মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম রূপকারদের সকলেই যৌবনে ‘পাকিস্তান’ কায়েমের ‘তরুণ তূর্কী’ ছিলেন।

মীর কাশেমের নয়া দিগন্ত, ধর্মবাদ, জাতীয়তাবাদ ও অন্যান্য
……………………………………………………………………..
……………………………………………………………………..
১৯৭১ সালে যারা অখন্ড পাকিস্তান চেয়েছিলো আইনত তারা কোন অপরাধ করেনি। এমনকি নৈতিকভাবেও কোন দোষ করেনি। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম রূপকারদের সকলেই যৌবনে ‘পাকিস্তান’ কায়েমের ‘তরুণ তূর্কী’ ছিলেন। পরবর্তীতে তাদের অনেকেই ‘পাকিস্তান’ থিউরী থেকে সরে আসাটা যেমন স্বাভাবিক ছিল, তেমনি ‘পাকিস্তানে’ আস্থা যারা রেখেছিলো সেটাও ছিল খুব স্বাভাবিক। গোলাম আযম বলেছিলো, পাকিস্তান অটুট থাকলে একদিন না একদিন আমাদের হক আদায় করা যাবে। এরকম মনোভাব অনেকেরই ছিল। কিন্তু তারা কেউ গোলাম আযমের মত গণহত্যা, নারী ও শিশু হত্যায় নিজেদের জড়ায়নি। পাকিস্তানী বাহিনীর সহযোগী কোন মিলিটারি দলও গঠন করেনি। গোলাম আযমদের যে বিচার আমরা করছি সেটা তাদের যুদ্ধাপরাধের, পাকিস্তানের পক্ষে থাকার জন্য নয়। এমনকি তারা যদি পাকিস্তানের পক্ষ হয়ে ‘যুদ্ধ’ করত তাহলেও তাদের কোন রকম বিচার করার সুযোগ ছিল না। ১৯৫ জন যে পাকিস্তানী সৈনিকের বিচার করার কথা ছিল সেটা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য নয়, তারা ‘যুদ্ধাপরাধ’ করেছিলো সে জন্য। ‘যুদ্ধ’ খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয়, যুদ্ধের আন্তর্জাতিক স্বীকৃত নিয়ম আছে। সেটা মেনে যুদ্ধ করা কোন দোষের কাজ নয়। কিন্তু যুদ্ধের সময় বেসমারিক লোককে টর্চার করা, নারী ধর্ষণ, গণহত্যা, ম্যাসাকার, দেশান্তরিন, ধর্মান্তরিন, সম্পত্তি দখল ইত্যাদি কাজগুলো যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচিত যা সারা বিশ্বে ভয়ানক অপরাধ হিসেবে দেখা হয়। বাংলাদেশে আমরা গোলাম আযম, সাঈদী, মুজাহিদ, সাকা, নিজামী, কাশেম আলীদের যে বিচারটা করলাম সেটা তাদের যুদ্ধাপরাধের, পাকিস্তানের পক্ষালম্বণ কিংবা তাদের হয়ে যুদ্ধ করার জন্য নয়।

গোলাম আযম ঘৃণ্যিত কেন আমাদের কাছে? সে পাকিস্তানের অখন্ডতা চেয়েছিল বলে? মোটেই নয়। গোলাম আযম ‘পাকিস্তান’ বলতে যা চাইত সেই একই জিনিস বাংলাদেশের সকল ইসলামী দলগুলোর গঠনতন্ত্রে লিপিবদ্ধ রয়েছে। অর্থ্যাৎ তারা যদি ক্ষমতায় যেতে পারে তাহলে তারা যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা বানাবে সেটা গোলাম আযমের ‘পাকিস্তান’ থেকে ভিন্ন কিছু নয়। এমনকি আমাদের মূল ধারার আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য দলগুলো বিগত ৪৪ বছরে একটু একটু করে বাংলাদেশকে যতখানি খৎনা করিয়ে মুসলমান বানিয়েছে সেটা কোনদিক দিয়েই গোলাম আযমদের ‘পাকিস্তান’ থেকে ভিন্ন কিছু নয়। বাংলাদেশ আজকে ‘একটি মুসলিম রাষ্ট্র’। এটি ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার’ কোথায় আছে? মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যদি ‘পাকিস্তান’ থেকে ভিন্নতর কিছু না থাকে তাহলে সেটা আলাদা কি বিশেষত্ব রাখে? তাই বরাবর বলে এসেছি যুদ্ধাপরাধীর বিচার কার্য মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার, এর বেশি কিছু নয়।

আমাদের দেশে অনেক গুণি ব্যক্তি অখন্ড পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন সেই ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত। তারা কেউ যুদ্ধাপরাধ করেননি এবং সমর্থনও করেনি। তাদের রাজনৈতিক দর্শন ছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার যে মূলমন্ত্র তার উপর। এই রাজনৈতিক অবস্থানে থেকেও অনেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত করেছেন। তারাই পরবর্তীকালে ‘এন্টি মুক্তিযুদ্ধ’ বলেও চিহিৃত হয়েছিলেন। ‘মুক্তিযোদ্ধা হয়েও রাজাকারের মত কথা বলে’- আমাদের এরকম বিস্ময় শুধুমাত্র ইতিহাসকে না জানা বা বিশ্লেষণকে একমুখি করে তোলার কারণে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিশ্লেষণ করতে হলে ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করতে হবে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পক্ষে ছিল এমন রাষ্ট্র, সংস্থার সঙ্গে আজকে আমাদের ‘বন্ধুত্ব’ পূর্ণ সম্পর্ক। এমনকি যারা বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করেছিল সে সমস্ত রাষ্ট্র সংস্থার সঙ্গে আজকে আমাদের শীতল সম্পর্কও তৈরি হয়েছে। এগুলো রাজনীতি। রাজনীতিতে শত্রু-মিত্র বলতে চিরকালণীন কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু ব্যক্তির বিষয়ে এক্ষেত্রে কি বলা হবে? একজন পাকিস্তানের পক্ষের সমর্থক ব্যক্তি কি আমাদের কাছে ব্রাত্য? তাকে ঘৃণা ভরে ফেলে দিতে হবে? পুলিশের হেড যেমন ক’দিন আগে বলে বসেছেন, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে নন তারা বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যান…। এরকম চেতনার ব্যবসাও যে রাজনীতিতে ধর্মের মতই প্রতিক্রিয়াশীলতা তৈরি করতে পারে তার উদাহরণ হচ্ছে আজকের বাংলাদেশ। কবি আল মাহমুদ ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ কবিতা যে দর্শন থেকে লিখেছিলেন সেই একই দর্শন গোলাম আযমও বিশ্বাস করতেন। কিন্তু কবি আল মাহমুদকে তো ফেলে দিতে আমরা পারি না। গোলাম আযম যদি স্রেফ পাকিস্তানের পক্ষের একজন রাজনৈতিক নেতা ও বুদ্ধিজীবী হয়ে থাকত, রাজাকার, আল বদর বাহিনীর মাস্টার মাইন্ড না হতো, যুদ্ধাপরাধসহ পাকিস্তানী মিলিটারিকে সহায়তা করার জন্য প্যারামিলিটারি বাহিনী গঠন না করত তাহলে তার সঙ্গে কি তফাত থাকত আজকের ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত মজলিস, হেফাজত ইসলাম, ওলামা লীগের সঙ্গে? কোনই তফাত থাকত না। আমাদের তাই পরিস্কার হতে হবে গোলাম আযম আমাদের কাছে পরিত্যাক্ত তার যুদ্ধাপরাধের কারণে। মীর কাশেম আলী একজন যুদ্ধাপরাধী। পৃথিবীর কোথাও এ ধরণের ভয়ংকর যুদ্ধাপরাধী সমাজে স্বাভাবিক জীবনযাপনে সুযোগ পায় না। তাদের আশ্রয় হয় জেলখান নয়ত ফাঁসির মঞ্চে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের পরিণতি সবাইকে স্মরণ করতে বলছি। এবার বলুন ওহে সুশীল, মীর কাশেমের কাগজে লেখালেখি করার আর কোন যুক্তি আছে? যারা চেতনা নিয়ে ব্যবসা করছে তাদের কথা তো উপরেই বললাম, সেটা বাদ দিয়ে ঘাতকদের কাগজে লেখালেখির করার আর কি চোস্ত যুক্তি বের করেছেন শুনি?

২.

এবার আসুন দেখি আমাদের ‘চেতনা’ কিসের উপর দাঁড়িয়ে!

‘পাকিস্তান’ আন্দোলনের মূল কুশিলবরা কি একটা পর্যায় গিয়ে ‘পাকিস্তান’ ভুল ছিল বলে স্বীকার করেছিলেন? তাহলে কি করে তারা এক সময় মুসলিম জাতীয়তাবাদ, মুসলিম জাতিসত্ত্বা, মুসলমানদের আলাদা দেশ ইত্যাদি বিশ্বাসগুলোতে অটুট থেকে পরবর্তীকালে সেক্যুলারিজম, সমাজতন্ত্র, বাঙালী জাতীয়তাবাদ, অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসী হলেন?

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার হবার পর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেছিলেন, পাকিস্তানে সংখ্যালঘু সম্পদায়ও সমঅধিকারে বসবাস করবে। পাকিস্তানের পতাকার সাদা অংশটি হচ্ছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি শান্তি বা সমবাস্থানের চিহৃ। যখন আপনি নিশ্চিত হলেন আপনার ধর্মীয় পরিচয়ে যে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা তৈরি হয়েছে, যাদেরকে আপনি শিক্ষা-দীক্ষায় যোগ্যতায় ভয় পেতেন তারা বিতাড়িত হবার পর যখন আপনি দেখলেন কয়েক শতাব্দী থেকে পিছিয়ে থাকা কিছু জনগোষ্ঠি, যারা তখনো থেকে গিয়েছিল, যারা কোনদিন সচিবালয়ে, সেনাবাহিনীতে, রাজভবনে, বিচারভবনে কোথাও আপনার প্রতিযোগী হতে পারবে না- তখন আপনি ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বানালেন! ধরেন, আমাদের পাহাড়ের জনগোষ্ঠিরা নিজেদের জাতি পরিচয়ে একটি রাষ্ট্র বানালো, যখন নিশ্চিত হলো এবার সংখ্যার বিচারে কোনদিনই তাদের টপকিয়ে শাসন ক্ষমতায়, চাকরিতে, সেনাবাহিনীতে কোথাও প্রতিযোগিতায় তারা পরীক্ষার সম্মুখিন হবে না- তারপর তারা ঘোষণা দিল, সংখ্যালঘু বাঙালীসহ অন্যান্যরাও ‘সমান অধিকার’ নিয়ে ‘সমান মর্যাদা’ নিয়ে এই রাষ্ট্রে বসবাস করতে পারবে- বলুন তো কেমন হবে? পাকিস্তান ও বাংলাদেশ নামের দুটো দেশে ঠিক সেটাই ঘটেছে। ঘৃণা ও সম্প্রদায়িক বিভেদের উপর দাঁড়িয়ে যার সূচনা সেই রাষ্ট্র ধর্মীয় বেড়াজালে যে জড়াবে এটা ইতিহাসে নতুন নয়।

এবার আসুন বর্তমান বিশ্বের বাস্তবতার দিকে তাকাই। ইউরোপ-আমেরিকাতে যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের শুরু হয়েছে সেটা অবিভক্ত ভারতবর্ষে যে চিন্তা থেকে পাকিস্তান আন্দোলন শুরু হয়েছিল সেই একই কারণে। অর্থ্যাৎ ‘ওদের জন্য আমরা পারব না’ সেই ভয় ও বিদ্বেষ! অবশ্য ইউরোপ-আমেরিকায় যাদের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দানা বাধছে তারা দুই ঘরনার। একটা মুসলিমদের ইসলামী সন্ত্রাস থেকে নিজেদের বাঁচানোর উপায়, দ্বিতীয়টি চাকরির বাজার দখল করা জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে ক্ষোভ। ইউরোপ ভাবছে- ‘উড়ে এসে জুড়ে বসেছে’ এইসব হাভাতেগুলো। কিন্তু পাকিস্তান আন্দোলন ছিল চরিত্র্রগত থেকে আলাদা। এই ভূমির সন্তানদের উচ্ছেদ করা হয়েছিল। নিজের জন্মভূমিকে চিরতরে ত্যাগ করতে হয়েছিল কারণ তারা থাকলে ওরা পেড়ে উঠবে না! আপনি কি ইউরোপে-আমেরিকায় জেগে উঠা উগ্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে সমর্থন করেন? তাহলে আগে নিশ্চিত হয়ে নিন ‘পাকিস্তান’ একটি ভুল! ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ, জাতিগত জাতীয়তাবাদ একটি ভুল! মানছেন তো? তবে সেই সঙ্গে আপনাকে মানতে হবে যুদ্ধাপরাধ কোন রাজনৈতিক দর্শন নয়। কোন চেতনা দিয়েও তাকে বিচার করতে লাগে না। কিন্তু তাদের সামাজিকভাবে প্রশ্রয় দানের জন্য একটি মড়ক প্রয়োজন। যেটি আমাদের সমাজে গত ৪৪ বছরে একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়েছিল। মাছের পঁচন শুরু হয় মাথা থেকে। একটা দেশের পঁচন শুরু হয় তাদের বুদ্ধিভিত্তিক অংশ থেকে…।

[প্রকাশকাল: জানুয়ারী ১৮, ২০১৫]