যৌথ পরিবার ভেঙে গিয়েছিল সেই কবে। সংসার ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল দুই ভাই। পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে এত দিন এমন কথাই বলে এসেছিলেন বিজ্ঞানীরা।
কিন্তু সেই দাবি নস্যাৎ করে দিলেন কল্যাণীর এক দল বিজ্ঞানী। তাঁদের
বক্তব্য, ‘‘না, দু’জন নয়। কয়েক লক্ষ বছর আগে পরিবার ছেড়ে বেরিয়ে যায় তিন
ভাই।’’ দেহাবশেষ না-মিললেও জিনতত্ত্বের ব্যাখ্যায় সেই তৃতীয় ভাইয়ের
অস্তিত্ব প্রমাণ করেছে কল্যাণীর ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োমেডিক্যাল
জিনোমিকস’। গবেষক দলের নেতৃত্বে রয়েছেন সংস্থার ডিরেক্টর তথা বিজ্ঞানী
পার্থপ্রতিম মজুমদার। এ দিন গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে বিজ্ঞান বিষয়ক
পত্রিকা

‘নেচার জেনেটিকস’-এ।

বিজ্ঞানের ইতিহাস বলে, প্রায় ২০ লক্ষ বছর আগে আফ্রিকায় জন্ম হোমো
ইরেকটাস-এর। এদের বিবর্তন হয়ে জন্ম নেয় হোমো হাইডেলবারজেনসিস। এদের
দেহাবশেষও পাওয়া গিয়েছিল। যা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে পরবর্তী কালে জানা যায়, ৬
লক্ষ বছর আগে হোমো হাইডেলবারজেনসিস-এর ঘরবাড়ি ছিল আজকের ইথিওপিয়ায়। এর পর
(অন্তত ৪ লক্ষ বছর আগে) আফ্রিকার গণ্ডি ছেড়ে বেরিয়ে আসে আদিম মানুষের
(হোমো হাইডেলবারজেনসিস) একটি দল। ভাগ হয়ে যায় দু’টো স্রোতে। এক দল চলে যায়
ইউরোপে। তাদের বিবর্তন হয়ে জন্ম হয় নিয়ানডারথ্যাল (হোমো
নিয়ানডারথ্যালেনসিস)-এর। অন্য দলটি যাত্রা করে আফ্রিকা থেকে পূর্ব দিকে।
তাদের বিবর্তন হয় ডেনিসোভ্যানস হিসেবে। বলা ভাল, এই ডেনিসোভ্যানস নামটা
এসেছিল রাশিয়ার ডেনিসোভা গুহা থেকে। ওই গুহার মধ্যে বিবর্তিত মানুষের একটি
আঙুলের হাড়ের জীবাশ্ম মেলে। অন্য দিকে, আফ্রিকায় থেকে যাওয়া হোমো
হাইডেলবারজেনসিস মানুষেরও বিবর্তন ঘটে। সে প্রায় ২ লক্ষ বছর আগে। জন্ম নেয়
হোমো স্যাপিয়েনস।

আধুনিক মানুষ হোমো স্যাপিয়েনস স্যাপিয়েনস-এর জন্মও আফ্রিকাতেই। প্রায় ৮০
হাজার বছর আগে। একটা সময় (৫০ হাজার বছর আগে) তারা আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে এসে
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে
পড়ে। তাদের দেখা হয় নিয়ানডারথ্যাল ও ডেনিসোভ্যানসদের সঙ্গে। ফের বিবর্তন ঘটে।

এই হোমো স্যাপিয়েনস, নিয়ানডারথ্যাল ও ডেনিসোভ্যানস— প্রত্যেকেরই
পূর্বপুরুষ এক। কিন্তু তার উত্তরসূরি কি শুধু এই তিন ‘ভাই’? নাকি আরও কেউ
আছে, যার কথা জানতেই পারেনি কেউ। বহু দিন আগেই সে প্রশ্ন উঠেছিল বিজ্ঞানী
মহলে। পার্থপ্রতিমবাবুদের গবেষণা, সেই সূত্রটাই ধরিয়ে দিল।

আসলে দীর্ঘ গবেষণার পর গত ফেব্রুয়ারি মাসেই বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত ভাবে
জানতে পারেন, ভারতের মূল ভূখণ্ডের মানুষের জেনেটিক গঠনের থেকে অনেক আলাদা
জারোয়া ও ওঙ্গিদের জিনের গঠন। তাতেই বিজ্ঞানীদের মাথায় খেলে যায় একটা
প্রশ্ন— আফ্রিকা থেকে আধুনিক মানুষের যে-স্রোতটি ভারতের মূল ভূখণ্ডে এসে
আস্তানা গেড়েছিল, তাদেরই একটি অংশ কি আন্দামানে গিয়েছিল?

পার্থপ্রতিমবাবুরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ৬০ জন বাসিন্দার জিনের গঠন
এবং ১০ জারোয়া-ওঙ্গির জিনের গঠন পরীক্ষা করে দেখেন। পুরনো বেশ কিছু গবেষণার
তথ্যও তাঁদের হাতে ছিল। তুলনা করে দেখেন সে সবের সঙ্গেও। তাতেই বেশ কিছু
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে আসে পার্থপ্রতিমবাবুদের হাতে—

জারোয়া-ওঙ্গিদের জিনের গঠনে সাম্প্রতিক কালে কোনও বদল ঘটেনি।

জারোয়া-ওঙ্গিদের সঙ্গে ভারতের মূল ভূখণ্ডের মানুষের জিনগত তফাত রয়েছে।

কিন্তু জারোয়া-ওঙ্গিদের সঙ্গে প্রশান্ত মহাসাগরীয় জনজাতির তফাত অনেক বেশি।

নিয়ানডারথ্যাল ও ডেনিসোভ্যান্সদের ডিএনএ-র গঠনের সঙ্গেও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে জারোয়া-ওঙ্গিদের।

তা হলে এই ভিন্‌ চরিত্রের ডিএনএ অংশগুলো জারোয়া-ওঙ্গিদের দেহে এল কোথা থেকে?

তাতেই বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছচ্ছেন যে, এদের উৎস পৃথিবী থেকে
হারিয়ে যাওয়া সেই ঠাকুরদাটি। যিনি ছিলেন নিয়ানডারথ্যাল ও ডেনিসোভ্যানস-এরই
আর এক ভাই। এবং জারোয়া-ওঙ্গিদের পূর্বপুরুষ (সন্তান-সন্ততি অবশ্য আরও
থাকতেই পারে, যাদের কথা জানা নেই)। এদের দেহাবশেষের সন্ধান অবশ্য এখনও
মেলেনি। কিন্তু তথ্যপ্রমাণ ঘেঁটে, বহু হিসেবেনিকেশ করে এমনটাই দাবি করছেন
বিজ্ঞানীরা।