Preyavihar Temple: ৯০০ বছরের পুরোনো মন্দির কেন যুদ্ধের কারণ? নেপথ্যে কী?

Preyavihar Temple

থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া সীমান্ত বিরোধ: ৯০০ বছরের পুরোনো মন্দির কেন যুদ্ধের কারণ? নেপথ্যে কী? নেপথ্যে কী? Preyavihar Temple

থাইল্যান্ডের নাম শুনলে আমাদের মনে ভেসে ওঠে সুন্দর সমুদ্রসৈকত, রঙিন বাজার আর উৎসবমুখর পর্যটকদের ভিড়। কিন্তু এই জনপ্রিয় পর্যটনস্থলের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক ভিন্ন বাস্তবতা—সীমান্তে যুদ্ধের ঘনঘটা। প্রতিবেশী দেশ কম্বোডিয়ার সাথে থাইল্যান্ডের সম্পর্ক এতটাই উত্তপ্ত যে, আকাশে উড়ছে এফ-সিক্সটিন যুদ্ধবিমান, চলছে রকেট হামলা, আর ঝরছে তাজা প্রাণ।

এই ভয়াবহ সংঘাতের একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে প্রায় ৯০০ বছরের পুরোনো এক শিব মন্দির, যা দুই দেশের জাতীয়তাবাদী আবেগকে দশকের পর দশক ধরে উস্কে দিয়ে চলেছে। চলুন, এই জটিল সংঘাতের পেছনের কারণগুলো বিস্তারিতভাবে জেনে নেওয়া যাক।

বিতর্কের মূলে যে মন্দির: প্রেয়াবিহার (Preah Vihear) Preyavihar Temple

একাদশ-দ্বাদশ শতকে খেমের সাম্রাজ্যের সময় তৈরি এই প্রাচীন শিব মন্দিরটি ড্যাংরেক পর্বতমালার চূড়ায় অবস্থিত। এর স্থাপত্যশৈলী এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বের কারণে এটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের মর্যাদা পেয়েছে। কিন্তু এর ভৌগোলিক অবস্থানই সব বিতর্কের মূল কারণ।

মন্দিরটি যে পাহাড়ের উপর অবস্থিত, তার চূড়া থাইল্যান্ডের দিকে বেশ সমতলভাবে মিশে গেছে। কিন্তু মন্দিরের মূল প্রবেশদ্বার এবং এর দিকে যাওয়ার রাস্তাটি কম্বোডিয়ার দিকে ঢালু হয়ে নেমে গেছে। এই অদ্ভুত অবস্থানই দুই দেশের মধ্যে মালিকানার দাবিকে জটিল করে তুলেছে।

ঔপনিবেশিক মানচিত্র ও আন্তর্জাতিক আদালতের রায়

এই বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করে ঔপনিবেশিক আমলের ইতিহাস। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ফরাসি শাসকরা একটি মানচিত্র তৈরি করে, যা আন্তর্জাতিক জলবিভাজন নীতি (Watershed Principle) থেকে কিছুটা ভিন্ন ছিল। এই নীতি অনুযায়ী, পাহাড়ের সর্বোচ্চ বিভাজন রেখা বরাবর সীমান্ত নির্ধারিত হয়, যা মানা হলে মন্দিরটি থাইল্যান্ডের অংশে পড়ত। কিন্তু ফরাসিদের তৈরি করা মানচিত্রে মন্দিরটিকে কম্বোডিয়ার অংশ হিসেবে দেখানো হয়।

থাইল্যান্ড প্রথমদিকে এই মানচিত্র মেনে নিলেও পরে এর বিরোধিতা শুরু করে। বিষয়টি আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে (ICJ) গড়ায়। ১৯৬২ সালে ICJ এক ঐতিহাসিক রায়ে ৯-৩ ভোটে মন্দিরের মালিকানা কম্বোডিয়াকে দেয়। এর পেছনে দুটি বড় কারণ ছিল:

  1. থাইল্যান্ড দীর্ঘ সময় ধরে মানচিত্রটির বিরুদ্ধে কোনো আনুষ্ঠানিক আপত্তি জানায়নি।

  2. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে থাইল্যান্ড জাপানের পক্ষে থাকায় আন্তর্জাতিকভাবে তাদের অবস্থান দুর্বল ছিল।

তবে, আদালত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অমীমাংসিত রেখে দেয়। মন্দিরের মালিকানা কম্বোডিয়াকে দেওয়া হলেও, এর সংলগ্ন প্রায় ৪.৬ বর্গ কিলোমিটার এলাকার মালিকানা কার হবে, সে বিষয়ে কোনো স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়নি। এই অস্পষ্টতাই আজকের সংঘাতের অন্যতম প্রধান কারণ।

কেন নতুন করে সংঘাত তীব্র হলো?

সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি ঘটনা এই পুরোনো বিরোধে নতুন করে আগুন জ্বালিয়েছে।

১. ইউনেস্কো বিতর্ক ও পূর্বের সংঘর্ষ

২০০৮ সালে কম্বোডিয়া যখন এককভাবে মন্দিরটিকে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে নথিভুক্ত করে, তখন উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়। এরপর ২০০৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে একাধিকবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়, যাতে প্রায় ৪০ জনের মৃত্যু হয়।

২. ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ ও কূটনৈতিক ভুল

সম্প্রতি থাইল্যান্ড, লাওস ও কম্বোডিয়ার সীমান্তবর্তী ‘এমেরাল্ড ট্রায়াঙ্গল’ এলাকায় ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণে কয়েকজন থাই সেনা আহত হন। থাইল্যান্ড এর জন্য সরাসরি কম্বোডিয়াকে সন্দেহ করে।

এর মধ্যেই একটি ফোন কল ফাঁস হয়ে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়। থাইল্যান্ডের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পেতংতান সিনাওয়াত্রা কম্বোডিয়ার প্রভাবশালী নেতা হুন সেনকে (বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বাবা) ব্যক্তিগত ফোনালাপে ‘আঙ্কেল’ বলে সম্বোধন করেন এবং নিজ দেশের এক সেনা কর্মকর্তার সমালোচনা করেন। এই ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার পর থাইল্যান্ডে তীব্র জাতীয়তাবাদী জনরোষ তৈরি হয় এবং প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়।

৩. পাল্টা হুমকি ও কূটনৈতিক অবনতি

এর প্রতিক্রিয়ায় থাইল্যান্ড সরকার কিছু কম্বোডিয়ান ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে অবৈধ জুয়া ও জালিয়াতির তদন্ত শুরু করে। জবাবে, হুন সেন পাল্টা হুমকি দিয়ে বলেন, সিনাওয়াত্রা পরিবারের বিরুদ্ধে থাইল্যান্ডের রাজতন্ত্র অবমাননার প্রমাণ তার কাছে আছে, যা থাইল্যান্ডে একটি অত্যন্ত গুরুতর অপরাধ। এই ঘটনার পর দুই দেশের সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছায় এবং উভয় দেশ রাষ্ট্রদূত পর্যন্ত প্রত্যাহার করে নেয়।

 

Preyavihar Temple: সংঘাতের নেপথ্যের বহুমুখী কারণ

এই বিরোধ শুধু একটি মন্দির বা সীমান্ত নিয়ে নয়। এর পেছনে কাজ করছে আরও অনেক গভীর ও জটিল বিষয়:

  • অভ্যন্তরীণ রাজনীতি: কম্বোডিয়ার নতুন প্রধানমন্ত্রী হুন মানেত তার ক্ষমতা সুসংহত করতে চাইছেন। অন্যদিকে, থাইল্যান্ডের জোট সরকারের ওপরও অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ রয়েছে। উভয় পক্ষই জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার করে অভ্যন্তরীণ সমর্থন ধরে রাখতে চায়।

  • জাতীয়তাবাদী আবেগ: উভয় দেশেই উগ্র জাতীয়তাবাদ একটি বড় রাজনৈতিক হাতিয়ার। প্রেয়াবিহার মন্দির এই আবেগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

  • ভূ-রাজনীতি: কম্বোডিয়া চীনের ঘনিষ্ঠ মিত্র, অন্যদিকে থাইল্যান্ড ঐতিহাসিকভাবে আমেরিকার দিকে ঝুঁকে। ফলে এই সংঘাতে বৃহৎ শক্তিগুলোর পরোক্ষ স্বার্থও জড়িয়ে থাকতে পারে।

থাইল্যান্ডের পর্যটন স্বর্গের আড়ালে এক চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে—আর তা হলো দীর্ঘদিনের থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া সীমান্ত বিরোধ। যা এখন এতটাই গুরুতর রূপ নিয়েছে যে, আকাশে উড়ছে যুদ্ধবিমান, সীমান্তে ঘটছে হতাহতের ঘটনা। এই সংঘাতের মূলে রয়েছে এক প্রাচীন মন্দির, যা দুটি দেশের জাতীয়তাবাদী আবেগকে উস্কে দিয়ে চলেছে। আজকের এই আলোচনায় আমরা এই বিরোধের গভীরতা অনুসন্ধান করব।

Preyavihar Temple: বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু

এই পুরো বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে প্রেয়াবিহার মন্দির। একাদশ-দ্বাদশ শতকে খেমের সাম্রাজ্যের তৈরি এই শিব মন্দিরটি স্থাপত্য ও ইতিহাসের এক দারুণ নিদর্শন, যা ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের মর্যাদা পেয়েছে। ড্যাংরেক পর্বতমালার চূড়ায় এর অবস্থানই মূলত সমস্যার কারণ। মন্দিরের চূড়া থাইল্যান্ডের দিকে সমতলভাবে মিশে গেলেও এর মূল প্রবেশপথ এবং ঢাল কম্বোডিয়ার দিকে অবস্থিত। এই ভৌগোলিক জটিলতাই মালিকানার দাবিকে কেন্দ্র করে থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া সংঘাত তৈরি করেছে।

ঔপনিবেশিক মানচিত্র থেকে আন্তর্জাতিক আদালত: বিরোধের জন্ম

বিরোধের ইতিহাস বেশ পুরোনো। ফরাসি ঔপনিবেশিক আমলে তৈরি একটি মানচিত্রে মন্দিরটিকে কম্বোডিয়ার অংশ দেখানো হয়, যদিও আন্তর্জাতিক জলবিভাজন নীতি মানা হলে এটি থাইল্যান্ডের অংশে পড়ত।

থাইল্যান্ড প্রথমে মেনে নিলেও পরে বিরোধিতা শুরু করলে বিষয়টি আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে (ICJ) পৌঁছায়। ১৯৬২ সালে আদালত মন্দিরের মালিকানা কম্বোডিয়াকে দেয়। কিন্তু আদালত মন্দিরের সংলগ্ন প্রায় ৪.৬ বর্গ কিলোমিটার এলাকার মালিকানা নিয়ে কোনো স্পষ্ট রায় দেয়নি। এই অমীমাংসিত এলাকাই থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া সীমান্ত বিরোধ-কে আজও জিইয়ে রেখেছে।

Preyavihar Temple:থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া সীমান্ত বিরোধ: সাম্প্রতিক উত্তেজনার কারণ

পুরোনো ক্ষত নতুন করে মাথাচাড়া দেওয়ার পেছনে বেশ কিছু সাম্প্রতিক ঘটনা রয়েছে:

  • ইউনেস্কো বিতর্ক ও পূর্বের সংঘর্ষ: ২০০৮ সালে কম্বোডিয়া এককভাবে মন্দিরটিকে ইউনেস্কোর তালিকাভুক্ত করলে তীব্র উত্তেজনা ছড়ায় এবং ২০০৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত সংঘর্ষে প্রায় ৪০ জন নিহত হন।

  • কূটনৈতিক ভুল ও পাল্টা হুমকি: সম্প্রতি ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ, থাই প্রধানমন্ত্রীর ফাঁস হওয়া ফোনালাপ এবং দুই দেশের নেতাদের মধ্যে পাল্টা হুমকি দুই দেশের সম্পর্ককে তলানিতে নিয়ে গেছে। এই ঘটনাগুলো প্রেয়াবিহার মন্দির বিতর্ক-কে আরও জটিল করে তুলেছে।

Preyavihar Temple: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূ-রাজনীতি ও অভ্যন্তরীণ চাপ

এই সীমান্ত বিরোধকে শুধু দুটি দেশের সমস্যা হিসেবে দেখলে ভুল হবে। এর পেছনে কাজ করছে আরও বড় কারণ:

  • অভ্যন্তরীণ রাজনীতি: কম্বোডিয়ার নতুন প্রধানমন্ত্রী হুন মানেত এবং থাইল্যান্ডের জোট সরকার, উভয় পক্ষই জাতীয়তাবাদী আবেগ ব্যবহার করে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে চাইছে।

  • ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব: কম্বোডিয়া চীনের ঘনিষ্ঠ মিত্র, অন্যদিকে থাইল্যান্ড আমেরিকার দিকে ঝুঁকে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূ-রাজনীতি-তে বৃহৎ শক্তিগুলোর এই প্রভাব সংঘাতকে আরও উস্কে দিতে পারে।

Preyavihar Temple শেষ কথা: সমাধান কোন পথে?

বিশেষজ্ঞদের মতে, পুরোদস্তুর যুদ্ধ হয়তো এখনই হবে না, কিন্তু ছোটখাটো সংঘর্ষের আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। দুঃখজনকভাবে, যে ঐতিহাসিক ঐতিহ্য দুই দেশের साझा সম্পদ হতে পারত, সেটাই আজ বিভেদ ও রক্তপাতের কারণ। এই থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া সীমান্ত বিরোধ কবে মিটবে এবং কীভাবে শান্তি ফিরবে, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

Scroll to Top