শব্দের আবিষ্কারক ছিলেন। চর্যাপদের বাঙালি এনলাইটেনমেন্টের যুগে
বুদ্ধাব্দই বঙ্গাব্দ ছিল এবং ‘আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী (ভুসুকু আজ
আলোকপ্রাপ্ত সিদ্ধপুরুষ বা বাঙালি হলেন)” থেকে ঐতিহাসিক ‘বাঙালি’ শব্দের
অভূতপূর্ব সংযোজন হয়েছিল। চর্যাপদের (দি বুক অব এনলাইটেনমেন্ট) ৪৯ নম্বর
কবিতায় সর্বপ্রথম ‘বাঙালি শব্দ’ মহাকবি ভুসুকু কর্তৃক আবিষ্কৃত হল। পূজনীয়
ব্যক্তির প্রতি সন্মান প্রদর্শন বাঞ্ছনীয়। সম্প্রতি টরন্টোয় ‘সাপ্তাহিক
আজকালে পৃষ্ঠা ১৩, ফেব্র“য়ারী ৪, ২০১১ (সাল)’ নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন,
বাংলা একাডেমীর অমর একুশে বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সন্মানিত অতিথি
হিসেবে “ভাষা চেতনা বাঙালির গর্বের বিষয়” শীর্ষক ভাষণে বলেন, “যেমন একাদশ
শতাব্দীতে চর্যাপদ।
এটি বৌদ্ধ ধর্মীয় লেখা। এর মধ্যে ভুসুকু বলে একজন কবি
ছিলেন। তিনি পদ্মা দিয়ে যাচ্ছিলেন নৌকাতে। পথে তার যাবতীয় সম্পত্তি ডাকাতরা
নিয়ে যায়, তাকে মারধর করে। তারপর তিনি লিখছেন, নিজেকে নিয়েই যে, ভুসুকু
তোমার সব সম্পত্তি ডাকাত নিয়ে গেছে। আমি (অর্মত্য সেন) সে যুগের বাংলা থেকে
এ যুগের বাংলা করছি। তিনি (ভুসুকু)বলছেন তোমার সব সম্পত্তি নিয়ে গিয়ে
তোমাকে ডাকাতরা মুক্তি দিয়েছে। তুমি এখানেই থেকে জাত বিচার বাদ দিয়ে একটি
চন্ডাল মেয়ে বিয়ে করে পরিবার প্রতিষ্ঠা করো। তারপর বলেছেন যে, তুমি সব
হারিয়ে সত্যি বাঙালি হলে।”
মহাকবি ভুসুকু অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস নিয়ে বলেছিলেন, “আমি আজ বাঙালি
হয়ে ‘অহং’ কে জয় করে সিদ্ধপুরুষ হয়েছি।” বৌদ্ধ পালি ভাষায় যার নাম
‘সউপাধিশেষ নির্বান লাভ’ বা রক্ত মাংসের শরীর নিয়ে পরমার্থ জীবন যাপন।
ধর্ম বা ব্রাহ্মণ নিয়ন্ত্রিত সমাজে মানবাধিকার রক্ষা ও প্রচার করার মানসে
বৌদ্ধধর্মের প্রয়োজন আজ ও বিরাজমান। চর্যাপদ এবং বঙ্গাব্দ প্রসঙ্গ নিয়ে
সন্মানিত অতিথি অমর্ত্য সেন ঢাকায় একুশের বইমেলা অনুষ্ঠানে আলোচনা করেছেন।
আমরা মনযোগ দিয়ে তাঁর লেখা পড়েছি। উক্ত বিষয়ে তথ্য জানা ও পাওয়া বাংলা
ভাষাভাষী জনতার মৌলিক অধিকার আছে বলে আমরা মনে করি। দুর্ভাগ্যবশত:
চর্যাপদের ৪৯ নম্বর কবিতায় জিতেন্দ্রীয় সিদ্ধপুরুষ কবি ভুসুকু সম্বন্ধে
অমর্ত্য সেনের আলোচ্যমান গল্পের সাথে আকাশ পাতাল তফাৎ পরিলক্ষিত হয়।
চন্ডাল মেয়ে বিয়ে করে বা সব হারিয়ে নয়, ভুসুকু ষড়রিপু সব জয় করে মহাজ্ঞানী ও
মহামানব হয়েছিলেন।
ভাষনে কোথায় ভুল ছিল তা আমরা জানতে পারি চর্যাপদের উক্ত ৪৯ নম্বর কবিতায়
এবং পরম শ্রদ্ধেয় কবি ভুসুকু লিখেছিলেন, “বজ্রনৌকা পাড়ি দিয়ে পদ্মানদীতে
গেলাম। নির্দয় দস্যু দেশ লুট করে নিয়ে গেল। নিজের গৃহিনীকে (কামতৃষ্ণাকে)
চন্ডালে নিয়ে যাবার পর ভুসুকু আজ তুমি বাঙালি হলে। পঞ্চপাটন (৫ উপাদান
স্কন্ধ) দগ্ধ, ইন্দ্রিয়ের বিষয় বিনষ্ঠ। জানি না আমার চিত্ত কোথায় গিয়া
প্রবেশ করলো। আমার সোনা রুপা কিছুই থাকলো না, নিজের পরিবারে মহাসুখে
থাকলুম। আমার চৌকোটি ভান্ডার নিঃশেষ হলো, জীবনে মরণে আর ভেদ নেই।”
আলোচ্যমান চর্যায় কবি ভুসুকু কামতৃষ্ণা বা বিয়ে করার ইচ্ছাকে গৃহিনী
বলেছেন, “আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী (আজ বাঙালির ইতিহাসে ভুসুকু কামতৃষ্ণাকে
জয় করে সিদ্ধপুরুষ বা বাঙালি হল), নিঅ (নিজ) ঘরিনী (কাম তৃষ্ণার লোভ লালশা
বা গৃহিনী) চন্ডাল লেলী (চন্ডালে নিয়ে গেল)।” কবি ভূসুকুই সর্বপ্রথম “
বাঙালি ” শব্দের আবিষ্কারক এবং পাল সম্রাটগণের ৮ম শতাব্দী থেকে ১১ শতাব্দী
৪০০ বছর পর্যন্ত চর্যাপদে বুদ্ধাব্দকে (২৫৫৫ বুদ্ধাব্দ) বঙ্গাব্দ হিসেবে
প্রতিষ্ঠিত ছিল। তারপর উক্ত ভাষনে অমর্ত্য সেন হিজরি (১৪৩২) সালকে বঙ্গাব্দ
(১৪১৭) বলে বর্ণনা করেন,
১৪০০ সাল হলো কী ভাবে। এখন ১৪১৭ তে কী ভাবে এলো, ১৪১৭ হচ্ছে মক্কা থেকে
মদীনায় মোহাম্মদের (সা.) যাওয়ার দিন থেকে গণনার স্মারক। প্রথম দিকে লুনার
এবং তারপরে সোলার ক্যালেন্ডার এই দুটি মিলিয়ে করা। আকবর সোলার ক্যালেন্ডারে
বিশ্বাস করতেন। এটি কিন্তু বাংলা ছাড়া সাব কন্টিনেন্টের কোনো অঞ্চলে আর
থাকেনি ” হিজরি সাল নিয়ে অমর্ত্য সেনের ভাষনের উক্ত কথা গুলোর সাথে
বাস্তবের বঙ্গাব্দের কোন মিল নেই। বঙ্গাব্দ প্রতিষ্ঠায় কি আমাদের ইতিহাসে
কোন অন্যায় প্রসঙ্গ লুকিয়ে আছে? বৌদ্ধ চর্যাপদের বুদ্ধাব্দকে বাদ দিয়ে
বঙ্গাব্দের জন্য হিজরি সালকে ভাড়া করে প্রথমে চাঁদ মার্কা লুনার পঞ্জিকা
অনুসরণ করার পর আবার সূর্য্য মার্কা সোলার পঞ্জিকা অনুসরণ করতে গিয়ে ১৪৩২
হিজরিকে ১৪১৭ বঙ্গাব্দ করার ইতিকথা সত্যি বিস্ময়।
তাঁর উপদেশ বাণী অমর্ত্য সেন সহ অনেকেরই মনে থাকার কথা। অন্যায় কাজ মেনে
নিয়ে নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনের ভাষনে তিনি সত্যি ঘটনা স্বীকার করে বলেছেন,
“অন্যরা করুক না করুক, সেটা করতে আমরা রাজি হয়েছি, চেষ্ঠা করেছি, সচেষ্ঠ
হয়েছি এবং এক্ষেত্রে সফল ও হয়েছি। বাংলা সন সম্বন্ধে তো সবাই জানেন।”
বুদ্ধাব্দকে বাদ দিয়ে হিজরির অনুকরনে বঙ্গাব্দ লেখা যে সম্রাট আকবরের আদেশ
ছিল, তা বাঙলাদেশের মহাবীর ঈশা খাঁ না মেনে সম্রাটের সেনাপতি মানসিংহের
সাথে যুদ্ধ করেছিলেন। কবি শঙ্খ ঘোষের ভাষায়, “সমস্ত মাঠের বিন্দু আমারই
ধর্মের ধান বোনা / সুচ্যগ্র মাটি ও আমি অন্য কোনো শরিকে দেব না।”
দ্বার স্বরূপ ফতোয়া জারি করে বৈদিক ব্রাহ্মণগণ বিধান দিলেন, “স্বরস্বতী
বাগদেবী, লিপির দেবী নয়। দেবভাষায় কোন লিপি নেই (দেশ. ১৪ পৃষ্ঠা, কলকাতা, ১
ফেব্র“য়ারী ১৯৯২)।” গৌতমবুদ্ধ দক্ষিন এশিয়ার এই সামাজিক বিকৃতির হাত থেকে
জনতাকে রক্ষা করেন। বুদ্ধাব্দকে বাদ দিয়ে বঙ্গাব্দের ঐতিহাসিক বিকৃতির
জবাবদিহিতা কোথায়? লেখক শৈলেন্দ্র ঘোষের মতে, “এই জটিলতা নিরসনের জন্য
পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে গৌড়েশ্বর হোসেন শাহ তাঁর উজির পুরন্দর খাঁ,
মুকুন্দ দাস, এবং মালাধর বসু প্রভৃতি সভাসদদের পরামশক্রমে বঙ্গাব্দের
প্রবর্তন করেন।”
চর্যাপদের মহাজনক ঘরের ছেলে
গৌতমবুদ্ধের বুদ্ধাব্দকে বাদ দিয়ে ডালে চালে খিচুরি করে সন্মানিত অমর্ত্য
সেন আজকের ১৪৩২ হিজরিকে ১৪১৭ বাংলা বললেন। বঙ্গাব্দ সাত পাঁকে বাঁধা কেন?
বিশ্বের ধর্ম প্রচারকদের মধ্যে একমাত্র গৌতমবুদ্ধ (রাজপুত্র সিদ্ধার্থ)
২৫৫৫ বছর আগে বঙ্গলিপি অধ্যয়ন করার গৌরবোজ্জ্বল কাহিনীর সচিত্র খন্ডচিত্র
ইতিহাস ভারতের অজন্তা গুহায় আজ ও বিরাজমান। একাদশ এবং দ্বাদশ শতাব্দী থেকে
শুরু হলো সাধক চর্যাকারগনের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। যার
দূর্ণিবার জীবন্ত স্রোত হাজার বছরের সংকোচের জগদ্দল পাথর ভেঙ্গে এলো আমার
ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্র“য়ারীর উনিশশো বায়ান্ন সাল থেকে আজকের
বাঙালী ঐতিহ্যমন্ডিত আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস। বাঙালী জাতি আবার নতুন
সহস্রাব্দের আলোকে আবিস্কার করবে বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন বৌদ্ধ
চর্যাপদের প্রতিটি শব্দ ও তার গভীর মর্মার্থকে। কারণ দেশ ও ভাষা বাঙালীর
কাছে নিরেট বাস্তব, অতিশয় অপরিহার্য। চর্যাপদ এবং বঙ্গাব্দের ইতিহাস পাঠ
করে গবেষণার সময় মনে হবে বাংলা কেবল একটি দেশ নয়, সে একটি সভ্যতা, একটি
সংস্কৃতি, একটি অপাপবিদ্ধ জীবনাদর্শ বা জীবন দর্শনের প্রতীক, যার মর্মবাণী
হল বিশ্ব মানবতাবাদ। জনতা সহ আমরা চর্যাপদ এবং ভাষা আন্দেলনের আলোকে
বঙ্গাব্দ চাই। হিজরি সালকে বঙ্গাব্দ করতে সম্রাট আকবরের সেনাপতি মানসিংহের
সাথে বাঙালি ঈশা খাঁর যুদ্ধ হয়েছিল। যেমন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহের ঘোষিত
উর্দূ ভাষার বিরুদ্ধে রাষ্ঠ্রভাষা বাংলা করার জন্যে বায়ান্নোর একুশে
ফেব্র“য়ারীতে ঢাকার রাজপথে প্রাণ দিলেন সালাম, জব্বার, বরকত, রফিক সহ নাম
না জানা শহীদগণ।