বাসযোগ্য গ্রহেই জল এমন কাণ্ড করে বসেছে যে ‘সাত কাণ্ড রামায়ণের পর প্রশ্ন
উঠছে সীতা কার বাপ’?গনগনে তাপেও, গা জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়া তাপমাত্রাতেও এখন দেখা যাচ্ছে, জল জমে গিয়ে বরফ হয়ে যাচ্ছে! হ্যাঁ, জীবনের অন্য নাম জলকে অত সহজ, সরল বলে ভাবার কোনও কারণ নেই! তার
‘ভুতুড়ে’ কাণ্ডকারখানায় এখন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় যাকে বলে, ঘেমে-নেয়ে জল হয়ে
যাওয়ার জোগাড় হয়েছে বিজ্ঞানীদের, ন্যানো-
টেকনোলজিস্টদের!ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় জল যে তরল অবস্থায় থাকে, তা তো সবাই জানেন।
এও জানেন, তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছলেই জল আর তরল অবস্থায় থাকে
না। চলে যায় গ্যাসীয় অবস্থায়। কিন্তু এটা ‘ওয়ান ওয়ে রুট’ নয়। তাপমাত্রা
কমিয়ে গ্যাসীয় অবস্থায় পৌঁছনো জলকে আবার তরল অবস্থায় ফেরানো যায়।
ফুটন্ত জলকে অত্যন্ত ঠান্ডায় ছড়িয়ে দিলে দেখতে হয় এমনটাই…
কোন পথ ধরে, কী ভাবে তৈরি হয় জলে্র অণু…
আমরা এও জানি, তাপমাত্রা নামাতে নামাতে যদি শূন্য ডিগ্রিতে পৌঁছয়, তা
হলে তরল অবস্থায় থাকা জল জমে গিয়ে কঠিন বরফ হয়ে যায়। শূন্য ডিগ্রি থেকে
শুরু। তাপমাত্রা যদি আর আরও নামানো যায় (তবে মাইনাস ২৭২.২ ডিগ্রি
সেলসিয়াসের (যাকে বলে ‘কেলভিন’) নীচে তাপমাত্রাকে আর নামানো যায় না। ওটা
মহাকাশেরও তাপমাত্রা।), মানে তাপমাত্রার স্কেলে মাইনাস ডিগ্রি, তা হলে সেই
বরফ কঠিন থেকে কঠিনতর হতে থাকে।
কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, ১০৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তো বটেই, এমনকী ১৫১ ডিগ্রি সেলসিয়াসেও জল জমে কঠিন বরফ হয়ে যাচ্ছে, দিব্যি!
জলের তিন অবস্থায় অণুদের বাঁধন আর চলাফেরার ছবি
একেবারে হালের সাড়াজাগানো একটি গবেষণায় জলের এই ‘হাঁড়ির খবর’টি
একেবারে চাউর হয়ে গিয়েছে। গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক
বিজ্ঞান-জার্নাল ‘নেচার-ন্যানোটেকনোলজি’র ২৮ নভেম্বর সংখ্যায়। গবেষকদলের
অন্যতম সদস্য আমেরিকার মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ও
মেটিরিয়াল সায়েন্স বিভাগের পোস্ট-ডক্টরাল ছাত্র অনাবাসী ভারতীয় কুমার বরুণ
অগ্রবাল। মুম্বইয়ের আইআইটি-র প্রাক্তনী কুমারের গবেষণা রীতিমতো সাড়া ফেলে
দিয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানী মহলে। মূল গবেষক ম্যাসাচুসেট্স ইনস্টিটিউট অফ
টেকনোলজি’র (এমআইটি) ‘কার্বন পি ডাব্স’ চেয়ার প্রফেসর মিশেল স্ট্রানো।
গবেষণাপত্রটির শিরোনাম- ‘অবজার্ভেশন অফ এক্সট্রিম ফেজ ট্রানজিশন
টেম্পারেচার্স অফ ওয়াটার কনফাইন্ড ইনসাইড আইসোলেটেড কার্বন ন্যানোটিউব্স’।
হচ্ছেটা কী? কেন এমনটা হচ্ছে?
কুমার বরুণ অগ্রবাল
আমেরিকার মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেটিরিয়াল
সায়েন্স বিভাগের পোস্ট-ডক্টরাল ছাত্র অনাবাসী ভারতীয় কুমার বরুণ অগ্রবাল
আনন্দবাজারের পাঠানো প্রশ্নের জবাবে ই-মেলে লিখেছেন, ‘‘স্কুলের ক্লাসে
সিক্স-সেভেনে উঠলেই আমাদের জানা হয়ে যায়, ঘরের সেই স্বাভাবিক তাপমাত্রায়
(বা, সমুদ্রের জলস্তরে) থাকা জলকে যদি ফোটাতে ফোটাতে (বাড়তি তাপমাত্রা
জুগিয়ে) ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ২১২ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায় পৌঁছনো
যায়, তা হলেই একেবারে দফারফা হয়ে যায় তরল জলের। বাড়িতে তাপ পেয়ে তরল
অবস্থায় থাকা জলের অণুগুলি খুব উত্তেজিত হয়ে ওঠে। তখন তাদের নিজেদের
মধ্যেকার বেড়ি-বাঁধনগুলি (ইন্টার-মলিকিউলার ফোর্স) আলগা হয়ে যায়। কোমরের
দড়ির বাঁধন আলগা করলে দুষ্টু শিশুরা যা করে, ঠিক সেই কাজটাই করে তখন জলের
অণুগুলি। তাদের দৌড়োদৌড়ি, ছুটোছুটি শুরু হয়ে যায়। আর তখনই সেই জল আর তরল
অবস্থায় থাকে না, থাকতে পারে না। তারা ধীরে ধীরে বাস্পীভূত হয়ে যায়। তাই
কেটলিতে জল ফোটালে তার মুখ থেকে কিছু পরে গরম ধোঁয়া বেরোতে থাকে। সেটাই
জলীয় বাস্প বা ওয়াটার ভেপার। এটাই জলের গ্যাসীয় অবস্থা। অনেকটা যেন ‘এক দেহ
ছেড়ে অন্য দেহে লীন হয়ে যাওয়া’! আর যে তাপমাত্রা থেকে তরল জলের বাস্পীভূত
হওয়া শুরু হয়, আমরা তাকে বলি, জলের স্ফূটনাঙ্ক বা ‘বয়েলিং পয়েন্ট’। অন্য
দিকে তাপমাত্রা কমাতে কমাতে শূন্য ডিগ্রিতে নিয়ে গেলে তরল অবস্থা থেকে জমে
গিয়ে কঠিন বরফ হতে শুরু করে জল। এটাকেই আমরা বলি জলের হিমাঙ্ক বা ‘ফ্রিজিং
পয়েন্ট’। তবে শুধু যে তাপমাত্রাই জলের অবস্থার রদবদলের পিছনে অন্যতম
‘চাণক্যে’র ভূমিকা নেয়, তা কিন্তু নয়। চাপ বা প্রেসারেরও বড় একটা ভূমিকা
থাকে জলের অবস্থার রকমফেরের (চেঞ্জ অফ স্টেট) জন্য। বিজ্ঞানীরা আগেই
দেখেছিলেন, খুব অল্প জায়গার মধ্যে জলকে রাখলে তার স্ফূটনাঙ্ক বা হিমাঙ্কের
মানে কিছুটা রদবদল হয়। তবে তা কখনওই মোটামুটি ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের চেয়ে কম
নয়। কিন্তু এ বার আমরা দেখেছি, তরল অবস্থায় থাকা জলকে যদি সোডা স্ট্র’য়ের
মতো দেখতে কার্বন ন্যানোটিউবের (যার ব্যাস কয়েকটা জলের অণুর আকারের চেয়ে
মোটেই বড় নয়। এক মিটারের ১০০ কোটি ভাগের এক ভাগ। ভাবুন, তা হলে কতটা ছোট!)
মধ্যে ঢোকানো যায়, তা হলে এমনকী স্ফূটনাঙ্কেও জল জমে গিয়ে কঠিন বরফ হয়ে
যাচ্ছে।’’
কার্বন ন্যানোটিউবেরে মধ্যে জলের অণুকে যেমন দেখতে লাগে…
কী বলছেন মূল গবেষক ম্যাসাচুসেট্স ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি’র (এমআইটি) ‘কার্বন পি ডাব্স’ চেয়ার প্রফেসর মিশেল স্ট্রানো?
গবেষণাপত্রে স্ট্রানো লিখেছেন, ‘‘ খুব ছোট জায়গায় কোনও ফ্লুইড (তরল বা
গ্যাস)-কে রাখলে যে তার আচার-আচরণের যে বিস্তর রদবদল ঘটানো যায়, তা আগেও
জানা ছিল। কিন্তু জলের ক্ষেত্রে যেটা দেখা গিয়েছে, তা সত্যিই অভূতপূর্ব।
একেবারে উলটপূরাণ। গ্যাসের দিকে না গিয়ে সে মোড় ঘুরছে একেবারেই উল্টো
দিকে। কঠিন বরফ হয়ে যাচ্ছে। ১০৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তো বটেই, ১৫১ ডিগ্রি
সেলসিয়াস তাপমাত্রাতেও জলকে জমিয়ে কঠিন বরফ করে তোলা যাচ্ছে।’’
‘দেহ’ ছেড়ে ‘অন্য দেহে’ যেতে গেলে যে তাপ ছাড়ে জল, বরফ (ইউনিট ‘জুল্স’ বা ‘জে’)
জলকে নিয়ে আমাদের চমকটা যদি এখানেই শেষ হতো, তা-ও না হয় একটা কথা ছিল।
কিন্তু আরও চমক দেখিয়েছে জল। সেটা কী?
ডান দিকের ছবিতেই ধরা পড়বে হবে জলের ‘পাগলামি’!
মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেটিরিয়াল সায়েন্স
বিভাগের পোস্ট-ডক্টরাল ছাত্র কুমার ই-মেলে লিখেছেন, ‘‘এর আগে কখনও কার্বন
ন্যানোটিউবে তরল জল ঢোকানো সম্ভব হয়নি। তাই কার্বন ন্যানোটিউবকে ‘ওয়াটার
রিপেলিং’ বা ‘জল-বিদ্বেষী’ বলা হয়। কিন্তু আমরা দেখাতে পেরেছি, কার্বন
ন্যানোটিউবেও তরল অবস্থায় থাকা জলকে ঢোকানো সম্ভব। তবে কী ভাবে জলের
অণুগুলি ওই ‘চক্রব্যূহ’ ভেঙে ঢুকছে, সেই রহস্যটা কিন্তু এখনও আমরা জানতে
পারিনি।’’
- বিদ্যাদেবী কথা ও ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা’র অস…
- উপমহাদেশের বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানীদের কথা! (পর্ব-১)…
- উপমহাদেশের বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানীদের কথা! (পর্ব-২)…
- উপমহাদেশের বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানীদের কথা! (পর্ব-৩)…
- উপমহাদেশের বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানীদের কথা! (পর্ব-৪)…
- উপমহাদেশের বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানীদের কথা! (পর্ব-৫)…
- উপমহাদেশের বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানীদের কথা! (পর্ব-৬)…
- ভাষাতাত্ত্বিক, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ সুনীতি কুমার