কুরআন পড়লে কখনো মনে হয় নামাজ ৩ ওয়াক্ত কখনো ২ ওয়াক্ত। কেউ কেউ আবার নানা ত্যানা প্যাঁচিয়ে বের করেন ৫ ওয়াক্ত। মুসলমানরা দাবী করেন ইসলাম হচ্ছে দলিল ভিত্তিক ধর্ম। এর বাইরে কে কি মনে করল তাতে কিছু যায় আসে না। তাহলে নামাজ ৫ ওয়াক্ত এমন ধারণার মানে কি? কিংবা ৩ ওয়াক্ত সেটাই বা কেমন করে মেনে নিতে হবে? আরো একটা বড় প্রশ্ন কুরআনে বারবার নামাজ বলতে যে ‘সালাত’ ‘জিকির’ ‘স্মরণ’ শব্দটি এসেছে তা কি বর্তমান নামাজ বলতে উঠবসকে বুঝায়? এটিও একটি বড় প্রশ্ন। সেসব নিয়ে আলোচনা করতেই শুরুতে আসুন কুরআনের সালাত তথা নামাজ সংক্রান্ত আয়াত নিয়ে আলোচনা করি।
“সূর্য ঢলে পড়ার সময় থেকে রাত্রির অন্ধকার পর্যন্ত নামায কায়েম করুন এবং ফজরের কোরআন পাঠও। নিশ্চয় ফজরের কোরআন পাঠ মুখোমুখি হয় (সুরা বনী-ইসরাঈল ১৭:৭৮)”
ভোরে কুরআন পাঠকে কি নামাজ ধরার কোন পয়েন্ট আছে? কেউ ধরে নিতেই পারে। কিন্তু সেখানে তো সুস্পষ্ট কোন ঘোষণা নেই। দ্বিতীয়ত এই আয়াতে ‘সূর্য ঢলে পড়ার থেকে রাত্রীর অন্ধকার পর্যন্ত’ যে সময়কাল বলা আছে তাকে আমরা দুই তিন ধরণের অনুমান করে নিতে পারি। প্রথমত এই সময়কালের মধ্যে একবার নামাজ পড়ার কথা বলা হয়েছে। এই অনুমানের উপরই যারা ৩ ওযাক্ত ও ২ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে তারা এই আয়াত থেকেই দলিল নিয়েছে বা অনুমান করে নিয়েছে। যারা ৫ ওয়াক্ত নামাজের পক্ষে তারা এই সময়কালের মধ্যে ফজর (ভোর) জুহর (দুপুর) আসর (বিকেল) মাগরিক (সন্ধ্যা) এশা (রাত্রী) ধরে ৫ ওয়াক্ত নামাজ বানিয়েছে। যদিও আয়াতে কোথাও বলা নেই এই সময়কালের মধ্যে ৫ বার নামাজ পড়তে হবে। কুরআনের নামাজের কথা ৮০ বার বিভিন্ন প্রসঙ্গে আসলেও কোথাও একবারের জন্য ৫ বার নামাজ পড়ার কথা নেই। মুমিনরা দাবী করেন কুরআনে ৫ বার নামাজের কথা না থাকলেও কুরআন পড়লে সেটা যে ৫ ওয়াক্ত বুঝা যায়। কে কি বুঝল না বুঝল তা দিয়ে ইসলাম হয় না। এই একই কুরআন পড়ে কেউ তিন ওয়াক্ত নামাজ খুঁজে পেয়েছে, কেউ ২ ওয়াক্ত, কেউ ৪ ওয়াক্ত, কেউ ৫ ওয়াক্ত। ইসলামে নামাজ এতখানি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অথচ কুরআনে সেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সম্পূর্ণই বিভ্রান্তিকর অবস্থা সৃষ্টি করা হয়েছে। অথচ পালক পুত্রের বউকে বিয়ে করার জন্য কুরআনে সুস্পষ্ট আয়াত ঠিকই আছে। লুট করা মাল কয় ভাগ হবে আর কে কতখানি নিবে তাও পরিস্কার করে বলা আছে। কিন্তু নামাজ কয় ওয়াক্ত সেটা নিয়েই একটা কথা নেই। কি অস্বাভাবিক আর হাস্যকার না?
এবার আমরা নামাজ সম্পর্কে কুরআনের অন্যান্য আয়াত দেখব যা থেকে ৫ ওয়াক্ত নামাজ আন্দাজ করা যায় কিনা বুঝার চেষ্টা করব-
“অতএব তোমরা আল্লাহর তাসবীহ কর, যখন সন্ধ্যায় উপনীত হবে এবং সকালে উঠবে (৩০.১৭)।আর অপরাহ্নে ও যুহরের সময়ে; আর আসমান ও যমীনে সকল প্রশংসা একমাত্র তাঁরই (৩০.১৮)”
“এবং দিবসের দুই প্রান্তভাগে এবং রজনীর প্রথমভাগে সালাত কায়েম কর। কারণ যা ভালো তা অবশ্যই মন্দকে দূরীভূত করে । যারা [তাদের প্রভুকে] স্মরণ করে এটা তাদের জন্য এক উপদেশ (১১.১১৪)”
“সমস্ত নামাযের প্রতি যত্নবান হও, বিশেষ করে মধ্যবর্তী নামাযের ব্যাপারে। আর আল্লাহর সামনে একান্ত আদবের সাথে দাঁড়াও। (সুরা বাকারা ২:২৩৮)”
আর স্মরণ করতে থাক স্বীয় পালনকর্তাকে আপন মনে ক্রন্দনরত ও ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় এবং এমন স্বরে যা চিৎকার করে বলা অপেক্ষা কম; সকালে ও সন্ধ্যায়। আর বে-খবর থেকো না (সুরা আরাফ ৭:২০৫)
কুরআনের এই আয়াতগুলো দিয়ে ৫ ওয়াক্ত নামাজ বের করা বেশ কষ্ট কল্পনা। ২:২৩৮ আয়াতে বিশেষ করে মধ্যবর্তী নামাজের প্রতি যত্মবান হতে বলা হয়েছে। তাহলে ধরা যায় অন্যান্য নাসাজগুলো ‘বিশেষ’ নয় এবং তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। যদিও অগুরুত্বপর্ণ নামাজের প্রতি যত্মবান হতে বলা হয়েছে। মানে যখন করবে তখন ভালো করেই করবে। কিন্তু দুপুরের সূর্য মাথার উপর থাকার সময় ‘সালাত’ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ? বিষয়টা যে বিভ্রান্তকর সেটি মুসলিমদের বিভিন্ন গ্রুপের মাঝে নামাজ নিয়ে বিবাদমান বিতর্ক থেকে বুঝা যায়। আরো একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ কুরআনে বারবার ‘সালাত’ বলতে যে জিনিসটি এসেছে তার বর্তমানে প্রচলিত নামাজ বুঝায় কিনা সেটি আরেকটি প্রশ্ন। জিকির বা ধ্যানের মত করে ঈশ্বর বন্দনাকে সালাত বলে মত দেন বিভিন্ন ফেকরার মুসলমানরা। সুফি মুজারপন্থিদের কিছু গ্রুপ নামাজ না পড়ে জিকির করাটা কিন্তু এই কুরআনকে দলিল ধরেই। তাদের মত নামাজ যারা বানিয়েছে তার প্রকৃত ইসলাম সম্মত নয়। কুরআনে এরকম কোন নামাজের কথা বলা নেই! বুঝেন কি অবস্থা। যারা নামাজ পড়ে তারাও কুরআনকে দলিল দিয়ে প্রমাণ করে তারাই সঠিক আর যারা দ্বিমত করে তারাও কুরআন থেকে প্রমাণ করে তারাই সঠিক!
ধারণা করা হয় এখন যে নামাজ ৫ ওয়াক্ত সেটা পরবর্তী কোন একটা সময়কালে প্রচলিত হয়েছিলো। এই সম্ভাবনাটা উড়িয়ে দেয়া যায় না যখন নামাজে দুরূদ শরীফ পড়া হতে দেখি। প্রশ্ন জাগে মুহাম্মদ নিজে কি নামাজে দুরূদ পড়তেন নিজের নামে, তার স্ত্রী এবং বংশধরদের নামে? অন্য একটি মত হচ্ছে মদিনা একটি সম্প্রদায় ছিলো যারা দিনে ৫ বার দাঁড়িয়ে উঠে বসে এক ধরণের প্রার্থনা করত এবং প্রার্থনা করার আগে ওযু করে নিতো। এটা থেকেই মুহাম্মদ নামাজ ধারণাটা কপি করেছিলেন। কিন্তু দুনিয়ার অবান্তর কথায় ভর্তি কুরআনে নামাজের মত এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কেন ৫ ওয়াক্তের কথা থাকবে না? কেন কুরআনে কিভাবে নামাজ পড়তে হয় তার নিময় থাকবে না? রুকু সিজদায় কি বলতে হবে সেটাও কুরআনে নেই। কেন আজান কুরআনে নেই?
মুসলমানরা নামাজ ৩, ২, ৫ কিংবা ১০ ওয়াক্ত পড়ুক তাতে আমার কোন সমস্যা নাই। আমি কেবল বলতে চেয়েছি কুরআন হচ্ছে একটা হযবরল বই। এই বই পড়েই কেউ মনে করে নেয় নামাজ ৩ ওয়াক্ত, কেউ ২…। এই বই পড়েই কেউ শিয়া, কেউ সুন্নি। কুরআনের আয়াত ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হযরত আলীর সঙ্গে ওমর একমত হননি। উমারের সঙ্গে অন্যরা একমত হননি। প্রধান চার খলিফা কুরআন হাতে নিয়েই নিজেদের মধ্যে কলহে লিপ্ত হয়েছেন এবং কুরআনের ব্যাখ্যায় পরস্পরকে খারিজি বলে অবিহিত করেছেন। কুরআনের এই বিবাদ আজকের যুগ পর্যন্ত ধেয়ে আসছে। সুন্নিরা শিয়াদের কাফের মনে করে তাদের মসজিদে হামলা চালিয়ে এক-দুইশো মানুষকে হত্যা করে ফেলে। কুরআনে পরস্পর বিরোধী কথাবার্তা, সুস্পষ্ট করে বিধান বাতলে না দেয়ার ফলে হাদিসের মাধ্যমে সমাধান করতে গিয়ে মুসলমানদের মধ্যে কলহ আরো বেড়েছে। কারণ হাদিস হচ্ছে হাস্যকর উদ্ভট বানোয়াট গাঁজাখুরি কথামালার সংকলন। মুমিনদের কাছে যদিও এরকম কিছু মনে না হলেও তারা ‘জাল হাদিস’ ‘দুর্বল হাদিস’ নিয়ে চরম বিভ্রান্তিকর অবস্থায় রয়েছে। হাদিসগুলোর জাল আর দুর্বলের অবস্থান কিন্তু ইসলামের আরো একটি বিবাদের ক্ষতচিহ্ন বলা উচিত। সুন্নিদের কাছে শিয়া মতালম্বীদের বলা সকল হাদিসই জাল। অন্যদিকে আয়েশা বর্ণিত সব হাদিসই শিয়াদের কাছে জাল। এদিকে বর্তমানকালে মুহাম্মদের কুকীর্তির দলিল সম্বলিত হাদিসগুলো, বৈজ্ঞানিক বক্তব্য, খুনোখুনি, ধর্ষণ লুটপাটের ঘোষণা দেয়া হাদিসগুলো নিয়ে একশ্রেণীর মুনাফেক মুসলমান খুবই বিব্রত লজ্জ্বিত কুন্ঠিত। এরা ইসলামের ইজ্জ্বত বাঁচাতে এখন আশ্রয় নিয়েছে ‘জাল হাদিসে’। অর্থ্যাৎ প্রছন্দ না হলেই হাদিসটি জাল কিনা সেই প্রশ্ন তুলবে। দ্বিতীয়ত হাদিস নম্বর চেয়ে খুঁজে না পাওয়ার দাবী। অনুবাদের ভুল থেকে শুরু করে নাস্তিকরা হাদিস বানায় এমন সব উদ্ভট দাবী করে পাড় পাবার চেষ্টা করে। এদের সেভাবে গোনায় না ধরলেও মূল বিপদ হচ্ছে হাদিসগুলো কুরআনের বিকল্প হতে গিয়ে বিভ্রান্ত আরো বেশি করে ছড়িয়েছে। এসব কারণে কেউ কেউ একমাত্র কুরআনকেই দলিল হিসেবে দাবী করেন। তারা আর কোন কিছু মানতে রাজি নন। সেক্ষেত্রে বিপদ আগের মতই সমাধানহীন। কুরআনের সালাত বা নামাজের ওয়াক্ত কয়টি? উত্তরে ৫টি বলার কোন অধিকার আছে কি? এক্ষেত্রে তাদের বলতে হবে কুরআনের বর্ণনা পড়ে বুঝা যায় সেটা ৫ ওয়াক্তই। কিন্তু কে কি মনে করল তা দিয়ে কি ইসলাম বুঝাবে? তাহলে যারা ৩ ওয়াক্ত মনে করছে কুরআন পড়ে তাদেরটাও মানতে হয়? যারা কুরআন পড়েই কতল করতে যায়, জঙ্গি দল গঠন করে তাদেরকে আপনি ইসলাম থেকে খারিজ মনে করলেও তারা তো কুরআন পড়েই এই পথে নেমেছে। তো এই যে মুসলমানদের মধ্যে এত মতবিরোধ তার মূলে তো কুরআন। এই হ-য-ব-র-ল বইটি যে কেবল অমুসলিমদের জন্যই বিপদ তা নয়, খোদ মুসলমানদের শান্তি নষ্ট করে দিয়েছে…।