#রমেশচন্দ্র মজুমদার
ভারত স্বাধীন হবার পর ভারত সরকারের পক্ষ থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার জন্য বিখ্যাত ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার 1948 এ সরকারের কাছে এক আবেদন জানান। সেই আবেদন মঞ্জুর হয় ও 1952 সালে এক কমিটি নিয়োগ করা হয় যার প্রধান হিসাবে ঐতিহাসিক মজুমদারকে নিযুক্ত করা হয়।
ঐতিহাসিক মজুমদার কে ছিলেন সেটা অন্য এক জায়গায় জানাবো। একটা সিরিজ লিখছি এই সব অজানা, কম জানা ভারত মাতার বাঙালি সন্তানদের নিয়ে।
কমিটি গঠনের পর থেকেই রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ শুরু হয়ে যায়। কমিটিতে রাজনীতির লোক ও তাদের অকারণ নাক গলানোতে ঐতিহাসিক মজুমদার বিরক্ত প্রকাশ করেন। কিন্তু হস্তক্ষেপ এত নির্লজ হতে থাকে যে বিরোধ শুরু হয় ঐতিহাসিক মজুমদার ও কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রকের। বিরোধিতা শুধু মতাদর্শগত বিরোধীতা না, ঐতিহাসিক তথ্য বিকৃত করার জন্য জেদাজেদি করতে থাকে তদানীন্তন কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রী মৌলানা আবুল কালাম আজাদ। অবশেষে ঐতিহাসিক মজুমদার কমিটি থেকে বেরিয়ে আসেন।
কেন্দ্রীয় সরকার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার জন্য একটি মাত্র ব্যক্তির উপর নির্ভর করলো। সে হলো কংগ্রেস অনুগত তেহরানে(1951-56) ভারতীয় রাষ্ট্রদূত তারাচাঁদ। অন্য ঐতিহাসিকদের কোনো আপত্তি মৌলানা আজাদ শোনেনি। সেই বই প্রকাশিত হলো 1967 সালে। মজার ব্যাপার হলো ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার এর বই আর তারাচাঁদ এর বই একি নামে প্রকাশিত হলো History of Freedom Movement. তারাচাঁদ এর বই তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক থেকে ছাপা হলেও প্রামাণিকতার দিক দিয়ে ঐতিহাসিক মজুমদার এর বই শুধু বই নয়, এক মহাকাব্য যেন। একক প্রচেষ্টায় নিরলস পরিশ্রমে 7 বছর ধরে 3 খণ্ডের এই বই লিখলেন। সেই যুগে আজকের মত প্রযুক্তি বা উৎস বিশেষ ছিল না। এক বাঙালি সন্তানের ভারত মাতাকে অনন্য নিরপেক্ষ উপহার। সরকারী স্বীকৃতি না পেলেও এই বইটির জন্য তিনি সারা জীবন অমর হয়ে থাকবেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এর থেকে প্রামাণ্য তথ্য এখনো অবধি নেই।
এবার দেখি কি নিয়ে এত আপত্তি ছিল ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার এর। উল্লেখযোগ্য মাত্র দুটো উল্লেখ করলাম মাত্র।
1. ঐতিহাসিক মজুমদার পরাধীন ভারতের ইতিহাস মুসলমান আক্রমণ থেকে শুরু হয় বলে অভিমত পোষণ করতেন। অর্থাৎ পৃথ্বীরাজ চৌহানের পরাজয়ের সাথে সাথে ভারত পরাধীন হয়। শিক্ষা মন্ত্রী মৌলানা আজাদ কিছুতেই এই তথ্য মেনে নেননি। তাঁর মতে ব্রিটিশ আমল হলো পরাধীন আমল। অবাক কাণ্ডই বটে। আরব তুর্কি বিদেশী আক্রমণকারী ছিল। সেক্ষেত্রে ভারতবাসী তো পরাধীন ছিল তাদের রাজত্বে। অন্য জাতির অধীন থাকাই তো পরাধীনতা। ভারতে তার আগে হাজার হাজার রাজবংশ থাকলেও তারা কিন্তু বহিরাগত ছিল না কেউ। না মৌলানা আজাদ শোনেননি সে কথা।
2. সিপাহী বিদ্রোহকে প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে দেখানোর জন্য খুব চাপ সৃষ্টি হয়। ঐতিহাসিক মজুমদার কিন্তু কিছুতেই মেনে নেননি। ঐতিহাসিক মজুমদার এর মত অনুযায়ী সিপাহী বিদ্রোহ চরিত্রগত ও গঠনগত দিক থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। সিপাহী বিদ্রোহ এক সেনা বিদ্রোহ ছিল যার কারণ ব্যক্তিগত ছিল। জাতিগত ব্যাপার আসেনি তখনো। আর আপামর জনগণ অংশগ্রহণ না করলে তা কখনোই স্বাধীনতা সংগ্রাম নয়। এখানে হিন্দু মুসলিম একতা দেখানোর জন্য জোর দেওয়া হয়। ঐতিহাসিক মজুমদার বারবার বলেছেন হিন্দু ও মুসলিম কখনো কোনো দিন ভারতবর্ষে শান্তিতে সহাবস্থান করেনি। চারিত্রিক ও প্রকৃতিগত পার্থক্য ছিল বরাবর। না শোনেনি কেউ।
ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার কমিটি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য যে সুদূরপ্রসারী ফল ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা ভোগ করেছে, তা এক কথায় অপরিসীম ক্ষতি। আমরা এমন এক হতভাগ্য জাতি যারা নিজেদের প্রকৃত ইতিহাস জানি না। বিকৃত, অসত্য, অর্ধসত্য, মিথ্যা জানানো হয়েছে হিন্দু মুসলিম একতা দেখাতে গিয়ে। শিক্ষায় রাজনীতি করণ, সব কমিটিতে রাজনীতির লোকেদের প্রাধান্য শুরু হয়। এরপর Indian Council of History Research পুরোপুরি বামপন্থী ঐতিহাসিকরা দখল করে নেয়। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস আসলে কংগ্রেসের ইতিহাস। অসংখ্য তথ্য প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও উল্লেখ করা হয়নি। প্রমাণ না থাকলেও সবাই মিলিত ভাবে এক সাথে লিখে বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করা হয়েছে। ইতিহাস এর মুখ বন্ধ করা হয়েছে তার গলা কেটে। আমাদের সাংবিধানিক অধিকার হনন হয়েছে। আমরা এক প্রতিবন্ধী জাতিতে পরিণত হয়েছি ঘৃণিত রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য। মিথ্যাচার ও দুর্নীতি গ্রাস করে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম শেষ হয়ে যাচ্ছে। প্রতিকার হয়নি। অথচ এই কংগ্রেস গলা ফাটায় এখন শিক্ষায় গৈরিকীকরণ হচ্ছে বলে। নিজেদের অপরাধ কেউ মনে রাখে না। অপরাধ বলে তো কোনো দিন স্বীকার করে না।