ভারতের নতুন ব্রহ্মাস্ত্র UPI: ডলার এবং চীনের আধিপত্যের অবসান?

UPI

ভারতের নতুন ব্রহ্মাস্ত্র UPI: ডলার এবং চীনের আধিপত্যের অবসান?

 

একটি QR কোড কি সত্যিই এমন বৈশ্বিক ক্ষমতা পরিবর্তন করতে পারে? আপনার ফোনের এই সাধারণ QR কোড স্ক্যান… এটি শুধু আপনার জীবনকেই সহজ করেনি, এটি নীরবে এক ভয়ঙ্কর আন্তর্জাতিক যুদ্ধ শুরু করেছে।

এই যুদ্ধ ভিসা, মাস্টারকার্ডের মতো বিলিয়ন ডলারের কোম্পানির বিরুদ্ধে। বাংলাদেশেও তো বিকাশ বা নগদের মতো পেমেন্ট সিস্টেম আছে, তাহলে ভারতের এই UPI কীভাবে আলাদা? আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—এটি কি সত্যিই আমেরিকান ডলারের বিশ্বব্যাপী আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবে? এটি শুধু একটি পেমেন্ট সিস্টেম নয়, এটি হলো একুশ শতকে ভারতের নতুন ব্রহ্মাস্ত্র। কীভাবে ভারতের এই ডিজিটাল ব্রহ্মাস্ত্র নীরবে বিশ্বের আর্থিক ব্যবস্থাকে দখল করছে? আজ আমরা উন্মোচন করব UPI-এর সেই তিনটি গোপন স্তর, যা ভারতকে বিশ্বের পরবর্তী ডিজিটাল সুপারপাওয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চলেছে… এবং শেষ স্তরটি আপনাকে অবাক করতে বাধ্য।

 

প্রথম স্তর: অভ্যন্তরীণ বিপ্লব এবং “ইন্ডিয়া স্ট্যাক”-এর জাদু

 

এই বিপ্লবী ধারণাটি কোথা থেকে এলো? এটি কোনো বিচ্ছিন্ন উদ্ভাবন ছিল না, এটি ছিল ভারতের একটি বিশাল স্বপ্নের অংশ। সহজ কথায়, UPI এমন একটি সিস্টেম যা আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টকে আপনার মোবাইল ফোনের সাথে সরাসরি যুক্ত করে দেয়। কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেমের সাথে এর পার্থক্য কোথায়? পার্থক্যটি হলো তিনটি বিপ্লবী ধারণা: বিনামূল্যে, তাৎক্ষণিক এবং উন্মুক্ত

যেখানে Visa বা Mastercard প্রতিটি লেনদেনের জন্য ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে একটি মোটা অংকের ফি নেয়, সেখানে UPI প্রায় বিনামূল্যে। Google Pay বা PhonePe হলো গাড়ির মতো, কিন্তু তাদের চলার জন্য যে মসৃণ এবং টোল-ফ্রি হাইওয়ে, সেটিই হলো ভারত সরকারের তৈরি UPI।

এই বিপ্লবী ধারণাটির জন্ম হয়েছে ভারতের একটি আরও বড় এবং গভীর পরিকাঠামো থেকে, যা পরিচিত “ইন্ডিয়া স্ট্যাক” (India Stack) নামে। তিনটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে আছে এই ডিজিটাল সাম্রাজ্য: জন ধন, আধার এবং মোবাইল, যাকে সংক্ষেপে বলা হয় “জ্যাম ট্রিনিটি” (JAM Trinity)। এই তিনটি স্তম্ভকে একসাথে যুক্ত করেই UPI-এর মতো একটি শক্তিশালী অস্ত্রের জন্ম হয়েছে।

 

UPI বনাম বিকাশ/নগদ: আসল পার্থক্য

 

এখন প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের বিকাশ বা নগদের সাথে এর পার্থক্য কী? পার্থক্যটি বিশাল এবং এটি আপনার পকেটের উপরও সরাসরি প্রভাব ফেলে।

সবচেয়ে বড় পার্থক্যটি হলো খরচ। UPI ব্যবহার করা সাধারণ মানুষের জন্য সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের পেমেন্ট সিস্টেম, যেমন বিকাশ বা নগদ, প্রায় প্রতিটি লেনদেনের জন্যই চার্জ কাটে। এর কারণ হলো, বিকাশ বা নগদ হলো “ক্লোজড ওয়ালেট” (Closed Wallet) সিস্টেম, যা একটি বেসরকারি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে। অন্যদিকে, UPI হলো একটি “ওপেন হাইওয়ে” (Open Highway), যা সরাসরি আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সাথে যুক্ত এবং এটি একটি জাতীয় পরিকাঠামো।

এর ফলাফল? আজ ভারতে প্রতি মাসে এক হাজার কোটি-রও বেশি UPI লেনদেন হয়, যা আমেরিকা এবং ইউরোপের মিলিত ডিজিটাল লেনদেনের চেয়েও বেশি। এই অবিশ্বাস্য অভ্যন্তরীণ বিপ্লবই ছিল ভারতের বিশ্বজয়ের প্রথম ধাপ।

 

দ্বিতীয় স্তর: আন্তর্জাতিক যুদ্ধ – ভিসা, মাস্টারকার্ড এবং চীনের বিরুদ্ধে

 

ভারতের লক্ষ্য শুধু নিজের দেশেই সীমাবদ্ধ ছিল না। আসল খেলাটা তো শুরু হলো তখন, যখন ভারত তার এই প্রযুক্তিকে বিশ্বের দরবারে নিয়ে গেল এবং পশ্চিমা বিশ্বের আর্থিক দুর্গে আঘাত হানল।

কয়েক দশক ধরে, বিশ্বের ডিজিটাল পেমেন্টের বাজার ছিল দুটি আমেরিকান জায়ান্ট—ভিসা এবং মাস্টারকার্ডের দখলে। কিন্তু UPI আসার পর, ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে তারা প্রায় অদৃশ্য হতে শুরু করে। ভারতের ডিজিটাল লেনদেনের ৯৯%-এরও বেশি এখন UPI-এর মাধ্যমে হয়।

এই সাফল্য এতটাই বড় ছিল যে, জার্মানির একজন মন্ত্রী ভারত সফরের পর অবাক হয়ে বলেছিলেন, “জার্মানির মতো উন্নত দেশেরও UPI থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।”

কিন্তু ভারত এখানেই থেমে থাকেনি। সে নিজেকে একটি নতুন এবং আরও বড় যুদ্ধের মাঝখানে আবিষ্কার করল। এই যুদ্ধটি ছিল চীনের বিরুদ্ধে। ফ্রান্স, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, শ্রীলঙ্কা এবং নেপালের মতো দেশগুলো চীনের নিয়ন্ত্রিত এবং নজরদারি চালানো সিস্টেমের বদলে ভারতের উন্মুক্ত এবং বন্ধুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিকে বেছে নিয়েছে। এটি হলো ভারতের নতুন “ফিনটেক ডিপ্লোমেসি” (Fintech Diplomacy)—যেখানে ভারত ডলার বা অস্ত্র দিয়ে নয়, বরং তার নিজস্ব প্রযুক্তি দিয়ে বন্ধু বানাচ্ছে।

 

চ্যালেঞ্জ এবং ঝুঁকি: পথটি কি সত্যিই মসৃণ?

 

UPI-এর এই বিশ্বজয়যাত্রা দেখে হয়তো মনে হতে পারে, এর সামনে আর কোনো বাধা নেই। কিন্তু বাস্তবতা ততটা সহজ নয়। ভারতের সামনে রয়েছে দুটি বড় চ্যালেঞ্জ: ডেটা সুরক্ষা এবং প্রতিযোগিতা। তাহলে কি ভারত এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে পারবে? উত্তরটি লুকিয়ে আছে এর চূড়ান্ত লক্ষ্যের মধ্যে।

 

তৃতীয় স্তর: চূড়ান্ত লক্ষ্য – ডলারের আধিপত্যের অবসান?

 

তাহলে UPI-এর এই বিশ্বজয়ের চূড়ান্ত লক্ষ্য কী? এটি কি শুধু টাকা-পয়সার লেনদেনকে সহজ করা? না, এর পেছনের স্বপ্নটি আরও অনেক বড় এবং ভয়ংকর।

কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, UPI-এর মতো প্রযুক্তিগুলোই একদিন আমেরিকান ডলারের বিশ্বব্যাপী আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে। বর্তমানে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য দেশগুলোকে SWIFT সিস্টেম এবং আমেরিকান ডলারের উপর নির্ভর করতে হয়। এই সিস্টেমটি আমেরিকার নিয়ন্ত্রণে থাকায়, তারা যেকোনো দেশের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে তাকে একঘরে করে দিতে পারে।

কিন্তু যদি ভারত, রাশিয়া, চীন এবং অন্যান্য দেশগুলো তাদের নিজস্ব পেমেন্ট সিস্টেমকে একসাথে যুক্ত করে একটি বিকল্প ব্যবস্থা তৈরি করতে পারে, তাহলে তারা ডলারকে পাশ কাটিয়ে নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য করতে পারবে। এটি হয়তো এখনও একটি দূরবর্তী স্বপ্ন, কিন্তু UPI-এর এই অবিশ্বাস্য উত্থান প্রমাণ করে যে, একুশ শতকের যুদ্ধ শুধু সীমান্তে নয়, ডিজিটাল জগতেও লড়া হবে।

 

উপসংহার

 

একটি সাধারণ QR কোড থেকে শুরু করে বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ম বদলে দেওয়ার স্বপ্ন—UPI-এর এই যাত্রাটি ভারতের অবিশ্বাস্য উদ্ভাবনী শক্তি এবং দূরদৃষ্টির প্রমাণ। এটি শুধু একটি পেমেন্ট সিস্টেম নয়, এটি হলো একুশ শতকে ভারতের নতুন “ব্রহ্মাস্ত্র”।

 

ভারতের সেমিকন্ডাক্টর মিশন: ‘বিক্রম’ চিপ কি ভূ-রাজনীতির নতুন গেম চেঞ্জার?

Scroll to Top