সাধারণভাবে কোনো দোষ না থাকলেও, তাদের একটাই দোষ, তারা জন্মসূত্রে হিন্দু। টোটাল ব্যাপারটা বোঝানোর জন্য প্রাচীন কাল থেকেই শুরু করছি- প্রাচীন যুগের বঙ্গ বলতে যা বোঝাতো, অর্থাৎ বর্তমানের- বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, আসামের কিছু অংশ, ত্রিপুরা এবং মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশের কিছু অংশ- এই সমগ্র এলাকা ই শুধু হিন্দু প্রধান নয়, হিন্দুদেরই ছিলো; কারণ, সম্রাট অশোক কর্তৃক বৌদ্ধধর্ম গ্রহনের আগে এই পুরো এলাকায় কোনো বৌদ্ধ বা মুসলিম জনবসতি ছিলো না।
খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে সম্রাট অশোক কর্তৃক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ এবং প্রচারের ফলে শুধু বঙ্গেই নয় সমগ্র ভারত, অর্থাৎ বর্তমানের বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, মায়ানমার এবং আফগানিস্তান, নেপাল ও ভুটান- এই সমগ্র এলাকার প্রায় দুই তৃতীয়াংশ জন গোষ্ঠী বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহন করে ফেলেছিলো।
এই পরিস্থিতিতে ৭০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে শংকরাচার্য, কুমারিল ভট্ট এবং এরকম আরো কয়েকজনের প্রচেষ্টায়- বর্তমান ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও নেপাল ভূথণ্ডে হিন্দু ধর্ম আবার পুণঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। এই সিস্টেমটা ছিলো – বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সাথে সনাতন ধর্মের উক্ত ধর্মগুরুরা চ্যালেঞ্জে আসে যে, খোলামাঠে ধর্ম নিয়ে রক্তপাতহীন যুক্তি-তর্ক হবে, যদি হিন্দুরা পরাজিত হয়, তাহলে ঐ এলাকার অবশিষ্ট সকল হিন্দু বৌদ্ধধর্ম গ্রহন করবে, আর যদি বৌদ্ধরা পরাজিত হয়, তাহলে তাদেরকে আবার সনাতন ধর্মে ফিরে আসতে হবে; বলা বাহুল্য সনাতন ধর্মের ধর্মগুরুদের সাথে বৌদ্ধরা কোনোদিনই জিততে পারে নি, এভাবে ঐ পুরো এলাকার বৌদ্ধরা আবার হিন্দু ধর্মে ফিরে আসে। শংকরাচার্য ছিলেন পশ্চিমভারত অর্থাৎ গুজরাটের মানুষ, তার জীবনকালও ছিলো অল্প, মাত্র ৩২ বছরের, এই কারণেই হোক বা দূরত্বের কারণেই হোক, তারা আমাদের এই বঙ্গে এসে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সাথে যুক্তি-তর্কে তারা লিপ্ত হতে পারেন নি, এই কারণে বঙ্গের বৌদ্ধরা আর হিন্দু ধর্মে ফিরে আসে নি, সেই সময় থেকেই বঙ্গে বৌদ্ধ ও হিন্দু জনসংখ্যার অনুপাত ছিলো ৬০:৪০। এই পরিস্থিতি চলে ১২০০ সাল পর্যন্ত।
এর মাঝে আবার বঙ্গের শাসনভার বৌদ্ধ পাল বংশের থেকে আসে হিন্দু সেন বংশের কাছে। শেষে ১২০৪ সালে বখতিয়ার খিলজি যখন বিহার ও বঙ্গ আক্রমন ক’রে দখল করে, তখন সমগ্র বাংলার বৌদ্ধ ও হিন্দুরা একই সাথে বখতিয়ার খিলজির মুসলিম শক্তির সম্মুখীন হয় এবং বৌদ্ধরা পরাজিত হয়ে বাংলাদেশের নওগাঁ জেলার পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার, যার প্রকৃত নাম সোমপুর বিহার, কুমিল্লার ময়নামতি বিহার এবং ভারতের পাটনার নালন্দা বিহার ছেড়ে, তাদের কিছু বই পুস্তক নিয়ে জীবিত বৌদ্ধ ভিক্ষুরা পালিয়ে চলে যায় নেপাল-ভুটানে, এই কারণেই বাংলা সাহিত্যের প্রথম গ্রন্থ ‘চর্যাপদ’, যা ছিলো বৌদ্ধভিক্ষুদের সাধন সঙ্গীত, তা আবিষ্কৃত হয়েছিলো নেপাল থেকে। এই পরিস্থিতিতে সাধারণ বৌদ্ধরা মুসলিম আক্রমনকে ঠেকাতে না পেরে এবং এক এলাকার হিন্দু ও বৌদ্ধদের উপর অত্যাচারের কাহিনী শুনে অন্য এলাকার বৌদ্ধরা, বাঁচার জন্য দলে দলে ইসলাম গ্রহন করে মুসলমান হয়ে যায়, এভাবে যারা মুসলমান হয়, তারা পরিচিত হয় “শুইন্যা মুসলমান” নামে, এছাড়াও এদেরকে “ন্যাড়া মুসলমান”ও বলা হতো একারণে যে, বৌদ্ধ ভিক্ষুরা সবসময় ন্যাড়া মাথায় থাকতো, তাই তারা যখন মুসলমান হলো, তখন তাদেরকে ন্যাড়া মুসলমান নামে চিহ্নিত করা হলো; তাছাড়াও বৌদ্ধরা লুঙ্গি পড়ে থাকতো বলে বৌদ্ধ থেকে ধর্মান্তরিত মুসলমানদের পোষাক লুঙ্গিই থেকে যায়, এসব তথ্যে সন্দেহ থাকলে একটু খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন যে- লুঙ্গি, বার্মিজ ভাষার শব্দ এবং এখনো বার্মা বা মায়ানমারের বৌদ্ধদের প্রধান পোষাক লুঙ্গি এবং কোনোদিন কখনোই হিন্দুদের পোষাক লুঙ্গি ছিলো না।
বর্তমানে বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের কিছু হিন্দু যে লুঙ্গি পরে, এটা ইসলামিক কালচারের প্রভাবে।
যা হোক, মুসলিম আক্রমনে পড়ে বাংলার প্রায় সব বৌদ্ধ মুসলমান হয়ে যায়; কারণ, এই লোকগুলোর ধর্ম বিশ্বাস ছিলো দুর্বল, প্রথমে এরা হিন্দু থেকে বৌদ্ধ হয়েছিলো এবং পরে আবার বৌদ্ধ থেকে মুসলমান হয়; কিন্তু মুসলমান শাসকদের সেই অত্যাচার নির্যাতনের মুখে পড়েও বাংলার হিন্দুরা তেমনভাবে মুসলমান হয় নি, তারা অত্যাচারিত হয়েছে, নির্যাতিত হয়েছে, ক্ষেত্র বিশেষে জীবন দিয়েছে, কিন্তু ধর্ম ত্যাগ করে নি। যে দু চার জন হিন্দু মুসলমান হয়েছে, তারা তা করতে বাধ্য হয়েছে মুসলমান শাসকদের প্যাঁচে পড়ে, যেমন বাংলার সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ, তার সবগুলো মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলো রাজা কন্দর্পনারায়নের ছেলেদের সাথে- জোর করে তাদেরকে মুসলমান বানিয়ে, এছাড়াও কিছু হিন্দু মুসলমান হয়েছিলো জিজিয়া কর না দিয়ে আর্থিক সুবিধা পাওয়ার জন্য। এভাবে বাংলার ৪০% এর মধ্যে প্রায় ৩৫% হিন্দুই তাদের ধর্ম রক্ষা করে বা করতে সমর্থ হয়।
এখানে একটা প্রশ্ন আসতে পারে যে, বাংলাদেশের সব বৌদ্ধ যদি মুসলমান হয়েই যায়, তাহলে চট্টগ্রাম বা পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় এখনও অনেক বৌদ্ধ থাকার কারণ কী ?
মধ্যযুগে বাংলায় ইসলামিক ঝড়ের ফলে, প্রায় সমগ্র বাংলাদেশের লোকজনই ইসলামে দীক্ষিত হয়, সেই সময় দীক্ষিত হয় পুরো পাহাড়ী এলাকাও, কিন্তু ১৬০০ থেকে ১৭০০ সালের মধ্যে মায়ানমার থেকে কোনো এ বৌদ্ধ ভিক্ষু এসে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার কোনো এক রাজাকে আবার বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত করতে সমর্থ হয়, তার ফলেই ঐ এলাকার আবার সমস্ত প্রজা বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হয় এবং একারণেই চট্টগ্রাম এলাকায় এখনো অনেক বৌদ্ধের বাস।
বাংলাদেশের প্রায় সব মুসলমান যে বৌদ্ধ থেকে ধর্মান্তরিত, এই ইতিহাস বাংলার ইতিহাস থেকে সম্পূর্ণ মুছে দেওয়া হয়েছে এবং এই ইতিহাসকে চাপা দেওয়ার জন্য মিথ্যা ইতিহাস লিখা হয়েছে যে, উচ্চবর্ণের হিন্দুদের অত্যাচারে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা দলে দলে মুসলমান হয়েছে। কিন্তু এই ইতিহাস সম্পূর্ণ মিথ্যা। মুসলিম শাসনামলে উচ্চ বর্ণের হিন্দু অর্থাৎ ব্রাহ্মণরাই হয়েছিলো সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত; কারণ, ব্রাহ্মণরাই ছিলো হিন্দু সমাজের মাথা, মুসলমান শাসকদের মনে এই বিশ্বাস ঢুকেছিলো যে, যদি ব্রাহ্মণদেরকে ধর্মান্তরিত করা যায়, তাহলে নিম্নবর্ণের হিন্দুদেরকে সহজেই মুসলমান বানানো যাবে। আমা্র এই কথার প্রমান পাবেন রাজা রামমোহন রায়, তাঁর
“তুহফা-উল-মওয়াহিদ্দীন” গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে যা বলেছেন, তা জানলে, তিনি বলেছেন,
“ইসলামের অনুসরণকারীদের হাতে অনেক নির্যাতন ও পীড়ন সহ্য করিয়াও, এমন কি প্রাণ নাশের ভীতি প্রদর্শন সত্ত্বেও এই সব দৈব বিধানে বিশ্বাসী ব্রাহ্মণ সমাজের লোকেরা তাহাদের ধর্মমত বর্জন করেন নাই।”
এখানে দেখা যাচ্ছে মুসলমান শাসকদের কাছে নির্যাতিত হয়ে ব্রাহ্মণদেরই প্রাণ নিয়ে টানাটানি, এই অবস্থায় তারা নিচুর জাতের হিন্দুদেরকে নির্যাতন করবে, এটা কি বাস্তব সম্মত ? তবে ব্রাহ্মণরা, নিচু জাতের হিন্দুদেরকে যে একেবারে নির্যাতন করে নি, তা কিন্তু নয়, কিন্তু সেই নির্যাতন ফিজিক্যাল ছিলো না, ছিলো মেন্টাল; ধর্মশাস্ত্রের উপর নিজেদের আধিপত্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য তারা নিচু জাতের হিন্দুদের জন্য বেদ এবং এর মতো ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন নিষিদ্ধ করেছিলো বলে শোনা যায়, আর এই সূত্রকে কাজে লাগিয়েই নেহেরু মার্কা ইতিহাস রচয়িতারা এই কথা ইতিহাসের বইয়ে লিখে দিয়েছে যে, উচ্চবর্ণের হিন্দুদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা দলে দলে ইসলাম গ্রহন করেছে। এটা যদি সত্য হয়, তাহলে ইতিহাসবিদদের কাছে আমার কয়েকটি প্রশ্ন- পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার ছিলো সেই সময় এশিয়ার সবচেয়ে বড় বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়, এরপরেই ছিলো কুমিল্লার ময়নামতির স্থান এবং তারপর বগুড়ার মহাস্থান গড়, এ থেকে স্পষ্ট যে বাংলায় ব্যাপকহারে বৌদ্ধ জন বসতি ছিলো, সেই বৌদ্ধগুলো গেলো কোথায় ? কিভাবে বাঙ্গালি মুসলমানদের প্রধান পোষাক হয়ে উঠলো লুঙ্গি ? শুইন্যা মুসলমমান শব্দ গুচ্ছটির উৎপত্তি হয়েছিলো কিভাবে ? এবং মুসলমানদেরকে আড়ালে আবডালে কেনো এখনও ‘ন্যাড়া’ বলা হয় ?
ইতিহাসের বইয়ে যা খুশি তা লিখলেই সত্য হয়ে যায় না, তার পেছনে যুক্তি এবং বাস্তব পরিস্থিতি থাকতে হয়। ইতিহাস সম্পর্কে একটা কথা মনে রাখবেন, বাংলার পাঠ্যপুস্তকে সেই ইতিহাসই লিখা হয়েছে যা মুসলমানদের পক্ষে যায় বা যেই ঘটনায় তাদেরকে পজিটিভলি তুলে ধরা যায়; এটা করতে গিয়েও তারা সত্যকে চাপা দিয়ে অনেক মিথ্যা কথা লিখেছে, আর যেখানে কোনোভাবেই মুসলমানদেরকে পজিটিভ আকারে তুলে ধরা যায় নি, সেই ইতিহাসই তারা ডিলিট করে দিয়েছে, যেমন ১৯৪৬ সালের নোয়াখালির হিন্দু হত্যা, ১৯৫০ সালে ১ মাসে ৫০ লক্ষ হিন্দু বিতাড়ন, ভারত-পাকিস্তানের ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে হিন্দু বিতাড়ন এবং ১৯৭১ সালের ম্যাক্সিম্যাম হিন্দু নির্যাতনের ঘটনাগুলি।
যা হোক, ভূমিকা ছেড়ে এবার মূল প্রসঙ্গে যাই, বাংলার হিন্দুরা, মুসলমনদের হাতে প্রথম মার খায় ১৯৪৬ সালে, কোলকাতায়। তখন অবিভক্ত বাংলার মূখ্যমন্ত্রী- মুসলমান হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। সে নেহেরু-গান্ধী তথা কংগ্রেসকে ভয় দেখিয়ে পাকিস্তান আদায়ের জন্য প্ল্যান করে কোলকাতায় ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে পালনের নামে নিরস্ত্র হিন্দুদের উপর হামলা করে, এই ঘটনায় প্রায় ২০ হাজার হিন্দু নিহত হয়, লুঠ হয় বহু হিন্দু বাড়ি ও দোকানপাট, ধর্ষণ ও অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে ধর্মান্তরের চেষ্টা হয় অগিনত। ৩ দিন একতরফা হামলার পর হিন্দু বীর গোপাল পাঁঠার নেতৃত্বে অস্ত্র হাতে ঘুরে দাঁড়ায় হিন্দুরা, ফলে দ্রুত পুলিশ নামিয়ে দাঙ্গা বন্ধ করে মূখ্যমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী।
হিন্দুরা, মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলতে এবং প্রতিশোধ হিসেবে কিছু মুসলমানকে খুন করতে পারে, এই অপমান সহ্য করা সম্ভব হয় না মূখ্যমন্ত্রীর দল মুসলিম লীগের, তারা আবার হিন্দুদের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পরিকল্পনা করে নোয়াখালি এ্যাটাকের, এই এ্যাটাকে নিহত হয় প্রায় ১ হাজার হিন্দু, ধর্ষিতা হয় বর্তমানের নোয়াখালি, চাঁদপুর, কুমিল্লা, ফেনী ও লক্ষ্মীপুর জেলার ১২ থেকে ৫২ এর সব হিন্দু মেয়ে, জোর করে ধর্মান্তিরত করা হয় প্রায় সবাইকে। এরপর ভারত ভাগ হয় এবং সেই সময়ও পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় হত্যা করা হয় শত শত হিন্দুকে। তারপর পূর্ববঙ্গকে হিন্দু শুন্য করার পরিকল্পনা হিসেবে ১৯৫০ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে প্রায় ৫০ লক্ষ হিন্দুকে এক কাপড়ে দেশ থেকে বিতাড়িত করা হয়, এই ঘটনা ঘটাতে গিয়ে যে কী পরিমান অত্যাচার নির্যাতন হিন্দুদের উপর মুসলমানরা চালিয়েছে সেটা একবার কল্পনা করুন। তারপর ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ পাকিস্তান যুদ্ধ, সবখানেই শিকার হিন্দুরা আর শিকারী হলো মুসলমানরা। ইতিহাসের এই ঘটনাগুলোকে বিশ্লেষণ করে দেখবেন, সবক্ষেত্রেই বিনা কারণে মুসলমানদের হাতে মার খেয়েছে হিন্দুরা।
বাংলাদেশের হিন্দুরা ১৯৭১ এর পর আবারও মার খায় ১৯৯২ সালে, বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার ঘটনায়। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের হিন্দুরা কি মসজিদ ভাঙতে অযোধ্যায় গিয়েছিলো ? তাহলে এটাকে বিনা কারণে মার খাওয়া ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে ? অপরাধ তাদের একটাই, আর তা হলো তারা জন্মসূত্রে হিন্দু।
১৯৯২ সালের পর বাংলাদেশের হিন্দুরা আবারও পাইকারী হারে মার খায় ২০০১ সালে, এখানে অপরাধ ছিলো দুইটা- তারা হিন্দু এবং নৌকার সমর্থক।
২০০১ এর পর আবার মার খা্য় ২০১৩ সালে রাজাকার সাঈদীর ফাঁসির রায় হলে, এই অপরাধেরও একমাত্র কারণ, তারা হিন্দু। তাছাড়া সরকার সাঈদীর বিচার করেছে এবং রায় দিয়েছে, তাতে হিন্দুদের কী করার ছিলো ?
২০১৩ এরপর ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন থেকে হিন্দুদের উপর চলছে লাগাতার হামলা আক্রমন জবরদখল। অপরাধ, তারা হিন্দু এবং সংখ্যায় কম।
২০১৫ সালে ফেনীর এক জেলে পাড়ায় দাবীকৃত চাঁদা না দেওয়ায় পাড়ায় হামলা করে এক অন্তঃসত্ত্বা মহিলার পেটে লাথি মেরে তার গর্ভপাত ঘটানো হয়, এখানেও সে হিন্দু হওয়ার অপরাধে অপরাধী।
এরপর ২০১৬ সালে বড় ঘটনা ঘটে নারায়ণগঞ্জের শ্যামল কান্তি স্যারের ঘটনা, যেখানে মিথ্যা ইসলাম অবমাননার গুজব রটিয়ে তাকে কান ধরে উঠবস করিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে হেনস্থা করা হয়। তারও অপরাধ, সে হিন্দু। ২০১৬ সালেই শ্যামল স্যারের মতোই আরো বেশ কয়েকজন হিন্দু শিক্ষকের চাকরি কেড়ে নেবার জন্য তাদের উপর মিথ্যা ইসলাম অবমানার অভিযোগ আনা হয়, যদিও সেই ঘটনাগুলো খুব বড় আকারে প্রকাশ হয় নি।
এখন পর্যন্ত ২০১৬ সালের সবচেয়ে বড় ঘটনা হলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের ঘটনা। এখানে হিন্দুদের বাড়ি-ঘরে হামলা ও লুঠপাট করার জন্য এবং তাদেরকে ভয় দেখিয়ে দেশ থেকে বিতাড়িত করে তাদের সম্পদ সস্তায় কেনা বা দখল করার জন্য ফারুক মিয়া নামের এক মুসলমান, নিজে কাবা শরীফের উপর শিবের ছবি বসিয়ে তা রসরাজ দাস নামের এক হিন্দু ছেলের ফেসবুকে প্রচার করে হামলার পরিবেশ তৈরি করে এবং তাতে মুসলমান পুলিশ প্রশাসন প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করে। এই ঘটনায় বেশ কিছু হিন্দুকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়, ১৫ টি মন্দির, কয়েকশো হিন্দু বাড়ি-ঘরে লুঠপাট করা হয়, প্রথম হামলার দুদিন পরে ৫ টি বাড়িতে অগ্নি সংযোগ করে তাদের পথের ভিখারি বানিয়ে দেওয়া হয় এবং মূল ঘটনার ২ সপ্তাহ পর আবারো একটি হিন্দু বাড়িতে আগুন লাগিয়ে প্রায় ২ লক্ষ টাকার মাছ ধরার জাল পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং ১৬.১১১.১৬ তারিখে আবারও একটি হিন্দু বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়, এতে একজন মারাও যায়। এগুলো দৃশ্যমান ক্ষতি, দেশি বিদেশি চাপে সরকার হয়তো মুসলমানদের এই সব অপরাধের কাফফারা হিসেবে ঘর বাড়ি মন্দির তৈরি করে দেবে, কিন্তু হিন্দুদের আত্মবিশ্বাসের যে ক্ষতি হয়েছে, তা কি কোনো দিন পূরণ হবে ?
আমি মুসলমানদের কাছে প্রশ্ন করছি, এই যে এত বড় ঘটনা ঘটানো হলো, এর পেছনে হিন্দুদের অপরাধ কী ছিলো ? তাদের কি এটাই অপরাধ নয় যে, তারা হিন্দু ?
হ্যাঁ, এটাই তাদের অপরাধ যে তারা হিন্দু। এর প্রমান আছে ইসলামের ইতিহাসে। মুহম্মদ চায় নি যে তার দেশে কোনো অমুসলিম থাকুক, তাই সে বলে গেছে,
“একমাত্র মুসলমান ছাড়া ইহুদি খ্রিষ্টান সবাইকে আমি আরব ছাড়া করবো”।- মুসলিম শরীফ, ৪৩৬৬
“পৌত্তলিকদেরআরব থেকে তাড়াও” – মুসলিম, ৮০১৮
এবং একারণে,
“খলিফা ওমর আরব থেকে ইহুদি ও খ্রিষ্টানদেরকে বিতাড়িত করে।”– বুখারি, ৩/৩৯/৫৩
মুহম্মদ, পৌত্তলিকদের মূর্তি পূজা পছন্দ করতো না, তাই কোরানের মাধ্যমে সে বলে গেছে,
“নিঃসন্দেহে তোমরা ও তোমাদের যেসব মাবুদ, যাদের তোমরা পূজা-উপাসনা করতে, জাহান্নামের ইন্ধন হবে, তোমাদেরও সেখানেই যেতে হবে।- (কোরান, ২১/৯৮)
“আল্লার কাছে শুধু শিরকই (মূর্তি পূজা) ক্ষমা পেতে পারে না।…. যে ব্যক্ত আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করলো সে তো পথভ্রষ্টাতার পথে অনেক দূর অগ্রসর হয়ে গেছে।”- (কোরান, ৪/১১৬)
“এই ধরণের লোকেরা আল্লাকে বাদ দিয়ে দেব-দেবীসমূহকে উপাস্যরূপে গ্রহন করে। তারা সেই আল্লাদ্রোহী শয়তানকেও মাবুদরূপে মেনে নেয়।”– ৪/১১৭
“এরা যদি প্রকৃত ইলাহ হতো, তবে তারা নিশ্চয় সেখানে (জাহান্নামে) যেতো না।”- (কোরান, ২১/৯৯)
এবং এই মনোভাবের কারণে মক্কা দখলের পর মুহম্মদ নিজের হাতে কাবার মধ্যে থাকা মূর্তিগুলো ভেঙ্গে ফেলে, যা এখন মুসলমানদের জন্য নবীর সুন্নত হিসেবে পুন্যের কাজ।
শুধু তাই নয় ইসলামের দাবী মতে মুহম্মদের আল্লা নাকি পৃথিবীর সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা, সেই আল্লা তাকে স্বীকার না করার জন্য, অমুসলিমদের অস্বীকার করেছে এবং তাদেরকে নিজের শত্রু হিসেবে গণ্য করেছে, দেখুন নিচে-
“আমরা তোমাদের অস্বীকার করেছি এবং আমাদের ও তোমাদের মাঝে চিরকালের শত্রুতা স্থাপিত হয়েছে ও বিরোধ ব্যবধান শুরু হয়ে গেছে, যতক্ষণ তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান না আনবে।- ৬০/৪
এই বাক্যটা যে আল্লা নয়, মুহম্মদের পক্ষ থেকে মুসলমানরা বলেছে, একটু ভালো করে খেয়াল করলেই সেটা বুঝতে পারবেন। কেননা, পার্সন হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে ‘আমরা’ এবং ‘আমাদের’ শব্দ দুটি। এটা যদি কোরানের বাণী হয়, তাহলে আল্লা এক নয় বহু।
যা হোক, মুসলমানদের সাথে যে অমুসলিমরা বসবাস করতে পারবে না, সেটা বলা আছে কোরানের নিচের এই আয়াতে
“পরে এই শহরে তোমাদের সাথে তাদের বসবাসই কঠিন হবে।”- ৩৩/৬০
এমনি কি আর পুতিন বলেছে যে, মুসলমানরা যদি রাশিয়ায় বোমা ফাটায় তাহলে ৩০ মিনিটের মধ্যে সকল মুসলমানকে হত্যা করবে। আর ট্রাম্প কি এমনি এমনি আমেরিকা থেকে মুসলমানদেরকে শুধু বের করে দেওয়ায় নয়, মঙ্গল গ্রহেও পাঠাতে চায় ।
ইসলামের মূল লক্ষ্য হলো সকল অমুসলিমকে ইসলাম স্বীকার করতে বাধ্য করা, কিন্তু শেষ পর্যন্ত অমুসলিমরা যদি ইসলামকে স্বীকার না করে, তাহলে তাদের পরিণতি কী, দেখুন নিচে-
“তাদের উপর চারেদিক হতে অভিশাপ বর্ষিত হবে, যেখানেই তাদেরকে পাওয়া যাবে, তাদেরকে পাকড়াও করা হবে ও নির্মমভাবে হত্যা করা হবে”।- ৩৩/৬১
শুধু এখানেই শেষ নয়, কিভাবে অমুসলিমদেরকে হত্যা করতে হবে, সেই পদ্ধতি পর্যন্ত বলে দেওয়া হয়েছে নিচের এই আয়াতে-
অতএব হারাম মাস যখন অতিবাহিত হয়ে যাবে, তখন মুশরিকদের হত্যা কর যেখানেই তাদের পাও এবং তাদের ধরো, ঘেরাও করো এবং তাদের প্রতিটি ঘাঁটিতে তাদের খবরাখবর নেওয়ার জন্য শক্ত হয়ে বসো। অতঃপর তারা যদি তওবা করে, নামায কায়েম করে ও যাকাত দেয়, তাহলে তাদেরকে তাদের পথ ছেড়ে দাও। আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল ও করুনাময়।- ৯/৫
এখানে বলা হচ্ছে, মুসলমান হলে তাদের পথ ছেড়ে দাও, মানে বেঁচে থাকার অনুমতি দাও। কারণ, কোরানের বিধান হলো-
“ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম চাইলে কখনো তা গ্রহণ করা হবে না- কোরান”, ৩/৮৫
এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে ৯০% দেশে ১০% অমুসলিম বা হিন্দু বাস করবে কিভাবে ? বাংলাদেশের হিন্দুদের উপর এই যে বিনা কারণে- অত্যাচার, ধর্ষণ, লুঠপাট, হামলা, অগ্নি সংযোগ- কিসের অপরাধে ? কোনো বাস্তব কারণ কি আছে ? না নেই। তাদের একটাই অপরাধ, তারা মুহম্মদকে স্বীকার করে না, তাদের একটাই অপরাধ, তারা হিন্দু হয়ে জন্মেছে। কিন্তু এই জন্ম দেওয়ার পেছনে দায়ী কে ? আল্লার হাতে যদি সকল ক্ষমতা থাকে, সে ই যদি সকলকে সৃষ্টি করে থাকে, তাহলে হিন্দু পরিবারে সন্তান জন্ম বন্ধ করে দিয়ে হিন্দু জাতিক ধ্বংস করে দিতে পারছে না কেনো ? বা কেনো সবাইকে মুসলমান হিসেবে জন্ম দিচ্ছে না ?
কোনো মুসলমানের যদি ক্ষমতা থাকে তাহলে যেন এই প্রশ্নের জবাব দেয় ।