আদি পিতা ও মাতা

আদি পিতা ও মাতা: মনু শতরূপার ছেলে মেয়েরা ভাই বোন হওয়া সত্ত্বেও কিভাবে বিবাহ করেছিল?

আদি পিতা ও মাতার নাম কি? মনু শতরূপার ছেলে মেয়েরা ভাই বোন হওয়া সত্ত্বেও কিভাবে বিবাহ করেছিল? সনাতন শাস্ত্রমতে, পৃথিবীতে দুইজন মানুষ আসেন নাই, আপনার জানার মধ্যে একটু ভুল আছে।

 

আপনি হয়ত বলতে চাচ্ছেন, সনাতনধর্ম মতে তো মনু শতরূপা পৃথিবীর প্রথম মানব মানবী। হুম,আপনার কথা সত্য,মনু শতরূপা পৃথিবীর প্রথম মানব মানবী, আমিও এক মত। কিন্তু মনু আর শতরূপা যে তারাই শুধু দু জন ছিল এমন নয়, সনাতনধর্ম সম্পর্কে জানতে হলে শাস্ত্রগ্রন্থ তো আগে পড়তে হবে, আন্দাজে কথা বলা সনাতনধর্ম শাস্ত্র সমর্থন করে না।

 

মনু (সংস্কৃত: मनु) হিন্দুধর্মে বিভিন্ন অর্থ সহ একটি শব্দ। প্রাথমিক গ্রন্থে, এটি প্রত্নতাত্ত্বিক মানুষ বা প্রথম মানুষ (মানবজাতির পূর্বপুরুষ) কে বোঝায়। সংস্কৃতে মানব শব্দের অর্থ ‘মনু’ বা ‘মনুর সন্তান’।  পাঠের শিরোনাম মনুস্মৃতি এই শব্দটিকে উপসর্গ হিসেবে ব্যবহার করে, কিন্তু প্রথম মনুকে বোঝায় – ব্রহ্মার আধ্যাত্মিক পুত্র স্বয়ম্ভুব।

হিন্দু সৃষ্টিতত্ত্বে, প্রতিটি কল্পে চৌদ্দটি মন্বন্তর থাকে এবং প্রতিটি মন্বন্তর ভিন্ন ভিন্ন মনুর নেতৃত্বে দিয়ে থাকে। বর্তমান মহাবিশ্ব, ৭ম মনু কর্তৃক শাসিত,  যার নাম বৈবস্বত।

 

আদি পিতা ও মাতা
১।পৃথিবীতে যদি প্রথমে দুজন মানুষ আসেন, তাহলে রক্তের গ্রুপ আটটা কেন?
২। মনু শতরূপার ছেলে মেয়েরা ভাই বোন হওয়া সত্ত্বেও কিভাবে বিবাহ করেছিল?

৩। হিন্দু ধর্ম অনুসারে আদি পিতা ও মাতার নাম কি?

 

সনাতন শাস্ত্র মতে, সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি- এই চারটি সহস্র যুগে (অর্থাৎ চার হাজার যুগে) ভগবান ব্রহ্মার এক দিন। ঐ এক ব্রহ্মা দিবসে ১৪ জন মনু জন্মগ্রহন করেন। ঐ এক এক মনুর কাল কে বলা হয় ‘মন্বন্তর‘। সনাতন শাস্ত্র ১৪ জন মনুর কথা বলেছে, একজন মনু বা শতরূপা নয়। তাই রক্তের গ্রুপ আটটা কেন চৌদ্দটা হলেও সমস্যা নাই, কেননা ১৪ জন মানুষের আটটা রক্তের গ্রুপ হতেই পারে, আপনার মেডিকেল সাইন্সও এ বিষয়ে দ্বিমত করবে না আশা করি। 

প্রত্যেক মন্বন্তরে ভিন্ন ভিন্ন মনু, সপ্তর্ষিগন, দেব-দেবী, ইন্দ্র ও মনুপুত্ররা আবির্ভূত হয়। দেবতাদের হিসেবে আট লক্ষ বাহান্ন বছর এবং মানুষের হিসেবে ত্রিশ কোটি সাতষট্টি লাখ বিশ হাজার বছরে এক মন্বন্তর হয়। মন্বন্তরের কাল পূর্ণ হলেই দেবতা, সপ্তর্ষি, ইন্দ্র, মনু- পুত্ররা বিলুপ্ত হয় এবং অন্য মনু, দেবতা ইত্যাদি উদ্ভব হয়। সকল মন্বন্তরেই সপ্তর্ষিরা ধর্মের ব্যবস্থা ও লোক রক্ষার জন্য পৃথিবীতে আসেন। প্রত্তেক চতুর্যুগের শেষে বেদ বিপ্লব হয় এবং সপ্তর্ষিরা পৃথিবীতে এসে আবার বেদ প্রচার করেন।এই প্রত্যেক চতুর্যুগকে এক একটি কল্প বলা হয়।আদি পিতা ও মাতা 

চৌদ্দ মনুর নাম:
১। স্বায়দ্ভুব ২। স্বরোচিষ ৩। উত্তম ৪। তামস ৫। রৈবত ৬। চাক্ষুষ ৭। বৈবস্বত বা সত্যব্রত ৮। সাবর্ণি ৯। দক্ষ সাবর্ণি ১০। ব্রহ্ম সাবর্ণি ১১। ধর্ম সাবর্ণি ১২। রুদ্র সাবর্ণি ১৩। দেবতা সাবর্ণি ১৪। ইন্দ্র সাবর্ণি।

আদি পিতা ও মাতা

বিভিন্ন পুরাণ এ বিভিন্ন মনুর নাম দেখা যায়।

মৎস্য পুরাণ এ মনুদের নাম:

১। স্বায়দ্ভুব (ব্রহ্মা ও গায়ত্রী হতে সম্ভূত) ২। স্বরোচিষ ৩। উত্তম ৪। তামস ৫। রৈবত ৬। চাক্ষুষ ৭। বৈবস্বত বা সত্যব্রত ৮। সাবর্ণি ৯। রোচ্য ১০। ভৌত ১১। মেরূ সাবর্ণি ১২। ঋভু ১৩। ঋতুধামা ১৪বিস্বব সেন।

প্রতি কল্পে এই চৌদ্দ মনুর আবির্ভাব হয়। জন্ম: সকল মনুই ধর্মশাস্ত্রকার। মনুদের মাঝে যিনি প্রথম, অর্থাৎ স্বায়দ্ভব মনু, ইনি ব্রহ্মার মানসপুত্র, ব্রহ্মার দেহ হতে উদ্ভুত। স্বয়ং ব্রহ্মা নিজেকে বিভক্ত করে নারী ও পুরুষ সৃষ্টি করেন।

স্বয়ম্ভু ‘মনু’কে আদিও বলা হয়। ‘আদি’ মানে শুরু। মানুষ, মনুজ, মানব, আদম, আদমি প্রভৃতি সকল ভাষায় মানুষের কথ্য সকল শব্দ মনু শব্দ দ্বারা প্রভাবিত হয়। তিনি সমগ্র মানবজাতির প্রথম মানব। তাকে প্রথম বিবেচনা করার অনেক কারণ রয়েছে। 

পৃথিবীর প্রথম পুরুষ স্বয়ম্ভু মনু  এবং প্রথম নারী শতরূপা। এই প্রথম পুরুষ ও প্রথম নারীর সন্তান থেকে পৃথিবীর সকল মানুষের উৎপত্তি। মনুর পুত্র হওয়ায় মানব বলা হতো।

মানুষ তাকে বলা হয় যেখানে পদার্থ এবং প্রাণের চেয়ে বেশি সক্রিয় – মন। মানুষের মনের শক্তি আছে, চিন্তা করার শক্তি আছে, তাই তাকে মানুষ বলা হয়। যেহেতু আমরা সবাই ‘মনু’র সন্তান, তাই মানুষকে মানবও বলা হয়।

শ্বেতাভারহ কল্পে ১৪টি মনুর উল্লেখ আছে। এই চৌদ্দ মনুষকে জৈন ধর্মে কুলকার বলা হয়েছে।

সনাতন ধর্ম মতে  পৃথিবীর প্রথম মানব মানবী

প্রজাপত্য কল্পে ব্রহ্মা রুদ্র রূপে স্বয়ম্ভু মনু এবং শতরূপা নারীরূপে প্রকাশীত হয়েছিলেন। স্বয়ম্ভুব মনু ও শতরূপার মোট পাঁচটি সন্তান ছিল, যার মধ্যে দুই পুত্র প্রিয়ব্রতউত্তানপদ এবং তিন কন্যা আকুতি, দেবহুতি এবং প্রসূতিআকুতির বিয়ে হয়েছিল রুচি প্রজাপতির সাথে এবং প্রসূতির বিয়ে হয়েছিল দক্ষিণ প্রজাপতির সাথে। দেবহুতির বিয়ে হয়েছিল প্রজাপতি কর্দমের সঙ্গে। আকুতির একটি পুত্রের জন্ম হয়, যার নাম ছিল যজ্ঞ, যজ্ঞ স্ত্রীর নাম ছিল দক্ষিণা। কপিল ছিলেন ঋষি দেবহুতির পুত্র। প্রসূতির ও দক্ষিণ ২৪টি মেয়ের জন্ম দেন। এদের নাম হল শ্রাদ্ধ, লক্ষ্মী, পুষ্টি, ধুতি, তুষ্টি, মেধা, ক্রিয়া, বুদ্ধি, লজ্জা, ভাপু, শান্তি, ঋদ্ধি এবং কীর্তি।

 

মনু ও শতরূপার  দুই ছেলে- প্রিয়ব্রতউত্তানপদউত্তরপদের সুনীতি ও সুরুচি নামে দুই স্ত্রী ছিল। রাজা উত্তরপদের সুনীতি সুরুচি থেকে ধ্রুব ও উত্তম নামে এক পুত্রের জন্ম হয়। ধ্রুব অনেক খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

স্বয়ম্ভুব মনুর দ্বিতীয় পুত্র প্রিয়ব্রত, বিশ্বকর্মার কন্যা বাহিরস্মতীকে বিয়ে করেছিলেন, যার থেকে অগ্নিধরা, যজ্ঞবাহু, মেধাতিথির মতো দশটি পুত্রের জন্ম হয়েছিল। প্রিয়ব্রতের দ্বিতীয় স্ত্রী উত্তম তামস থেকে – তিন পুত্রের জন্ম হয়েছিল যারা তাদের নামের মন্বন্তরদের শাসক হয়েছিল। মহারাজ প্রিয়ব্রতের দশ পুত্রের মধ্যে কবি, মহাবীর ও সাভান এই তিনজন ছিলেন নৈতিক ব্রহ্মচারী এবং তাঁরা ত্যাগের ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।

 

ভবিষ্যৎ পৃথিবী মানব যাত্র এভাবেই শুধু  হয়। হিন্দু পুরাণ অনুসারে, স্বয়ম্ভুব মনু ও শতরূপার এই পাঁচটি সন্তান নিয়ে পৃথিবীতে মানুষের যাত্রা। 

তবে এখানে উল্লেখ্য মনু ও শতরূপার ছেলে মেয়েদের বিবাহ হয়, যারে সাথে তাদের জন্ম বা সৃষ্টি ব্রহ্মা থেকে। কোন মানব সন্তান নন। যেহেতু মনু ও শতরূপা ছেলে মেয়েরাই মানব সন্তান ছিলেন তাই প্রথম বা আদি মাতাপিতা মনু ও শতরূপাকেই বলা হয়।

 

মহারাজ মনু বহু দিন এই সপ্তদ্বীপাবতী পৃথিবী শাসন করেছিলেন। তার রাজ্যে মানুষ খুব সুখী ছিল। তিনি ‘মনুস্মৃতি’ রচনা করেছিলেন যা আজ তার আসল রূপে পাওয়া যায় না। এর অর্থ বিপর্যয় ঘটাচ্ছে।

 

হারাজ মনু যখন পরিত্রাণ কামনা করেছিলেন, তখন তিনি তাঁর বড় ছেলে উত্তানপাদের কাছে সমগ্র রাজ্য হস্তান্তর করেছিলেন এবং স্ত্রী শতরূপার সাথে নির্জনে নৈমিষারণ্য তীর্থযাত্রায় যান, কিন্তু তাঁর দ্বিতীয় পুত্র রাজা প্রিয়ব্রতের খ্যাতি উত্তরপদের চেয়ে বেশি ছিল।

 

মনু সুনন্দা নদীর তীরে একশত বছর তপস্যা করেছিলেন। গৌমতীর তীরে নৈমিষারণ্য নামক পবিত্র তীর্থে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই দীর্ঘকাল তপস্যা করেন। ওই স্থানে উভয়ের সমাধি নির্মিত হয়।

স্বয়ম্ভু মনুর সময়ের ঋষিরা হলেন মারিচি, অত্রি, অঙ্গিরস, পুলহ, কৃতু, পুলস্ত্য এবং বশিষ্ঠ। রাজা মনুর সাথে কথিত ঋষিরা মানুষকে সভ্য, আরামদায়ক, শ্রমসাধ্য এবং সংস্কৃতিবান করার কাজ করেছিলেন। বৈবস্বত মনু রাজা মনু ও নূহের

 

চারদিকে তথ্যসন্ত্রাসীদের আক্রমনে শিক্ষিত হিন্দু যুবক যুবতীরা দিশেহারা হয়ে কেউ নাস্তিক হচ্ছে, কেউবা হচ্ছে ধর্মান্তরিত। তাই তথ্য সন্ত্রাস রুখতে বেশি করে ধর্মশাস্ত্র পড়ুন। অন্য দর্শন গুলোতে যেমন একজন মাতাপিতা থেকে মানুষ সৃষ্টি তার পর তাদের বিয়ে ভাই বোনের মধ্যে এমন চিন্তা সনাতন ধর্মশাস্ত্র অনুমদন দেওয় না।

ধন্যবাদ সবাইকে কষ্ট করে পড়ার জন্য

অভিরুপ বন্দ্যোপাধ্যায়- কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।

উৎস-