে মিল পাওয়া যায় । 

তাদের দুজনের জীবনের ঘটনাগুলোকে অনেক বেশী নিয়তি নির্ভর মনে হতে পারে । কামিল ক্লদেলকে আধুনিক ভাস্কর্যের একজন অগ্রদূত বলে মনে করা হয় । কামিল এবং রদ্যাঁ দুজনই শিল্পী মাইকেল্যান্জোলোকে ধারণ করেছেন তাঁদের কাজের মধ্যে । 

কামিলও একজন উপেক্ষিত ভাস্কর এবং রঁদ্যা যাকে ব্যবহার করে সুনাম কামিয়ে নিয়েছিলো সেই সময়ে । সেই কামিল ক্লদেলের জীবনীও কম বেদনাদায়ক ছিলো না । তিনিও তিরিশ বছর নির্বাসিত ছিলেন এক মানসিক হাসপাতালে ।

প্যারিসের রেট্রোস্পেকটিভ প্রদশর্নীর ব্রোশারে , প্রদশর্নীটির কিউরেটর প্যাট্রিক আমিন দাবী করেছেন যে, নভেরা কবিগুরু রবিন্দ্রনাথ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন । তাঁর কাজের মধ্যে কবিগুরুর কবিতার কথা ফুটে ওঠে । 

নভেরা আহমেদ যে অসাধারণ প্রতিভা নিয়ে জন্ম গ্রহন করেছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই । জীবনে অনেক সুযোগও তিনি পেয়েছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর জীবন সংগ্রাম কে এবং শিল্প সংগ্রমকে তিনি একটি সুনিপুন পর্যায়ে পৌঁছে নিতে ব্যার্থ হয়েছেন । 

কিন্তু কেনো ? তাহলে কি আমাদের উপমহাদেশের শিক্ষা ব্যাবস্থায় বিরাট কোনো ঘাটতি আজো রয়ে গেছে, সেই সময় থেকেই ! তিনি দেশকে কি মনে করতেন না, যে তাঁর কাজের মধ্যে আমরা স্বদেশ ত্যাগের বেদনার ভাষা খুঁজে পাই না। 

দেশকে তিনি মনে করবেন কিভাবে? ৪০ বছর তো কম সময় নয়, বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাবার জন্য । কিন্তু আরো কয়েকটি প্রশ্ন আমার সাধারণ শিল্পী মনে ভেসে ওঠে সেগুলো হলো ; কেনো একজন শিল্পীকে দেশ ত্যাগ করতে হয় ? 

শিল্পীরা কেনো দেশত্যাগী হন ? শিল্পীরা কেনো স্বেচ্ছায় নির্বাসনে যান? দেশ কি চায় না তার প্রতিভাবান সন্তানকে জায়গা দিতে ? দেশ কি তার প্রতিভাবান সন্তানকে ফেরাতে চেয়েছে কখনও ? 

দেশ কি তার প্রিয় শিল্পীকে ফেরাতে চেয়েছে কোনোদিনও ? শিল্পী সমাজের ভূমিকা কতটুকুইবা ছিলো এক অভিমানী শিল্পীর অভিমান ভাঙ্গাতে ?

শিল্পী এস এম সুলতানও তো ছিলেন একঘরে, কে তাঁর খোঁজ রেখেছে ! আমরা তবে কেনো নভেরা আহমেদের ব্যাপারে এখন বেশ উচ্চবাচ্য করছি; তিনি ফ্রান্সের মতো ধনীদেশের বাসিন্দা ছিলেন বলে ? 

সুবিধাপ্রাপ্তদের একটু তোষণ করে চলবার সংস্কৃতি আমাদের চিরকালের । আমরা তো স্বাধীনতার পর থেকে বেশ একটা লম্বা সময় পেয়েছিলাম এই ঘোলাটে ঘটনাকে একটা সমাধানের আলো দেখানোর । 

এবং সব পক্ষের জন্যই সেই সময়টা ছিলো নিজের অবস্থানকে পরিষ্কার করবার । যাতে করে কাউকেই সেই দোষের বোঝাগুলো বয়ে বেড়াতে না হতো । 

নভেরা আহমেদ কে অনেকে কিংবদন্তীয় বলে আখ্যায়িত করছেন, কিন্তু আমরা জানি না সেই শব্দের অর্থ কি? নাকি আমরা শব্দের পরে শব্দ সাজাতে পচ্ছন্দ করি। যেমন রঙের পাশে রঙ বসিয়ে আপন মনে আমরা এঁকে যাই অর্থহীন যত চিত্রকর্ম । 

যার কোনো অর্থ হয় না ; যার কোনো ইতিহাস হয় না । যা শুধু হয়ে ওঠে প্রাণহীন এক শরীর; শিল্প হয়ে উঠতে পারে না কখনই !

তিনি নির্বাসনে ছিলেন বলেই কি তিনি কিংবদন্তী ! হয়তো বা আমাদের কারো কারো ক্ষেত্রে কিংবদন্তী খোঁজার মানসিকতা, কাউকে আইকনিক রুপ দেবার অতিআগ্রহ অনুৎসাহিত করে দেয় সব ধরনের বিশ্লেষণ প্রচেষ্টা। 

সামাজিক সেই অদৃশ্য কর্তৃত্বের চাপটি হয়তো তারা অনুভব করেন এই সিদ্ধান্তে পৌছাঁতে। কোনো কোনো ব্যক্তি বিশেষকে আমরা এমন একটা বিশেষ স্থানে বসিয়ে দিতে পচ্ছন্দ করি যেখান থেকে আসলে বিভ্রমের সৃষ্টি হওয়া ছাড়া তেমন কোনো অর্জন করা সম্ভব না । 

তবে সব কিছু বিশ্লেষণ করে আমরা যেটুকু বুঝতে পারি, সেটা হলো শিল্পী নভেরা আহমেদের মৃত্যু আমাদের মাঝে কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়ে গেলো আবার … ১. কেনো একজন শিল্পীকে নির্বাসিত হতে হয় ?

কেনো বাংলাদেশ গুনী প্রতিভাধর মানুষকে তার যোগ্য স্থান দিতে ব্যার্থ হচ্ছে বারবার ?
উত্তরটা সংক্ষিপ্ত কিন্তু ভয়ঙ্কর । রাজনীতি, দুর্নীতি, স্বজনপ্রিয়তা, দলাদলি, সংকীর্নমন্যতা, আধুনিক শিক্ষারপ্রতি অনাগ্রহ শিল্পী সমাজের আটপৌরে জীবনের সঙ্গি । সেখানে কোনো সৎ প্রতিভাবানদের স্থান নেই !


কিন্তু একজন শিল্পী কি নিজের মেধা দিয়ে, শক্তি দিয়ে, সততা দিয়ে সেই যুদ্ধে জয়ী হতে পারেন না? প্রশ্নটা কেনো আমি নিজেকে নিজে করছি না ?