“যোগ, যোগ ধর্ম এবং বর্তমান যোগী জাতি”
ডাঃ মৃনাল কান্তি দেবনাথ
যোগ কথার অর্থ যোগাযোগ, যুক্ত হওয়া। কার সংগে যোগ সাধন করা হবে, করা উচিত ? ঈশ্বরের সংগে ।
ঈশ্বর নানা নামে পুজিত হন। ঈশ্বরের সনাতনী তত্ব খুব গভীর। স্রষ্টা- সৃষ্টি, জীবাত্মা-পরমাত্মা, ক্ষর পুরুষ-অক্ষর পুরুষ, ভক্ত-ভগবান ইত্যাদি কতো তত্বগত কথা আমরা জানি, শুনি বা জানিও না, শুনিও না। সেই তত্বগত কথা বলা হয়েছে সাংখ্য দর্শনে , বেদে ,উপনিষদে, ব্রহ্মসুত্রে। সেই তত্ব কথা যারা জানেন, তারা জ্ঞানী, ব্রহ্মকে জানেন তাই ব্রাহ্মন, এই জ্ঞানীরা বা ব্রাহ্মনেরা যখন কর্ম যোগ এবং রাজযোগের সাধনা করে সিদ্ধি লাভ করেন তখন “যোগী” হন। যোগের সাধনা করলে তবে ঈশ্বরের দেখা পান , ঈশ্বরের সংগে যুক্ত হতে পারেন। সুতরাং জ্ঞানী পন্ডিত, ব্রাহ্মন এবং যোগী সমার্থক নয়। সমাজে ব্রাহ্মন বংশে জন্মালে ব্রাহ্মন পদবাচ্য হওয়া যায়, আবার রাস্তায় নেমে গুরুর মাংস খেয়েও বলা যায় আমি ব্রাহ্মন, মাথায় হিজাব পরে স্বগর্বে “আমি গরু খাই ,খাবো”বলা যায়, ইফতার পার্টি দিয়েও বলা যায় আমি ব্রাহ্মন সন্তান, আমিই খাটি হিন্দু।
জানাটাই সব নয়। যারা বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করেন, তাদের চিন্তা ভাবনায় অনেক কিছু আসে। কিন্তু যতক্ষন না সেই ভাবনা তত্বত প্রমান করা যাচ্ছে ততোক্ষন তিনি বিজ্ঞানী নন, তার জ্ঞান দিয়ে কিছুই হয় না। ঠিক সেই রুপ, ঈশ্বরের সরুপ জানলেই হবে না। তাকে পাবার চেষ্টা করতে হবে। তার সংগে যোগা যোগ স্থাপন করতে হবে। যোগা যোগ স্থাপনের প্রচেষ্টাই সাধনা। সাধনাহীন জ্ঞানী, আর অজ্ঞান মুর্খ প্রায় একই।। তফাত খুব কম। কিছু তফাত আছে। অজ্ঞান নিজেই বলে “আমি তো জানি না”। জ্ঞানী সেই কথা টা আস্ফালন করে বলেন, “আমি সব জানি”। সাধনা হীন জীবন ব্যার্থাতার জীবন।
গীতায় শ্রী কৃষ্ণ এই সুপ্রাচীন যোগ ধর্মের কথা অর্জুনকে বিস্তারিত বলেছেন। ————————
“লোকহস্মিনো দ্বিবিধা নিষ্ঠা, পুরা প্রোক্তা ময়ানঘ ।
জ্ঞানযোগেন সাংখ্যানাম কর্ম যোগেন যোগিনাম।।“
অর্থ্যাত, জ্ঞান যোগে ঈশ্বরকে বুঝতে হলে সাংখ্য দর্শন ( সাংখ্য যোগ= কপিল মুনি= গঙ্গাসাগর স্নানের মন্দির/আশ্রম) অবলম্বন করতে হবে। সাংখ্য দর্শন বুঝতে হলে আধ্যাত্ম পন্ডিত হতে হবে।এই ছাড়া উপায় নেই।
কিন্তু মানুষ যদি যোগ ধর্ম পালন করে, তাহলে নিষ্কাম কর্ম করে চিত্ত শুদ্ধি করে ধ্যান মার্গে ঈশ্বরকে জানতে পারে ,তাকে পেতে পারে।
যোগ সাধনা, দুই প্রকার। ‘হঠ যোগ’ এবং “রাজ যোগ”। হঠ যোগ নানা প্রকার আসন,প্রনায়াম ইত্যাদির দ্বারা শরীরকে সুস্থ রাখার এক সাধনা ( যা কিনা রামদেব শেখান= এর সংগে পতঞ্জলি প্রচারিত রাজযোগ এর কোনো সম্বন্ধ নেই)। শরীর সুস্থ না থাকলে ঈশ্বর সাধনা, নিষ্কাম কর্মের অনুষ্ঠান করা যায় না। তাই শুধু কিছু আসন, প্রানায়াম করা শিখলাম আর তাতেই ধর্ম হলো, এটা ভ্রান্ত ধারনা।
পতঞ্জলি তার “যোগ শাস্ত্র”র প্রথম শ্লোকে বলেছেন “ যোগশ্চিত্তবৃত্তি নিরোধ”। মানুষের চিত্তে সর্বদা যে কামনা বাসনার উদয় হয় এবং সেই জন্য মানুষের অন্তর্নিহিত আদিম প্রবৃত্তি জাগরিত হয়, সেই প্রবৃত্তিগুলোকে চিত্ত সংযমের দ্বারা নিরোধ করে রাখার নামই “যোগ সাধনা”। এই যোগ সাধনা, হঠযোগ স্তরে শেষ করলে সুস্থ শরীর পাবেন কিন্তু আধ্যাত্ম সাধনা হবে না।
সৃষ্টির আদি থেকে এই যোগ ধর্ম চলে আসছে। শ্রী কৃষ্ণ বলছেন, “ হে অর্জুন, আমি এই যে যোগ ধর্মের কথা তোমাকে বলিলাম ( পুরো তৃতীয় অধ্যায়) , সেই যোগ ধর্মের কথা নতুন কিছু নয়।পুরাকাল হইতে ইহা প্রচলিত আছে। অতি পুরাকালে এই যোগ ধর্ম আমি সমস্ত রাজাদের আদি পুরুষ বিস্ববান (সুর্য্য) কে বলিয়াছিলাম, বিস্ববান নিজ পুত্র বৈবস্বত্ব মনুকে বলেন এবং তিনি তার পুত্র ইক্ষাকুকে বলেন। এই যোগ ধর্ম অতীব প্রাচীন”।।
যোগধর্মের মুল কথা হলো,—–
“সর্বভুতস্থমাত্মানাং সর্বভুতানি চাত্মানি
ইক্ষকে যোগযুক্তাত্ম্যা সর্বত্র সমদর্শন”
“ঈশ্বর সমস্ত প্রানীতে অবস্থান করেন। যোগ যুক্ত হয়ে সব কিছুতেই সমান ভাবে ঈশ্বর দর্শন” করতে হবে। এটাই যোগ। জীবাত্মার সংগে জীবাত্মার যোগ, জীবাত্মার সংগে পরমাত্মার যোগ। সহজ সরল। কিন্তু মানুষ যতোদিন “অহম”, আমি সব, অন্য তুচ্ছ এই পাপ চিন্তা বন্ধ না করতে পারবে, ততোদিন ঈশ্বরের সংগেে যোগ হবে না। মন্দিরে, মসজিদে, চার্চে কোথাও গিয়ে চেচিয়ে গলা ফাটালে কিছুই হবে না
কবি রবীন্দ্রনাথ এই সত্যের ওপরে কবিতা লিখলেন—
“বিশ্বজনের পায়ের তলে ধুলিময় যে ভুমি
সেই তো স্বর্গভুমি।
সবায় নিয়ে সবার মাঝে লুকিয়ে আছো তুমি
সেই তো আমার তুমি”।।
তাহলে কি দাড়ালো ? মানুষের আদি থেকে এই যোগ ধর্ম। দেবাদিদেব মহাদেব এই যোগধর্মের প্রবর্তক সেই সৃষ্টির আদি থেকে। তিনি মহাযোগী মহেশ্বর। শ্রী রাম চন্দ্র তাকে স্মরন করেন ,পুজা করে শ্রী লংকার রাবনের সংগে যুদ্ধ যাত্রা করেন। শ্রী কৃষ্ণের পালক পিতা নিজের বাড়ীতে নিত্য মহাদেবের পুজা করেন, সেই মন্দির এখনো আছে।
সেই দেবাদিদেব মহাদেবের অংশে জন্মান যোগী মৎসেন্দ্র নাথ।তার শিষ্য গুরু গোরক্ষ নাথ। এই দুই মহাপুরুষ আধুনিক কালে যোগ ধর্মের প্রচার করেন। সারা ভারতে এবং ভারতের বাইরে সেই যোগ ধর্মের প্রচলন হয়। পুর্বে আধুনিক ভিয়েতনাম থেকে (চম্পারাজ্য=দা নাং এরিয়া), পশ্চিমে মধ্য এশিয়া ছাড়িয়ে ইউরোপ অবধি এর প্রসার লাভ করে।
যোগ ধর্মে কোনো জাতিভেদ নেই। ব্রাহ্মন, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র সকলেরই যোগ সাধনা করার অধিকার আছে, ঈশ্বরের সংগে যুক্ত হবার অধিকার আছে। যোগী জাতি তাই জাতি ভেদ মানেনা। যোগ গুরুগন সেই সুপ্রাচীন কাল থেকেই সেই সর্ব মানুষের কল্যা্নকারী যোগ ধর্ম প্রচার করে এসেছেন।
ভারত বর্ষে এই ‘যোগ ধর্ম’ র উৎপত্তি। যে প্রাচীন হিন্দু রাজারা বৈদেশিক আক্রমন থেকে ভারত কে স্বাধীন রাখার সংগ্রাম করেছেন তাদের সবাই ‘শিব ভক্ত’ ছিলেন। মহারাজ পৃথ্বীরাজের ‘পিথোরাগড়’ প্রাসাদে শিব মন্দির গুড়িয়ে দিয়ে মুহাম্মদ ঘোরীর দাস কুতুবুউদ্দিন আইবেক “কুতুব মিনার বানায়। কিন্তু সব শিব মন্দিরের সামনে যে স্তম্ভ থাকে সেই স্তম্ভ আজো বিদ্যমান। নানা মুনি নানা তথ্য দেন কিন্তু কেউই আজো বলতে পারলেন না সেই স্তম্ভ কি ধাতু দিয়ে তৈরী। গোকুলে নন্দ রাজের বাড়ীতে প্রায় ৪২ টি সেই একই বস্তুর স্তম্ভ দিয়ে তার প্রাসাদ তৈরী।
শ্রী রামচন্দ্র শিব পুজা করে সেতু তৈরী শুরু করেছিলেন, মা দুর্গার পুজা করে যুদ্ধ যাত্রা করেন। আদি শংকরাচার্য কে শিবের অবতার বলা হয়, মানা হয়। তিনি প্রায় সব প্রাচীন সনাতনী মন্দিরের সংষ্কার করেন। স্বামী বিবেকানন্দ দুষ্টু ছিলেন ছোটবেলায়। তাকে ঠান্ডা করতে তার মা “শিব শিব বলে মাথায় জল ঢালতেন। দিকে দিকে আজো ‘শিব মন্দির’ বিভিন্ন নামে আছে।
যোগী জাতি ‘শিব গোত্রীয়’ তারা অকুতোভয়ে যুগে যুগে অন্যায়ের প্রতিবাদ করে এসেছেন। ঈশ্বরের সংগে যোগযুক্ত যোগী পুরুষেরা অসীম মহাজাগতিক শক্তির অধিকারী ছিলেন। চটপটি নাথ থেকে শুরু করে, গোরক্ষনাথ, চৌরঙ্গীনাথ, মীন নাথ, আদিনাথ, মৎসেন্দ্রনাথ সবাই অসীম অপ্রাকৃত শক্তিধর ছিলেন। তারা কোনোদিন সেই শক্তির অপপ্রয়োগ করেন নি। সমাজের কল্যানে তাদের সেই শক্তিকে কাজে লাগিয়েছেন। তারা ছিলেন সব রাজাদের গুরুস্থানীয় তাই তাদের বলা হয় “রাজগুরু”।।
আজ এই মহান যোগ ধর্মের উত্তর সুরীরা, যারা নিজেদের যোগী বলে (নাথ যোগী), তারা সংখ্যায় প্রায় ১ কোটি ৭০ লক্ষ। বাংলায় এই নাথ যোগিদের রাজরোষে পড়তে হয়েছিলো রাজা বল্লাল সেন সমাজকে কুলীন (সর্ব সুবিধা ভোগী শ্রেনী , ব্রাহ্মন এবং কায়স্থদের কুলীন আখ্যা দেন) অকুলীন (সমাজের অন্ত্যজ শ্রেনীকে), এই দুই ভাগে বিভক্ত করার জন্য। এই অকুলীন দের বলা হয় ‘পতিত’। কুলীনরা সব সুবিধা পাবে (সংরক্ষন), অকুলীনরা পাবে না। সমাজ দুই ভাগ হয়ে গেলো।
সেই সময় নাথ যোগীগুরুরা বল্লাল সেনের সমাজ ভাগ করার তীব্র প্রতিবাদ করে পতিত শ্রেনীর পক্ষে এসে রাজার বিপক্ষে বিদ্রোহ করেন। তারা সব সময়ই ব্রাহ্মনদের উপরেই স্থান পেতেন। কিন্তু সঙ্গ দিলেন অব্রাহ্মনদের, অবহেলিত জনদের। সেটাই তাদের অপরাধ। বল্লাল সেন সমস্ত গৃহী যোগী, সন্ন্যাসী যোগীদের তার রাজ্য থেকে বিতাড়িত করেন। উদবাস্তু হয়ে সমস্ত নাথ যোগীরা ছড়িয়ে পড়ে, আসাম, পুর্ব বাংলা, ত্রিপুরার দুর্গম অঞ্চলে, বাংলাদেশের দক্ষিন অঞ্চলে সুন্দর বনের জংগলে। সেই থেকে শুরু বাংলায় নাথ যোগী দের জীবন ধারনের সংগ্রাম। আজ তারা তাদের অতীত ভুলে এক আত্মবিস্মৃত জাতিতে পরিনত হয়েছে। যোগী জাতির তীর্থ ক্ষেত্রগুলি কলকাতার বাগুইয়াটির পাশে ‘গোরক্ষবাসুলী’ মন্দির, হুগলী জেলার জটেশ্বর মহানাদ ইত্যাদি মন্দিরের সম্পত্তি বেদখল হয়ে গেছে। আসাম বংগ যোগী সম্মীলনী, ১১১ বছরের পুরানো নাথ যোগীদের একত্র করার চেষ্টা চালাচ্ছে, মন্দির গুলি সংরক্ষন করার চেষ্টা করছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় “ নাথ যোগীদের একাংশ নিজেদের ব্রাহ্মন প্রমান করার জন্য ( যদিও নাথ যোগীরা চারি বর্নের ঊর্দ্ধে, জাত পাতের উর্দ্ধে) “রুদ্রজ ব্রাহ্মন” বলে এক স্বতন্ত্র সংঘটন তৈরী করে মুল সমিতির বিরোধিতা করে চলেছে।
‘নাথ যোগী’ বংশে জন্মানো মানুষ গুলোর মধ্যে আজ হীনমন্যতা এসে বাসা বেধেছে!!!!!!!!!