১০০ কোটি হিন্দু অধ্যুষিত রাষ্ট্র ভারতে গিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ বলে বক্তৃতা শুরু করলেন -তবুও তিনি অসাম্প্রদায়িক।
অন্যদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কিন্তু বাংলাদেশ সফরে এসে ‘জয় শ্রীরাম’ বলে বক্তৃতা শুরু করেন নাই -তবুও তিনি সাম্প্রদায়িক।
আমরা জানি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী কোন রাষ্ট্র প্রধান তাদের বিশেষ ধর্ম প্রচার করে বক্তৃতা রাখেন না। শুধুমাত্র ইসলামিক রাষ্ট্রের প্রধানরাই এসব করে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হঠাৎ এত রবীন্দ্র প্রেমী হলেন কেন বুঝলাম না, যার জন্য ভারতে যেতে হয়।
পাকিস্তান আমলে একবার এবং বর্তমান সরকারের আমলে আরেকবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লাঞ্ছিত হয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলার কবি, বাঙালির কবি। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিশ্ব দরবারে তাঁর মর্যাদার আসন করে নেয়। অথচ পাকিস্তান সরকার এবং তাঁর এদেশীয় চাটুকার সমর্থকগণ রবীন্দ্রনাথকে হিন্দুত্বের পরিচয়ের কারণে নির্বাসন দেয়ার সকল আয়োজন সম্পন্ন করে।
১৯৬১ সাল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশত বার্ষিকী। স্বভাবতঃ ই বাঙালি সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মীরা এ নিয়ে খুবই উদ্বেলিত ছিল। কিন্তু আইয়ুব খান ও তাঁর অনুসারীগণ বাঙালির আবেগের বিষয়টি অনুধাবন করতে সক্ষম হয়নি। ফলে রবীন্দ্র জয়ন্তী উপলক্ষে যেন কোন অনুষ্ঠান হতে না পারে সেজন্য সরকার সকল প্রচেষ্টা গ্রহণ করে। এমনকি সংস্কৃতি কর্মীদের আতঙ্কিত করার জন্য কে. জি. মোস্তফা ও সাহিত্যিক আলাউদ্দিন আল আজাদ প্রমুখকে গ্রেফতার করে। এর ফলে দেশে ব্যাপকভাবে অনুষ্ঠান আয়োজনে ভাটা পড়ে। তবে সরকার রবীন্দ্র জন্মশত বার্ষিকী উদযাপন থামাতে পারেনি। বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদ এবং অধ্যাপক খান সারওয়ার মুর্শিদের নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘রবীন্দ্র জন্মশত বার্ষিকী’ উদযাপন কমিটি। এ কমিটি ৬ দিনব্যাপী অনুষ্ঠান মালার আয়োজন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ কার্জন হলে দু’ দিনব্যাপী অনুষ্ঠান আয়োজন করে। অন্যান্য শিল্পী-সাহিত্যিকগণ প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠান আয়োজন করে। বিভিন্ন মফস্বল শহরেও জাঁকজমকের সাথে রবীন্দ্র জন্মশত বার্ষিকী পালন করা হয়।
রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী সানজীদা খাতুন এ সময় এক অসাধারণ কাজ করেন। তিনি গঠন করেন ‘ছায়ানট’। স্বৈরাশাসক আইয়ুব খানের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে যে ‘ছায়ানটের’ যাত্রা শুরু তা আজ বিশাল মহীরুহের আকার ধারণ করছে। ছায়ানট আজ বাঙালি বর্ষবরণের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে এ সুযোগে পাকিস্তান সরকার বেতার ও টেলিভিশনে রবীন্দ্র সঙ্গীত সীমিত পরিসরে বেতার ও টেলিভিশনে সম্প্রচার করার অনুমতি প্রদান করা হয়।
১৯৬৭ সালের জুন মাসে পাকিস্তানের রাজধানী রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের সংসদ অধিবেশন বসে। ২০ জুন এ অধিবেশনে মুসলিমলীগ নেতা খান আব্দুস সবুর খান রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এক অনির্ধারিত বক্তৃতার মাধ্যমে বিতর্কের সূত্রপাত ঘটান। তিনি তাঁর বক্তৃতায় বলেন, “ইদানিং পূর্ব বাংলায় সাংস্কৃতিক পুনরুজ্জীবনের অশুভ তৎপরতা তিনি উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছেন। পহেলা বৈশাখ ও রবীন্দ্র জয়ন্তী উদযাপনের নামে বিদেশী সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে ইসলামি জীবনাদর্শের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তানের মূলে আঘাত করা হচ্ছে”।
২২ জুন ড. আলীম আল রাজী এবং মজিবর রহমান চৌধুরীর প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্রীয় তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন বলেন, “রবীন্দ্রনাথের গান প্রচারের সময়সীমা যথাসম্ভব কমিয়ে দেয়া হয়েছে এবং তাঁর যে রচনা পাকিস্তানি আদেশের পরিপন্হী বিবেচিত হবে সেগুলোর প্রচার ভবিষ্যতে সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়া হবে”।
জাতীয় পরিষদের এই বিতর্কের সংবাদ ঢাকার সংবাদপত্র দৈনিক পাকিস্তান ও দৈনিক অবজারভারে ২৩-২৮ জুন ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। এতে ঢাকার বুদ্ধিজীবী মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। তথ্যমন্ত্রী শাহাবুদ্দিনের বক্তব্যের পক্ষে বিপক্ষে বক্তৃতা-বিবৃতি প্রদান ও সভা-সমাবেশ অব্যহত গতিতে চলতে থাকে। ছাত্ররাও এসব প্রতিবাদে বুদ্ধিজীবীদের সাথে একাত্ন হয়। পূর্ব পাকিস্তানের একজন সংসদ সদস্য এ. কে. এম সোলাইমান রবীন্দ্র বিরোধীদের ঢাকায় পা ফেলার প্রতি চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করে বসেন। এতে সংসদ অধিবেশনে চরম হট্টগোল সৃষ্টি হয়। সবুর খান এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা সাহিত্যের উপর একটি দীর্ঘ বক্তৃতা প্রদান করেন। তিনি তাঁর বক্তৃতায় ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও মধুসূদন দত্তকে চক্রান্তকারী হিসেবে অভিহিত করেন। এক পর্যায়ে সংসদ নেতা সবুর খান রবীন্দ্রনাথকে ব্যঙ্গ করে ‘ড. রবীন্দ্রনাথ’ বলে সম্বোধন করেন। তিনি রবীন্দ্র ভক্তদের ‘Howling Idiot’ বলে তিরস্কার করেন।
বাঙালি বুদ্ধিজীবীগণ রবীন্দ্র বিতর্কে বিভক্ত হয়ে পড়েন। আবুল মনসুর আহমেদের মত রাজনীতিবিদগণও প্রতিক্রিয়াশীলদের পক্ষাবলম্বান করেন। এছাড়া ইব্রাহিম খাঁ, তালিম হোসেন, ফররুখ আহমেদ, ড. হাসান জামান, মুজিবর রহমান খাঁ প্রমুখ বিবৃতির মাধ্যমে সবুর খান ও খাজা শাহাবুদ্দীনের বক্তব্যকে সমর্থন জানান।
পাকিস্তানপন্হী বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদদের বক্তব্যের মাধ্যমে এরূপ মনোভাব সংগঠনের চেষ্টা করা হয় যেন ‘রবীন্দ্রনাথ’ ব্যতীত আর সকল সঙ্গীত ও নৃত্যই বৈধ ও পবিত্র। এরূপ প্রচারণার নিন্দা জানিয়ে ১৯৬৭ সালের ২৫ জুন পূর্ব বাংলার শীর্ষ স্হানীয় ১৮ জন বুদ্ধিজীবী যেমন- ড. কুদরত-ই-খোদা, সুফিয়া কামাল, শিল্পী জয়নুল আবেদীন, অধ্যাপক আব্দুল হাই, মুনীর চৌধুরী, ড. আহমদ শরীফ, ড. নীলিমা ইব্রাহিম, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, ড. আনিসুজ্জামান, রফিকুল ইসলাম, ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, শহীদুল্লাহ কায়সার, খান সারওয়ার মুরশিদ, কবি সিকান্দার আবু জাফর, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ও অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম প্রমুখ একটি যৌথ বিবৃতি প্রদান করেন। বিবৃতিতে বলা হলো সরকারি মাধ্যম হতে রবীন্দ্র সঙ্গীতের প্রচার হ্রাস ও বর্জনের সিদ্ধান্ত প্রকাশ হওয়ায় আমরা অত্যন্ত দুঃখজনক বলে মনে করি।
এভাবে পাকিস্তানী শাসকচক্র পূর্ব বাংলার বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। রবীন্দ্র বিতর্কে এদেশের আলেম সমাজও অংশ নিয়েছিলেন। ২০ জুন পূর্ব বাংলার কতিপয় আলেম তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্যকে সমর্থন করে যে বিবৃতি প্রদান করেন তাঁর অংশবিশেষ ছিল নিম্নরূপ- “পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম দিন হইতেই এই সকল সঙ্গীতের আবর্জনা হইতে রেডিও এবং টেলিভিশনকে পবিত্র রাখা প্রয়োজন ছিল”।
এইতো গেল পাকিস্তান শাসনামলে রবীন্দ্র বিরোধী কার্যকলাপ। এবার দেখুন বর্তমান সরকারের শাসনামলে রবীন্দ্র বিরোধীদের কার্যক্রম। আপনারা জানেন হেফাজতে ইসলামের কথা ধরে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার পাঠ্যপুস্তক থেকে রবীন্দ্রনাথের গল্প-কবিতা উঠিয়ে দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথকে ইসলাম বিদ্বেষী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধী বলছে। রবীন্দ্রনাথের লেখা জাতীয় সংগীত বয়কটের দাবি উঠেছে। রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধীতা করা হয়েছে। পাকিস্তান শাসনামলে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করায় পাকিস্তান সরকার ধন্যবাদ জানিয়ে ছিলেন কবি ফররুখ আহমেদ। পাঠ্যপুস্তকে সেই রবীন্দ্র বিদ্বেষী ফররুখ আহমেদের কবিতা স্হান পায় কিন্তু রবীন্দ্রনাথ পায় না।
যে দেশের মানুষ রবীন্দ্র বিদ্বেষী, সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী বিশ্ব ভারতীয় রবীন্দ্র সম্মেলনে গেলেন।
এতই যদি রবীন্দ্র প্রেমী হন তবে রবীন্দ্র বিদ্বেষীদের শাস্তির ব্যবস্হা করুন।