শচীন্দ্রনাথ বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করেন নাটক রচনায়। স্বাধীনতা লাভের
পূর্ব পর্যন্ত যারা ঐতিহাসিক,রাজনৈতিক ও সামাজিক রচনা করে খ্যাতিমান
হয়েছিলেন শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত তাদের মাঝে অন্যতম। তাঁর রচিত ঐতিহাসিক ও
রাজনৈতিক নাটকের মূল প্রতিপাদ্য দেশাত্মবোধ। তাঁর ঐতিহাসিক নাটক
সিরাজুদ্দৌলা সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯৪৬ সালে কলকাতার
রঙ্গমঞ্চে অভিনীত রাষ্ট্রবিপ্লব নাটকটিও বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
শচীন্দ্রনাথ কিছুদিন একটি কলেজে অধ্যাপনা এব্ং সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত
ছিলেন। সাংবাদিকতার সূত্রে তিনি অনেক ঘটনাকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন।
যেগুলি তাঁর নাট্য রচনায় রসদ যুগিয়েছে। বৃহত্তর সামাজিক, রাজনৈতিক,
সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অঙ্গ হিসেবেই তিনি নাট্য-আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন।
নাটককে হাতিয়ার করে মানুষকে সচেতন করতে চেয়েছেন। ফলে তাঁর সামাজিক
নাটকগুলিতে উঠে এসেছে – কুমারী জীবনে মাতৃত্বের সমস্যা, দাম্পত্যজীবনে
নারী-পুরুষের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের দ্বন্দ্ব, নারীস্বাধীনতার সুস্পষ্ট
রূপ, সমাজ জীবনের নানা ভাঙন, ভণ্ড দেশপ্রেম, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন
সার্বিক অবক্ষয় ইত্যাদি দিকগুলি। দর্শক-পাঠক আকর্ষণের মশলাগুলিকে তিনি
সযত্নে পরিহার করেছেন তাঁর নাটকে। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে স্বদেশী আন্দোলনে যোগ
দিয়েছিলেন শচীন্দ্রনাথ। আজ এই নাট্যকারের ৫৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৬১ সালের আজকের দিনে তাঁর মৃত্যু হয়। নাট্যকার, সাংবাদিক শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
১৮৯২ সালের জুলাই ইং ১২৯৯ বঙ্গাব্দের ৪ শ্রাবণ খুলনা জেলার সেনহাটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। পিতা
সত্যচরণ সেনগুপ্ত। পিতার কর্মস্থল রংপুরে প্রাথমিক শিক্ষালাভ করে ১৯০৫
খ্রিস্টাব্দে স্বদেশী আন্দোলনে যোগ দিয়ে শচীন্দ্রনাথ বিদ্যালয় ত্যাগ করেন
এবং অনুশীলন সমিতির সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার জাতীয়
বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা পাস করে তিনি বিএ পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। পরে তিনি
কটক মেডিক্যাল স্কুলে চিকিৎসাবিদ্যা ও ময়মনসিংহে কবিরাজি শেখেন।
কর্মজীবনের শুরুতে শচীন্দ্রনাথ কিছুদিন একটি কলেজে অধ্যাপনা করেন। পরে
সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত হন। তাঁর সাংবাদিক জীবনের শুরু দৈনিক কৃষক ও ভারত
পত্রিকায় সহসম্পাদকরূপে। এছাড়া তিনি সাপ্তাহিক হিতবাদী, বিজলী (
বারীন্দ্রকুমার ঘোষ প্রতিষ্ঠিত), আত্মশক্তি প্রভৃতি পত্রিকাও সম্পাদনা
করেন। বেসরকারি সাংস্কৃতিক দলের নেতা হিসেবে তিনি রাশিয়া, নরওয়ে, পোল্যান্ড, চীন, সিংহল প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করেন।
শচীন্দ্রনাথ বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করেন নাটক রচনায়। তাঁর
রচিত ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক নাটকের মূল প্রতিপাদ্য দেশাত্মবোধ। সামাজিক নাটক
রচনায়ও তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও
হিন্দু-মুসলমানের মিলনের বাণী তাঁর নাটকের অপর বৈশিষ্ট্য। ইতিহাসনিষ্ঠায়,
কাহিনীর দৃঢ় সংবদ্ধতায় ও শক্তিশালী সংলাপে শচীন্দ্রনাথের নাটক সমৃদ্ধ।
তাঁর উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক নাটকগুলি হলোঃ গৈরিক পতাকা (১৯৩০),
দেশের দাবি (১৯৩৪), রাষ্ট্রবিপ্লব (১৯৪৪), সিরাজুদ্দৌলা (১৯৩৮),
ধাত্রীপান্না (১৯৪৮), সবার উপরে মানুষ সত্য (১৯৫৭), আর্তনাদ ও জয়নাদ
(১৯৬১)। রক্তকমল (১৯২৯), ঝড়ের রাতে (১৯৩১), নার্সিংহোম (১৯৩৩),
স্বামী-স্ত্রী (১৯৩৭), তটিনীর বিচার (১৯৩৯), মাটির মায়া, কাঁটা ও কমল,
প্রলয়, জননী প্রভৃতি তাঁর সামাজিক নাটক। এসব নাটকে ব্যক্তি ও পারিবারিক
জীবনের বিচিত্র জটিলতা ও সমস্যা বিধৃত হয়েছে। এছাড়াও তাঁর রচিত কিশোরদের
নাটক, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনী ও অনুবাদ গ্রন্থ আছে। বাংলা নাট্যসাহিত্যে
শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত নিঃসন্দেহে এক শক্তিশালী, জনপ্রিয় নাটককার। বিশেষ করে
তাঁর ঐতিহাসিক নাটকগুলি যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। সে তুলনায় তাঁর
সামাজিক নাটকগুলি দর্শক – পাঠকের কাছে তেমনভাবে গ্রহণযোগ্য হয়নি। তার
একটি অন্যতম কারণ হল এই যে, গণনাট্যের আদর্শে বিশ্বাসী এই নাটককার পাঠক,
দর্শকের মনকে জাগাতে চেয়েছিলেন তাঁর নাটকের মাধ্যমে। তাদের মনের জোগান দিতে
তিনি নাটক লেখেননি।
১৯৬১ সালের ৫ মার্চ মৃত্যু বরণ করেন নাট্যকার শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। তাঁর সামাজিক নাটকগুলি সময়ের প্রতিনিধিত্ব করে
বাংলা নাট্যসাহিত্যে অমূল্য সম্পদ হয়ে রয়েছে। বহু জিজ্ঞাসায় ঋদ্ধ শচীন
সেনগুপ্তের সামাজিক নাটকগুলি আজ ইতিহাস।