হিন্দু জাতি কেন হাজার বছর পরাধীন থেকে বিদেশীদের গোলামী করেছে? কারন অনেক।কিছু কারন এমন আহম্মকি, যা আমাকে অবাক করেছে। ক্ষত্রিয় রাজশক্তির মনোনীত যুবরাজকে জীবিত রেখে, বাকী রাজকুমারদের হত্যা করতো―যাতে তারা ভবিষ্যতে পৈত্রিক রাজ্যের ভাগ দাবী করে মনোনীত রাজকুমারকে উত্যক্ত না করে।সাধারণ ক্ষত্রিয়দের মধ্য থেকে কোন সেনানায়ক উঠে এসে যদি রাজ্য কেড়ে নেয়, এই আশঙ্কায় ক্ষত্রিয় রাজারা সাধারন ক্ষত্রিয় পরিবারের প্রতিভাবান বালকদের হত্যা করতো।যার ফলে সম্ভাব্য উপযুক্ত সেনানায়কদের সেবা থেকে জাতি বঞ্চিত হয়েছে।
পবিত্র গ্রন্থ বেদে আছে,জনগন যোগ্যতার ভিত্তিতে তাদের শাসক নির্বাচিত করবে।―যা ছিল পৃথিবীর প্রাচীনতম গনতন্ত্র।কিন্তু ক্ষত্রিয় রাজশক্তি তাদের বংশানুক্রমিক শাসন বজায় রাখতে ব্রাহ্মণদের বাধ্য করে-ধর্ম শাস্ত্রের বিকৃত ব্যখ্যা করতে যে,রাজার ছেলেই রাজা হবে।ক্ষত্রিয় রাজারা নিজেদের অনৈতিক বংশানুক্রমিক রাষ্ট্র ক্ষমতা উপভোগ সিদ্ধ করতে,ব্রাহ্মণ ও বৈশ্যদের সুযোগ দেয় বংশানুক্রমিক পেশা নির্ভর জীবন ধারনের।এখান থেকেই জন্ম অনুযায়ী বর্ন প্রথার উৎপত্তি―যা ধর্মে নাই।শাস্ত্রে আছে গুন ও যোগ্যতা অনুযায়ী বর্ন।বঞ্চিত হয় শূদ্ররা।অন্যান্য বর্নের মানুষ কমবেশী সুবিধা পায়।তবে রাষ্ট্রশক্তি যার হাতে সেই ক্ষত্রিয়ের সুযোগ সুবিধা ভোগ বিলাসের ধারে কাছেও কেউ যেতে পারে নি। তা ছাড়া রাজার ইচ্ছায় রাষ্ট্রের সব কিছু হয়―এক কথায় রাজার ইচ্ছাই ঈশ্বরের বিধান হয়ে যায়। বিদ্রোহ প্রতিরোধের আগাম প্রস্তুতি হিসেবে, প্রজাদের শরীর ও মগজ দুর্বল রাখতে-মাছ মাংস পিঁয়াজ রসুন প্রভৃতি খাবার গ্রহনে সাধারন মানুষদের নিরুৎসাহিত করা হয়। মাছ মাংস না খাওয়ার কারনে দুর্বলদেহী হিন্দুরা,বিদেশী মাংসাশী বলবান আক্রমণকারীদের সাথে যুদ্ধে বার বার পরাজিত হয়েছে।
এতো কিছুর পরেও ক্ষত্রিয় রাজশক্তি সবসময় ক্ষমতা ধরে রাখতে পারে নি।বিচ্ছিন্ন ও ব্যর্থ শূদ্র বিদ্রোহ হ’তে থাকে।অলৌকিক ও অচিন্তনীয় জ্ঞানসম্পন্ন একজন ব্রাহ্মণ অধ্যাপক ও রাষ্ট্র বিজ্ঞানী বিষ্ণুগুপ্ত চানক্য,নয় বছর বয়সী একজন শূদ্র জারজ ক্রিতদাসের মধ্যে অপরিমিত সুপ্ত প্রতিভা দেখে মুগ্ধ হয়ে- তাকে খরিদ করে ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাম দান করেন এবং তাকে উপযুক্ত ভাবে প্রশিক্ষিত করে তার মাধ্যমে অখন্ড ভারত প্রতিষ্ঠা করেন।প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে চানক্য বলেছেন,ভারত যদি অখণ্ড না থাকে, তাহলে ভারতবাসীর ভাগ্যে দাসত্ব ও সীমাহীন লাঞ্ছনা অবধারিত।
অখণ্ড ভারতের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম সম্রাট ‘শূদ্র চন্দ্রগুপ্ত’ তার ভাগ্য বিধাতা ও মহামান্য গুরু চানক্যের অনুমতি নিয়ে, সনাতন ধর্ম ত্যাগ করে জৈন ধর্ম গ্রহণ করেন। চন্দ্রগুপ্তের নাতি অশোক- যিনি মাতার ভাগ্য দোষে রাজপুত্র হয়েও সাধারণ পথশিশুর মতো বড় হচ্ছিলেন,বৃদ্ধ চানক্য অশোকের মধ্যে চন্দ্রগুপ্তের প্রতিভার ছায়া দেখে, তাকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে উপযুক্ত ভাবে গড়ে তোলেন।সম্রাট অশোক জৈন ধর্ম ত্যাগ করে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করলে উত্তর ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব অত্যন্ত বেড়ে যায়।সনাতন ধর্ম কোনঠাসা হয়ে পড়ে।ব্রাহ্মণ সেনাপতি পুষ্যমিত্র সুঙ্গা বিদ্রোহ করে বৌদ্ধ শাসকদের উচ্ছেদ করলেও, তার মৃত্যুর পর বৌদ্ধ রাজারা ধীরে ধীরে তাদের হারানো জামি উদ্ধার করতে সমর্থ হ’ন।
আজ ভারতে যে সনাতন হিন্দুদের সংখ্যাধিক্য,এটা শূদ্রদের অবদান।চতুর্থ শতকের গোড়ার দিকে শ্রীগুপ্ত নামক একজন শূদ্র জেনারেল রাজত্ব স্থাপন করে নিজেকে ক্ষত্রিয় ঘোষণা করেন।এই গুপ্ত বংশের দুই শতাধিক বছরের শাসনামলকে বলা হয় ভারতের স্বর্ণযুগ।বিক্রমাদিত্য এই বংশের এবং ভারতের শ্রেষ্ঠ সম্রাট।গুপ্ত যুগে জ্ঞান-বিজ্ঞান-শিল্প-সহিত্যের ব্যাপক উন্নতি ঘটলেও শূদ্রদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন ঘটে নি।অভিজাত বৌদ্ধদের সনাতন ধর্মে ফিরিয়ে এনে স্থান দিতে, ব্রাহ্মণদের কাছাকাছি ‘কায়স্থ’―নামক একটা শ্রেনী তৈরি করা হয়।সনাতন ধর্মে ফিরে আসা সাধারণ দরিদ্র বৌদ্ধদের স্থান দেওয়া হয়, নমঃশূদ্র( ব্রাহ্মণ+শূদ্র) নামক প্রান্তিক স্তরে।
পরবর্তী সময়ে অল্প বয়সী ও অকালপ্রয়াত দক্ষিণ ভারতীয় ব্রাহ্মণ পন্ডিত শঙ্করাচার্য্য ভক্তিবাদী ধর্মের উত্থান ঘটিয়ে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব প্রতিপত্তি অস্তমিত করেন।এরই ধারাবাহিকতায় শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু নামক বঙ্গ দেশীয় একজন ব্রাহ্মণ পন্ডিত ভক্তিবাদী ধর্মের সংস্কার ও বিকাশ সাধন করে, জাতিভেদ প্রথার চরম অন্যায় ও অধর্মের বিরুদ্ধে বঙ্গভূমিতে এক নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেন।দুঃখের বিষয় হলেও সত্যি, এই ভক্তিবাদী ধর্মের প্রভাবে মাছ-মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়ে দুর্বল হয়ে যাওয়া হিন্দু রাজন্যবর্গ, যুদ্ধ-বিমুখ হয়ে যাওয়ার কারনে তুর্কি দখলদারদের অবাধ লুন্ঠন ও সাম্রাজ্য বিস্তারে যথেষ্ট সুবিধা হয়।