আমি যখন ছোট ছিলাম তখন প্রতিদিন মসজিদে যেতাম। সেখানে আমি ইসলামি প্রার্থনা শিক্ষা ছাড়াও কোরান তেলাওয়াৎ, হাদিস এবং তফসির শিখতাম।
আমাদের মসজিদের শিক্ষক (ইমাম) এবং অন্যান্য ইসলামী পন্ডিতেরা আমাদের বলতেন যে, যেহেতু আমরা মুসলমান সেইহেতু আমরা হচ্ছি বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। ওনারা আরো বলতেন যে সৌদি আরবের মুসলমানেরা হচ্ছে একমাত্র প্রকৃত মুসলিম। সেই জন্য বিশ্বের তাবত মুসলিমরা এক মাত্র সৌদি মুসলিমদের অনুসরণ করবে, অন্য কাউকে নয়। বলা বাহুল্য আমরা একবাক্যে,কোন প্রশ্ন ছাড়াই, দৃঢ় ভাবে ঐ সব মেনে নিতাম।
এই ভাবে আমরা নিজেরা মুসলমান হিসাবে খুবই গর্ব বোধ কোরতাম।
কিন্তু এখন আমি বুঝি যে, এসব ছিল একেবারেই মিথ্যা।
পাঠকবৃন্দ, আমি আমি সৌদি আরবের মসজিদ থেকে যা বুঝেছি এবং শিখেছি তার ভিত্তিতে আমি হলফ্ সহ বলতে পারি যে, ইসলামের প্রকৃত শিক্ষাই (কোরানের প্রাসঙ্গিক আয়াত সমূহ যেমন – তোমাদের উপর যুদ্ধ ফরজ করা হলো (২:২১৬),তাদেরকে বন্ধু রূপে গ্রহণ করো না (২:৮৯), তাদেরকে যেখানেই পাবে হত্যা কর (২:২৯১, ৯:৫ ) ইত্যাদি) ওসামা বিন লাদেনরা হুবহু পালন করার চেষ্টা করে। এতে কারো মনে কোন সন্দেহ থাকা উচিত নয়। আসলে ইসলামের চোখে বিন লাদেন একেবারে পাক্কা মুসলমান। বিশ্বাস করুন, সৌদি আরবের প্রায় সবাই বিন লাদেনের সমর্থক এবং তাকে দারুন ভাবে তাকে ভালবাসে তার কার্য্য কলাপের জন্য (সামগ্রিকভাবে পুরো ইসলামী বিশ্বেই অবস্থা একইরকম, বিন লাদেন তাদের কাছে হিরো)।
বিন লাদেনের ক্রিয়া কলাপের জন্য আমরা কি তাকে দোষী করতে পারি? মোটেই নয়। তার পরিবর্তে আমাদের ইঙ্গিত করতে হবে ইসলামের প্রতি। বিন লাদেন তো অক্ষরে অক্ষরে ইসলাম পালন করছে। সে নিঃসন্দেহে ইসলামের নির্ভিক সেনানি, একে বারে খাঁটি মুসলমান।
এখন আমার কথায় আসা যাক। আমার ইসলাম ছাড়ার ঘটনা শুরু হয় আমি যখন পঞ্চম গ্রেডের ছাত্র।আমি কোরানের সুরা আল-কাহফ্ আয়াত ৮৬ (১৮:৮৬) পড়লাম। এখানে লেখা আছে যখন জুলকারনাইন সুর্যাস্তের প্রান্তে পৌঁছাল তখন সে দেখল অনেক লোক সূর্যের প্রচন্ড তাপে অসহনীয় ভাবে পীড়িত। এর কারন হল সূর্যটা তখন ঐ লোকদের খুব কাছাকাছি ছিল। ঐ একই ঘটনা ঘটল যখন সে সুর্য্যদয়ের প্রান্তে পৌছাল।
আমি ভাবলাম: এটা কি ভাবে সম্ভব! পৃথিবী তো একটা বলের মত গোলাকার। তা হলে জুলকারনাইন কেমন ভাবে পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে পৌছাল? আমি আমার শিক্ষককে এ বিষয়ে জিজ্জাসা করলাম। আমার শিক্ষক একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন। তিনি কোন উত্তর দিতে পারলেননা, শুধু বললেন কোরানে যা লেখা আছে তাতেই বিশ্বাস করতে হবে-কোন প্রশ্ন করা চলবেনা।
এই ভাবে কোরানের প্রতি আমার সংশয় শুরু হয়।
এরপর একটা বিশাল বিস্ময় আমার মনকে পীড়িত করলো। আমি জানলাম যে আমি যদি ভাল মুসলিম হতে চাই তবে আমাকে অবশ্যই অমুসলিমদের থেকে দূরে থাকতে হবে। আরো বিস্মিত হলাম এই জেনে যে আমি যদি অমুসলিমদের সাথে বন্ধুত্ব করি তা হলে আমি কাফের হয়ে যাব (আল কোরান ৫:৫১,২:৮৯, ৩:২৮, ৪:১৪৪ ইত্যাদি দ্রঃ) ।
আমি অন্যন্য ক্রিয়া কলাপের মত চলচ্চিত্র দেখা,গান শোনা এবং খেলাধুলায় পারদর্শিদের সাথে বন্ধুত্ব করা খুবই পছন্দ করতাম। এদের বেশির ভাগই ছিল অমুসলিম। এখন ইসলামের নীতি আনুযায়ী আমি সত্যিই কাফের হয়ে গেছি। আমি শিখেছি যে স্বর্গে যেতে হলে নবী মোহাম্মদ কে শর্তহীন ভাবে ভালবাসতে হবে, যদিও আমি কোনদিনই তাঁকে দেখি নাই। এখন আমি সম্পুর্ন নিশ্চিত হলাম যে আমার স্থান নরকে।
আমি ইমামদের কথাবার্তা শুনে আরো বিক্ষুব্ধ হলাম। তারা অত্যান্ত গালিগালাজপূর্ণ ভাষায় অমুসলিমদের বানর এবং শুকরের নাতি/নাতনি বলে আখ্যায়িত করলো। আমি চিন্তা করলাম যদি কেউ পাপ করে তার শাস্তি আল্লাহ্ দিবেন। আমাদের ইমামরা কেনই বা ওদের আপমানজনক ভাবে নিন্দা এবং বিদ্রুপ করবে?
আমি আরো বিস্মিত হলাম যখন আমার মুসলিম বন্ধুরা এবং আমার নিজের ইমাম বললো যেহেতু অমুসলিমরা মুসলিমদের শত্রু সেহেতু আমাদের কর্ত্তব্য হবে সর্ব ভাবে অমুসলিমদের হেয় প্রতিপন্ন করা এবং তীব্র ভাষায় কটুক্তি করা। আমি তাদের কথায় রাজী না হওয়ায় তারা আমাকে দুর্বল মুসলিম আখ্যায়িত কোরল। তারা আমাকে এটাও বললো যে একজন বিদেশী না জানা মুসলিম একজন অতি পুরাতন বিশ্বস্ত কাফের বন্ধুর চাইতে অনেক ভালো।
আমি কিন্তু আমার প্রশ্ন থেকে বিরত থাকলামনা। সবচাইতে উল্লেখযোগ্য যে প্রশ্ন আমার মনে সর্বদা বিরাজমান ছিল সেটা হলো: এ কেমন আল্লাহ্ যিনি নিজেকে সবসমই পরম দয়ালু ও ক্ষমাশীল হিসেবে দাবি করেন তিনি কেমন ভাবে তাঁর প্রিয় বান্দাদের একে অপরের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করতে বলেন? তাকে কিঞ্চিৎ অবিশ্বাস করলে আল্লাহ্ কেন আগুনে পোড়ানোর এবং অসীম নির্যাতনের ভীতি প্রদর্শন করেন তাঁরই সৃষ্ট মানবকুলের প্রতি? আল্লাহ্ কি আমাদের উপাসনার জন্য এতই কাঙ্গাল? আমরা সর্বদা তাঁর উপাসনা করি এটা কি তাঁর জন্য সত্যিই এত গুরুত্বপূর্ণ?
এই সব প্রশ্ন নিয়ে আমি গভীর চিন্তা করলাম। আমি কোরান ঘেঁটে ঘেঁটে দেখলাম যে আমাদের নিয়তি আল্লাহ্ আগেই নির্ধারিত করে দিয়েছেন। কে স্বর্গে যাবে, কে নরকে যাবে সেতো আল্লাহ্ বহু পুর্বেই ঠিক করেছেন। যুক্তিযুক্ত কারনে তাই বলা যায় যে প্রার্থনা করে কিইবা হবে? আমি যখন এই প্রশ্ন ধর্মপ্রান মুসল্লীদের করলাম তখন ওরা আমার প্রতি ভীষন ক্রদ্ব হয়ে গেল। ওরা আমাকে জিজ্ঞাসা করল আমি পুর্বথেকে কেমন করে জানি আমার স্থান কোথায়—স্বর্গে না নরকে? আমি উত্তর দিলাম যেহেতু আল্লাহ্ আমাদের সবার পরিনতি আগেই ঠিক করে দিয়েছেন কাজেই নামাজ পড়া আর না পড়া কোন পার্থক্য আনবেনা। ওরা আমাকে বিকৃতমস্তিষ্ক ঠিক করল কারন আমি আল্লাহ্র ব্যাপারে সন্দেহ করেছি।
এই ভাবেই আমার ইসলামের প্রতি ঘৃণার শুরু। কিন্তু সৌদি আরবে আমি হলাম অসহায়। আমি যে সমাজে বাস করি সেখানে খোলাখুলি ভাবে বে-ইসলামি কিছু করা যাবেনা।
১৯৯৯ সালে আমার মা অসুস্থ হয়ে পড়েন, এবং কিছুদিন পরে মারা যান। এই ঘটনা আমার জীবনের মোড় পরিবর্তন করে দেয়। আমি চিন্তা করে বুঝলাম আমরা মুসলিমরা কোন ক্রমেই বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জাতি নই। অন্যান্যদের মতো আমরাও পীড়িত হই এবং সময়ের সাথে আমরাও মারা যাই। আমি এটাও বুঝলাম যে পরিশ্রমী হলে আমরাও উন্নতির পথে অগ্রসর হতে পারি। আর তা যদি না করি তবে আমাদের পশ্চাদপদতা একেবার সুনিশ্চিত। ‘আল্লাহ্র ইচ্ছা’ বলতে কিছুই নাই। মুসলিমদের বিশেষ স্থানের দাবি নিতান্তই হাস্যকর।
আজ আমি যখন ইসলামি বিশ্বের প্রতি তাকাই শুধুই দেখি চরম অন্যায়, অবিচার এবং নারী ও কাফেরদের প্রতি অসীম বৈষম্যমূলক আচরন আর নগ্ন ভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন। ইসলামি জগতে সীমাহীন অরাজকাতা ও দূর্নিতির কথা নাই বা বললাম।আমরা পরিষ্কার দেখি যে ইসলামি বিশ্ব এক গভীর সমস্যায় নিমজ্জিত।
আমি নিজেকেই প্রশ্ন করি: “ইসলামি বিশ্বের এই অসীম দূর্গতির কারন কি?” আমি আবার নিজেই বিশ্বাসযোগ্য উত্তর পাই—সেটা হল ইসলাম। আমি এখন সন্দেহাতীত যে ইসলাম হচ্ছে একটা অর্থহীন, মূঢ় এবং ভূল ধর্ম।
দুঃখের বিষয় হল: ইসলামের প্রতি আমার ঘৃনা বৃদ্ধি সত্তেও আমি ইসলামকে তখন আমার জীবন হতে বিতাড়িত করতে পারি নাই। মনের গভিরে আমি চিন্তা করতাম যে ইসলাম এত খারাপ হতে পারেনা—হয়তবা সমস্যা টা মুসলিমদের—ইসলামের নয়।
কিন্তু ৯/১১-এ আমি যা দেখলাম সেতো ইসলামের প্রকৃত রূপ। কোথায় এর প্রতিবাদ হবে না না – আমি বিস্মিত হয়ে আমাদের এখানকার লোকদের মুখে দেখলাম হাসি এবং সুখের ছায়া। এত সহজেই অগুনতি কাফের মেরে ফেলা যাবে সেটা তখন চিন্তাই করা যায়নি।আমি অসীম বেদনার সাথে লক্ষ্য করলাম আমার লোকদের উল্লাস—যেহেতু এত বেশী নিরীহ কাফের মারা গেছে। আমি দেখলাম প্রচুর মুসলিম আল্লাহ্কে শুকরিয়া জানাল এই নির্দয় হত্যাকান্ডের জন্য। এই সব ইসলামি জনগণ ভাবে যে আল্লাহ্ মুসলিমদের কামনা বাসনা পরিপূর্ন করেছেন। এই ভাবেই বুঝি শুরু হল জগৎ জুড়ে কাফের ধ্বংসের খেলা।
কিন্তু আমার নিকট এ সব ছিল নিতান্তই অমানবিক আচরণ।
এর কিছুদিন পর আমাদের ইমাম আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা শুরু করলেন তালিবানদের বিজয়ের জন্য—মার্কিন সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে।আমি নিতান্তই ক্রুদ্ধ হয়ে নামাজ পড়া ছেড়ে দিলাম।
২০০৪ সালে আমার এক পাকিস্তানি ম্যানেজারের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়। আমার বিশ্বাস উনি ইসলামের উপর খাপ্পা এবং সন্দিহান ছিলেন। উনার সংস্পর্শে আশার ফলে আমার মানবচেতনা ফিরে আসে। উনি আমাকে আশ্বাস দেন যে আমি বিকৃতমস্তিষ্ক নই। এর পর আমি মসজিদে যাওয়া বন্ধ করে দিলাম, এবং রমজান মাসের রোজা রাখা হতে বিরত থাকলাম। গত বছর আমি একটি রোজাও রাখি নাই।
আমার জীবন হতে ইসলাম মুছে দেয়ার পর আমি না এখন কতই মুক্ত এবং সুখী বোধ করছি। নিজেকে আর আমি দোষী বা অপরাধী ভাবি না। আমি এখন কোন চিন্তা ছাড়া চলচ্চিত্র উপভোগ করতে পারি—গানও শুনতে পারি। আমার মনে হয় আমার যেন নতুন জন্ম হয়েছে—আমি এখন সর্বভাবে মুক্ত ও আমার যা ভাল লাগে তাই-ই করতে পারি।
আমি আশা রাখি ভবিষ্যতে আমি ভয়ংকর ইসলাম সম্বন্ধে অনেক কিছু লিখব।
আপানাদের ওয়েব সাইটকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি—এর কারনেই আমি আজ আর একাকি বোধ করিনা। এখন আমি সম্পুর্ন ভাবে নিশ্চিত আমি ভুল করি নাই।
ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছান্তে।
খালেদ
সৌদি আরব
জানুয়ারী ১৩, ২০০৬