নতুন করে ইজরাইল-ফিলিস্তিন ইস্যু চলে আসায় ইতিহাস চর্চাও শুরু করে দিয়েছে যে যার মত করে। সব ইতিহাস চর্চাকারীই- হোক সে সোশালিস্ট কি ইসলামিস্ট, ‘বিবিসি বাংলা’ কি ‘বাঁশের কেল্লা’- সবার ইতিহাসেই প্যালেস্টাইনে ইহুদীরা সব বহিরাগত! সবার ইতিহাসই শুরু হয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে। কি করে ফিলিস্তিনের জেরুজালেমকে কেন্দ্র করে একটি ইহুদী রাষ্ট্র গঠন করা যায়- ইউরোপ আমেরিকায় থাকা ইহুদীরা (যাদের পূর্ব পুরুষরা ফিলিস্তিনী থেকে শরণার্থী হয়েছিলেন) রাজনৈতিক এবং সামরিকভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে সফল হয়েছিলেন ইতিহাস চর্চাকারীদের ইতিহাস এখান থেকে শুরু হয়েছে। কিন্তু এটা ইতিহাসের একটা অধ্যায় মাত্র, সম্পূর্ণ ইতিহাস নয়।
আজ থেকে ৩ হাজার বছর আগে মধ্যপাচ্যে কারা বাস করত, তাদের নৃতাত্বিক পরিচয় জানতে আমাদের ইতিহাস, ধর্মীয় মিথ, প্রত্মতাত্বিক নিদর্শনকে মিলিয়ে একটা ছবি দাঁড় করাতে হয়। ইহুদী ধর্মীয় মিথ অনুযায়ী আব্রাহাম নামের একজন ব্যক্তি জিহোবা নামের এক ঈশ্বরকে এই বিশ্বজগতের মালিক হিসেবে পুজা করতেন। এদের এবং এদের ধর্মকে সেমেটিক জাতি এবং সেমেটিক ধর্ম বলা হয়। নূহ নবী বলতে ইহুদীদের যে নবী ছিলেন তার ৩ ছেলের একজনের নাম ছিলো সাম। সামের বংশধরদের বলা হয় সেমেটিক। এরাই গোটা মধ্যপাচ্য জুড়ে বসবাসকৃত জনসাধারণ। যাই হোক, জিহোবার নির্দেশ মান্য করলে আব্রাহাম এবং তার জাতিকে চির কল্যাণ এবং শান্তির দেশ উপহার দিবেন –এই ছিলো জিহোবার সঙ্গে আব্রাহামের চুক্তি। ফলশ্রুতিতে আব্রাহাম কেনান (বর্তমান ফিলিস্তিন) দেশে এসে বসবাস শুরু করেন এবং তার বংশধররা নবী হিসেবে সেমিটিক জাতির মধ্যে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। আব্রাহামের পুত্র ইসহাক, তার পুত্র ইয়াকুব ওরফে ইজরাইলের ১২ ছেলের একজনের নাম ছিলো ইউসুফ। তাকে তার ভাইরা চক্রান্ত করে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়। কিন্তু ঘটনাচক্রে সে মিশরের ফারাওদের নেকনজরে পড়ে এবং শাসকদের একজন হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। ইউসুফ তার ভাইদের ক্ষমা করে দেয় এবং পিতা ইয়াকুব এবং ভাইদের মিশরে নিয়ে আসেন। ইয়াকুবের ১২ সন্তানের একজন লেভির বংশেই মোসেজ বা মুসার জন্ম হয়। মুসার সময়ই মিশরীয়রা ইহুদীদের উপর নিপীড়ন শুরু করে এই তকমা দিয়ে- ইহুদীরা বহিরাগত..। যদিও ফারাওদের ইহুদীদের জ্ঞাতী হিসেবে ধরা হয়। নূহের ৩ পুত্রের আরেকজন হ্যামের বংশধররাই মিশরীয় বা হ্যামিটিক। যেমন নূহের পুত্র সামের বংশধররা স্যামিটিক বা ইহুদী। নির্যাতন যখন চরমে উঠে তখন মুসার নেতৃত্বে বণি ইজরাইল বা ইয়াকুবের বংশধররা ফের তাদের জিহোবা নির্দেশিত কেনান (ফিলিস্তিন) ফিরে আসেন। মুসা আসার সময় তাদের পূর্ব পুরুষ ইউসুফের দেবাশেষ তুলে এনে কেনানে সমাহিত করেন। এই সময়ই মুসা তার কথিত নবীত্ব লাভ করেন। জিহোবা এক ঝোপের আড়ালে স্বকন্ঠে তার সঙ্গে কথা বলেন। …
এসবই মিথ, ধর্মীয় পুরাণ এবং ইতিহাসের মিশ্রন। তবে সেটি যে সেমিটিক নামের একটি জাতিকে ঘিরে, তাদের ইতিহাস, ধর্ম, সংস্কৃতি, পুরাণকে ঘিরে তা তো বলাই বাহুল্য। এই সুবিশাল জাতিগোষ্ঠি কি করে নিশ্চিহৃ হয়ে গেলো? তাজ্জব ব্যাপার মক্কা থেকে যখন মুহাম্মদ তার অনুসারীদের নিয়ে মদিনা আসেন তখন মদিনা এবং আশেপাশের অঞ্চলে বিপুল সংখ্যাক ইহুদীর বাস ছিলো। তারা কোথায় কিভাবে গেলো, কি পরিণতি তাদের হয়েছিলো সেই প্রশ্ন না তুললে কি করে ফিলিস্তিন-ইজরাইল ইতিহাস সম্পূর্ণ হবে? মুহাম্মদের জমানায় ইসলামী খিলাফতকালে ইহুদী এবং অন্যান্য অমুসলমান সম্প্রদায়ের উপর নিপীড়ন এবং নির্যাতন চলে তাতে নিশ্চিহৃ হয়ে পড়ে সেমিটিক জাতির সংস্কৃতি, ধর্ম। হাদিসে আছে নবী বলছেন, ইহুদী ও নাসারাদের আরব থেকে বের করে দেব, এখানে মুসলিম ছাড়া কেউ থাকবে না (আবুদাউদ-৩০২০), আরব উপদ্বীপ থেকে ইহুদী-নাসারাদের অবশ্যই বের করে দিব (তিরমিযী-১৫৫৪)। নবীর অবশিষ্ঠ কাজ সম্পন্ন করেন তার সাহাবী হযরত উমার। তিনি ইহুদীদের আরব ভূমি থেকে বহিস্কার করেন (আবুদাউদ-৩০২৪)।
এই ধারাবাহিক ইতিহাস, ধর্মকথা বাদ দিয়ে ১৯৩০ সালে পোলেন্ড থেকে কিছু ইহুদী ফিলিস্তিনে বসবাস শুরু করে- এভাবে শুরু করলে সত্যকে ধামাচাপা দেয়া হয়। খবরের কাগজ থেকে জ্ঞানী-গুণিদের কলামে সর্বত্র ইতিহাস শুরু হচ্ছে এই ১৯৩০ সাল থেকে। ‘ইহুদীবাদকে’ বা ইজরাইল রাষ্ট্রের চিন্তা নায়কদের সঙ্গে মধ্যপাচ্যের ইহুদীদের ইতিহাসকে খর্ব করা কতটা সততার পরিচয়? সেমিটিক ধর্মের ঈশ্বর একজন রক্তলোলুপ অত্যাচারি নিষ্টুর সৃষ্টি। ইহুদীরা সেই নিষ্ঠুরতা কেনানে ফিরে আসা কালে মুসার নেতৃত্বে কেনানের তখনকার বাসিন্দাদের উপর চালিয়েছিলো। মুসলমানদের ঈশ্বর সেই একই ধারায় চলেছেন। তবু সত্য হচ্ছে, গোটা জেরুজালেমই হচ্ছে সেমিটিক ধর্মের সবচেয়ে প্রাচীন ধর্ম ইহুদী ধর্মের অনুসঙ্গ। গয়া-কাশিতেও মসজিদ আছে। জেরুজালেমেও একটা মসজিদ থাকতে পারে তাতে কি করে সেটাই প্রধান হয়ে উঠে?
ইতিহাস বলতে হলে শুরু থেকে শুরু করতে হবে। খন্ডিত ইতিহাস থেকেই প্রতিক্রিয়াশীলতার জন্ম হয়। আরব, ইহুদী, মুসলমান, খ্রিস্টান, অনারব, সাদা, কালো মিলেমিশেই রাষ্ট্র গড়তে হবে। জেরুজালেমের যে অংশটুকু ধর্মীয় তীর্থ হিসেবে বিবেচিত ততটুকু বিশ্ববাসীর কাছে উন্মক্ত রাখা উচিত। শুধু ধর্মকর্ম করতে নয় প্রাচীন নিদর্শন দেখতে। যেমন মক্কা-মদিনার তীর্থক্ষেত্রটুকু সৌদির আওতার বাইরে রেখে উন্মুক্ত করা উচিত। অমুসলিমদের মক্কা-মদিনায় প্রবেশ নিষিদ্ধের মত বর্বর ঘৃণা উদ্রেগ নিষেধাজ্ঞা আজকের সভ্য বিশ্বের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়। হজ থেকে আসা বিপুল অর্থ ব্যয় করা উচিত বিশ্বের সমস্ত দরিদ্র নিপীড়িত মানুষের জন্য। সৌদি প্রিন্সদের লাম্পট্যের খরচ যোগাতে নয়।