বুদ্ধিজীবী কারে কয়? সে কি কেবলই তৈলময়? / দেবাশিস লাহা
তুষার রায়ের নাম শুনেছেন ? হ্যাঁ ষাটের দশকের অমিত শক্তিধর এক কবি ! ১৯৩৫ থেকে ১৯৭৭ জীবনকালে তিনি ব্যান্ডমাস্টার, গাঁটছড়া, মরুভূমির আকাশে তারা, অপ্রকাশিত তুষার কাব্যগ্রন্থগুলি বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। প্রায় র্যাবোঁ-র মতই এক সুগভীর উচ্চারণে [ The poet turns himself into visionary by a long drastic and deliberate disordering of all his senses.] বিশ্বাস রাখা এই গভীর মানুষটির নাম যে আপনারা প্রায় কেউই শোনেন নি, শুনলেও হাতে গোনা কিছু মানুষ যারা নিবিড় কবিতা চর্চা করেন,] তা হলফ করে বলতে পারি। কেন শোনেন নি ? উত্তরটি খুব সোজা। কারণ ইনি এত অসাধারণ সাহিত্য সৃষ্টি করার পরও “বুদ্ধিজীবী” হতে পারেননি।
বিনয় মজুমদারের নাম শুনেছেন ? মূলত পঞ্চাশ দশকের এক অনন্যসাধারণ কবি। বাংলা সাহিত্যে এমন বিজ্ঞানসাধক এবং কবির যুগপৎ মিশ্রণ আর নেই বললেই চলে। তাঁর কাব্যগ্রন্থ ফিরে এসো চাকার নাম কেউ কেউ শুনে থাকবেন। এছাড়াও আঘ্রানের অনুভূতিমালা, ঈশ্বরীর স্বরচিত নিবন্ধ, নক্ষত্রের আলোয়, গায়ত্রীকে, বাল্মীকির কবিতা ইত্যাদি বেশ কিছু অসামান্য কাব্যগন্থের স্রষ্টা। স্বদেশ বিদেশ থেকে লোভনীয় চাকরির প্রস্তাব অবলীলায় প্রত্যাখান করে আদ্যন্ত রোম্যান্টিক এই এঞ্জিনিয়র কবিটি তাঁর সমগ্র জীবন কেবল কবিতার সাধনাতেই বিলিয়ে দেন। না। তবু তিনি “বুদ্ধিজীবী” হতে পারেন নি। অবহেলা, উপেক্ষা যে কত তীব্র হতে পারে, তাঁর জীবন যারা অল্পবিস্তর জানেন, তাঁরা অনুভব করবেন। জীবনের শেষ দিনগুলি তাঁর কিভাবে কেটেছিল এবং সমসাময়িক “বুদ্ধিজীবীকুলের” তাঁর প্রতি আচরণ কেমন ছিল, যারা কবিতা চর্চা করেন, যারা শিমূলপুর চিনতেন বা এখনও চেনেন, তাঁদের নতুন করে মনে করিয়ে দেওয়ার দরকার পড়বে না। জীবনের অন্তিম লগ্নে এক রকম চাপে পড়ে, এবং মুখ রক্ষার তাগিদে তাঁকে দুটি পুরস্কার দেওয়া হয়—রবীন্দ্র পুরস্কার এবং একাডেমি পুরস্কার। তবু তাঁকে কবিতা চর্চা করেন এমন মানুষ ছাড়া কেউ তেমন চেনেন না। কেন বলুন তো ? ২০০৬ সালে মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত “বুদ্ধিজীবী” হিসেবে তাঁকে কোথাও বাইট দিতে দেখা যায়নি।
অথবা উৎপল কুমার বসু? সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যের আরেক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক ! হাংরি আন্দোলনের এই খ্যাতনামা কবি [যদিও তিনি পরবর্তীকালে এই আন্দোলন থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন] যিনি পুরী সিরিজ, লোচনদাস কারিগর, নাইট স্কুল, সলমাজরির কাজ ইত্যাদি ব্যতিক্রমী কবিতা গ্রন্থের জন্ম দেওয়া সত্ত্বেও কিন্তু তথাকথিত “বুদ্ধিজীবী” হয়ে উঠতে পারেন নি। আর তাই কবিতার পাঠক/ কবি ছাড়া এঁর নামও আপনারা কেউ শোনেন নি। অথচ তাঁর জীবনের শেষ ভাগ রীতিমত ডিজিটাল যুগেই অতিবাহিত হয়েছে। এই সেদিন ২০১৫ তে তাঁর জীবনাবসান হয়েছে। ২০১৪ তে তিনি সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পান।
এত কাণ্ড করেও এঁরা “বুদ্ধিজীবী” হয়ে উঠতে পারলেন না ! কেন ? আসুন একটু সহজ ভাষায় উত্তর খোঁজা যাক। খুব সহজ একটি প্রশ্ন দিয়ে শুরু করি। প্রশ্নটি একেবারে সাধারণ মানুষের প্রতি যারা শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির অমৃত আস্বাদন না করেও টিভি দেখে, তাস খেলে, আড্ডা মেরে মেহনত করে জীবন কাটিয়ে দেন। প্রশ্নটি হল—যাদের আপনারা “বুদ্ধিজীবী” হিসেবে চেনেন আরো ভাল করে বললে চেনানো হচ্ছে, তাঁদের কোন কোন সৃষ্টি সম্পর্কে আপনারা ওয়াকিবহাল ? এই যেমন ধরুন নাট্যকার বুদ্ধিজীবি হিসেবে খ্যাত ব্যক্তিটির কটি নাটক দেখেছেন ? অথবা কবি বুদ্ধিজীবিটির কটি কবিতা বা কাব্যগ্রন্থ পড়েছেন? শিল্পী বুদ্ধিজীবিটির কটি ছবি দেখেছেন বা বুঝেছেন ?
কি ভাবনায় পড়লেন তো ? ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে এই সব কটি প্রশ্নের উত্তরই যে নেতিবাচক হবে, আপনি আমি খুব ভাল করেই জানি। তবে কিভাবে জানলেন এঁরা বুদ্ধিজীবী ? খুঁজে খুঁজে বই পত্র পড়ে, নাটক দেখে, গভীর চিন্তাভাবনা করে এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে এই মানুষগুলিকে বুদ্ধিজীবী, বিশিষ্ট জন, বিদ্য জন ইত্যাদি বিশেষণে বিশেষিত করা যায় ? অবশ্যই না। আপনাদের কানের গোড়ায়, মগজের খাঁজে বিশেষ কৌশলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে এঁরাই বুদ্ধিজীবী। কারা ঢুকিয়েছে ? অবশ্যই মিডিয়া , অর্থাৎ টেলিভিশন, সংবাদপত্র থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংগঠন এবং রাজনৈতিক দল। কিন্তু কেন ? শিপ্লী, সাহিত্যিক, কবি, নাট্যকার হিসেবে কি এই মানুষগুলির কোনো গুণই নেই ? এঁদের কি কোনো যোগ্যতাই নেই ? উঁহু ব্যাপারটা তা নয়। এঁদের গুণ বা যোগ্যতা নেই এমন ভেবে নেওয়া ভুল হবে, তবে একই সঙ্গে এটিও মাথায় রাখতে হবে “বুদ্ধিজীবী” হতে গেলে এই যোগ্যতাই যথেষ্ট নয়। কারণ “বুদ্ধিজীবী” বলে পরিচিত হওয়া মানুষগুলির সময়কালে তাঁদের চেয়ে অনেক বেশি যোগ্য অথবা সম মেধা সম্পন্ন মানুষ বর্তমান থাকেন। কিন্তু এঁরা কখনই “বুদ্ধিজীবী” হয়ে উঠতে পারেন না। কিন্তু কেন ? এই বিষয়টি আলোচনা করার জন্যই এই লেখাটির সূত্রপাত।
এবার দেখে নেওয়া যাক যে কোনো সমাজ ব্যবস্থায়, সে ধনতান্ত্রিকই হোক আর সমাজতান্ত্রিক হোক অথবা ফ্যাসিবাদী “বুদ্ধিজীবী” হিসেবে আখ্যাত হতে চাইলে নিম্নলিখিত শর্তগুলি মেনে চলতে হবে—১]সমসাময়িক সরকার/ রাজনীতি/ রাজনৈতিক দল তথা মিডিয়ার লিখিত/ অলিখিত ন্যারেটিভ বা গাইডলাইন মেনে চলা ২] মেইন স্ট্রিম ভাষ্য /কথনরীতি অথবা মাধ্যমে কুশলতা ৩] দাসসুলভ মানসিকতা তথা নিজেকে বিক্রয় করার মানসিকতা/ অভিলাষ।
বলাই বাহুল্য প্রথমে থাকা পর্যবেক্ষণটি সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। যে কোন সমাজব্যবস্থা/রাজনীতি একটি সুনির্দিষ্ট ভাষ্য তথা ন্যারেটিভের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। কোন শিল্পী সাহিত্যিক অথবা সাংস্কৃতিক কর্মীকে [“বুদ্ধিজীবী”] হতে চাইলে সেই ন্যারেটিভের প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্য দেখাতে হয়। নীরবে নয়, সরবে। সে “ধর্মনিরপেক্ষ” ভারতের ন্যারেটিভই হোক [যা প্রায় সব কটি রাজনৈতিক দল অনুসরণ করে থাকে, বিশেষ একটি জনগোষ্ঠীকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে] অথবা সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বহারার অধিকার প্রতিষ্ঠা তথা সংগ্রামের ভাষ্যই হোক, কিম্বা হিটলারের ইহুদী বিদ্বেষ তথা জার্মান রক্তের শ্রেষ্ঠত্বের ন্যারেটিভই হোক। কারণ এই ন্যারেটিভটির প্রতি আনুগত্যই আপনাকে পাদপ্রদীপের আলোতে নিয়ে আসতে পারে। “বুদ্ধিজীবী” হতে গেলে আপনাকে এই ট্রেন্ডটিকে বুঝে নিতে হবে, অর্থাৎ বেশিরভাগ মিডিয়া তথা রাজনৈতিক দল [এদেশের কথা বলছি] কোন দিকে হাঁটছে। এদেশের ক্ষেত্রে ন্যারেটিভটি যেহেতু এখনও এক চোখো ধর্মনিরপেক্ষতা, তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরাও তাকে বিনা প্রশ্নে অনুসরণ করছেন। কিন্তু এটাই যথেষ্ট নয়। এই ধরণের অন্ধ আনুগত্য দেখাতে এক পায়ে রাজি এমন অনেক বশংবদ শিল্পী সাহিত্যিক আছেন। তবে তাঁরা কেন “বুদ্ধিজীবী” হচ্ছেন না ! এটি বোঝার জন্যই দ্বিতীয় পর্যবেক্ষণে আসতে হবে। সেটি হলে মেইন স্ট্রিম ভাষ্য/ কথন বা মাধ্যম। এই রাজ্যের কথাও যদি ধরেন, তবে দেখবেন এখানে মুলত দুটি শক্তি এই “বুদ্ধিজীবী” তৈরি করে আসছে বা এসেছে।১] শক্তিশালী মিডিয়া যা বিপনণযোগ্য মাল খুঁজে থাকে। অর্থাৎ যা সাধারণে বুঝবে বা গিলবে। কারণ সাধারণ মানুষের সংখ্যায় বেশি এবং তাঁদের মগজটিই বেশি করে ধোলাই করা জরুরী। তাই ভাষারীতি সহজ সরল, সহজবোধ্য হওয়া জরুরী। তাদের চার্লস ডিকেন্স, জেইন অস্টিন চলতে পারে, কিন্তু জেমস জয়েস, স্যামুয়েল বেকেট চলবে না। সুনীল চলতে পারে কিন্তু তুষার রায়, বিনয় মজুমদার নয়। দু একটি বই কবিতা ছাপা যেতেই পারে, ক্ষমা ঘেন্না করে দু একটি পুরস্কারও দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু বুদ্ধিজীবী হিসেবে প্রজেক্ট করা ? নৈব নৈব চ ! পাবলিক তো কাঁচকলা বুঝবে। দু একটি কবিতা তো টিভিতে বাইট দেওয়ার সময় বলতেই হবে ! একটু যদি চাটনি/ চমক না থাকল পাবলিক কবি সাহিত্যিক মানবে কেন ? ২] রাজনৈতিক দলও “বুদ্ধিজীবী” তৈরি করে থাকে। এ রাজ্যেও বিশেষ একটি রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী দল কয়েক দশক ধরে বেশ কিছু বুদ্ধিজীবী উপহার দিয়েছেন। এর অর্থ এই নয় যে এঁদের যোগ্যতা ছিল না বা নেই।হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন এঁরা হলেন বামপন্থী ঘরানার ঘোষিত বুদ্ধিজীবী। অমিতাভ দাশগুপ্ত থেকে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায় এমন অনেক স্মরণীয় নাম আছে এই তালিকায়। কিন্তু তাঁদেরও এই রাজনৈতিক দর্শনের প্রতি আস্থা রেখেই লেখালেখি করতে হয়েছে। ইচ্ছায় ব অনিচ্ছায় যেভাবেই হোক। এই পার্টি লাইন ফলো করতে গিয়ে অনেক কুশলী লেখনীকে শেষ হয়ে যেতেও দেখেছি। সর্বোপরি মাধ্যমটি একটু চলেবল ইয়ে মানে জনগণ যেন অল্প হলেও বোঝে অথবা খায় এমন হতে হবে। এই যেমন ধরুন গায়ক হলে খুব ভাল, কিন্তু ছৌ নাচলে চলবে না। কারণ দ্বিতীয়টি শিল্প হলেও পাবলিক তেমন খায় না। তাই তাকে দিন রাত বাইট দেওয়ার সুযোগ দিয়ে “শিল্পী বুদ্ধিজীবী” বানানোর প্রশ্নই আসেনা।
হ্যাঁ মোটামুটিভাবে এই রূপরেখা অবলম্বন করেই মেইন স্ট্রিম “বুদ্ধিজীবী’ উৎপাদন করা হয়ে থাকে। প্রথমে হিটলারকে দিয়েই শুরু করি। তাঁর আমলে যত বুদ্ধিজীবী, শিল্পী সাহিত্যিককে হত্যা,বিতাড়ন তথা বন্দী করা হয়েছিল তা কেবল মাত্র স্তালিনের সঙ্গেই তুলনীয়। আধুনিক মনস্তত্ত্বের জনক সিগমন্ড ফ্রয়েডকে প্রাণ হাতে নিয়ে পালাতে হয়েছিল। তাঁর এক ভগিনীকে হত্যা করা হয়। ঠিক ধরেছেন ফ্রয়েড ইহুদি ছিলেন। তবে কি হিটলারের আমলে কোনো বুদ্ধিজীবী ছিলেন না ? ঘন ঘন বাইট না দিতে পারলেও [সেই সময় টিভি এত বিস্তৃত হয়নি, ১৯৩৫ সদ্য সম্প্রচার শুরু হয়েছে বার্লিন থেকে] প্রিন্ট মিডিয়া, সভা সমিতি ইত্যাদি তো ছিলই। নাজি মতাদর্শকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থন করে করে সেই সময় অনেকেই “বুদ্ধিজীবী” তকমা পেয়েছিলেন এবং মহানন্দে উপভোগ করছিলেন। কয়েকজনের নাম এবং অবদান দেখে নেওয়া যাক।
আসুন আলাপ করিয়ে দিই—ইনি হলেন ১] অ্যালফ্রেড রোজেনবার্গ [১৮৬৩—১৯৪৬] হিটলারের প্রিয়তম এবং “শ্রেষ্ঠতম” সাহিত্যিক। ইনি তাঁর লেখায় নাজিবাদের জাতিবিদ্বেষকে অসামান্য ভঙ্গিমায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন। ইনি নিজের হাতে একটি মানুষও খুন করেন নি। কেবল এই জাতিবিদ্বেষের দর্শন লিখে চলেছিলেন। তবু তাঁকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয় এবং নুরেমবার্গ ট্রায়ালের রায়ে ফাঁসিতে চড়ানো হয়।
২] মার্টিন হাইডেগার [ ১৮৮৯—১৯৭৬] বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক। যোগ্যতা অনস্বীকার্য । কিন্তু ওই যে লোভ ! নিজেকে বিক্রি করার বাসনা। তিনি নাজি পার্টির সদস্য পর্যন্ত হন। ফলশ্রুতি হিসেবে প্রায় রাতারাতি ফ্রেইবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের রেকটর হয়ে যান [কি, কিছু সাদৃশ্য পাচ্ছেন তো ?] ইনি অবশ্য খুবই বুদ্ধিমান, হিটলারের পতনের পর ব্যাপক হারে কান্নাকাটি করে ক্ষমা চেয়ে নেন।[ এ দৃশ্য এদেশেও দেখতে পাবেন। একটু অপেক্ষা করুন]
মাত্র দুটি উদাহরণই যথেষ্ট। এই “বুদ্ধিজীবীর’ সারিতে আরও অনেক নাম আছে। যেমন Carl Schmitt, Ernst Krieck, Alfred Baeumier, Alfred Ploetz, Eugen Fischer, Josef Mengele ইত্যাদি।
এবার আসি মহান সর্বহারা বিপ্লবের দেশ স্বপ্নের দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের “বুদ্ধিজীবী” অধ্যায়ে। সখি বুদ্ধিজীবী কারে কয়, সেকি কেবলই তেলানোময় ! যদি প্রশ্ন করা হয় লেনিন স্তালিনের জমানায় একজন বিখ্যাত সাহিত্যিক তথা “বুদ্ধিজীবীর” নাম কি ? উত্তর আসবে মায়োকোভস্কি, মায়োকোভস্কি, মায়োকোভস্কি, মায়োকোভস্কি, মায়োকোভস্কি, মায়োকোভস্কি, মায়োকোভস্কি, মায়োকোভস্কি, এবং মায়োকোভস্কি ! কিছুটা গোর্কি। “কিছুটা” কেন পরে আসছি। তা মায়োকোভস্কি যে এত বড় বুদ্ধিজীবী হলেন , শুধু তাই নয় লেনিনের সবচেয়ে কাছের মানুষ হয়ে উঠলেন [যদিও স্তালিনের সঙ্গে তাঁর কিঞ্চিৎ মনমালিন্য হয়েছিল, তবু বুদ্ধিমান স্তালিন কৌশলে তা মিটিয়ে নেন এই বলে যে—Mayakovosky is still the best and most talented poet of our Soviet epoch—“ ] সে কি কেবল তাঁর কলমের জোরে ? দি বেডবাগ, বাথহাউসের মত যত অসাধারণ সৃষ্টিই করুন না কেন, তাঁকে সোচ্চারে বলতে হয়েছে—লং লিভ লেনিন ! লিখতে হয়েছে — Lenin is enshrined / In the large heart of the working class,/ He was our teacher/ He carried on struggle along with us/ He is enshrined in the large heart of the working class. [Cantata on the day of Lenin’s death] এ তো সামান্য ঝলক। এটি ছাড়াও লেনিন তথা সমাজতন্ত্রের স্তুতি করে তিনি অজস্র লেখালেখি করেন। বস্তুত তাঁর কাজই ছিল সমসাময়িক সমাজব্যবস্থা তথা একনায়কের বন্দনা করা। তাঁর প্রতিভাকে তিনি এ কাজেই লাগিয়েছিলেন। ১৯২৪ খৃষ্টাব্দে ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন শীর্ষক একটি সুদীর্ঘ কবিতাও লেখেন। ১৯৩৪ এ লেখেন The Unconquerable Inscription.
সমসাময়িক কালে এই মহান কবিটি ছাড়া কি আর কোনো প্রতিভাবান শিল্পী সাহিত্যিক ছিলেন না। অবশ্যই ছিলেন। তাঁদের পরিণতি কি হয়েছিল আপনারা কম বেশি সবাই জানেন। কিছুদিন আগে এ ব্যাপারে আমি একটি ভিন্ন লেখা পোষ্ট করেছিলাম। যারা ধামাটা ঠিক ঠাক ধরতে পেরেছিলেন, তাঁদের কপালেই ননী মাখন জুটেছিল। বাকিদের হয় হত্যা করা করেছিল, নয় কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে কুকুর বিড়ালের চেয়েও খারাপ অবস্থায় তিলে তিলে মরতে হয়েছিল। আসুন দেখে নেওয়া যাক এ ব্যাপারে প্রবাদপ্রতিম সাহিত্যিক ম্যক্সিম গোর্কি কি বলছেন।
Lenin, Trotsky and their comrades have already been poisoned with the rotten poison of power, and the evidence of this is the shameful way that they treat freedom of speech and person and all the sum of those rights, which democracy was fighting for. Blind fanatics and unscrupulous opportunists are headlong racing along the path of the so-called ‘social revolution’…”
ভাবতে পারেন, যে মানুষটি ১৯১৭ সালের মহান বলশেভিক বিপ্লবকে অকুন্ঠ সমর্থন জানিয়েছিলেন, সেই তিনিই ১৯১৮ সালে নিজের চোখে রিভোলিউশন দেখার পর Untimely Thoughts নামে এমন একটি বই লিখে ফেলছেন। বলছেন—লেনিন, ট্রটস্কি এবং তাঁদের সাঙ্গোপাঙ্গরা ক্ষমতার পচে যাওয়া বিষে বিষাক্ত হয়ে উঠেছেন এবং তার প্রমাণ হল চরম নির্লজ্জতার সঙ্গে তাঁরা মানুষের বাকস্বাধীনতা এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রতি আচরণ করছেন, এবং সমস্ত অধিকার যা অর্জনের উদ্দেশ্যেই এই বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিল, যে গণতন্ত্রের জন্য এই লড়াইয়ের জন্ম হয়েছিল। অন্ধ মৌলবাদী এবং নীতিহীন সুযোগ সন্ধানীর দল সমাজ বিপ্লব নামক তথাকথিত গন্তব্যে সুতীব্র গতিতে ছুটে চলেছে। হ্যাঁ এই কারণেই বিপ্লব পরবর্তী সময়ে মায়াকোভস্কিকে নিয়ে যতটা মাতামাতি হত, গোর্কিকে নিয়ে হত না। লেনিনের তীব্র সমালোচক হওয়ার কারণে জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য সময় তাঁকে রাশিয়া তথা সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে নির্বাসিত অবস্থায় কাটাতে হয়েছিল। ১৯৩২ সালে তিনি স্তালিনের আমন্ত্রণে রাশিয়ায় ফিরে আসেন এবং কয়েক বছর পরেই রহস্যময় ভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। কেবল তাই নয়, মায়াকোভস্কির আকস্মিক মৃত্যুও সমানভাবে রহস্যাবৃত। প্রচার করা হয় যে নারীঘটিত/ প্রেম ঘটিত হতাশা তাঁকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তব তা বলে না। প্রথম দিকে তিনি সমাজতন্ত্র তথা লেনিনের অন্ধ অনুরাগী হয়ে থাকলেও পরের দিকে তাঁর লেখায় ব্যঙ্গ এবং সমালোচনার প্রকাশ হতে শুরু করেছিল। এব্যাপারে স্তালিন ক্ষোভও প্রকাশ করেন। এমনই এক পরিস্থিতিতে তাঁর আকস্মিক আত্মহত্যা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এ নিয়ে ভিন্ন একটি নিবন্ধ লেখার ইচ্ছে রইল।
ইভান বুনিন যিনি রাশিয়ান হিসেবে সাহিত্যে প্রথম নোবেল পেয়েছিলেন, তাঁর পর্যবেক্ষণ কেমন ছিল ? তাঁর Cursed Days নামক বইটিতে লিখছেন “Lenin, Trotsky, Dzerzhinsky… Who are the most base, bloodthirsty, and vile?”
লেনিন, ট্রটস্কি —-নীচ, রক্তপিপাসু, পিশাচ ! এর পর কি আর দেশে থাকা যায় ? প্রাণ হাতে নিয়ে তাঁকেও পালাতে হল । ১৯১৮ তে তিনি প্রথমে মস্কো থেকে ওডেসা যান তার দু বছর পর সোভিয়েত থেকেই গা ঢাকা দেন। এসব তিনি প্রথমে ডায়েরিতে লিখেছিলেন, পরে বই হয়ে প্রকাশিত হয়। বুঝুন এতেই এই অবস্থা। আসলে মনোভাব তো আর গোপন থাকে না। আর নবোকভ ? তাঁর অবস্থা আরও খারাপ ছিল। যেহেতু তাঁর পিতা বলশেভিকদের বিরোধী একটি দল Constitutional Democrats এর সদস্য ছিলেন। ১৯১৯ সালেই প্রাণ হাতে করে তাঁরা ইউরোপে পালিয়ে যান। কম বেশি একই পরিণতি হয়েছিল Dmitry Merezhkovsky, Boris Pasternak, Leonid Andreyev, Anna Akhmatova দের ! ভাবলে অবাক হবেন শেষোক্ত ব্যক্তিটি [আন্না আখমাতোভা] বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক কবি, অথচ তাঁর স্বামী কবি নিকোলাই গুমিলেভকে ১৯২১ সালে হত্যা করা হয়। ছেলেকে পাঠানো হয় কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে !
এভাবেই সমসাময়িক অনেক শিল্পী সাহিত্যিক যারা মায়াকোভোস্কির চেয়ে অনেক বেশি অথবা সমান কুশলী ছিলেন , হয় হত্যা নয় বন্দী করা হয়েছে। যারা পেরেছেন প্রাণ হাতে করে পালিয়েছন।
এবার বুঝলেন তো “বুদ্ধিজীবী” বস্তুটি আসলে কি ! হিটলার না হয় ঘোষিত নরপিশাচ ! কিন্তু সর্বহারার মহান প্রতিনিধি লেনিন তথা তাঁর সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আপনি কি বলবেন ! ওই যে প্রথমেই বলেছি প্রতিটি ব্যবস্থার একটি সুনির্দিষ্ট ন্যারেটিভ থাকে ! ফারাক এই গণতান্রিক ব্যবস্থায় ভিন্ন মতের শিল্পী সাহিত্যিকদের হত্যা করা হয় না, কিন্তু মিডিয়া দিয়ে দাবিয়ে দেওয়া হয়, দিনের পর দিন অবহেলা করা হয়। তাতে অবশ্য সত্যিকারের শিল্প সাধকের কিছু যায় আসেনা। তাঁরা তাঁদের সৃষ্টিতে মগ্ন করতে পারলেই সার্থক।
কিন্তু কোনো একটি ভাষ্য বা ন্যারেটিভ চিরস্থায়ী নয়। থিসিস এর বিপরীতে চিরকাল একটি এন্টি থিসিস সরবে বা নীরবে কাজ করে চলে। আর সেই ন্যারেটিভটি যদি একমুখী তথা একচোখো হয় তবে তো কথাই নেই। লেনিনের সোভিয়েত, হিটলারের জার্মানীতেও পালটা ন্যারেটিভের জন্ম হয়েছিল।। এখানেও একটি পাল্টা ন্যারেটিভএর জন্ম হয়েছে। সেটিই এন্টি থিসিস। দুইয়ের সংঘাত একদিন সিন্থেসিস-এর জন্ম দেবে। তখন আবার নতুন কিছু “বুদ্ধিজীবীর” জন্ম হবে। এই যেমন ভারত যদি সত্যিই একদিন হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত হয়, ( আশংকাটি যদি এক মুহূর্তের জন্য সত্য ধরে নেওয়া যায়), তখন অনেক কিছুর সঙ্গে বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞাটিও বদলে যাবে। বদলে যাবে ধর্মনিরপেক্ষতার ইন্টারিপ্রিটেশন। বর্তমানে “বুদ্ধিজীবী” বলে পরিচিত মানুষগুলি তখন শিবির বদলাতে ছুটবেন ! কেউ কেউ ইতিমধ্যেই প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছেন। আহ ! কি মধুর সেই দৃশ্য ! না এতে ন্যায় অন্যায় বলে কিছু নেই। এটিই সত্য, কারণ এটিই বাস্তব। মানুষের তৈরি সভ্যতাটিই এমন ভিন্ন ভিন্ন ন্যারেটিভে-এর উপর দাঁড়িয়ে। আর এই ভিন্ন ভিন্ন ন্যারেটিভগুলি ভিন্ন ভিন্ন মগজের কাছে সমানভাবেই সত্য। যে যতদূর দেখতে পায়, ততটাই দিগন্ত ! ওই যে মহাকবি শেক্সপীয়র হ্যামলেট নামক মাস্টারপিসটিতে সার কথা বলে গেছেন – there is nothing either good or bad, but thinking makes it so ! লীলাময়ী পৃথিবীতে ভাল মন্দ বলে নির্দিষ্ট কোনো প্রতীতি নেই, যে যার চিন্তা অনুযায়ী শুভ অশুভ নির্ণয় করে থাকেন !