তাজমহল না তেজোমহালয় : …. ??
( স্যাটায়ার-ডে স্পেশাল … )
আমরা নেহেরু মার্কা ইতিহাসের দৌলতে পড়েছি, – সম্রাট শাজাহান তার প্রিয়তম স্ত্রীর মৃত্যুতে শোকাহত হয়ে তাজমহল নির্মান করেন। এতে ২০ হাজার শ্রমিক, ২২ বছর ধরের কাজ করে, ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি…।
শুরুতেই নেহেরু মার্কা ইতিহাস কেনো বললাম, তার ব্যাখ্যা দিয়ে নিই। অখণ্ড ভারত দুই টুকরা হওয়ার পর, বর্তমান ভারতের শাসনভার- ব্রিটিশদের এজেন্ট নেহেরুর কাছে হস্তান্তর হলে, ইতিহাস রচয়িতাদের প্রতি নেহেরু সরকারে একটি অলিখিত নির্দেশ ছিলো- মুসলমানদের নামে কোনো কিছু খারাপ লেখা যাবে না। যেখানে দরকার বলতে হবে ভালো ভাবে, আর যেটা ভালো ভাবে বলা যাবে না, সেটাকে এড়িয়ে যেতে হবে। যেমন ২৮ এপ্রিল ১৯৮৯ সালে, পশ্চিমবঙ্গের সেকুলার বামফ্রন্ট সরকার মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদ এর মাধ্যমে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে, যার মূল কথা ছিলো- “ভারতের মুসলমান আমলের সময়কে কোনোরকম বিরূপ সমালোচনা করা যাবে না। মুসলমান শাসকরা যে হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেছে তা উল্লেখ করা যাবে না।” এই নির্দেশ অনুযায়ী বাংলার ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকগুলো সংশোধিত বা লিখিত হয় আর তাতে লেখা হয় এইধরণের ইতিহাস – “গজনীর সুলতান মাহমুদ ১৭ বার ভারতে অভিযান পরিচালনা করেন”। কিন্তু প্রতিবারই সুলতান মাহমুদ যে লক্ষ লক্ষ হিন্দু পুরুষকে খুন করে লক্ষ লক্ষ হিন্দু মেয়েকে বন্দী করে নিয়ে গিয়ে যৌনদাসী হিসেবে বাজারে বিক্রি করেছিলো, আর সেই সাথে সোমনাথ মন্দিরের মূর্তি ভেঙ্গে ফেলে মন্দির লুঠ করে কোটি কোটি টাকার সমমূল্যের সম্পদ লুঠ করে নিয়ে গিয়েছিলো, সেই ইতিহাস কোথাও লিখা নেই। হিন্দু ছেলেমেয়েরা প্রকৃত ইতিহাস জানবে কিভাবে, কোথা থেকে ?
যা হোক, ফিরে যাই তাজমহলের ইতিহাসে, প্রথমে মিথ্যা প্রচারণার পোস্টমর্টেম করি, শেষে প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমান দিয়ে লেখার পরিসমাপ্তি ঘটাবো।
তাজমহল নির্মানের ইতিহাস সম্পর্কে বলা হয়, তাজের নকশা করার জন্য আন্তর্জাতিক টেন্ডার ডাকা হয়েছিলো এবং সেই নকশার সাথে কাঠের তৈরি তাজের একটি ছোট্ট নমুনা দাখিল করতে বলা হয়েছিলো। বহু নকশা ও নমুনা জমা পড়েছিলো এবং শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর নামকরা স্থপতিদের ডেকে একটা পরিষদ গঠন করা হয় এবং সেই পরিষদ তাজের চুড়ান্ত নমুনা নির্বাচন করে এবং এই নমুনা হলো পারস্য বা তুরস্কের স্থপতি ওস্তাদ ইশা নামের এক ব্যক্তির; হ্যাঁ, এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা ই বলছে এইসব কথা।
এখন কমনসেন্সটাকে একটু খাটান। তাজের মতো একটি বিখ্যাত অট্টালিকা, যার মতো সৌন্দর্যময় দ্বিতীয় কোনো অট্টালিকা এখনও পৃথিবীতে নেই। যার সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বলেছিলেন, পৃথিবীতে দুই ধরনের মানুষ আছে; এক. যারা তাজমহল দেখেছে, আর দুই. যারা তাজমহল দেখে নি। সেই তাজমহলে নকশা যার কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে, তিনি পারস্য না তুরস্কের লোক, সেই কথাই কেউ ঠিক মতো বলতে পারছে না। ইনি নাকি আবার বিখ্যাত স্থপতি ! যার দেশ সম্পর্কেই সঠিক কিছু জানা যাচ্ছে না, তার সম্পর্কে আর অন্যান্য তথ্য জানার চেষ্টা করাটাই তো বৃথা; কারণ, ওস্তাদ ইশা নামের কেউ থাকলে তো তার সম্পর্কে কিছু জানা যাবে ?
আর একটা বিষয়; চীন ও কোরিয়ার ইঞ্জিনিয়াররা বাংলাদেশের অনেক বড় বড় সেতু, ফ্লাইওভার ইত্যাদি নির্মান করেছে এবং করছে, এর কারণ তারা প্রথমে নিজেদের দেশে ঐসব নির্মান করে দেখিয়েছে, তারপর তাদেরকে ডেকে এনে আমরা তাদেরকে ঐসব বানানোর দায়িত্ব দিয়েছি, এই সূত্রে ওস্তাদ ইশা নামের যদি কেউ থাকতো এবং সে যদি পারস্য বা তুরস্কের কোনো ব্যক্তি হতো, তাহলে নিশ্চয় তাজমহল বা এর মতো বা এই জাতীয় কোনো অট্টালিকা পারস্য বা তুরস্কে নিশ্চয় থাকতো, সেটা কি আছে ?
যদি ধরে নিই শাজাহান তাজমহল বানিয়েছিলো, তাহলে এই সব বিক্রীত ঐতিহাসিকদের মতে, তাজমহলের নির্মান শরু হয়- কারো মতে ১৬৩০, কারো মতে ১৬৩১, কারো মতে ১৬৩২, আবার কারো মতে ১৬৪১ সালে। কিন্তু ১৬৪১ সালে কোনোমতেই সম্ভব নয়; কারণ, শাজাহানের জীবনী ‘বাদশানামা’র তথ্য মতে, শাজাহানের স্ত্রী মমতাজ মহলের মৃত্যু হয় ১৬৩০ সালে, এর পর তাকে অস্থায়ীভাবে বুরহানপুরের একটি উদ্যানে সমাহিত করা হয়, মৃত্যুর ৬ মাস পর তাকে তাজের মধ্যে এনে স্থায়ীভাবে কবরস্থ করা হয়। এই সূত্রে ১৬৩২ সালও গ্রহনযোগ্য নয়; কারণ, ‘বাদশানামা’য় উল্লেখ আছে, আরবি মাস ১৫ জমাদিয়াল আউয়াল মমতাজের মৃতদেহ তাজের মধ্যে স্থানান্তরিত করা হয়। আরবি বছর যেহেতু হয় ৩৫৪ বা ৩৫৫ দিনে, সেহেতু ঐ দিনটি ইংরেজি সাল অনুযায়ী সঠিক কোন তারিখ ছিলো তা বের করা খুবই কঠিন হিসাবের একটা ব্যাপার, এই হিসেবকে এড়িয়ে গিয়ে যদি ধরে নিই যে, মমতাজের মৃত্যুর সময়টি ছিলো ১৬৩০ সালের শেষ দিকে, তাহলে মৃত্যুর ৬ মাস পর তাজের মধ্যে তার মরদেহ স্থানান্তর ১৬৩১ সালে হয়েছিলো বলে ধরে নেওয়া যায়। ফলে তাজের নির্মান শুরুর সাল ১৬৩২ ও খারিজ হয়ে যায়।
উপরের এই তথ্য থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, মমতাজের মৃত্যুর ৬ মাস পর তার দেহকে স্থায়ীভাবে তাজের মধ্যে সমাহিত করা হয়। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, তাজমহল নির্মানের জন্য সময় পাওয়া যাচ্ছে ৬ মাসেরও কম। অথচ আমাদের ঐতিহাসিকরা বলছে, এই সময়ের মধ্যে আন্তর্জাতিক টেণ্ডার ডেকে নকশা অনুমোদন করে তাজ নির্মান করা হয়। এটা কি সম্ভব ? খেয়াল করুন, সময়টা ১৬৩০ সাল, যখন যাতয়াতের একমাত্র দ্রুত মাধ্যম স্থলপথে ঘোড়ার গাড়ি আর জল পথে পাল তোলা জাহাজ। যে জাহাজে ১৭৫৬ সালেও কোলকাতা থেকে মাদ্রাজ যেতেও সময় লাগতো একমাস। এইসব পুরোনো সময়ের কথা ছেড়ে এই আধুনিক যুগের প্রেক্ষাপটেও কী ওরকম একটি ইমারত এক বছরেও কি নির্মান করা সম্ভব ? আপনাদের কমনসেন্স কী বলে ?
এখন দেখুন তাজমহল নির্মানের ইতিহাস সম্পর্কে ইতিহাসের গ্রন্থগুলো কী বলছে ?
সম্রাট শাজহানের রাজত্বকাল এবং তার কিছু আগে পরের ইতিহাস পাওয়া যায় নিচের এই ৭ টি গ্রন্থে –
১.আবদুল হামিদ লাহোরী রচিত ‘বাদশানামা’
২. সম্রাট জাহাঙ্গীরের লেখা আত্মজীবনী ‘ ওয়াকিঅৎ জাহাঙ্গিরী’
৩. ইনায়েত খাঁ রচিত ‘শাহজাহাননামা’
৪. মুফাজ্জল খাঁ রচিত ‘তারিখ-ই-মুফাজ্জলি’
৫. বখতিয়ার খাঁ রচিত “মিরাত-ই-আলম’
৬. মহম্মদ কাজিম রচিত ‘আলমগির নামা’ এবং
৭. কাফি খাঁ রচিত ‘মুস্তাখাবুল লুবাব’
বর্তমান ইতিহাস মতে, শাজাহানের জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো তাজমহল নির্মান, কিন্তু অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় হলো শাজাহানের প্রায় সমসাময়িক এই সব বেতনভোগী মুসলিম ইতিহাস রচয়িতাদের মধ্যে শুধু আবদুল হামিদ লাহোরী রচিত ‘বাদশানামা’ ছাড়া তাজের ব্যাপারে আর কারো কোনো গ্রন্থে তাজের ব্যাপারে কিছু উল্লেখই নেই। বিষয়টি কি মানানসই ? আর বাদশানামায় তাজের ব্যাপারে কী কী বলা আছে, এই পোস্টের মধ্যে প্রসঙ্গক্রমে সেগুলোএকটা একটা করে জানতে পারবেন।
এবার দেখুন তাজ নির্মানের জন্য খরচের ব্যাপারে কে কী বলছে ?
– বাদশানামায় আবদুল হামিদল লাহোরী বলছে, তাজের জন্য খরচ হয়েছে ৪০ লক্ষ টাকা। পরবর্তীতে শ্রী রমেশচন্দ্র মজমুদার এবং অতুলচন্দ্র রায় এই সত্যের কাছাকাছি থাকার জন্য বলেছেন ৫০ লক্ষ টাকা। কিন্তু তাজের মতো এত সুন্দর ও বিশাল একটি অট্টালিকা যে এত কম টাকায় নির্মান করা সম্ভব নয় এটা বুঝতে পেরে বিক্রীত ইতিহাস রচয়িতারা এর নির্মান ব্যয় বাড়াতে শুরু করে, এ ব্যাপারে মহম্মদ দীন নামে একজন বলে ১ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা; গাইড টু তাজে বলা আছে ১ কোটি ৮৪ লক্ষ ৬৫ হাজার টাকা; তাবার্নিয়ে বলেছে ৩ কোটি, এই তাবার্নিয়েই ২২ বছর সময়ের প্রবক্তা; যা হোক, তাজমহল যদি সত্যই শাজহান নির্মান করতো, তাহলে মমতাজের মৃত্যুর পর থেকে সেই প্ল্যান করলেও ১৬৩২/৩৩ সালের আগে তা নির্মান শুরু সম্ভব হতো না এবং তখন থেকে ২২ বছর লাগলে নির্মান শেষ হতো ১৬৫৫ সালে, কিন্তু ১৬৫০ সালে থেভেনট নামে এক ফরাসী পর্যটক তাজমহল দেখে বর্ণনা করে গেছেন, ‘তাজ ভারতীয় ভারতীয়দের সূক্ষ্ম শিল্পনৈপূন্যের এক উজ্জ্বল নিদর্শন’।
এর মানে নির্মান শেষ হওয়ার আগে থেকেই তাজ তার জায়গায় দাঁড়িয়েছিলো। এটা কিভাবে সম্ভব ? সম্ভব এভাবেই যে, তাজ শাজাহান বানায় ই নি।
যা হোক, ‘কানোয়ারলাল’ বলেছে তাজের নির্মান ব্যয় ৪ কোটি ১৮ লক্ষ ৪৮ হাজার ৮২৬ টাকা; টাকার হিসেবে যেমন পয়সা উল্লেখ করা যায়, তেমনি কোটির হিসেবে লক্ষ বা খুব বেশি হলে হাজার উল্লেখ করা যায়, কিন্তু এই ‘কানোয়ার লাল’ ৮২৬ টাকা পর্যন্ত উল্লেখ করেছে এই ভাবনা থেকে যে সূক্ষ্ম হিসেব ধরে নিয়ে তার তথ্যটাই যেন মানুষ বিশ্বাস করে। যা হোক এর পর ‘কীনস’ বলেছে তাজের নির্মানের পিছে ব্যয় হয়েছে ৯ কোটি ১৭ লক্ষ টাকা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাজের নির্মানের ব্যয় হিসেবে এত মুনির এত মত কেনো ? সত্য তো একটাই হয়। এতগুলো তো আর সত্য নয়। তাহলে তাজের নির্মান ব্যয়ের পেছনে প্রকৃত সত্যটা কী ? প্রকৃত সত্য হিসেবে আমাদেরকে সেটাই ধরে নিতে হবে, তাজ সম্পর্কে যার গ্রন্থে কিছু তথ্যের উল্লেখ আছে, সেই আব্দুল হামিদ লাহোরীর তথ্যকে, যিনি বলেছেন ৪০ লক্ষ টাকার কথা। কিন্তু তাজের মতো একটি বিশাল ও সৌন্দর্যময় অট্টালিকা কী মাত্র ৪০ লক্ষ টাকায় নির্মান করা সম্ভব ?একটু পরে পাবেন এই প্রশ্নের উত্তর।
এখন দেখুন আবদুল হামিদ লাহোরীর ‘বাদশানামা’য় তাজমহল সম্পর্কে কী লিখা আছে। বাদশনামা ফার্সি ভাষায় লিখা; এই গ্রন্থের ৪০৩ নং পৃষ্ঠায় ২১ নং পঙক্তি থেকে ৪১ নং পঙক্তি পর্যন্ত যা লিখা আছে তার বাংলা অনুবাদ এরকম :
২১.শুক্রবার, ১৫ জমাদিয়াল আউয়াল, পরপারের যাত্রী পবিত্রা হজরত মমতাজ উল জামানির সেই পবিত্র মৃতদেহ,
২২. যা অস্থায়ীভাবে কবরস্থ করা হয়েছিলো, তা
২৩. যুবরাজ শাহ সুজা বাহাদুর, ওয়াজির খাঁ এবং সতিউন্নেসা খানম, যারা
২৪. মৃতের মন মেজাজের ব্যাপারে খুবই ওয়াকিবহাল ছিলো,
২৫. এবং রানীদের রানীর মনোভাব বুঝতো এবং তার কার্যাবলীর সঙ্গে পরিচিত ছিলো,
২৬. তাদের সাহায্যে রাজধানী আগ্রায় আনা হলো
২৭. শহরের দক্ষিনে যেখানে সবুজ ঘাসে ঢাকা বিশাল উদ্যান,
২৮. যার মাঝখানে সেই বিশাল ইমারত, যা পূর্বে রাজা মানসিংহের সম্পত্তি ছিলো এবং
২৯. যার বর্তমান মালিক তাঁর পৌত্র রাজা জয়সিংহ,
৩০. সেখানেই বেহেশতবাসী রানীকে কবরস্থ করা হবে বলে স্থির করা হয়েছিলো,
৩১. যদিও রাজা জয়সিংহ পূর্বপুরুষের সেই সম্পত্তিকে অতিশয় মূল্যবান বলে মনে করতেন, তথাপি সম্রাট শাজাহানকে তা ছেড়ে দিতে রাজী হন।
৩২. কিন্তু ধর্মীয় নিয়ম ও মৃতের প্রতি মর্যাদার কথা চিন্তা করে সম্রাট সেই প্রাসাদ বিনা পয়সায় নেওয়া যুক্তিযুক্ত হবে না বিবেচনা করে শরীফাবাদ নামক স্থান তাকে দিলেন।
৩৩. কাজেই সেই বিশাল প্রাসাদ এর বদলে জয়সিংহকে সরকারী জমি দেওয়া হলো।
৩৪. ১৫ জমাদিয়াল আউয়াল, শবদেহ আগ্রায় পৌঁছবার পর
৩৫. সেই শোভন শবদেহকে চির বিশ্রামে শায়িত করা হলো……
৪১. সেই প্রাসাদ নির্মানে ৪০ লক্ষ টাকা খরচ করা হলো।
অর্থাৎ, এই ৪০ লক্ষ টাকা আসলে জয়সিংহের কাছ থেকে যে প্রাসাদ নেওয়া হয়েছিলো, সেটাকে একটা ইসলামিক কবরখানায় রুপান্তরিত করতে সংস্কারের জন্য ব্যয় করা হয়েছিলো।
এখন দেখা যাক রাজা জয় সিংহ বা তার পূর্ব পুরুষের হাতে এই বিশাল অট্টালিকা এলো কিভাবে ?
আগ্রা শহরের একটি জয়গার নাম বটেশ্বর, এটি আগ্রা থেকে ৪ কি.মি দূরে অবস্থিত। ১৯০০ সালে, ঐ বটেশ্বরের একটা ঢিবি খুঁড়ে ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের প্রথম অধিকর্তা জেনারেল ক্যানিংহাম একটা শিলালিপি আবিষ্কার করেন, যা বটেশ্বর শিলালিপি নামে পরিচিত। এই শিলালিপিটি বর্তমানে লখনৌ এর সরকারী সংগ্রহশালায় রাখা আছে। এই বটেশ্বর শিলালিপিটি সংস্কৃত ভাষায় লিখা এবং এতে মোট ৩৪টি শ্লোক আছে। এর মধ্যে ২৫, ২৬ এবং ৩৪ নং শ্লোকের বাংলা অর্থ হলো-
২৫. তিনি একটি সৌধ নির্মান করেছেন, যার মধ্যে ভগবান বিষ্ণু অধিষ্ঠান করছেন, রাজা মাথা নত করে তার চরণ স্পর্শ করেন।
২৬.রাজা মর্মর পাথরে আরও একটি মন্দির নির্মান করেছেন এবং সেখানে সেই দেব অধিষ্ঠান করছেন, যার কপালে শোভা পাচ্ছে চন্দ্র। যিনি এই সুরম্য মন্দিরকে বাসস্থান হিসেবে পেয়ে কৈলাসে ফিরে যাওয়ার বাসনা ত্যাগ করেছেন।
৩৪. এই শিলালিপিটি আজ বিক্রম সংবতের ১২১২ সালের আশ্বিন মাসে, রবিবার শুক্ল পঞ্চমীর দিনে স্থাপন করা হলো।
বিক্রম সংবত ১২১২ মানে ১১৫৬ খ্রিষ্টাব্দ, যা খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ শতক। এই সময়ের রাজা ছিলেন চান্দেল রাজ পরমার্দিদেব, যার অন্য নাম ছিলো পরমাল। চান্দেলদের রাজ্যের নাম ছিলো বুন্দেলখণ্ড, যা বর্তমানে ভারতের উত্তর প্রদেশে অবস্থিত ছিলো। এই শিলালিপি অনুযায়ী রাজা চান্দেলদেব বিষ্ণু এবং শিবের জন্য শ্বেত পাথরের দুটো মন্দির নির্মান করেছিলেন, সম্ভবত নানা উত্থান পতনের মধ্যে দিয়ে এই দুটি মন্দির আকবরের সময়ে রাজা মানসিংহের হাতে আসে, মানসিংহ যেহেতু নিজের বোনকে আকবরের সাথে বিয়ে দিয়ে আকবরের বশ্যতা স্বীকার করেছিলো, সেহেতু আকবর, জাহাঙ্গীরের সময় পর্যন্ত হয়তো সেই মন্দিরগুলো হয়তো অক্ষত ছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে সেই মন্দির দুটি গেলো কোথায় ?
বর্তমানে আগ্রা শহরে শ্বেতপাথরের মাত্র দুটি ই ইমারত আছে, একটি তাজমহল এবং অপরটি নূরজাহানের পিতা ইদমত-উদ-দৌলার সমাধি। এ থেকে স্পষ্ট যে, শিব মন্দিরটিকে তাজমহল এবং বিষ্ণু মন্দিরটিকে নূরজাহানের বাবার সমাধি বানানো হয়েছে।
শিব মন্দিরটিই যে তাজমহল, এখুন দেখুন তার আকৃতিগত ও প্রত্নতাত্ত্বিকগত কিছু প্রমান :
১. তাজমহলের প্রধান গম্বুজের শীর্ষদেশে রয়েছে ত্রিশুল যা অভ্রান্তভাবে মহাদেবের অস্ত্র বা প্রতীক।
২. বটেশ্বর শিলালিপিতে বলা হয়েছে, এই মন্দিরকে বাসস্থান হিসেবে পেয়ে মহাদেব শিব কৈলাসে ফিরে যাওয়ার বাসনা ত্যাগ করেছেন, একমাত্র তাজমহলের সৌন্দর্যের সাথেই শিলালিপিতে বর্ণিত ঐ মন্দিরের সৌন্দর্য মিলে।
৩. তাজমহলের দুটি তলায় কবর রয়েছে, উপরের তলায় নকল কবর, নিচের তলায় আসল কবর। দুই তলায় কবর বিশিষ্ট কোনো কবরস্থান ইসলামের ইতিহাসে আর দ্বিতীয়টি নেই, কিন্তু দুই তলায় শিবলিঙ্গ বিশিষ্ট শিব মন্দির ভারতের নানা জায়গায় আছে।
৪. ইসলামিক কবরখানায় কেউ কবরকে প্রদক্ষিণ করে না, কিন্তু তাজের কবর প্রদক্ষিণ করার ব্যবস্থা আছে, এ থেকে স্পষ্ট যে, ভক্তরা এককালে সেই পথে শিবলিঙ্গকে প্রদক্ষিণ করতো।
৫. তাজমহলের প্রধান গম্বুজের ছাদ থেকে ঝুলছে একটি শিকল, কবরখানার সঙ্গে যার কোনো সম্পর্ক নেই। এক সময় সেই শিকলের সঙ্গে ঝোলানো ছিলো একটি মঙ্গলঘট, যার থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল শিবলিঙ্গের মাথায় পড়তো, এখনও বৃষ্টি হলে সেই বৃষ্টির জল কবরের উপর পড়ে। আসলে এটা শিবলিঙ্গের উপর জল পড়ার স্মৃতিমাত্র।
৬. ‘জ্যঁ বাপতিস্ট তাভার্নিয়ে’ ভারত ভ্রমন করে গিয়ে এ সম্পর্কে একটি বই লিখেন যা লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয় ১৮৮৯ সালে, সেই বই’য়ে তিনি লিখেছন, তাজ পরিসরের মধ্যে বাজার বসতো। একমাত্র হিন্দু মন্দিরের মধ্যেই বাজার বসে এবং যেখানে ফুল, ফল, প্রসাদের উপকরণসহ আরও নানা জিনিসের বেচাকেনা হয়, কোনো মুসলিম কবরখানায় কোনোদিন বাজার বসে না।
৭. তাজমহলে স্থাপিত শিবলিঙ্গের নাম ছিলো তেজোলিঙ্গ, এই নাম থেকেই তাজমহলের পূর্বনাম ছিলো তেজোমহালয়। তেজোমহালয়ে স্থাপিত মহাদেব শিবের আরেকটি নাম ছিলো অগ্রেশ্বর মহাদেব, যার থেকেই উৎপত্তি হয় আগ্রা নামের।
৮. যার কবরকে নিয়ে এত কথা ও কাহিনী, শাজাহানের সেই স্ত্রীর নাম প্রকৃত নাম ছিলো ‘আরজুমান্দ বানু’ যাকে ‘মমতাজ উল জামানি’ বলেও ডাকা হতো। এখন প্রশ্ন হচ্ছে মমতাজের নামে সমাধি বানানো হলো, অথচ তার নাম ‘মমতাজমহল’ না হয়ে বা নাম থেকে ‘মম’ বাদ দিয়েশুধু ‘তাজমহল’ হবে কেনো ? প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে, এর পূর্ব নাম ‘তেজোমহালয়’ এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে এর নাম করণ করা হয়েছে তাজমহল। যদিও এর কোনো প্রয়োজন ছিলো না, কিন্তু ঐ যে খুনিরা যেমন খুনের প্রমান রেখে যায়, এই ব্যাপারটিও ঠিক তেমন।
৯. তাজমহলের প্রধান ফটকের উপর রয়েছে একটা স্থান, বর্তমানে যার নাম দেওয়া হয়েছে নহবত খানা; এককালে সেখান থেকে নাকি সকাল সন্ধ্যা সানাই বাজানো হতো; আসলে সেখান থেকে এক সময় পূজা উপলক্ষে ঢাক ঢোল বাজানো হতো । নিস্তব্ধতায় কবরখানার বৈশিষ্ট্য, সেখানে এরকম সানাই বাজানোর স্থান বড়ই বেমানান। কিন্তু আগে থেকেই যেহেতু আছে এবং সেটাকে আর ভেঙ্গেও ফেলা যাচ্ছে না, তাই ঢাক ঢোল বাজানোর স্থানকে নহবতখানা নাম দিয়ে প্রকৃতসত্যকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে মাত্র।
১০. তাজের বিশাল কমপ্লেক্স জুড়ে রয়েছে নানা বাড়িঘর দালান কোঠা। যা একটি মুসলিম কবরখানার জন্য অপ্রয়োজনীয় ও বেমানান। বরং অতিথিশালা, গোশালা, ভাণ্ডারঘর, রন্ধনশালা, ঠাকুরের ঘর, চাকর ও রক্ষীদের থাকার ঘর এবং অফিস ঘর ইত্যাদি …. একটা মন্দিরের জন্যেই এসব দরকার এবং যা এখনও আছে ভারতের বিভিন্ন মন্দিরে, কিন্তু যা নেই কোনো ইসলামিক কবরখানায়।
১১. তাজমহলের নিচতলার ঘরগুলোকে স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কারণটা কী ?
নেহেরু সরকারে সময়ে একবার তাজমহলে ফাটল দেখা দেয়। সেইসময় প্রত্নতত্ত্ববিদ শ্রী এস.আর.রাও আগ্রার আর্কিওলজিক্যাল সুপারিটেনডেন্ট ছিলেন। তার নেতৃত্বে একটি দল তাজের ফাটল পরীক্ষা করার জন্য একটু দেওয়াল খুঁড়তেই দেওয়ালে আঁকানো বিভিন্ন হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তি বেরিয়ে পড়ে, যেটা বিভিন্ন মন্দিরের গায়ে অঙ্কিত একটি সাধারণ চিত্র। সেই সময় নেহেরুর নির্দেশে ঘটনাটা দ্রুত চাপা দেওয়ার জন্য একেবারে নিচতলায় যাবার রাস্তা ই স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়, সেই থেকেই নিচতলার যাওয়ার রাস্তা বন্ধ।
১২. তাজমহল এবং শাজাহানের পক্ষে সাফাই প্রদানকারী ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন তাজমহলের বাগানের নকশা করেছিলেন ‘রনমল’ নামে কাশ্মিরের এক লোক। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আন্তর্জাতিক টেন্ডার ডেকে যে তাজের নকশা অনুমোদন করা হয় সেই তাজের বাগানের নকশা, কাশ্মিরের কোনো হিন্দুকে দিয়ে করাতে হবে কেনো ? নাকি মিথ্যার আড়ালে সত্যের ইঙ্গিত এভাবেই মাঝে মাঝে প্রকাশ পায়।
১৩. ১৯৭৩ সালে, যখন নেহেরু আর নেই, আমেরিকার নিউইয়র্কের প্র্যাট স্কুলের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের এক অধ্যাপক ‘মারভিন মিলস’ আগ্রায় তাজ পরীক্ষা করতে আসে এবং তাজের কোনো এক কাঠের দরজার সামান্য নমুনা সংগ্রহ করে আগ্রায় নিয়ে যায়। আমেরিকার ব্রুকলিন কলেজের রেডিও কার্বন ল্যাবরেটরির অধ্যক্ষ ড. ইভান উইলিয়ামস এর তত্ত্বাবধানে ঐ কাঠের নমুনাটির ‘কার্বন-১৪’ পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায়, সেটা ১৩২০ থেকে ১৪০০ সালের মধ্যে কোনো এক সময়ের তৈরি। যেটা শাজহানের সময় থেকে প্রায় ৩০০ বছর আগের। এখন এটা অসম্ভব কিছু নয় যে, দ্বাদশ শতকে তৈরি করা শিব মন্দির তেজোমহালয়ের কোনো দরজা বা জানালার সংস্কার দেড়শ দুশো বছর করা হয় নি ? কিন্তু এই পরীক্ষা থেকে এটা তো প্রমানিত যে, শাজহানের অনেক আগে থেকেই তাজমহল বলে যাকে চালানো হচ্ছে, তা পৃথিবীতে ছিলো ।
মমতাজমহল ওরফে আরজুমান্দ বানু ছাড়া শাজহানের আরো অনেক নিকা করা বিবি ছিলো। তাজমহলের চত্বরের মধ্যেই আরো দুজন নিকা করা বিবি কবর আছে। এরা হলো সতিউন্নেসা খানম ও সরহন্দি বেগম। এছাড়া আরজুমান্দ বানুর এক খাস পরিচারিকার কবরও তাজের মধ্যে আছে। এখানে উল্লেখ্য যে এই তিনজনের কবর প্রায় হুবহু একই রকম। এখন প্রশ্ন হলো, একই সমাধি সৌধের মধ্যে প্রধান বেগমের সাথে অপ্রধান বেগম এবং তার দাসীকে কবর দিয়ে শাজাহান কি মমতাজের সম্মান বাড়িয়েছে, না কমিয়েছে ? আসলে শাজাহান, কোনো একটা উছিলায়, জয়সিংহের এই মন্দিরটিকে দখল করবে ব’লে, মমতাজের মৃত্যু উপলক্ষে দখল করেছিলো এবং পরে তাকে পারিবারিক কবরস্থান বানিয়েছে, প্রেম ট্রেম কিচ্ছু নয়, মমতাজের প্রতি এত প্রেম থাকলে মমতাজের মৃত্যুর পরই শাজহান মমতাজের ছোট বোনকে বিয়ে করতে পারতো না।
এসব ই হচ্ছে ইতিহাসের কচকচানি। কিন্তু এই কচকচানির প্রয়োজন এখন এজন্যই যে, মুসলিম শক্তির কাছে পরাজিত হয়ে হিন্দুরা যেমন শুধু তেজোমহালয়ই নয়, অনেক কিছু হারিয়েছে, তেমনি ভারতে বর্তমান মুসলিম সেন্টিমেন্টকে মূল্য দিতে গিয়ে ভারতের সেকুলার সরকারগুলো প্রকৃত সত্যকে চাপা দিয়ে মিথ্যা ইতিহাস প্রচার করেছে এবং এখনও করছে। কিন্তু প্রকৃত সত্য তো বের হবেই, আজ বা কাল;..
সেই সত্য আজ বের হয়েছে। কিন্তু এই সত্য জানাটাই শেষ কথা নয়। মুসলিম শক্তির কাছে পরাজিত হয়ে হিন্দুরা তেজোমহালয় হারিয়েছে, দীর্ঘদিন সেই সত্যাটা পর্যন্ত তারা জানতে পারে নি, এখনও সর্বস্তরের হিন্দু সেই কথা জানে না; এখন দরকার সর্বস্তরের হিন্দুকে সেই প্রকৃত সত্য জানানো এবং তাজমহলকে পুনরায় তেজোমহালয়ে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করা।
এখানে আর একটি রূঢ় বাস্তব কথা প্রত্যেক হিন্দুর মনে রাখা দরকার যে, এত সুন্দর মন্দির পেয়ে কৈলাসে ফিরে যাবার ইচ্ছা ত্যাগ করেছেন বলে মহাদেব সম্পর্কে কল্পনা করে যে শিলালিপি লিখা হয়েছিলো, সেই মন্দির রক্ষার জন্য মহাদেব কিন্তু কোনো ভূমিকা রাখেন নি, আর ভবিষ্যতেও কখনো রাখবেনও না। মহাদেবের যদি কিছু করার ক্ষমতা থাকতো তাহলে তার সোমনাথ মন্দির ১৭ বার সুলতান মাহমুদের হাতে লুন্ঠিত হতো না। মহাদেব শিব কোনো হিন্দু’র জন্যী কিছু করবেন না, যা করার করতে হবে নিজেকেই; কারণ, পৃথিবীতে মানুষের শক্তিই শেষ কথা। কিন্তু শিবের মূর্তির মধ্যেই বলা আছে কোথায় আছে সেই শক্তি, আর কিভাবে তার ব্যবহার করতে হবে। শিবের সকল শক্তি নিহিত আছে তার ত্রিশুলের মধ্যে, যখন তা কোনো শিবভক্তের হাতে উঠে আসে।
এই ত্রিশুল শিবভক্তরা হাতে তুলে নেয় নি বলেই হিন্দুরা বার বার পরাজিত হয়েছে, বার বার মার খেয়েছে এবং এখনও খাচ্ছে এবং ততদিন খাবে যতদিন না শিবের অস্ত্র ত্রিশুলকে নিজের হাতে তুলে না নেবে।
( সৌজন্যেঃ শ্রী Uttam Kumar Das …. )