- চন্দ্রাবতী (জন্ম: ১৫৫০ – মৃত্যু: ১৬০০) বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম বাঙালি মহিলা কবি৷[১]
জন্ম ও পরিবার
তার পিতা মনসা মঙ্গল কাব্যের অন্যতম রচয়িতা দ্বিজ বংশী দাস
এবং মাতার নাম সুলোচনা৷ তাঁর জন্ম ষোড়শ শতাব্দীতে ৷ নিবাস অধুনা
বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার পাটোয়ারী গ্রামে৷ জীবনকাল ষোড়শ শতাব্দী।সাহিত্যকর্ম
মৈমনসিংহ গীতিকায় তার কথা পাওয়া যায়৷ তাঁর নিজের জীবনের ট্র্যাজেডি নিয়ে রচিত লোকগাঁথা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অবিভক্ত ময়মনসিংহ জেলার মানুষের মুখে মুখে ফিরে এসেছে৷ চন্দ্রাবতীর রচিত কাব্য হলও;
- মলুয়া,
- দস্যু কেনারামের পালা,
- রামায়ণ।
ড. দীনেশচন্দ্র সেন
১৯৩২ সালে চন্দ্রাবতীর রামায়ণ প্রকাশ করেন। লৌকিক মানবিক ও কিছু মৌলিক
উপাদান সংযোগের ফলে এই রামায়ণ কাব্যটি বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে।[২]চন্দ্রাবতীর লোকগাঁথা
বাল্যকালে
চন্দ্রাবতীর বন্ধু ও খেলার সাথী ছিলেন জয়ানন্দ নামের এক অনাথ বালক৷
জয়ানন্দের নিবাস সুন্ধা গ্রামে৷ জয়ানন্দ তাঁর মাতুলগৃহে পালিত৷ দ্বিজ
বংশীদাসের অনেক রচনায় এই দুজনার রচিত ছোট ছোট অনেক পদ রয়েছে৷ কৈশোর
উত্তীর্ন হলে দুজনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবেন বলে স্থির করেন ৷ বিবাহের দিনও
স্থির হয়৷ ইতোমধ্যে জয়ানন্দ অন্য এক রমনীর প্রেমে পড়ে যান৷ স্থানীয়
মুসলমান শাসনকর্তা বা কাজীর মেয়ে আসমানীর অসামান্য রূপে মুগ্ধ হয়ে
জয়ানন্দ আসমানীকে একাধিক প্রেমপত্র লেখেন৷ এই ত্রিকোন প্রেমের ফলাফল হয়
মারাত্মক৷ জয়ানন্দের সাথে চন্দ্রাবতীর প্রেমের কথা জেনেও আসমানী তার
পিতাকে জানান তিনি জয়ানন্দকে বিবাহ করতে চান৷ কাজী জয়ানন্দকে বলপূর্ববক
ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করে আসমানীর সঙ্গে তার বিবাহ দেন৷ ঘটনাটি ঘটে
যেদিন জয়ানন্দ ও চন্দ্রাবতীর বিবাহের দিন স্থির হয়েছিল সেই দিন৷ সেদিন
সন্ধ্যাবেলা চন্দ্রাবতী বিবাহের সাজে পিত্রালয়ে বসে ছিলেন৷ তখনই সংবাদ
পেলেন জয়ানন্দ ধর্মান্তরিত হয়ে অনত্র্য বিবাহ করেছেন৷এরপর শুরু হয় চন্দ্রাবতীর বিরহ বিধুর জীবন৷ তিনি পিতার কাছে অনুমতি নেন
যে সারা জীবন অবিবাহিত থেকে তিনি শিবের সাধনা করবেন ৷ তাঁর পিতা তার জন্য
একটি শিবের মন্দির নির্মান করিয়ে দেন৷ সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ চন্দ্রাবতীর
কৈশোরকাল থেকেই ছিল ৷ তিনি বাকী জীবন শিবের উপাসনা ও সাহিত্যচর্চা করে
কাটাবেন বলে স্থির করেন৷ ইতোমধ্যে বেশ কিছুকাল পরে জয়ানন্দ বুঝতে পারেন
যে, আসমানীর প্রতি তার টানটা ছিল মোহ মাত্র ৷ মনের থেকে তিনি চন্দ্রাবতীকেই
প্রকৃত ভালবাসেন৷ জয়ানন্দ স্থির করেন যে চন্দ্রাবতীকে তাঁর মনের কথা
জানাবেন৷ আবার অনেক গবেষকের মতে জয়ানন্দ এসেছিলেন চন্দ্রাবতীর কাছে দীক্ষা
নেবার জন্য৷এক সন্ধ্যায় জয়ানন্দ ও চন্দ্রাবতীর বিচ্ছেদ হয়েছিল৷ অপর সন্ধ্যায়
সেই বিচ্ছেদ মুছে গিয়ে মিলন হবে দুজনার এই আশায় জয়ানন্দ রওনা দিলেন
পাটোয়ারী গ্রামে ৷ জয়ানন্দ যখন গন্তব্যস্থলে পৌঁছলেন তখন সূর্য্যাস্ত
হয়ে গেছে, তখন দিন ও বাত্রির সন্ধিক্ষন৷ শিব মন্দিরের ভেতর দ্বার রুদ্ধ
করে সন্ধ্যারতি ও তপজপে নিজেকে নিবদ্ধ করেছেন চন্দ্রাবতী৷ জয়ানন্দ
মন্দিরের দ্বারে এসে কয়েকবার ডাকলেন চন্দ্রাবতীকে৷ কিন্তু দ্বার রুদ্ধ
থাকায় এবং একাগ্রমনে ধ্যানে নিমগ্ন থাকায় সেই শব্দ প্রবেশ করল না
চন্দ্রাবতীর কানে৷ ব্যর্থ প্রেমিক জয়ানন্দ তখন লালবর্ণের সন্ধ্যামালতী ফুল
দিয়ে মন্দিরের দ্বারে চারছত্রের একটি পদে চন্দ্রাবতী ও ধরাধামকে
চিরবিদায় জানিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করেন৷অনেক পরে মন্দির থেকে বেরিয়ে চন্দ্রাবতী বুঝতে পারেন যে দেবালয় কলুসিত
হয়েছে৷ দ্বার পরিষ্কার করার জন্য তিনি কলসী কাঁধে জল আনতে যান
পার্শ্ববর্তী ফুলেশ্বরী (স্থানীয় নাম ফুলিয়া) নদীতে৷ ঘাটে পৌঁছেই
চন্দ্রাবতী বুঝলেন সব শেষ৷ ফুলেশ্বরীর জলে নিজেকে নিমগ্ন করে প্রাণত্যাগ
করেছেন জয়ানন্দ৷ প্রাণহীন দেহ ভাসছে ফুলেশ্বরীর জলে৷ এই অবস্থায় নিজের
আবেগ ধরে রাখতে পারলেন না চন্দ্রাবতী৷ তিনিও প্রেমিকের সাথে পরলোকে
চিরমিলনের কামনায় ফুলেশ্বরীর জলে ডুবে প্রাণত্যাগ করেন।জয়ানন্দের গ্রাম সুন্ধা খুঁজে পাওয়া যায়নি৷ তবে ইতিহাসের স্মৃতি
বিজড়িত পাটোয়ারী গ্রাম আজও আছে৷ কিশোরগঞ্জ শহর থেকে উত্তর পূর্ব্ব দিকে
মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে৷ আর আছে ফুলেশ্বরী নদীর ধাবে চন্দ্রাবতীর পূজিত
শিব মন্দির৷তথ্যসূত্র
- http://www.milansagar.com/kobi-maimansinghageetika.html
সেলিনা হোসেন ও নুরুল ইসলাম সম্পাদিত; বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান; ঢাকা, ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৭; পৃষ্ঠা-১৫৭।