রেলিজিয়ন মানে কখনো ধর্মের সমার্থক নয়।

রিলিজিয়ন (যা কখনই ধর্মের সমার্থক নয়) মাত্রেরই একেশ্বরবাদী হওয়ার প্রবণতা।  বিশ্বের সর্বাধিক প্রচারিত, সর্বগ্রাসী রিলিজিয়ন বলতে আমরা সাধারণত খ্রিশ্চিয়ানিটি এবং ইসলামকেই বুঝি। এই মুহূর্তে ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যা প্রায় ১৮০ কোটি, খ্রিস্টানদের সংখ্যা প্রায় ২৩০ কোটি। কিন্তু  পরবর্তী সংখ্যাটি প্রকৃত চিত্র দেয়না। এই ২৩০ কোটি মানুষের সিংহভাগই কেবল নামে খ্রিস্টান, বাস্তবে নাস্তিক অথবা নন রিলিজিয়াস। অর্থাৎ কেবল খ্রিস্টান নামটিই ব্যবহার করেন।

কেন?  উত্তর খুব সোজা। এই দুটি একেশ্বরবাদী ধর্ম এতটাই গোঁড়া, একদেশদর্শী, যে চিন্তাশীল, শিক্ষিত মানুষ মাত্রেরই দম বন্ধ হয়ে যায়। তাই শিক্ষা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে খ্রিশ্চিয়ানিটি নামক আব্রাহামিক ধর্মটি সবচেয়ে বেশি সংখ্যাক নাস্তিক উৎপাদন করে ফেলেছে, যা সনাতন ধর্মে কখনও ঘটেনি। কারণ প্রথম থেকে হিন্দু বিশ্বাসে বহুত্ববাদের স্রোতটি বিদ্যমান।  সেখানে আস্তিক এবং নাস্তিক উভয়ের স্থানই সম্মানজনক।
 নাস্তিক হত্যা তো দূরের কথা, সৃষ্টিকর্তায় অবিশ্বাসের কারণে কাউকে নিপীড়ন করা হচ্ছে, মন্দিরে না গেলে ভয় দেখানো হচ্ছে এজাতীয় কোনো উদাহরণ নেই বলেই এদেশে চার্বাক, অজিত কেশকম্বলির মত নাস্তিক তাত্ত্বিক, কপিল মুনির মত সাংখ্যকার, বুদ্ধের মত নিরীশ্বরবাদীর আবির্ভাব ঘটেছে।  তাই সুতীব্র প্রতিক্রিয়া জন্ম হয়নি, যে প্রতিক্রিয়া চরম আস্তিকতা থেকে চরম নাস্তিকতার পথ প্রশস্ত করে। এই সংস্কৃতিতে মূর্তি পূজা না করে, মন্দিরে প্রবেশ না করেও দিব্যি  হিন্দু থাকা যায়। 
এই কারণেই প্রথম বিশ্ব সহ সমগ্র ভূমণ্ডলেই হিন্দুদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে কোনো সমস্যা হয়না। কিন্তু উপরিউক্ত রিলিজিয়নদুটিতে নাস্তিকতার কোনো স্থান নেই বলেই শিক্ষিত, চিন্তাশীল মানুষের কাছে দুটি বিকল্পই অবশিষ্ট থাকে– ১) আস্তিক হিসেবে সব কিছু বিনা প্রশ্নে মেনে নেওয় ২) নাস্তিক হিসেবে সব কিছুকে নস্যাত করে দিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করা।  
যা সনাতন সংস্কৃতির বিপরীত। নিষিদ্ধ ক্ষেত্র হিসেবে নাস্তিকতার প্রতি আকর্ষণ এখানে শূন্য, এডভেঞ্চার হিসেবেও এটির কোনো আবেদন নেই, যা ক্রিশ্চিয়ানিটির ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে সত্য, এবং ইসলামের ক্ষেত্রেও যার প্রতিফলন ঘটতে শুরু করেছে। ইউরোপে বিলুপ্ত হতে বসা খ্রিস্টান ধর্মকে এখন তৃতীয় বিশ্বের অশিক্ষিত জনতার শরণাপন্ন হতে হচ্ছে। নইলে অস্তিত্বই থাকবেনা। ভক্তের অভাবে বন্ধ হওয়া চার্চগুলি  হানাবাড়ির আকার নিয়েছে। 
২৩০ কোটি খ্রিস্টানের হিসেবটি তাই নিছক  কাগজে কলমে। ইসলাম ধর্মটিও  অশিক্ষাকে লক্ষ্য করেই ছড়িয়ে পড়েছে। বিজ্ঞানচিন্তা এখানে ঘোরতর নিষিদ্ধ যাতে নাস্তিকতার বিপদটিকে কাটিয়ে ওঠা যায়। নাস্তিকদের প্রতি আচরণও যথেষ্ট নৃশংস। কিন্তু মহাকালের স্রোতকে রুদ্ধ করা অসম্ভব। দমন পীড়ন,  ভয় অথবা যুক্তিহীন বিশ্বাস দিয়ে এটিকে আর টিকিয়ে রাখা যাবেনা। তাই আগামীতে এই ধর্মটিই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক নাস্তিকের জন্ম দেবে। 
এই প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই আরম্ভ হয়ে গেছে। অবিশ্বাসীর সংখ্যা বিদুৎ বেগে বাড়ছে। কুচক্রী  সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, ধান্দাবাজ ধর্মব্যবসায়ী এবং ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক দল যদি এটির পৃষ্ঠপোষকতা করা বন্ধ করে দেয়, আগামী একশো বছরেই এটির অবস্থা বর্তমান খ্রিস্টান ধর্মের রূপ পরিগ্রহ করবে। অর্থাৎ নামে মুসলমান, বাস্তবে নাস্তিক বা নন রিলিজিয়াস! এটিই মহাকালের লিখন । তবে অনেক রক্তপাতের পর।
Scroll to Top