বিজ্ঞানী নিউটনের পূর্বে বিজ্ঞানী ভাস্করাচার্য কি মহাকর্ষ শক্তি আবিষ্কার করেছিলেন???

হিন্দু বিজ্ঞানী ভাস্করাচার্য (১১১৪-১১৮৫) বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনের (১৬৪২-১৭২৭) জন্মেরও কমপক্ষে পাঁচশত বছর পূর্বে মহাকর্ষ শক্তি আবিষ্কার করে তাঁর গ্রন্থ  আধুনিক বিশ্বে সকলের ধারণা মহাকর্ষ ও অভিকর্ষ শক্তি নিউটন প্রথম আবিষ্কার
করেছেন | অনেকেই জানেন না যে, এ বিষয়ে  বেদে
স্পষ্টভাবে আলোচনা করা হয়েছে |

সবিতা যন্ত্রৈঃ
“পৃথিবী মরভণাদস্কম্ভনে সবিতা দ্যামদৃংহৎ
অশ্বমিবাধুক্ষদ্ধু নিমন্তরিক্ষমতূর্তে বদ্ধং সবিতা সমুদ্রম ঋগ্বেদ,”
১০/১৪৯/১

অনুবাদ: “সূর্য রজ্জুবৎ আকর্ষণ দ্বারা পৃথিবীকে বাঁধিয়া রাখিয়াছে, নিরাধার
আকাশে দ্যুলোকের অন্যান্য গ্রহকেও ইহা সুদৃঢ় রাখিয়াছে, অচ্ছেদ্য আকর্ষণ

রর্জ্জুতে আবদ্ধ, গর্জনশীল গ্রহসমূহ নিরাধার আকাশে অশ্বের ন্যায় পরিভ্রমণ
করিতেছে |”

দেখুন, আকাশ যে ‘নিরাধার’ এবং ‘রজ্জুবৎ আকর্ষণ’ অর্থাৎ মহাকর্ষ শক্তির
দ্বারাই যে সেই নিরাধার আকাশে সূর্য ও গ্রহসমূহ নিজ অক্ষরেখায় সুদৃঢ় রয়েছে
-এখানে সেকথা বলা হয়েছে বিশ্বের প্রভাবশালী অনেক ধর্মগ্রন্থে আকাশকে
স্পষ্টভাবে ‘পৃথিবীর ছাদ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে অথচ এই সব ধর্মমতের
জন্মেরও হাজার বছর পূর্বে বেদে আর্য ঋষিগণ আকাশকে ‘নিরাধার’ অর্থাৎ
পৃথিবীকে ও গ্রহসমূহকে শূন্যে ভাসমান বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন |
আরও লক্ষণীয়, মহাকর্ষ শক্তিতে আবদ্ধ গ্রহসমূহ যে নিরাধারে অর্থাৎ মহাশূন্যে
স্থির নয়, বরং পরিভ্রমণ করছে নিজ কক্ষপথে -এই তত্ত্বও আবিষ্কার করেছিলেন
বৈদিক ঋষিগণ , এমনকি সূর্য নিজেও যে তার নিজস্ব কক্ষপথে চলছে সেই
অত্যাশ্চর্য গূঢ় বিজ্ঞানও আলোচিত হয়েছে নিম্নের মন্ত্রে : –

“আকৃষ্ণেন রজসা বর্তমানো নিবেশয়ন্নমৃতং মর্তঞ্চ
হিরণ্ময়েন সবিতা রথেনা দেবো যাতি ভুবনানি পশ্যন্ ঋগ্বেদ,” ১/৩৫/২

অনুবাদ: – “সূর্য আকর্ষণযুক্ত পৃথিব্যাদি লোক-লোকান্তরকে সঙ্গে রাখিয়া
নশ্বর-অবিনশ্বর উভয় পদার্থকে নিজ নিজ কার্যে নিযুক্ত রাখিয়া এবং
মাধ্যাকর্ষণ রূপে রথে চড়িয়া যেন সারা লোকান্তর দেখিতে দেখিতে গমন করিতেছে
|”

খুব অবাক হতে হয়, পৃথিবী যেমন চাঁদকে সঙ্গে নিয়ে সূর্যের চারপাশে প্রদক্ষিণ
করছে, তদ্রুপ সূর্যও যে তার গ্রহ-উপগ্রহসমূহকে সঙ্গে নিয়ে নিজের কক্ষপথে
গমন করছে -এই গভীর জ্ঞানও পবিত্র বেদে আলোচিত হয়েছে |
মহাবিজ্ঞানী ভাস্করাচার্য (১১৫০ খ্রি: তাঁর ‘সিদ্ধান্ত শিরোমণি’ নামক
জ্যোতিঃশাস্ত্রের গোলাধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন –

“আকৃষ্টি শক্তিশ্চ মহী তয়া যৎ স্বস্থং স্বাভিমুখী করোতি
আকৃষ্যতে তৎ পততীব ভাতি সমে সমন্তাৎ কুবিয়ং প্রতীতিঃ”
অর্থাৎ “সর্ব পদার্থের মধ্যে এক আকর্ষণ শক্তি বিদ্যমান রহিয়াছে, যে শক্তি
দ্বারা পৃথিবী আকাশস্থ পদার্থকে নিজের দিকে লইয়া আসে যাহাকে ইহা আকর্ষণ করে
তাহা পতিত হইল বলিয়া মনে হয়”
অর্থাৎ প্রাচীন ঋগ্বেদ শাস্ত্রের পাশাপাশি ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করলেও  বিজ্ঞানী ভাস্করাচার্য (১১১৪-১১৮৫) বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনের
(১৬৪২-১৭২৭) জন্মেরও কমপক্ষে পাঁচশত বছর পূর্বে মহাকর্ষ শক্তি আবিষ্কার করে
তাঁর গ্রন্থ ‘সিদ্ধান্ত শিরোমণি’তে আলোচনা করে গিয়েছেন |

ভাস্করাচার্য জীবনী

দক্ষিণ ভারতের বিজ্জবিড় নামে এক নগরে বাস করতেন ভাস্করাচার্য। অঙ্ক এবং
জ্যোতিষ দু’টি বিষয়েই ছিল তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্য। নগরের সীমানা ছাড়িয়ে
তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল দূর দেশে।  দেশের রাজা মহারাজা থেকে শুরু করে
সাধারণ মানুষ সকলেই তাঁকে শ্রদ্ধা করত। বিধবা কন্যা লীলাবতীর জীবনের দুঃখ
ভোলাবার জন্য ভাস্করাচার্য কন্যাকে বিদ্যাশিক্ষা দিতে আরম্ভ করেন। আর সেই
জন্য রচনা করলেন গণিত শাস্ত্রের বিশাল এক গ্রন্থ ‘সিদ্ধান্ত শিরোমণি’। এই
গ্রন্থের মোট চারটি খণ্ড। প্রথম খণ্ডের নাম লীলাবতী। এতে সাধারণ গণিত নিয়ে
আলোচনা করা হয়েছে। লীলাবতী পৃথিবীর আদিমতম গণিতের গ্রন্থ। প্রাচীন ভারতের
সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা।

আনুমানিক ১১৫০ খ্রিস্ট্রাব্দে ‘সিদ্ধান্ত শিরোমণি’ রচিত হয়েছিল। তখন
ভাস্করাচার্যের বয়স মাত্র ৩৬। ইউরোপে প্রথম গণিতের বই প্রকাশিত হয়েছিল ১২০২
খ্রিস্টাব্দে। লিওনার্দো দ্য পিসা নামে এক পণ্ডিত এই বই রচনা করেছিলেন।

আনুমানিক ১১১৪ খ্রিস্টাব্দে দাক্ষিণাত্যের বিজ্জবিড় গ্রামে
ভাস্করাচার্যের জন্ম হয়। তাঁর জীবন কাহিনি সম্পর্কে যতটুকু জানা যায় তার
কতটুকু সত্য কতটুকু কল্পনা বিচার করা কঠিন। তবে সাম্প্রতিক কালে
মহারাষ্ট্রের চালিসগাও নামে একটি স্থান থেকে কয়েক মাইল দূরে একটি পুরনো
মন্দিরের শিলালিপি থেকে জানা যায় ভাস্করাচার্যের পিতার নাম ছিল মহেশ
দৈবজ্ঞ; তাঁর পিতামহের নাম মনোরথ; তাঁর ঊর্ধ্বতন পুরুষের নাম যথাক্রমে
প্রভাকর, গোবিন্দ, ভাস্করভট্র এবং ত্রিবিক্রম। ভাস্করাচার্যের দুই পুত্রের
নাম জানা যায়, লক্ষ্মীধর ও চঙ্গদেব। এঁরা সকলেই ছিলেন শাস্ত্রজ্ঞ।

পাণ্ডিত্যের জন্য তাঁরা ছিলেন সকলের শ্রদ্ধেয়। শিলালিপিতে প্রত্যেকের
সম্পর্কেই রয়েছে প্রশস্তি। তবে ভাস্করাচার্যের প্রশংসায় মুখরিত হয়ে উঠেছেন
লিপিকার। তাঁকে বলা হয়েছে ‘ভট্র পারদর্শী তিনি সাংখ্য, তন্ত্র, বেদে
মহাপণ্ডিত। তাঁর তুল্য জ্ঞান আর কারও নেই। কাব্যে, কবিতায়, ছন্দে অতুলনীয়।
গণিতে তিনি মহাজ্ঞানী, তাঁর চরণে প্রণাম জানাই’।

এই লিপিতে কোথাও লীলাবতীর উল্লেখ নেই। তা হলে লীলাবতীর অস্তিত্ব কি
শুধুই কাল্পনিক! এই বিষয়ে নানা রকম মত আছে। অনেকের ধারণা লীলাবতী ছিলেন
ভাস্করাচার্যের কন্যা। তিনি অত্যন্ত বিদূষী ছিলেন। লীলাবতী অংশটি তাঁরই
রচিত। ভাস্করাচার্য সমগ্র ‘সিদ্ধান্ত শিরোমণি’ গ্রন্থটি কন্যাকে উৎসর্গ
করেছিলেন। কেউ বলেন লীলাবতী নামে কোন নারীরই অস্তিত্ব নেই। কারণ এই বইটির
বিভিন্ন শ্লোকে কোথাও শখে, কোথাও প্রিয়ে, চঞ্চলা ইত্যাদি সম্বোধন করেছেন।
কন্যাকে কেউই প্রিয়ে বা সখে বলে সম্বোধন করে না। সম্ভবত ভাস্করাচার্য
জ্ঞানের দেবী সরস্বতীকেই বিভিন্ন সম্বোধনে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করেছেন।

সূত্র : বিশ্বের সেরা ১০১ বিজ্ঞানীর জীবনী, আ. ন. ম. মিজানুর রহমান পাটওয়ারি, মিজান পাবলিশার্স, ঢাকা