কলকাতায় বা পশ্চিমবাংলায় আমার ঘনিষ্ঠজনদের কেউ কেউ একটা রসিকতা চালু করেছিলেন। মূলত তারা, যারা ইসলামের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করার ঝামেলায় যেতে চান না, নির্ঝঞ্ঝাট জীবন চান আর কি। রসিকতাটা হল, বাংলা থেকে যদি পাততাড়ি গুটোতে হয়, যদি বাংলার অবস্থা আরেকটা কাশ্মীরের মত হয়, সেক্ষেত্রে তমালদার ছাদ আছে, সেখানেই বাসা বাঁধা যাবে। এখানে ছাদ অর্থে আমার কেশবিরল কপালের মেটাফর নয়, আমার ফ্ল্যাটেরই ছাদ। দিল্লিতে আমার হাজার স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট, চারতলার ফ্ল্যাট। তার ছাদটা বেশ প্রশস্ত। অন্তত চল্লিশ পঞ্চাশজন শিক্ষক অধ্যাপক লেখকের জন্য ঢালাও বিছানা পেতে উদ্বাস্তু শিবির চালানো যাবে। ছাদ থেকে কুতুব মিনার দেখা যায়, চমৎকার ভিউ।
কিন্তু আর সে সুযোগ নেই, কারণ আর সে ফ্ল্যাট নেই। ফ্ল্যাটটা বেচে দিতে বাধ্য হলাম, স্থান সঙ্কুলান হচ্ছে না আর নতুন বইয়ের। নতুন বুকশেলফ রাখার জায়গা নেই এই ফ্ল্যাটে। নতুন বইগুলো মেঝেতে রাখতে হচ্ছে, চেয়ারে ডাঁই করে রাখতে হচ্ছে। ওদিকে লাইব্রেরি ঘরের মেঝের অনেকটা স্টোর রুমে পরিণত হয়েছে স্থানাভাবে, ফলে সেখানে তিনটে বুক শেলফ পুরো দুর্ভেদ্য ব্যারিকেডের আড়ালে চলে গেছে, সেসব হিমালয় ডিঙিয়ে পথ ভেঙে সেইসব শেলফ থেকে আর বই আনাই যাচ্ছে না। এখুনি অন্তত বারোশো-তেরোশো স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট চাই। নতুন ফ্ল্যাটে উঠে না গেলে বই কেনা একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে।
আর ছাদের ফ্ল্যাটে দিল্লিতে হোম লোন হয় না। আগের ফ্ল্যাট পার্সনাল লোন নিয়ে কিনেছিলাম, কিন্তু বড় ফ্ল্যাট হোম লোন ছাড়া কেনা যাবে না। অতএব, ছাদ নেই এবং উদ্বাস্তু শিবির চালানোর উপায়ও আর নেই।
মানে আগেভাগেই জানিয়ে রাখলাম পাব্লিককে। আমার সেই ছাদ আর নেই। উদ্বাস্তু শিবিরের জন্য বন্ধুগণকে অন্য জায়গা দেখতে হবে।
পুরোনো ফ্ল্যাট আজই বিক্রি হয়ে গেল, যদিও এখানে আরও কিছু দিন থাকব। মনটা বেশ ভারাক্রান্ত লাগছে। অনেক স্মৃতি। বিদেশ বিভুঁইতে এই বাঙালির নিজের আশিয়ানা ছিল এই ফ্ল্যাটবাড়ি এতদিন।
ব্যক্তিগত বিষণ্ণ স্টেটাস। বন্ধুদের জন্য। শত্রুরা আমার ছাদ গেল ছাদ গেল বলে আহ্লাদ করবেন না, মনে রাখবেন চক্রবৎ পরিবর্তন্তে সুখানি চ দুখানি চ। যত হাসি তত কান্না।
এই ফ্ল্যাট কেনা বিক্রির ঝঞ্ঝাটে সপ্তডিঙা পৌষ সংখ্যা প্রকাশ একটু পিছিয়ে যাচ্ছে, কিছু করার নেই। আগামী তিন দিনের মধ্যে প্রকাশের আপ্রাণ চেষ্টা করছি।