মার্ক্সবাদের সঙ্গে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সম্পর্কবিচার।
এক, বাঙালি জাতীয়তাবাদের একটি কোর স্টেটমেন্ট, বাঙালি বুর্জোয়ার উত্থান চাই, এ বক্তব্য ধ্রুপদী মার্ক্সবাদের সঙ্গে মিলে যায়, যেখান থেকে পরে সেকেন্ড ইন্টারন্যাশনাল এসেছিল। লেনিন আর মাওয়ের বক্তব্যের সঙ্গে মেলেনা অবশ্য।
দুই, মার্ক্স এবং এঙ্গেলস নিজেরাই জার্মান জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতায় কাজ করেছেন জার্মান জাতির একীকরণের প্রশ্নে। বিস্তারিত জনাথন স্পার্বারের বইতে পাবেন। বাঙালি জাতির ঐক্য সম্পর্কে মার্ক্সবাদের একই স্ট্যান্ড হবে।
তিন, বাঙালি জাতির শুধু ঐক্য নয়, বিভাজনও আছে। সেক্ষেত্রেও মার্ক্স যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক, ইসলাম যে বিভাজন তৈরি করে বিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসীর মধ্যে, এবং কাফেরদের জাতিকে ইসলাম যে নিষিদ্ধ করে, কাফেরকে যে হার্ব বা শত্রু বলে ঘোষণা করে, তাঁর এই বক্তব্য যথেষ্টই অনুধাবনযোগ্য।
বিপ্লবী জাতীয়তাবাদের সঙ্গে মার্ক্সবাদের যোগাযোগ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই হয়েছে, ভারতের ক্ষেত্রে বলা যায়, সৌরেন্দ্রমোহন ঠাকুরের গণবাণী গ্রুপ, পরে আর সি পি আই, এরা বন্দেমাতরম স্লোগান দিতেন। ভূপেন দত্ত একজন হিন্দু মার্ক্সিস্ট ছিলেন, এবং উৎপল দত্ত তাঁর গিরিশ মানসে একজন হিন্দু মার্ক্সিস্ট। আলোচনাটা লঘু হয়ে যাবে সেই আশঙ্কায় এখানে কমেডিয়ান ভানুর নাম এক নিঃশ্বাসে নিতে পারছি না, কিন্তু উৎপল দত্তকে দিয়ে ওই গিরিশ মানস বইটা ভানুই লিখিয়েছিলেন। বাংলায় একটা ফল্গুধারার মত জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী ধারার সঙ্গে মার্ক্সবাদের মিশ্রণ বয়ে চলেছে, সেটা প্রকাশ্যে কেন একটি সচেতন ডিসকোর্স হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারেনি, সে অন্য প্রশ্ন।
ব্রিটেনে রেমন্ড উইলিয়ামস কালচারাল মেটেরিয়ালিজম নামক একটি চিন্তাধারার জনক, মার্ক্সবাদী তাঁকে বলা যায়, যদিও বেস সুপারস্ট্রাকচার মডেলকে তিনি যথেষ্ট পরিমাণে প্রশ্ন করেছিলেন। যাই হোক, অ্যাকাডেমিক মার্ক্সিজমের জনক তাঁকেই ধরা হয়। সেই রেমন্ড উইলিয়ামস ছিলেন ওয়েলশ জাতীয়তাবাদী, তিনি ওয়েলসের Plaid Cymru (প্লাইদ কুমরি) দলের কার্ডহোল্ডার সদস্য ছিলেন। টেরি ইগলটন, তাঁর ছাত্র, আইরিশ জাতীয়তাবাদী এবং যেহেতু শুধু আইরিশ বললে আইরিশ ক্যাথলিকই বোঝায়, আইরিশ প্রোটেস্ট্যান্টরা সাধারণত অ্যাংলো আইরিশ বলেই পরিচিত হন, তো ইগলটন হলেন আইরিশ ক্যাথলিক জাতীয়তাবাদী। ইগলটন খ্রীষ্টধর্ম নিয়ে প্রচুর কাজ করেছেন ও করছেন। দুর্ভাগ্যবশত, ভারতে উইলিয়ামস এবং ইগলটন বহুলপ্রচলিত নাম (বিশেষ করে ইংরেজি ডিপার্টমেন্টগুলোতে) হলেও এঁদের এই দিকটা সম্পর্কে আলোচনা করাই আমাদের দেশের বিশেষ রকমের মার্ক্সবাদীরা নিষিদ্ধ করে রেখেছেন। কেন করে রেখেছেন, সে অন্য প্রশ্ন।
ঘরের পাশে শ্রীলঙ্কায় একটি ট্রটস্কিপন্থী বাম দল আছে, জনতা বিমুক্তি পেরামুনা। দলটি দস্তুরমত সিংহলী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী।
ল্যাটিন অ্যামেরিকায় যে বামপন্থী দলগুলি আছে, তারা জাতীয়তাবাদী এবং তারা খ্রীষ্টধর্মের সঙ্গে মার্ক্সবাদের মিশ্রণে লিবারেশন থিওলজি নামে একটি আদর্শের জন্ম দিয়েছেন। টেরি ইগলটনের ক্যাথলিক বামপন্থা অবশ্য আদর্শ হিসেবে আরও বেশি উন্নত, মূলত ওয়েস্টার্ন মার্ক্সিজমের ইন্টেলেকচুয়াল ধারায় বর্ধিত হওয়ার সুফল পেয়েছে, সে তুলনায় ল্যাটিন অ্যামেরিকার খ্রীষ্টীয় জাতীয়তাবাদী বামপন্থা আন্দোলন হিসেবে যদিও অনেক বেশি সফল, কিন্তু ডিসকোর্স হিসেবে অতটা উন্নত নয়।
সব মিলিয়ে মার্ক্সবাদের সঙ্গে মা কালীর সম্পর্ক বাংলায় এর আগে কেন তৈরি হয়নি, আমি জানি না। আমায় দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অবাঙালি কমিউনিস্ট বলেছিলেন, কালীভক্ত কমিউনিস্ট প্রথমবার দেখছি। আগে কেন দেখেন নি, সেটাই প্রশ্ন। ব্যক্তিগতভাবে আমি অবশ্য লেনিন বা মাওয়ের ধারার কমিউনিস্ট নই, কিন্তু টেরি ইগলটনের ধারায় জাতীয়তাবাদী এবং উৎপল দত্তের ধারায় হিন্দু মার্ক্সিস্ট, তাতে সন্দেহ নেই।
মার্ক্স বলেছিলেন, ধর্ম হচ্ছে জনগণের আফিম। বক্তব্যটি খণ্ডভাবে উপস্থাপিত হয়। সেযুগে আফিম ছিল ওষুধ, নেশার দ্রব্য হিসেবে যদিও ব্যবহার হত, কিন্তু মার্ক্সের পুরো বক্তব্যটা পড়ুন, দেখবেন ওখানে আফিমকে analgesic, anodyne, painkiller হিসেবেই দেখানো হয়েছে।