সিন্ধু বিজয়েয় সংগে সংগেই
ভারতে জিহাদী আগ্রাসন’ শেষ
হয়ে যায়নি। তবে কাসিমের
মর্মান্তিক পরিনতি, রাজা দাহিরের ,রানী
‘রানি বাই’ এর এবং
তাদের দুই কন্যার বীরত্ব,
ইসলামিক জিহাদিদের মনে দ্বিধা এবং
ভয় দুটোই তৈরী করেছিলো।
ভারতের অতুল ঐশ্বর্য্য তাদের
বার বার হাতছানি দিয়েছে।
তুরষ্কের খলিফারা তখন বংশ পরম্পরায়
ইউরোপের ‘নাইট’দের সংগে
ক্রুশেডে ব্যাস্ত। উত্তর আফ্রিকা জয়
করে স্পেনে আন্দুলেশিয়া গঠন
করলেও সেখানেও খুব একটা স্বস্তি
ছিলো না। পামীর গ্রন্থী
পার হয়ে ভারতে ঢোকার
মতো সাহস সঞ্চার করতে
আরবীরা আর কোনোদিন পারেনি।
তবে সিন্ধু কেন্দ্রিক যে
মুসলিম জনগোষ্টি ভারতে এসে মৌরুষী
পাট্টা নিয়ে বসে গেলো
তার প্রভাব হলো সুদুর
প্রসারী।
খলিফা সিন্ধু দেশ তার
‘খিলাফত’ এর অংশ হিসাবে
পরগনিত করলো। সেই সংগে
ধর্মীয় পরিবর্তন এবং হিন্দুদের প্রতি
অত্যাচার অনাচার চললো অবিরত।
হিন্দু সংষ্কৃতির পীঠস্থান মুলতান পরিনত হলো
আরবী সংষ্কৃতির পীঠস্থান। ইবন হুকাল লিখলেন,
“ কাফের এবং মুসলিম রা
সব এক ধরনের পোষাক
আসাক পরতে শুরু করলো,
ইসলামে অবিশ্বাসী কাফের গুলো আরবী
খাবার খেতে শুরু করলো।
মুলতান, মনসুরা এবং আর
যে যে অঞ্চল মুসলিম
দখলে এলো সেখানকার ভাষা
পরিবর্তিত হয়ে গেলো আরবী
তে”। ভাষা,
পোষাক এবং খাদ্য, এই
তিন জীবন ধারন প্রনালীর
আমুল পরিবর্তন সিন্ধু বিজয়ের আসল
ক্ষতি। যেখানে একটি ও
আরবী মানুষ ছিলো না,
সেখানে এক বিরাট সংখ্যক
আরবী জীবন, ধ্যান ধারনার
মানুষের সংগে সনাতনি ভাবনায়
ভাবিত মানুষের জীবন মিশে গেলো।
তৈরী হতে শুরু করলো
মিশ্র সংকর জাতি।
ইরান দখলের পর আফগানিস্তান
দখল হয় এবং সেই
পথে খাইবার গিরিপথ পার
না করে (হিন্দু রাজাদের
ভয়ে) আরবী জিহাদীরা গেলো
বর্তমান কেন্দ্রীয় এশিয়া (Central Asia) তে ইসলামী শাসন
প্রতিষ্ঠা করতে। তাজাকিস্তান, উজবেকিস্তান,
তুর্কমেনিস্তান ইত্যাদি আঞ্চলিক উপজাতিদের সব জায়গা দখল
হলো । বিজিত
এই সব উপজাতিদের আরবীরা
খাটি মুসলমান বলে আজো ভাবে
না, তখনো ভাবতো না।
এরা ছিলো আরবী প্রভুদের
দাস। আরবী খলিফা এবং
রাজ কর্চারীদের দেহ রক্ষী এবং
অন্যান্য দাস সুলভ কাজ
কর্ম করতেই এই তুর্কী
দাস দের ব্যাবহার করা
হতো।
এমন ই এক তুর্কী
দাস ছিলো ‘আলপ্তিগীন’।
সে কিছু নিজের গোষ্টির
লোক নিয়ে খলিফার অধীনস্ত
আফগানিস্তানের “গজনী” তে এক
রাজ্য স্থাপন করলো। আলপ্তীগীনের
ছিলো আর এক তুর্কি
দাস নাম সুবুক্তীগীন। সে
বেশ যুদ্ধ বাজ ছিলো।
সুবুক্তিগীনের প্রভু ভক্তিতে খুশী
হয়ে আলপ্তীগীন তাকে নিজের জামাতা
বানায়। আলপ্তীগীনের কোনো ছেলে না
থাকায় তার মৃত্যুর পর
সুবুক্তিগীন শাসক হয়(৯৭৭
সালে)। তুরষ্কের
আরবী খলিফা এতদঞ্চলে কে
রাজা হলো আর কে
প্রজা হলো তা নিয়ে
মাথা ঘামাতো না। ধর্মে
মুসলমান আর নিয়মিত সুলতানের
নজরানা এবং দাস দাসী
পাঠালেই সব চলতো। সেই
সংগে জিহাদী কার্য ক্রমে
অতিউৎসাহী এবং উদ্দামতা থাকলেই
সে খলিফার নিজের লোক
হতে পারতো। সেই হিসাবে
গজনী কেন্দ্রিক এই নতুন উপনিবেশের
পত্তন খলিফার থেকে স্বীকৃতি
পেতে অসুবিধা হলো না। এই
প্রথম, ইসলামিক উম্মার মধ্যে এমন
একটি শক্তি কেন্দ্র তৈরী
হলো যা মুলত আরবী
নয়।
সুবুক্তীগীন যখন রাজা হয়
(৯৭৭সাল) তখন পাঞ্জাব থেকে
শুরু করে উত্তরে কাশ্মীর
অবধি এবং পশ্চিমে কান্দাহার
অবধি বিস্তৃত এক বিশাল সাম্রাজ্য
ছিলো যার নাম “ হিন্দু
সাহাইয়া ব্রাহ্মন সাম্রাজ্য”। দক্ষিনে
সিন্ধুদেশ, তার পাশে বালুচদের
জায়গা, উত্তরে নানা উপজাতিদের
রাজ্য, আর তারাও মুসলিম।
পশ্চিমেও ইরান এবং ইরাক
ইত্যাদি মুসলিম ভাইদের রাজ্য।
তাই উত্তর পুবের এই
‘হিন্দু সাহাইয়া সাম্রাজ্য”র দিকে নজর
পড়লো সুবুক্তিগীনের।
সুবুক্তিগীন তুর্কি দাস। আফগানিস্তানের
‘তালীবান” দের কথা ভাবুন।
এই সেদিন তালীবানি শাসনে
ঠিক কি ধরনের বর্বরতার
পরিচয় তারা দিয়েছে সেটা
স্মরন করুন। আজ থেকে
প্রায় ১০০০ বছরের কিছু
আগে এই সমস্ত জায়গার
উপজাতি মানুষগুলো ঠিক কেমন বর্বর
, অসভ্য এবং অমানুষিক মনোভাবের
ছিলো তা ভাবুন।
তা, ঠিক তেমনি এক
উপজাতি দাস, সুবুক্তিগীন তার
বর্বর মানিসিকতা নিয়ে শুরু করলো
জিহাদী “রিজিয়া” (যার কথা আগেই
লিখেছি)। বারে
বারে লুট তরাজ, ধন
সম্পত্তির ক্ষতি, সুযোগ মতো
হিন্দুদের দাস বানিয়ে নিয়ে
যাওয়া, হিন্দু মহিলাদের ইজ্জত
হানি এবং ‘যৌণ দাসী”
বানিয়ে নিয়ে যাওয়া এই
সবে শাহী সাম্রাজ্যের রাজা
জয়াপাল বিরক্ত হয়ে পড়লেন।
দক্ষিনের সিন্ধু দেশে ৩
শো বছর আগে কি
হয়েছে সে ইতিহাস ও
জয়াপালের জানা ছিলো। সুবুক্তিগীনের
অত্যাচারের হাত থেকে প্রজা
কুলকে রক্ষা করার জন্য
এবং সনাতনি হিন্দুদের স্বাধীনতার
পতাকা উচু করে উড়িয়ে
রাখার জন্য রাজা জয়াপাল
সুবুক্তিগীনের রাজ্য গজনী র
দিকে এগোলেন প্রায় এক
লক্ষ মানুষের এক বিশাল সৈন্য
বাহিনী নিয়ে।
এদিকে সেই খবর পেয়ে
সুবুক্তিগীন তার আফগান সৈন্য
(আরবীরা আর রইলো না)
নিয়ে গজনী থেকে এসে
পড়লো। জয়পালের সৈন্য বাহিনীতে প্রায়
এক লক্ষ সৈন্য। উদ্দেশ্য
রাজা বিক্রমাদিত্যের মতো (শক দস্যু
দের সার্বিক পরাজয় ), এই অসভ্য তুর্কি
রাজা এবং আফগান সৈন্যদের
সমুলে দমন করা, যাতে
ভবিষ্যতে আর ভারতে শক
হুনদের মতো লুট তরাজ
করার সাহস না দেখায়।
সুবুক্তিগীনের সৈন্য সংখ্যা খুব
কম । সে
সামনা সামনি যুদ্ধ না
করে রাতের অন্ধকারে জয়পালের
সৈন্য ছাউনিতে হামলা চালাতে শুরু
করলো। এই ভাবে চললো
কিছুদিন। জয়পালা তখন ঠিক
করলেন একেবারে ‘গজনী’ তে গিয়ে
সুবুক্তিগীনের মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিয়ে আসার।
সেই খবর পেয়ে বর্বর
সুবুক্তিগীন যা করলো তা
কোনো অসভ্য কেনো, মানুষের
রক্ত যাদের শরীরে আছে
তারা তা করতে পারে
না। জয়পালের সৈন্যদের খাবার জলের উৎসে
(যে ঝরনা গুলো থেকে
জল সংগ্রহ করা হতো)
‘গোমাংস এবং গরুর রক্ত’
মিশিয়ে দিলো। (Legacy Of Jihad ,
Edited by Andrew G Bostom, pubilshed in NewYork by Prometheus Books ,page-
440).
খুব ভোরে সেই অমানুষিক
কাজের খবর পেয়ে জয়পাল
তার বিপদ বুঝতে পারলেন।
কোনো হিন্দু ঐ জল
স্পর্শ ও করবে না।
কিছু ঝরনা তখনো বাকি
ছিলো। কিন্তু তাও ঐ
বর্বর গুলো কতো শীঘ্র
করবে তার ঠিক আছে
কি????? সেই জায়গাও জয়াপালের
রাজ্যের বাইরে, অপরিচিত।। তিনি
সুবুক্তিগীনের কাছে সন্ধির প্রস্তাব
পাঠালেন। সুবুক্তিগীন তার বিখ্যাত পুত্র’
“গজনীর মাহমুদ” এর পরামর্শে সেই
সন্ধি প্রস্তাব গ্রহন করতে দেরী
করার কৌশল নিলো। এদিকে
একের পর এক জলের
উৎস গরুর মাংস এবং
রক্তে দুষিত হচ্ছে রাতের
অন্ধকারে। লক্ষাধিক মানুষের খাবার জল ,ভোজন
তৈরী করা ইত্যাদি কর্ম
যজ্ঞ কি করে সামাল
দেওয়া যাবে????
রাজা জয়াপাল লিখলেন, “ তুমি
এতোদিনে হিন্দুদের মানসিক স্থৈর্য্য, শক্তি
দেখেছো। হিন্দুরা নিজেদের মান সম্মান বজায়
রাখতে, মাতৃভুমির স্বাধীনতা সুরিক্ষিত রাখতে জীবন দিতে
ভয় পায় না। যখন
এই ধরনের অপশক্তির কাছ
থেকে বিপদ আসে, যেমন
এখন এসেছে, তখন হিন্দুর
মানসিকতা আরো কঠিন হয়।
লুট, আর্থিক নজরানা, ধংস,
দাস দাসী এবং আমাদের
হাতি নেবার জন্য যদি
‘শান্তি প্রস্তাব’ গ্রহন না করো
,তাহলে আমরা, হিন্দুরা আমাদের
ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে,
আমাদের মনকে পাথর বানিয়ে,
আমাদের সমস্ত খাদ্য শষ্য
নষ্ট করে দেবো, ক্ষেত
খামার ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে
দেবো, আমাদের হাতিদের চোখ
লোহার শলা দিয়ে অন্ধ
করে দেবো, আমাদের মহিলাদের
এবং বাচ্চাদের আগুনের পুড়িয়ে মেরে
দেবো এবং পরিশেষ আমরা
একে অপরের দিকে বর্শা
নিয়ে দৌড়ে এসে একে
অপরকে মেরে দেবো। তুমি
যখন আমাদের দেশে যাবে
তখন শুধু পাবে পাথর,
ধুলো কাদা, মৃতদেহ এবং
এখানে ওখানে ছড়িয়ে থাকা
হাড় গোড়ের রাশি”।
জয়াপালের এই ধরনের তেজষ্বী
কথয়,সুবিক্তিগীন তখন সেই সন্ধি
প্রস্তাব মেনে নেয় এক
শর্তে, সবাইকে ইসলাম গ্রহন
করতে হবে এবং তার
অধীনস্ত এক সামন্ত রাজা
হিসাবে বাৎসরিক কর দিতে হবে।
জয়াপাল, সেই প্রস্তাব ঘৃনা
ভরে প্রত্যাখান করে তার পিপাষার্ত
সৈন্যদের বললেন, “ তোমরা এই বর্বর
অপশক্তির সংগে যুদ্ধ করো।
জানি তোমাদের পিপাসার জল নেই, খাবার
রান্না করা নেই, তবুও
হিন্দু বীরের মতো অভুক্ত
এবং পিপাষার্ত হয়ে যুদ্ধ করে
স্বর্গে যাও”।
হর হর মহাদেব ধ্বনি তুলে জয়াপালের সৈন্য রা তেড়ে গেলো বর্বর অসভ্য অপশক্তির দিকে। কিন্তু অভুক্ত এবং পিপাষার্ত রা কতোক্ষন যুদ্ধ করবে? বিকেলের দিকে জয়াপাল বুঝলেন এই ভাবে এই ‘জিহাদী’ দের সংগে যুদ্ধ জয় হবে না। তিনি তার সৈন্যদের অস্ত্র সংবরন করতে বললেন এবং স্বসৈন্যে নিজের দেশের দিকে রওনা দিলেন। তার পরিকল্পনা রইলো ‘ আর একদিন অন্য কোনো ভাবে এই অপশক্তির বিরুদ্ধে মোকাবিলা করা’। জয়াপালের সৈন্যদের ফেলে যাওয়া জিনিষ পত্র, শষ্য সামগ্রী, থালা বাসন, কিছু হাতি এবং ঘোড়া নিয়ে সুবুক্তিগীনের সন্তুষ্ট থাকতে হলো এবং সে তার গজনী তে ফিরে গেলো। সেটা ৯৯৭ সালের ঘটনা। কাসিমের সিন্ধু জয়ের ২৮৫ বছর পর।।
ডাঃ মৃনাল কান্তি দেবনাথ