বনু ছাহামে গোত্র ছিল নিতান্তই হাভাতে, ঠিক মত তাদের খাবার জোটে না। হযরত মুহাম্মদ তার অনুসারীদের দিকে চেয়ে দেখেন আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। এই দীর্ঘশ্বাসটা গিয়ে পড়ে ইহুদীদের বাড়বাড়ন্ত গ্রামগুলির দিকে। তাদের গোলা ভরা শস্য দানা। খোয়ারে ভর্তি গবাদি পশু। তাদের ছেলেমেয়েরা কি রুষ্টপুষ্ট আর স্বাস্থ্যবান! ইসলাম ঘোষণা হয়েছে ১৩ বছর। এই ১৩ বছরে তো একদিনও না খেয়ে থাকা যায়নি। বাঁচতে হলে খেতে হবে সে তুমি ইহুদী হও আর মুসলমানই হও। শুধু তো খাওয়া নয়, বাঁচার মত বাঁচতে না পারলে মানুষ হিসেবে নিজের আত্ম সম্মানটা আর অবশিষ্ট থাকে না। কিন্তু উপায় কি? খাবার তো আকাশ থেকে আসে না। মুহাম্মদের সঙ্গে আছেন একজন আল্লাহ যিনি তাকে এক ফেরেস্তার মাধ্যমে কবিতার মত কিছু পঙক্তি পাঠান যা মুহাম্মদ তার অনুসারীদের আবৃত্তি করে শোনান। কিন্তু পেটের খিদে কি কাব্য শুনে মিটবে? যে ফেরেস্তা মুহাম্মদের কাছে কবিতা নিয়ে আসেন সে কি আল্লাহ’র কাছে গিয়ে তাদের অনাহারের কথা বলতে পারে না? মুহাম্মদ জানে তার আল্লার কোন জমি নেই। তিনি ফসল ফলান না। একটা শষ্য দানাও বাজার থেকে তার কিনে দেয়ার স্বাধ্য নেই। সলাম গোত্রের শাখা বনু ছাহামের লোকজন যখন নিজেদের অভাবের কথা মুহাম্মদের কাছে পেশ করল তখন মুহাম্মদ তাদের সামনে তার আল্লাহ’র কাছে দোয়া করতে লাগল, “হে আল্লাহ, তুমি ওদের অবস্থা জানো। তুমি জানো যে, ওদের মধ্যে শক্তি নেই, আর আমার কাছে এমন কিছু নেই যে ওদের দেবো। হে আল্লাহ, ইহুদীদের এমন দুর্গ জয় করিয়ে আমাদের সাহায্য করো যে দুর্গ জয় আমাদের জন্যে সর্বাধিক ফলপ্রসূ হয়, যে দুর্গে সবচেয়ে বেশী খাদ্য-সামগ্রী ও চর্বি পাওয়া যায়।“-[ইবনে হিশাম, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৩২]
ইসলামের নবী তার অনুসারীদের তারপর খয়বরের ছা‘ব ইবনে মায়া‘য দুর্গ আক্রমনের হুকুম দেন। অস্তিত্বেব সংকট যেখানে সেখানে মড়িয়া লুটেরাদের সামনে দাঁড়ায় এমন কে আছে! ইহুদীরা মূলত কৃষিজীবী। এরা যুদ্ধে পটু নয়। ছা‘ব ইবনে মায়া‘য দুর্গ মুসলমানের দখলে চলে আসে। এ দুর্গের চেয়ে অধিক খাদ্যদ্রব্য এবং চর্বি খয়বরের অন্য কোন দুর্গে ছিলো না।-[ইবনে হিশাম, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৩২]
ছা‘ব ইবনে মায়া‘য দুর্গ দখলের পর মুসলমানদের নজর পড়ে যোবায়ের দূর্গের দিকে। এটি ছিল খুবই সুরক্ষিত একটি দূর্গ। পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত এই দূর্গে উঠার পথ ছিল খুবই কষ্টকর। হযরত মুহাম্মদ এই দূর্গকে তিন দিন পর্যন্ত অবরোধ করে রাখার ঘোষণা দেন। সব যুদ্ধ, দুর্যোগ আর খারাপ সময়েই নিজেদের মধ্যের লোকজনই বিশ্বাসঘাতকতা করে থাকে। তেমনই একজন ইহুদী দূর্গের সমস্ত ইহুদীদের সর্বনাশ করতে এগিয়ে আসে। ইবনে হিশাম এই ইহুদীকে “হৃদয়বান” হিসেবে বর্ণনা করলেও সে ছিল আসলে একটা “রাজাকার”! সে মুহাম্মদকে যেচে গোপনে এসে বলে, “হে আবুল কাশেম, আপনি যদি একমাস যাবত দুর্গ অবরোধ করে রাখেন তবুও ইহুদীরা পরোয়া করবে না। তবে তাদের পানিয় ঝর্ণা নীচে রয়েছে। রাতের বেলা তারা এসে পানি পান করে এবং সারাদিনের প্রয়োজনীয় পানি তুলে নিয়ে যায়। আপনি যদি ওদের পানি বন্ধ করে দিতে পারেন, তবে তারা নত হবে।“ [দৃষ্টাব্দ: ঐ]
মুহাম্মদ সঙ্গে সঙ্গে ইহুদীদের পানির উৎস বন্ধ করে দেন। ইহুদীদের এরপর দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়। যোবায়ের দূর্গও মুসলিমদের দখলে আসলো অতি সহজে।
এরপর একে একে উবাই দূর্গও মুসলিমরা আক্রমন চালিয়েয়ে ইহুদীদের বন্দি করে তাদের সম্পত্তি গণিমতের মাল হিসেবে ডিক্রি জারি করেন। পতন হতে থাকে খয়বরের একের পর এক ইহুদীদের বসতি। কিন্তু নেজার দূর্গ নিয়ে ইহুদীদের বিশ্বাস ছিল এটা মুসলমানদের পক্ষে দথল করা নাও সম্ভব হতে পারে। এ কারণে তাদের সমস্ত নারী ও শিশুদের তারা নেজার দূর্গে সমবেত করে রেখেছিল। যথারীতি হযরত মুহাম্মদ এই দূর্গকেও অবরোধ করে রাখলেন। অবশেষে দূর্গের দেয়াল গোলা নিক্ষেপ (পাথরের চাড়) করে দেয়াল ভেঙ্গে দূর্গে মুসলিম হানাদার বাহিনী প্রবেশ করতে সক্ষম হয়। এই দূর্গ জয় ছিল আসলে খয়বরের অর্ধেক জয়ের সামিল। এই মজবুত ও সুরক্ষ দূর্গের পতনের সংবাদে অন্যান্য দূর্গের ইহুদীদের মনোবল ধ্বংস হয়ে যায়। তারা রক্তপাত ও ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে স্বেচ্ছায় নিজেদের আত্মসমর্পনের ঘোষণা দেয়।- [ইবনে হিশাম, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৩১, ৩৩৬, ৩৩৭]
কোতায়বায় এসে মুহাম্মদ ১৪ দিনের অবরোধ জারি রাখেন। শেষ পর্যন্ত ইহুদীরা আত্মসমর্পনের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। ইহুদীদের নেতা ইবনে আবুল হাকিক হযরত মুহাম্মদের কাছে সন্ধির প্রস্তাব পাঠান। সন্ধির আলোচনা ইবনে আবুল হাকিক মুহাম্মদের কাছে পয়গাম পাঠায় যে, “আমি কি আপনার কাছে এসে কথা বলতে পারি? মুহাম্মদ বললেন, হ্যাঁ। অনুমতি পাওয়ার পর আবুল হাকিক এই শর্তে সন্ধি প্রস্তাব পেশ করে যে, দুর্গে যেসকল সৈন্য রয়েছে তাদের প্রাণ ভিক্ষা দেয়া হবে এবং তাদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যাও তাদের কাছেই থাকবে। অর্থাৎ তারা মুসলমানদের দাস-দাসী হিসেবে বন্দী থাকবে না। তারা নিজেদের অর্থ-সম্পদ সোনা-রূপা, জায়গা-জমি, ঘোড়া, বর্ম ইত্যাদি সব কিছু আল্লাহর রসূলের কাছে অর্পণ করবে, শুধু পরিধানের পোশাক নিয়ে বেরিয়ে যাবে।–[আবু দাউদ, ২য় খণ্ড, খয়বর প্রসঙ্গ। পৃ. ৭৬]
সব শুনে মুহাম্মদ জানালেন যদি তারা কিছু লুকায় (সোনাদানা) তবে সে জন্য তার আল্লাহ ও রসূল দায়ী হবেন না। অর্থ্যাৎ যদি তারা যাওয়ার সময় লুকিয়ে সঙ্গে কিছু নেয় তো তাদের কপালে খারাপি আছে! নিজের সয়সম্পত্তিকে কেউ চুরি করে না। আত্মসাৎও করে না। তবে কথিত “সন্ধির” শর্ত লঙ্ঘন হয়। আবুল হাকিকের উপর অভিযোগ উঠে সে তাদের সোনাদানা কোথাও মাটিতে পুঁতে গোপন করে রেখেছে। মুসলমানদের সর্দার মুহাম্মদের কাছে আবুল হাকিকে আনা হয়। জানতে চাওয়া হয় সোনাদানা সব কোথায়? অবিকল যেন ৭১ সালের পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর কোন মেজর একটা অসহায় বাঙালী পরিবারকে দোনাদানা কোথায় লুকিয়ে রেখেছে জানতে চাইছে। আবুল হাকিক খুবই বজ্জাত। আল্লার রসূলের মুখের সামনে মিথ্যা কথা বলে। আল্লার নবী তার সাহাবীদের হুকুম দিলেন, যতক্ষণ সে স্বীকার না করবে ততক্ষণ তার বুকে চকমকি পাথর ঘষতে থাকবে!- [দেখুন: ইবনে হিশাম]
এখানেও এক “ইহুদী রাজাকার” ছিল। সে এসে জানালো আবুল হাকিক কোথায় মাটিতে সোনাদানা রেখেছে সে দেখেছে। সঙ্গে সঙ্গে মুহাম্মদ হুকুম দিলেন খনন করতে। পাওয়া গেলো গচ্ছিত সম্পদ। আবুল হাকিককে আরো বেশি নির্যাতন বাড়ানো হলো যাতে সে অবিশিষ্ট সম্পত্তির কথা জানায়। কিন্তু পাষন্ড ইহুদীটা দুনিয়াবী সম্পত্তির প্রতি এতটাই লোভী ছিল যে শেষ পর্যন্ত মুখ খুলল না। অগত্যা আল্লাহ’র নবীর আর কি করার থাকে? তাকে শেষ পর্যন্ত হত্যা করা হয়। আবুল হাকিক দুই পুত্রকেও সম্পত্তি গোপন করায় হত্যা করা হয়।
খয়বর বিখ্যাত আরো একটি কারণে। সে সাফিয়া। দূর্গ দখলের পর ইহুদী নারী ও শিশুদের নিয়তি ছিল গণিমতের মাল হয়ে উঠা। তাদেরকে ভাগটোগ করার পর শেষে দাস হিসেবে বাজারে বিক্রি করে দেয়া হবে। কিন্তু সাফিয়া ছিলেন অনন্য সুন্দরী। মুহাম্মদ তাকে বিয়ে করেন সেদিনই। ইবনে হিশামে উল্লেখ আছে, তাদের বাসরঘরের বাইরে একজন সাহাবী সারারাত জেগে তাঁবু পাহাড়া দিচ্ছিলেন কারণ সাফিয়া যাতে তার বাবা-স্বামীর হত্যাকারী মুহাম্মদকে আক্রোশ বশত হত্যা না করে বসে। [সাফিয়ার বিয়ে সম্পর্কে দেখুন: সহীহ বোখারী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫৪ যাদুল মায়াদ ২য় খণ্ড, পৃ. ১৩৭]
খয়বর থেকে মুহাম্মদ সমস্ত ইহুদীদের উচ্ছেদ করতেই চেয়েছিলেন। কিন্তু ইহুদের একটা প্রস্তাবে সে ইচ্ছা থেকে সাময়িক সরে আসেন। আরবরা কৃষিকাজ করেনি কোন কালেই। খয়বরে উর্বর জমি থেকে ইহুদীরা ফসল ফলায়। মুসলিমরা যদি বসে বসে তার অর্ধেক ভাগ পায় তো সোনায় সোহাগা! ইহুদীদের নিজ দেশ থেকে বের করে দেয়ার খবর শুনে ইহুদীরা মুহাম্মদের কাছে প্রস্তাব দেয়- “হে মোহাম্মদ আপনি আমাদের এই যমিনেই থাকতে দিন আমরা এর তত্ত্বাবধান করবো। এই ভূখণ্ড সম্পর্কে আমরা আপনাদের চেয়ে বেশী অবগত।“ মুহাম্মদ একদম লুফে নেন প্রস্তাব। ইহুদীদের জমি ইহুদীদের কাছেই বর্গা দেয়া হলো! ইহুদীরা ফসল ফলাবে যার অর্ধেক মুসলিমরা ভোগ করবে! তবে এটা যতদিন মুহাম্মদ চাইবেন ততদিনই চলবে। যদি মুহাম্মদ চান ইহুদীদের বহিস্কার করবেন তো যখন খুশি তখনই করতে পারবেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে রওয়াহাকে খয়বরের জমির তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করা হয়। খয়বরের মোট জমির ৩৬ ভাগে ভাগ করা হয়।-[যাদুল মায়দ, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৩৭-১৩৮]
খয়বর দখল করার পূর্বে মুসলমানরা পেট ভরে খেতেও পারত না। আল্লাহ মেহেরবান! ইহুদীদের সম্পদ, তাদের বাগান, শষ্য, ঘরের বউ-ঝিদেরকে দিয়ে মুসলমানদের বুভুক্ষু উদর ভরিয়ে দিয়েছেন। হযরত আয়শা (রা) বলেন, খয়বর বিজয়ের পর আমরা বলাবলি করলাম যে, এখন থেকে আমরা পেটভরে খেজুর খেতে পারবো।[সহীহ বোখারী, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৬০৯]
কিন্তু খয়বর মুসলমানদের পেট ভরে খেতে দিলেও মুহাম্মদের জন্য দুর্ভাগ্য বয়ে এনেছি খয়বর বিজয় শেষে। সালাম ইবনে মুশকিম এর স্ত্রী যয়নব বিনতে হারেছ মুহাম্মদের কাছে একটি বকরির ভুনা মাংস উপঢৌকন হিসেবে পাঠান। যয়নব বিনতে হারেছ নামের এই ইহুদী বৃদ্ধা নারী আসলে তার পুত্র ও স্বামী হত্যাকারী হযরত মুহাম্মদকে হত্যা করে প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন। মনে মনে আরো ভেবেছিলেন যদি এই লোক রাজা হয়ে থাকে তো এর হাত থেকে আমরা মুক্তি পাবো। আর যদি সত্যিই সে নবী হয় তো খাওয়ার আগেই সে জেনে যাবে মাংসে বিষ মাখানো রয়েছে…। যয়নব বিনতে হারেছ মুহাম্মদের প্রিয় বকরির ভুনা মাংসে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিলেন। মুহাম্মদ মাংস নিয়ে মুখে দিলেন। খেতে খেতে বুঝতে পারলেন মাংসে বিষ মাখানো আছে! বিষ তখন খানিকটা পাকস্থালিতে পৌছে গেছে। তার সঙ্গে খেতে বসা সাহাবী হযরত বাশার ইবনে বারা ইবনে মারুর পেটে মাংস যেতেই সে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে। মুহাম্মদ থু থু করে মুখ থেকে মাংস ফেলে দেন। যয়নব বিনতে হারেছকে ডেকে আনা হলে সে সব স্বীকার করে। মুহাম্মদ তার নির্জলা স্বীকারক্তি শুনে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু অন্য একটা বর্ণনায় পাওয়া যায় যয়নব বিনতে হারেছ পরে হত্যা করা হয়েছিল বাশার ইবনের মৃত্যুর কারণে।- [ যাদুল মায়াদ, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৩৯, ফতহুল বারী, সপ্তম খণ্ড, পৃ. ৪৯৭ ইবনে হিশাম, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৩৭]
খয়বরের এই বিষ মাখানো মাংস খেয়েই হযরত মুহাম্মদ বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে চার বছর পর মারাত্মক অসুস্থ অবস্থায় মারা যান। (সহি বুখারী, খন্ড-৭, অধ্যায়-৭১, হাদিস- ৬৬৯)।