লোকসাহিত্য মৌখিক ধারার সাহিত্য যা অতীত ঐতিহ্য ও বর্তমান
অভিজ্ঞতাকে আশ্রয় করে রচিত হয়। একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক পরিমন্ডলে একটি
সংহত সমাজমানস থেকে এর উদ্ভব। সাধারণত অক্ষরজ্ঞানহীন পল্লিবাসীরা স্মৃতি ও
শ্রুতির ওপর নির্ভর করে এর লালন করে। মূলে ব্যক্তিবিশেষের রচনা হলেও
সমষ্টির চর্চায় তা পুষ্টি ও পরিপক্কতা লাভ করে। এজন্য লোকসাহিত্য সমষ্টির
ঐতিহ্য, আবেগ, চিন্তা ও মূল্যবোধকে ধারণ করে। বিষয়, ভাষা ও রীতির ক্ষেত্রে
প্রচলিত ধারাই এতে অনুসৃত হয়। কল্পনাশক্তি, উদ্ভাবন-ক্ষমতা ও পরিশীলিত
চিন্তার অভাব থাকলেও লোকসাহিত্যে শিল্পসৌন্দর্য, রস ও আনন্দবোধের অভাব থাকে
না।
লোকসাহিত্য লোকসংস্কৃতির একটি জীবন্ত ধারা; এর মধ্য দিয়ে জাতির আত্মার স্পন্দন শোনা যায়। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একে ‘জনপদের হূদয়-কলরব’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। লোকসাহিত্যকে প্রধানত লোকসঙ্গীত, গীতিকা, লোককাহিনী, লোকনাট্য, ছড়া, মন্ত্র, ধাঁধা ও প্রবাদ এই আটটি শাখায় ভাগ করা যায়।
লোকসঙ্গীত ঐতিহ্যগতভাবে বিশেষ সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত
গান; সাধারণত পল্লীর অনক্ষর জনগণ এর প্রধান ধারক। বিষয়, কাল ও উপলক্ষভেদে
এ গানের অবয়ব ছোট-বড় হয়। ধুয়া, অন্তরা, অস্থায়ী ও আভোগ সম্বলিত
দশ-বারো চরণের লোকসঙ্গীত আছে; আবার ব্রতগান, মেয়েলী গীত, মাগনের গান, জারি গান, গম্ভীরা গান ইত্যাদি আকারে অপেক্ষাকৃত বড় হয়। কবির লড়াই, আলকাপ গান, লেটো গান এবং যাত্রাগান হয় আরও দীর্ঘ, কারণ সারারাত ধরে এগুলি পরিবেশিত হয়।
লোকসঙ্গীতের গায়করা পেশাদার ও অপেশাদার উভয়ই হতে পারে। পেশাদার
কোনো গায়েন বা বয়াতি দল গঠন করে অর্থের বিনিময়ে গান গায়; কবিয়াল দলবল
নিয়ে কবির লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করে। আলকাপ গানের ছোকরা এবং ঘাটু গানের ঘাটু
পেশাদার নটী ও গায়ক; উদাস বাউল নিজেই গান করে তার অধ্যাত্মপিপাসা নিবৃত্ত করে। বৈরাগী-বৈরাগিণী বা বোষ্টম-বোষ্টমী গান গেয়ে ভিক্ষা করে। বিবাহাদি অনুষ্ঠানে মেয়েলি গীত
গাওয়ার জন্য পেশাদার গিদাল থাকে; তবে সাধারণ মেয়েরাও গান গায়।
ক্ষেত-খামারে কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষ, মাঠে-ঘাটে রাখাল এবং নদী-হাওরে
মাঝি-মাল্লারাও চিত্তবিনোদন, অবসরযাপন বা শ্রম লাঘবের জন্য গান গায়।
বাংলা লোকসঙ্গীত নাম ও প্রকারভেদে বিচিত্র; অঞ্চলভেদে এর প্রায়
শতাধিক নাম রয়েছে এবং প্রকারভেদে প্রায় পঞ্চাশোর্ধ্ব শ্রেণির গান চিহ্নিত
করা যায়। কেউ কেউ আঞ্চলিক ও সর্বাঞ্চলীয়, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক,
সাধারণ ও তত্ত্বপ্রধান, তালযুক্ত ও তালহীন এরূপ স্থূলভাবে ভাগ করে সেগুলির
আবার নানা উপবিভাগ করেছেন। আশুতোষ ভট্টাচার্য
লোকসঙ্গীতকে আঞ্চলিক, ব্যবহারিক, আনুষ্ঠানিক (ritual), কর্মমূলক ও
প্রেমমূলক এই পাঁচটি ভাগে ভাগ করেছেন। বিষয়গত দিক থেকে একে প্রেম,
ধর্ম-আচার-সংস্কার, তত্ত্ব ও ভক্তি, কর্ম ও শ্রম, পেশা ও বৃত্তি, ব্যঙ্গ ও
হাস্যকৌতুক এবং মিশ্র এরূপ সাতটি ভাগ করা যায়।
নর-নারীর প্রেম অবলম্বন করে রচিত বাংলা লোকসঙ্গীতে লৌকিক বা পার্থিব
প্রেম এবং তত্ত্ব-ভক্তিমূলক গানে অলৌকিক বা অপার্থিব প্রেমের কথা আছে।
রাধাকৃষ্ণের আখ্যান অবলম্বনে রচিত আলকাপ, কবিগান, ঘাটু গান, ঝুমুর, বারমাসি, মেয়েলি গীত, যাত্রাগান, সারি গান,
হোলির গান ইত্যাদিতে দেহজ কামনা-বাসনা, মান-অভিমান, মিলন-বিরহ ইত্যাদি
ব্যক্ত হয়। যেমন ‘বনে কানুর বাঁশি বাজিল রে’ (আলকাপ), ‘কি হেরিলাম যমুনায়
আসিয়া গো সজনি’ (ঘাটু গান), ‘শুন গো রাই, বলি তোরে’ (ঝুমুর), ‘মাঘ না
মাসেতে মাধব মতুরায় গমন’ (বারোমাসি), ‘তুই মোরে নিদয়ার কালিয়া রে’
(ভাওয়াইয়া), ‘মন দুঃখে মরিবে সুবল সখা’ (বিচ্ছেদি গান), ‘সুন্দরী লো
বাইরইয়া দেখ, শ্যামে বাঁশি বাজাইয়া যায় রে’ (সারিগান), ‘নিধুবনে শ্যাম
কিশোর সনে খেলব হোলি আয়’ (হোলির গান) ইত্যাদি। এ গানগুলিতে রাধা, কৃষ্ণ, সুবল, মথুরা, যমুনা, বাঁশি
ইত্যাদি শব্দ থাকলেও তাতে ধর্মীয় ভাব বা আধ্যাত্মিকতা নেই, আছে মানবিকবোধ
ও বৈষয়িক চেতনা। গাড়িয়াল, মৈষাল, মাহুত, মাঝি, সওদাগর, বানিয়া, নদী,
হাওর প্রভৃতি বাংলার পেশাজীবী মানুষ ও প্রকৃতি নিয়েও এ ধরণের গান রচিত
হয়। ‘ও কি গাড়িয়াল ভাই, কত রব আমি পন্থের দিকে চায়া রে’ (ভাওয়াইয়া),
‘আরে গেইলে কি আসিবেন মোর মাহুত বন্ধু’ (ওই), ‘আমার বাড়ি যান ও মোর
প্রাণের মৈষাল রে’ (চটকা), ‘ও মোর বানিয়া বন্ধু রে’ (ওই), ‘সুজন মাঝি রে,
কোন ঘাটে লাগাইবা তোর নাও’ (ভাটিয়ালি), ‘সুন্দইর্যা মাঝির নাও উজান চলো
ধাইয়া’ (সারিগান) ইত্যাদি গানে রূপক-প্রতীক নেই, আছে নিত্য পরিচিত মানুষ,
প্রাণী ও প্রকৃতির চিত্র।
জীবনের খন্ড খন্ড চিত্র কথায় ও সুরে অবলীলায় রূপ দিয়েছেন
লোকশিল্পীরা। ‘গাও তোল গাও তোল কন্যা হে, কন্যা পিন্দো বিয়ার শাড়ি’,
‘ঘাটে ডিঙ্গা লাগাইয়া মাঝি পান খেয়া যাও’, ‘কত পাষাণ বাইন্দ্যাছ পতি
মনেতে’, ‘জল ভর সুন্দরী কন্যা জলে দিয়া মন’, ‘লাল নীল চউর বাইয়া, হাটে
যাও রে সোনার নাইয়া’ ইত্যাদি প্রেমসঙ্গীতে জীবনের খন্ডচিত্র আবেগের ভাষায়
রূপ পেয়েছে।
দেহতত্ত্ব, আত্মতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব, দয়ালতত্ত্ব ও ভাবতত্ত্ব নিয়ে
রচিত হয় বাউল, মুর্শিদি, মারফতি, মাইজভান্ডারি প্রভৃতি আধ্যাত্মিক গান।
প্রধানত বাউল, ফকির, বৈরাগী ও ভক্তশিষ্যগণ এসব গানের চর্চা করে থাকে। জীবন,
সংসার ও জগৎকে অনিত্য এবং দুঃখময় ভেবে তারা আধ্যাত্মিক জগতে শান্তি ও
মুক্তি খোঁজে। কেউ সরাসরি ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করে, কেউ বা
গুরু-মুর্শিদের নিকট আবেদন-নিবেদন করে। ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে
যায়’ (বাউল), ‘মনমাঝি তোর বইঠা নেরে আমি আর বাইতে পারলাম না’ (ভাটিয়ালি),
‘ভবনদী পার করে দাও দয়াল মুর্শিদ আমারে’ (মুর্শিদি), ‘ও কি চমৎকার,
ভান্ডারে এক আজব কারবার’ ( মাইজভান্ডারি গান) ইত্যাদি এরূপ তত্ত্বসঙ্গীত। এগুলিতে সংসারবিমুখ ভাবের প্রতিফলন ও বিবাগী সুরের প্রতিধ্বনি আছে।
ধর্ম-সংস্কার-আচার-ব্যবহারমূলক বিচিত্র লোকসঙ্গীত প্রচলিত আছে।
প্রেমসঙ্গীতে জাতির চিরন্তন সত্তা আর অনুষ্ঠাননির্ভর সঙ্গীতে জাতির বিশিষ্ট
সত্তা প্রকাশিত। ‘আল্লাহ ম্যাঘ দে পানি দে, ছায়া দে রে তুই’ গানে বৃষ্টির
জন্য আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করা হয়েছে। এমন আবেদন সরাসরি মেঘের কাছেও
করা হয়েছে, যেমন: ‘মেঘ রাজারে তুইনি সুদর ভাই/ এক ঝাড়ি মেঘ দে ভিজ্যা ঘরে
যাই।’ রংপুরের রাজবংশী
কৃষকদের মধ্যে ‘হুদমার গান’ নামে এক ধরণের লোকসঙ্গীত প্রচলিত আছে। হুদমা
হচ্ছে মেঘের দেবতা; কৃষক রমণীরা রাত্রিবেলা নগ্ন হয়ে কৃষিক্ষেতে নাচ-গান
করে এবং পানি ঢেলে নকল চাষের অভিনয় করে।
পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় অঞ্চলের ভাদু, টুসু ও জাওয়া গান মূলত
ব্রতকেন্দ্রিক। জাওয়া শস্যোদ্গমের, আর ভাদু শস্য তোলার উৎসব। প্রাচীন যুগে
লোকের দৃষ্টিতে ভূমির শস্যবতী ও নারীর সন্তানবতী হওয়া ছিল অভিন্ন। কুমারী
মেয়েরা নিজেদের সফল জীবনের আশায় ভাদু ব্রত পালন করে। এছাড়া হিন্দু
নারীসমাজে আরও অনেক ব্রত আছে। সেসব ব্রতে সন্তান, সম্পদ ও জাগতিক
সুখসমৃদ্ধি কামনা করে গান করা, ছড়া বলা ও আলপনা অাঁকা হয়। কৃষির দেবতা শিবকে কেন্দ্র করে শিবের গাজন
ও গম্ভীরা উৎসব পালিত হয়। শিব-পার্বতীর গার্হস্থ্য জীবন নিয়ে রচিত গাজন
গানে আসলে কৃষকজীবনেরই ছায়াপাত ঘটেছে। এ গানের দুটি ধারা একটিতে থাকে
শিবের পারিবারিক জীবনচিত্র এবং অপরটিতে থাকে শিবের কাছে সাংসারিক জীবনের
নানাবিধ অভাব-অভিযোগের বিবরণ। ‘ধান লাড় ধান লাড়, গোরী, আউলাইয়া মাথার
কেশ’ এটি প্রথম ধারার এবং ‘শিব, তোমার লীলাখেলা কর অবসান/ বুঝি বাঁচে না আর
জান’ এটি দ্বিতীয় ধারার গান। বর্তমানে গম্ভীরার এই ধারায় ‘নানা-নাতি’র
গান ও অভিনয়ের মাধ্যমে রাজনীতি, সমাজ, শিক্ষা, অর্থনীতি, প্রাকৃতিক
দুর্যোগ, দুর্নীতি এবং ব্যক্তিচরিত্র সম্পর্কেও আলোকপাত করা হয়। এটি
গম্ভীরার রূপান্তরিত নতুন আঙ্গিক।
ঝড়বৃষ্টি ও বজ্রপাত থেকে ফসল রক্ষার জন্য ওঝা শ্রেণির শিরালিরা
শিঙ্গা বাজিয়ে ও মন্ত্রধর্মী গান গেয়ে মেঘ তাড়ায়। এ প্রথা এক সময় ময়মনসিংহ ও সিলেট
অঞ্চলে প্রচলিত ছিল। এ ধরণের কাজ করতে গিয়ে শিরালিরা বজ্রাঘাতে প্রাণ
হারিয়েছে এমন দৃষ্টান্তও আছে। বর্তমানে অবশ্য এ জাতীয় গান লুপ্তপ্রায়।
গোসম্পদ রক্ষার উদ্দেশ্যে গোয়াইলার শিরনি ও গোরক্ষনাথের শিরনি আচার
পালিত হয়। কৃষিকাজে গরুর ব্যবহার অপরিহার্য, তাই গরুর নিরাপত্তা কামনা
করে শির্নী
মানত করা হয়। এ উপলক্ষে রাখাল বালক ও অন্যান্য ছেলেমেয়ে দল বেঁধে ঘরে
ঘরে যায় এবং গান গেয়ে শির্নীর চাল-ডাল-অর্থ সংগ্রহ করে; একে মাগনের গানও
বলে।
হিন্দুসমাজে দেবদেবীর উদ্দেশে যেমন ব্রতের গান আছে, তেমনি মুসলমান সমাজেও আছে পীর-পীরানির উদ্দেশে জাগগান।
পীরের মাহাত্ম্যসূচক এ গান দীর্ঘরাত্রি জেগে গাওয়া হয়। গাজী পীর, মাদার
পীর, খোয়াজ-খিজির, মানিক পীর, সোনা পীর ও বদর পীর লোকদৃষ্টিতে অলৌকিক
ক্ষমতার অধিকারী; তাঁরা সন্তানহীনাকে সন্তানদান, রোগব্যাধি দূরীকরণ,
ধনসম্পদ দান এবং গরুবাছুর রক্ষা করতে সক্ষম বলে বিশ্বাস করা হয়। মাগনের
গানের মতো জাগগান গেয়েও শির্নীর চাল-ডাল সংগ্রহ করা হয়। জাগগানে
পীরমাহাত্ম্য বর্ণিত হলেও তাতে ধর্মভাব আছে সামান্যই; বৈষয়িক চেতনা ও
কল্যাণবুদ্ধিই মুখ্য। এগুলি আখ্যানধর্মী ও বিবৃতিমূলক বলে আকারে দীর্ঘ হয়।
গাজী পীরের উদ্দেশে নিবেদিত গান গাজীর গান
নামে পরিচিত। সন্তান, স্বাস্থ্য ও সম্পদ কামনায় মানত করে গাজীর গানের
পালা দেওয়ার রীতি আছে। শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীচৈতন্যের লীলাসংক্রান্ত জাগগানও
আছে।
মুসলমান সমাজে প্রচলিত জারিগান বা শোকসঙ্গীত মুহররম উপলক্ষে গাওয়া হয়। কারবালার বিষাদময় কাহিনী অবলম্বনে ছোট ও বড় আকারের জারিগান প্রচলিত আছে। জারি গান ও নাচে শিয়া সম্প্রদায়ের মুহররমের মিছিল, তাজিয়া, দরগাহ, দুলদুল, ইমামবারা,
মাতম, মর্সিয়া ইত্যাদির প্রভাব পড়েছে। বিষয়বস্ত্ততে মৃত্যু, শোক, বিলাপ
ও বিরহ থাকায় জারিগানে করুণ রসের প্রাধান্য থাকে। মুহররম ধর্মীয়
অনুষ্ঠান হলেও জারিগানে ধর্মীয় কোনো প্রভাব নেই; মানবহূদয়ের চিরন্তন
আর্তি ও বেদনার সুরই এতে ধ্বনিত হয়।
জারিগান দলীয় সঙ্গীত; গায়েন ও দোহাররা মিলিতভাবে এ গান পরিবেশন
করে। বাংলাদেশের নানা অঞ্চলে আজও জারিগানের প্রচলন আছে। তবে বর্তমানে এর
বিষয়বস্ত্তর বিস্তার ঘটেছে; ‘ইসমাইলের কোরবানির জারি’, ‘ইউসুফের জারি’,
‘আনাল হকের জারি’, ‘স্বাধীনতা দিবসের জারি’ ইত্যাদি নামে বিচিত্র বিষয়
অবলম্বনে জারিগান রচিত হচ্ছে। নারীরা মুহররম উপলক্ষে অন্তঃপুরে বসে যে মাতম
করে এবং গীত গায় তাকে বলে মর্সিয়া। এতে পতিহারা সখিনার বিরহ-যাতনা ও
আর্তনাদ গীতের ভাষা ও সুরে প্রকাশ পায় এবং তা সাধারণ বিধবার অন্তর্বেদনার
সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
কর্মসঙ্গীতের নামই প্রমাণ করে যে, এগুলি শ্রম ও কর্মের সঙ্গে জড়িত
লোকসঙ্গীত। কর্মে উৎসাহ দান, শ্রমভার লাঘব এবং চিত্তবিনোদনের উদ্দেশ্যে এ
সঙ্গীতের আয়োজন করা হয়। ক্ষেত নিড়ানো, ধান-পাট কাটা, ধান ভানা ইত্যাদি
কৃষিকাজ ছাড়াও দাঁড় টানা, ছাদ পেটানো, জাল বোনা, তাঁত বোনা, মাটি কাটা,
ভারি বস্ত্ত টানা ইত্যাদি কাজেও কর্মসঙ্গীতের প্রচলন আছে। কর্মের সঙ্গে
সঙ্গীতের কথা ও সুরের সরাসরি সম্পর্ক আছে। যেমন ‘আয় রে তরা ভুঁই নিড়াইতে
যাই’, ‘আমরা ধান ভানিরে ঢেকিতে পার দিয়া’, ‘রঙের নাও রঙের বৈঠা রঙে রঙে
বাও’ যথাক্রমে ক্ষেত নিড়ানো, ধান ভানা ও নৌকা বাইচের গান। এসব গানের কথা,
ছন্দ ও সুরে ছড়িয়ে আছে জীবনের সাধ-আহ্লাদ, রস-রসিকতা, আনন্দ-উল্লাস
ইত্যাদি। শ্রমসঙ্গীতে শাস্ত্রকথা ও নীতিকথার কোনো স্থান নেই।
নিম্নশ্রেণীভুক্ত পেশাজীবী পটুয়ারা কাগজ ও মাটির পাত্রে পট অাঁকে
এবং পটের চিত্র অনুযায়ী গান রচনা করে। গ্রামে-গঞ্জে পট দেখানোর সময় তারা
এই গানগুলি গেয়ে অর্থোপার্জন করে। তাদের পটের বিষয়বস্ত্ত রাধাকৃষ্ণ,
রামসীতা, নিমাই সন্ন্যাস, গাজী পীর ইত্যাদি। ময়মনসিংহ থেকে সংগৃহীত
‘পঞ্চকল্যাণী’ নামক একটি পটে শিব, শ্যাম, সীতা, নিমাই ও অসতী নারীর চিত্র আছে। পটুয়া গানে ভাব নয়, ঘটনার বর্ণনা থাকে। পটের চিত্র অনুযায়ী কথা সাজাতে হয় বলে এরূপ গানে শিল্পীর স্বাধীনতা থাকে অল্পই।
পটুয়াদের মতো বেদেরাও বর্ষাকালে নৌকায় করে গ্রামগঞ্জে গিয়ে
ছোটখাটো ব্যবসাদ্বারা জীবিকা নির্বাহ করে। সাপ ধরা, সাপ খেলানো ও ওঝাগিরি
তাদের প্রধান জীবিকা। এ উপলক্ষে তারা মন্ত্র ও গান রচনা করে। ‘সাপ খেলা
দেখবি যদি আয় রে সোনা বউ/ এমনি খেলা সাপের খেলা দেখেনি তো কেউ’ ঢাকা থেকে
সংগৃহীত ও রেকর্ডকৃত এই গানে সাপ খেলানোর চিত্র আছে। মনসা ও বেহুলা-লক্ষীন্দর প্রসঙ্গ তাদের গানের প্রধান বিষয়।
পুতুলনাচ দেখিয়ে ও গান গেয়ে জীবিকা অর্জন করে অপর এক শ্রেণির পেশাজীবী মানুষ। পুতুলনাচের প্রকৃতি ও বিষয় অনুযায়ী এর গান হয় ছোট-বড়। পাঁচালি, কীর্তন
ও মালসী সুরে এ গান পরিবেশিত হয়। মাঝেমধ্যে গদ্য সংলাপও থাকে। এতে অনেক
সময় মানবজীবনের খন্ডচিত্র ফুটে ওঠে, যেমন: ‘ও লো সুন্দরি! কার কথায়
কইরাছো তুমি মন ভারি/ আমি যেখানে সেখানে থাকি অনুগত তোমারি’ গানটিতে
দাম্পত্য জীবনের একটি সরস চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে।
ফেরিওয়ালারা ফেরি করতে করতে গান করে, আবার ফকির-বৈরাগীরা গান গেয়ে
ভিক্ষা করে। হাতিখেদার গান হাতি ধরার উদ্দেশ্যে রচিত ও গীত হয়। কর্ম ও
পেশার সঙ্গে এসব গানের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। খেমটা নাচ ও গান
ব্যবসায়বৃত্তির সঙ্গে জড়িত; এ উদ্দেশ্যে নাচের দলও আছে। প্রধানত
নপুংসকেরা এ ধরণের নাচ-গান করে জীবিকা নির্বাহ করে। বিবাহ, অন্নপ্রাশন
ইত্যাদি উৎসবে খেমটাওয়ালারা নাচ-গান করে দর্শকদের মনোরঞ্জন করে। এদের
গানের বিষয় সাধারণত লঘু রঙ্গরসাত্মক ও অশ্লীল হয়ে থাকে। রাধাকৃষ্ণের
লৌকিক প্রেম খেমটা গানের প্রধান বিষয়। চটকা, বোলান,
লেটো ইত্যাদি গানেও রঙ্গ-ব্যঙ্গ, ঠাট্টা-বিদ্রূপ ও অশীলতা আছে। এছাড়া
আলকাপ, কবির লড়াই, খেমটা, মেয়েলি গীত, সারি, ঘাটু ইত্যাদি গানও অংশত
ব্যঙ্গরসাত্মক। মূলত লোকমনোরঞ্জনই এ ধরণের গানের উদ্দেশ্য। গ্রামজীবনের
অভাব-অনটন, দুঃখ-শোক ও বঞ্চনার মধ্যেও হাসির ঈষৎ রেখাটি যে এখনও বিলীন হয়ে
যায়নি, এসব গানে তার পরিচয় পাওয়া যায়। অবৈধ ও পরকীয়া প্রেম, অবাঞ্ছিত
ব্যক্তি ও ঠাট্টা-মস্করার পাত্রকে অবলম্বন করে হাস্যরসের গান রচিত হয়।
সাময়িক উত্তেজনা ও লঘু রসিকতা এসব গানের মুখ্য আবেদন।
কবিগানে পৌরাণিক, ঐতিহাসিক, সামাজিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও
শিক্ষাবিষয়ক কাহিনী বা সমস্যাদি স্থান পায়। দাঁড়া কবিগানে তাৎক্ষণিকভাবে
প্রস্তাবিত বিষয় আলোচিত হয়। পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক আখ্যানগুলি ধর্মীয় ও
নীতিবিষয়ক হয়ে থাকে। রাধাকৃষ্ণের প্রেমাখ্যানকে ‘সখী সংবাদ’ এবং শ্যামার
ভক্তিমূলক গানকে ‘ভবানী বিষয়’ বলে। কবিগানের ‘খেউড়’ অংশ আদি রসাত্মক ও
রুচিহীন। ‘খিস্তি-খেউড়’ কথাটির এখান থেকেই উৎপত্তি। দুই দলের মধ্যে
প্রশ্নোত্তরের ধারায় কবির লড়াই চলে। উনিশ শতকে কলকাতা
শহরকে কেন্দ্র করে কবিগানের উৎপত্তি হয়। পরে তা দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে
পড়ে। কবিগানের আসরে ভাব, ভাষা, ছন্দ, সুর, বাদ্য ও ভঙ্গি সংযোগে একটি
সাঙ্গীতিক আবহ সৃষ্টি হয়। শ্রোতারা সারারাত ধরে তা শুনে মুগ্ধ হয় ও আনন্দ
উপভোগ করে।
সারিগানের সঙ্গে নদী, নৌকা,
মাঝি-মাল্লা, পারাপার ইত্যাদি বিষয় জড়িত। রাধা-কৃষ্ণ, গৌরী-মেনকা ও
রাম-সীতার লীলাবিষয়ক পুরাণাশ্রিত গান, নিমাই সন্ন্যাসমূলক ইতিহাসাশ্রিত
গান এবং নর-নারীর প্রেম-বিরহমূলক বাস্তব জীবনাশ্রিত গান সারিগানের
অন্তর্ভুক্ত। নৌকাবাইচ
উপলক্ষে গীত সঙ্গীতসমূহ সারিগানের প্রধান অংশ, তবে সাধারণভাবে দাঁড়-গুণ
টানা বা পাল তুলে নৌকা চালানোর সময়ও এ গান গাওয়া হয়। নৌকাবাইচের গান বেশ
জীবনরসসিক্ত, তাত্ত্বিক ও উদ্দীপনামূলক। ‘আষাড়িয়া নয়া পানি আইল রে ভাই
দেশেতে/ আয় রে ও ভাই আয় রে সবাই আয়রে ডিঙ্গা বাইতে’, ‘মন পবনে বেগ
উঠ্ঠ্যাছে ভক্তির বাদাম দেও নৌকায়’, ‘শ্যাম কালিয়া তোর পিরীতে মইলাম
জ্বলিয়া/ ডিঙ্গা সাজাও মাঝিভাই যমুনাতে যাই’ ইত্যাদি গানে বিষয়, সুর, তাল ও ছন্দোবৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়। সারিগান বাংলাদেশে এখনও জনপ্রিয় লোকসঙ্গীত।
মেয়েলী গীত নারীসমাজের অন্তর্জীবন ও বহির্জীবনের বিচিত্র
ভাব-আলেখ্য। কন্যা-জায়া-জননীরূপে পরিবারে নারীর অবস্থানকে কেন্দ্র করে
সংসার-সাগরে যে ভাবরাশি উত্থিত হয়, মেয়েলি গীত তার বাঙ্ময় প্রকাশ।
কুমারী জীবন, বিবাহিত জীবন ও সংসার জীবনের সুখ-দুঃখময় নানা ঘটনা ও বিচিত্র
ভাব নিয়ে মেয়েলি গীত রচিত হয়। বিবাহ উপলক্ষে রচিত মেয়েলি গীতের সংখ্যা
সর্বাধিক। কনে দেখা থেকে শুরু করে বিবাহের শেষ অনুষ্ঠান ফিরানি পর্যন্ত
প্রায় সবস্তরের আচার-অনুষ্ঠানে এ গান গাওয়া হয়। এ সময় পল্লিরমণীরা ঢেঁকি,
যাঁতা ও পাটায় কাজ করে এবং গান গেয়ে সারারাত কাটিয়ে দেয়। গর্ভাধান,
অন্নপ্রাশন, উপনয়ন, খতনা, কান ফোঁড়ানো, সখি পাতানো ইত্যাদি উপলক্ষেও
মেয়েলি গান রচিত ও গীত হয়। স্বামী-স্ত্রীর প্রেম-বিরহ ও নাইয়রকেন্দ্রিক
গীতও আছে। এসব গীতে বৈষয়িক চাওয়া-পাওয়া ও আশা-আকাঙ্ক্ষার চিত্র ফুঠে
ওঠে। মেয়েলি গীত বাংলার প্রায় সব অঞ্চলেই প্রচলিত।
গীতিকা গীতোপযোগী ছন্দোবদ্ধ রচনা এবং লোকসাহিত্যের নবীনতম শাখা। অন্তঃমধ্য যুগ এর রচনাকাল। নাটকীয়তা গীতিকার একটি প্রধান গুণ। গীতিধর্মী রচনা হলেও এটি পাঠ করে সাধারণ কাব্যপাঠের মতোই আনন্দ পাওয়া যায়।
গীতিকায় সাধারণত পাত্র-পাত্রীর নাম থাকে না; রাজপুত্র,
মন্ত্রিপুত্র, রাজকন্যা, পরীকন্যা, রাক্ষস, জাদুগিন্নী, সওদাগর, ধোপা,
মালিনী, সন্ন্যাসী, পীর-ফকির ইত্যাদি নৈর্ব্যক্তিক নামে তারা পরিচিত হয়।
তাদের রাজ্য ও আবাসগৃহ থাকে বটে, কিন্তু সেসবের ভৌগোলিক অস্তিত্ব থাকে না।
বাংলা গীতিকার প্রধান বিষয় নরনারীর প্রেম। মৈমনসিংহ-গীতিকার দশটি
পালার মধ্যে নয়টিই প্রেমমূলক, একটি দস্যুতামূলক। প্রেমগাথার
নায়ক-নায়িকারা বর্ণ-বিত্ত-কূল-ধর্মের দিক থেকে কেউ সমস্তরের, কেউ বা
অসমস্তরের। নায়ক-নায়িকার প্রেমে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে সামন্তপতি, তার
প্রতিনিধি, বিত্তশালী ও অন্যান্য ক্ষমতাধর ব্যক্তির রূপতৃষ্ণা,
প্রণয়বাসনা, কামপ্রবৃত্তি ইত্যাদির কথা আছে। দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার,
শোষণ, নির্যাতন, উচ্চবর্গের ইন্দ্রিয়াসক্তি, সম্ভোগপ্রিয়তা,
প্রতিহিংসাপরায়ণতা, সমাজের রক্ষণশীলতা, আভিজাত্যের অহঙ্কার, বহুবিবাহ,
যুদ্ধবিগ্রহ ইত্যাদিও গাথাগুলিতে স্থান পেয়েছে। সমাজের নিষ্ঠুর
বিধিনিষেধের কারণে কিছু কিছু গাথা, যেমন ‘কঙ্ক ও লীলা’, ‘শ্যামরায়’,
‘ধোপার পাট’, ‘দেওয়ানা মদিনা’, ‘ফুলকুমারী’, ‘চন্দ্রাবতী’, ‘মহুয়া’
ইত্যাদি বিয়োগান্তক পালায় পরিণত হয়েছে। গীতিকাসমূহের কয়েকটি সংকলন
গ্রন্থ হচ্ছে মৈমনসিংহ-গীতিকা, পূবর্ববঙ্গ-গীতিকা, মোমেনশাহী গীতিকা (১৯৭১), সিলেট গীতিকা (১৯৭২), রংপুর গীতিকা (১৯৭৭) ও বাংলার লোক-গীতিকথা (১৯৮৬)।
লোককাহিনী পুরুষানুক্রমে মুখে মুখে প্রচলিত বর্ণনামূলক গল্প। এর
মূল ভিত্তি কল্পনা। স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল পর্যন্ত গল্পের আখ্যানের সীমানা
বিস্তৃত। দেব-দৈত্য, জ্বীন-পরী, রাক্ষস-খোক্ষস, রাজা-প্রজা,
সাধু-সন্ন্যাসী, পীর-ফকির, কৃষক-তাঁতি, কামার-কুমার, ধোপা-নাপিত, পশু-পাখি,
নদী-সাগর, পাহাড়-পর্বত, চন্দ্র-সূর্য, দিন-রাত্রি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে
গল্প রচিত হয়। একক ও সরলরৈখিক গল্প যেমন আছে, তেমনি বিচিত্র শাখাসম্বলিত
জটিল গল্পও আছে। প্রথম শ্রেণির গল্প সাধারণত আকারে ছোট হয় এবং দ্বিতীয়
শ্রেণির গল্প হয় বড়।
বিষয় ও আঙ্গিক বিচারে লোককাহিনীগুলিকে বারোটি ভাগে ভাগ করা যায়,
যথা: রূপকথা, পুরাণকথা, ব্রতকথা (religious tale), রোমাঞ্চকথা, বীরকাহিনী,
সন্তকাহিনী (sage tale), পুরাকাহিনী, স্থানিক কাহিনী (legend), পশুকাহিনী,
নীতিকথা (fables), হাস্যরসাত্মক কাহিনী ও ব্যাখ্যামূলক কাহিনী। বাংলা
ভাষায় প্রায় সবশ্রেণীর লোককাহিনীই রচিত হয়েছে। রোমাঞ্চ কাহিনীর উর্বর
ভূমি হচ্ছে আরব-পারস্য। আলিবাবা ও চল্লিশ চোর, হাতেম তাই, সিন্দাবাদ,
আলাউদ্দীনের আশ্চর্য প্রদীপ ইত্যাদি কাহিনী আরব-পারস্য থেকে আগত; আরবি আলেফলায়লা-ওয়া-লায়লা গ্রন্থ এসব কাহিনীর উৎস। মধুমালা, রূপভান, চন্দ্রাবতী ইত্যাদি দেশীয় কাহিনী।
লোককাহিনীর নায়ক-নায়িকারা সাধারণত দৈব বা অদৃষ্টের ওপর বেশি
নির্ভরশীল, কর্মের ওপর নয়। তারা জাদুবিদ্যার ওপরও নির্ভর করে। ভোগবাদী
কর্মকুণ্ঠ চেতনা থেকেই এমন মনোভাবের জন্ম।
বাংলা লোককাহিনীতে সকল স্তরের মানবজীবন ও সমাজের অজস্র ছবি আছে।
সেসব বিশ্লেষণ করলে জাতির অনেক অজানা ইতিহাস বেরিয়ে আসে। বাল্যবিবাহ,
বহুবিবাহ, যৌতুকপ্রথা, জন্মান্তরবাদ, সতীন-বিদ্বেষ, সৎমার ঈর্ষাকাতরতা,
সবলের অত্যাচার, ধনীর ধনলিপ্সা, দুর্বল ও দরিদ্রের দুর্ভোগ, ধন ও
বর্ণবৈষম্য, জাতি ও ধর্মভেদ, কৌলীন্যবিচার, দাম্পত্য-প্রেম, ভ্রাতৃপ্রেম,
গুরুভক্তি, অতিথিসেবা, দান-ধ্যান ইত্যাদির অসংখ্য চিত্র লোককাহিনীতে পাওয়া
যায়। প্রাচীনকাল থেকেই লোককাহিনী লোকসাহিত্যের একটি জনপ্রিয় শাখা ছিল, কিন্তু আধুনিক শিক্ষা ও নগরসভ্যতা বিস্তারের ফলে এর চর্চা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।
লোকনাট্য লোকসমাজে প্রচলিত ঐতিহাসিক, ধর্মীয় ও লোককাহিনী
ভিত্তিক নাট্যাভিনয়। আশুতোষ ভট্টাচার্যের মতে: ‘গ্রামীণ সমাজে জনসাধারণের
জীবন অবলম্বন করে যে নাটকধর্মী রচনা মুখে মুখে রচিত হয়ে মুখে মুখে
প্রচারিত হয় তা-ই লোকনাট্য।’ উন্মুক্ত বা ঈষৎ আচ্ছাদিত আসরে নাচ, গান,
বাদ্য, সংলাপ ও অভিনয় সহযোগে এগুলি পরিবেশিত হয়, যেমন: ভাসান, যাত্রা, পালাগান,
ঘাটু, গম্ভীরা, আলকাপ, কবিগান, পুতুলনাচ ইত্যাদি। এগুলির কোনোটিতে থাকে
গানের প্রাধান্য, কোনোটিতে নাচের, আবার কোনোটিতে থাকে অভিনয়ের প্রাধান্য।
বিষয়, আঙ্গিক, পরিবেশনরীতি ও সময়কালের দিক দিয়েও একটি অপরটি থেকে পৃথক।
লোকনাট্যের উপস্থাপনায় দুটি স্তর থাকে প্রস্ত্ততিপর্ব ও মূলপর্ব। লপ্রস্ত্ততিপর্বে মূল কাহিনীর পূর্বে প্রস্তাবনা, সমবেত যন্ত্রসঙ্গীত
ও বন্দনা পরিবেশিত হয়; আর মূলপর্বে অভিনয়, নৃত্যগীত, কথা ও সংলাপ,
বাদ্য, সঙ বা ভাঁড় ইত্যাদি সহযোগে মূলকাহিনী পরিবেশিত হয়। রাম-সীতা,
অর্জুন-দ্রৌপদী, রাধা-কৃষ্ণ, নিমাই সন্ন্যাস, বেহুলা-লক্ষীন্দর, ঈসা খাঁ
দেওয়ান, ফিরোজ দেওয়ান, জয়নব-হাসান, সখিনা-কাসেম, হানিফা-জয়গুন, রহিম
বাদশা, রূপবান, বাইদ্যানি ইত্যাদি পৌরাণিক, ঐতিহাসিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও
লৌকিক বিষয় নিয়ে লোকনাট্য রচিত ও পরিবেশিত হয়। গ্রামের সাধারণ মানুষ
সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, অত্যাচার-পীড়ন, সংগ্রাম-বিরোধ, প্রেম-ভালোবাসা,
লোভ-লালসা ইত্যাদি মিশ্রিত এসব কাহিনী থেকে আনন্দলাভের পাশাপাশি সৎ-অসৎ,
ধর্মাধর্ম, পাপ-পুণ্য ইত্যাদি সম্পর্কেও শিক্ষালাভ করে থাকে।
পুরাণ,
ইতিহাস, লোককাহিনী ও পালাগানভিত্তিক যাত্রা দেশের প্রায় সর্বত্র অনুষ্ঠিত
হয়। উত্তরবঙ্গে প্রচলিত আলকাপে পৌরাণিক ও সামাজিক উভয় বিষয় স্থান পায়।
যাত্রার মতো আলকাপ সারারাত ধরে চলে; নাচ, গান ও বাদ্য সহযোগে তা
দীর্ঘায়িত করা হয়। রাজশাহী ও পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলায় প্রচলিত গম্ভীরা
মূলে ছিল শিব-শিবানীর গার্হস্থ্য জীবনের আলেখ্য; শিবের গাজন উপলক্ষে তা
অনুষ্ঠিত হতো। বর্তমানে সমাজ, শিক্ষা, অর্থনীতি, রাজনীতি, পরিবার যেকোনো
বিষয় নিয়ে তা রচিত হয় এবং দুজন অভিনেতার (নানা-নাতি) মাধ্যমে
নাচ-গান-বাদ্য-সংলাপ সহকারে পরিবেশিত হয়। ব্যঙ্গ-কৌতুক এর মুখ্য রস। এটি
একাঙ্কিকা নাটকের মতো; স্বল্পায়তনে স্বল্প সময়ের মধ্যে পরিবেশিত হয়।
যাত্রা ও আলকাপ থেকে গম্ভীরার এখানেই পার্থক্য।
লোকমনোরঞ্জক ঘাটু গান ও নাচ মূলত গীতিনাট্য। গায়েন ও দোহার গান
করে, বাদক বাজনা বাজায় আর ‘ঘাটু’ নামে এক বালক কিশোরীবেশে নাচে; নৌকার
পাটাতনে এর আসর বসে। তার গান ও নাচের মাধ্যমে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা অভিনীত
হয়। আলকাপেও ‘ছোকরা’ নামে এক তরুণ যুবতীবেশে নাচ-গান করে। উভয়ের
বিষয়বস্ত্ত ও পরিবেশনায় অশ্লীলতা আছে, তাই এর আসর বসে সাধারণত লোকালয়ের
বাইরে। তবে এখন শহরেও পেশাদার গায়েন ঘাটুগান পরিবেশন করে। ঘাটু
ময়মনসিংহ-সিলেট জেলায় প্রচলিত। বর্ধমানের লেটোগানের পালা অংশে গান, নাচ ও
অভিনয়ের মিশ্রণ আছে; কবিগানের লড়াই অংশ উত্তর-চাপানের আঙ্গিকে সংলাপের
ভাষায় রচিত। উত্তরবঙ্গে প্রচলিত ভাসানযাত্রার বিষয় বেহুলা-লক্ষিন্দরের
জনপ্রিয় কাহিনী; সমতল ভূমিতে নির্মিত বৃত্তাকার মঞ্চে এটি অভিনীত হয়।
কারবালার বিষাদময় কাহিনী অবলম্বনে রচিত জারিগানও নৃত্য, বাদ্য ও
অভিনয় সহযোগে পরিবেশিত হয়। জারিগানের স্থান প্রধানত দরগাহ। মুহররম
উপলক্ষে দশ-বারোজন তরুণ যুবক জারিদল গঠন করে বৃত্তাকারে নেচে নেচে গানের
অভিনয় করে। একজন থাকে মূল গায়েন, অন্যরা দোহার হিসেবে ধুয়া গায় ও
হাততালি দেয়। অভিনয়গুণের জন্য জারিগানকে রংপুরে ‘জারিযাত্রা’ বলা হয়।
কারবালার কাহিনীকে ইমামচুরি, জয়নাবের বিলাপ, সখিনার বিবাহ ও বিলাপ, জয়নাল
উদ্ধার ইত্যাদি পালায় বিভক্ত করে পরিবেশিত হয়। ইসলামি ভাবের জারিগানের
উদ্ভাবক স্বাভাবিকভাবেই মুসলিম সমাজ। বাংলা একাডেমীর লোকসাহিত্য সংকলনে
(১৮শ খন্ড) ‘জারিযাত্রা’ শিরোনামে কারবালার বিষাদময় কাহিনী অবলম্বনে রচিত
এরূপ একটি লোকনাট্য প্রকাশিত হয়েছে। এর মূল সংলাপ গদ্যে রচিত, মাঝে মাঝে
গান আছে। ঘটনার ক্রমধারায় রচিত গানগুলি কাহিনীকে গতিশীল করে। এদিক থেকে
জারিযাত্রার গানই হচ্ছে মূল কাহিনীর প্রাণস্বরূপ।
গীতাভিনয় সম্বলিত পালাগানকেও লোকনাট্যের অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
ধর্মীয়, সামাজিক ও ঐতিহাসিক জনপ্রিয় আখ্যান নিয়ে পালাগান রচিত হয়।
বাইদ্যানির পালা, গাজীর পালা, বনবিবির পালা, সখিনার পালা ইত্যাদি মূল
গায়েন, দোহার ও বাদক সহযোগে পরিবেশিত হয়। পালাগান বিষয়-রস-রুচির দিক
থেকে উন্নত মানের রচনা। সকল স্তরের নরনারী দিনের প্রকাশ্য আসরে এ ধরণের
লোকনাট্য উপভোগ করে।
পুতুলনাচ লোকনাট্যের একটি জনপ্রিয় মাধ্যম। পুরাণ, লোককথা ও
সমাজ-আশ্রিত যেকোনো কাহিনীকে পুতুলের অভিনয়দ্বারা ফুটিয়ে তোলা হয়।
চরিত্র অনুযায়ী পুতুলগুলির অবয়ব, রূপ ও অঙ্গসজ্জা নির্মাণ করা হয়।
পুতুলনাচের জন্য বিভিন্ন ধরণের শিল্পী থাকে। সূত্রধর সুতার সাহায্যে
পুতুলের অঙ্গভঙ্গি প্রকাশ করে, কথক সংলাপ বলে, গায়ক গান গায় এবং বাদক
বাদ্য বাজায়। এ সব কিছুই নেপথ্য থেকে করা হয়, যার জন্য বিশেষ ধরণের মঞ্চ ও
মঞ্চসজ্জার প্রয়োজন হয়।
ছড়া সাধারণত শিশুতোষ রচনা হিসেবে পরিচিত। শিশুর মনোরঞ্জন,
অবসরযাপন, জ্ঞানবৃদ্ধি ও নীতিশিক্ষার উদ্দেশ্যে এর চর্চা হয়ে থাকে। তবে
কিছু কিছু ছড়া সকল বয়সের লোকদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বাংলা ছড়াগুলিকে
বিষয়ভিত্তিতে নিম্নলিখিত ভাগে ভাগ করা যায়: ছেলেভুলানো ও শিশুতোষ ছড়া,
খেলার ছড়া, সামাজিক ছড়া, ঐতিহাসিক ছড়া, আচার-অনুষ্ঠানমূলক ছড়া,
ঐন্দ্রজালিক ছড়া, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপাত্মক ছড়া, পেশাভিত্তিক ছড়া ও
নীতিশিক্ষামূলক ছড়া।
অল্পবয়স্ক শিশুদের ভুলানো বা আনন্দ দেওয়ার জন্য মা-বোন, দাদী-নানী
প্রমুখ যেসব ছড়া আবৃত্তি করে, সেসব ছেলেভুলানো ছড়া। অনেক সময়
শিশু-কিশোররা নিজেরাই ছড়া আবৃত্তি করে আনন্দ উপভোগ করে। এগুলিকে শিশুতোষ
ছড়ার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিশোর-তরুণ-যুবক যেসব ছড়া বলে খেলা করে বা
খেলা উপলক্ষে ছড়া বলে, সেসব খেলার ছড়া নামে পরিচিত। হাডুডু, কানামাছি ইতাদি খেলায় এরূপ ছড়ার প্রচলন আছে।
শিশু-কিশোরদের মধ্যে লঘু হাস্যরস সৃষ্টির উদ্দেশ্যে
ব্যঙ্গ-বিদ্রূপাত্মক ছড়া রচিত হয়। এতে প্রধানত সমবয়সী ছেলেমেয়ে,
বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, জামাতা, পশু-পাখি ইত্যাদিকে ব্যঙ্গ বা সমালোচনা বা হেয়
প্রতিপন্ন করা হয়। কোনো কোনো কাজে শ্রমলাঘব করা ও প্রেরণা দেওয়া বা
চিত্তবিনোদনের জন্যও ছড়া রচিত হয়। বাইস্কোপ দেখানোর সময় ছড়া কেটে
চিত্রের বর্ণনা দেওয়া হয়; এটি জীবিকার সঙ্গে যুক্ত। নীতি-উপদেশ,
অঙ্ক-জ্যোতিষ ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান দানের জন্যও ছড়া আছে।
সামাজিক ছড়াগুলি রচিত হয় পিতা-মাতা, পুত্র-কন্যা, ভাই-বোন, শাশুড়ি-বধূ, জামাতা, ধোপা, নাপিত, মালী, তাঁতি, কামার, কুমার,
দারোগা, পেয়াদা, জমিদার, রাজা প্রভৃতিকে কেন্দ্র করে। ঐতিহাসিক
ছড়াগুলিতে জাতীয় জীবনের অনেক অলিখিত ইতিহাস লিপিবদ্ধ থাকে। ‘ছেলে ঘুমালো
পাড়া জুড়ালো, বর্গী এলো দেশে’ এ ছড়াটিতে বর্গী কর্তৃক বাংলা আক্রমণের
কথা আছে। ‘জাত মারলে পাদ্রী ধরে/ ভাত মারলে নীল বাঁদরে। বিড়াল চোখে হাঁদা
হেমদো/ নীলকুঠির নীল মামদো।’ এ ছড়াটিরও ঐতিহাসিক পটভূমি আছে। খ্রিস্টান
পাদ্রি অসহায় মানুষের ধর্মনাশ করে, আর নীলকর সাহেব কৃষকের ভূমি ও রুজি
গ্রাস করে। ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর-টুপুর নদে এলো বান/ শিব ঠাকুরের বিয়ে হল
তিন কন্যা দান।’ এ ছড়ায় এক পাত্রে তিন কন্যা সম্প্রদান তথা বহুবিবাহের
চিত্র আছে। গোপীচন্দ্রের গান
নাথগীতিকায় রাজপুত্র গোপীচন্দ্র রাজকন্যা অদুনাকে বিয়ে করে পদুনাকে দান
হিসেবে লাভ করে; এখানে আছে শ্যালিকাকে পত্নীরূপে লাভ করার দৃষ্টান্ত।
মন্ত্রের ছড়ায় প্রাচীন বিশ্বাস-সংস্কারের বীজ আরও সজীব ও প্রকট।
বৃষ্টি আবাহনের জন্য বলা হয়, ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে, ধান দিব মেপে’; আবার
বৃষ্টি বারণের জন্য বলা হয় ‘লেবুর পাতায় করঞ্চা, এই মেঘখান উড়ে যা’
ইত্যাদি। বৃষ্টির আবাহনে ছড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু আচার পালনেরও ব্যাপার আছে।
ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা মাথায় কুলা নিয়ে বাড়ি বাড়ি যায় এবং ছড়া বলে
মাগনের চাল-ডাল সংগ্রহ করে; গৃহস্থরা তখন কুলায় পানি ঢালে আর সেই পানি গা
বেয়ে মাটিতে পড়ে। এটি হলো বৃষ্টির নকল। ব্রতের ছড়ায় আরাধ্য দেবতার কাছে
মনস্কামনা ব্যক্ত করে ফলের প্রত্যাশা করা হয়। দশপুত্তল ব্রতে সুস্থ,
সুন্দর ও আদর্শ জীবন কামনা করা হয়; ভাইফোঁটা
ব্রতে সহোদর ভাইয়ের সৌভাগ্য ও মঙ্গল কামনা করা হয়; লক্ষ্মীর ব্রতে
পিতা-ভ্রাতার নিরাপদ বাণিজ্য-যাত্রা কামনা করা হয়। এছাড়া সন্তান, ভালো
ফসল, নীরোগ জীবন ইত্যাদি লাভের উদ্দেশ্যে আরও অনেক ব্রত আছে যাতে ছড়ার
মাধ্যমে মনস্কামনা ব্যক্ত করা হয়। এসব ছড়ায় ধর্মের আড়ালে বিষয়বুদ্ধিই
প্রধান থাকে; পরকালের সুখ-স্বপ্ন-আনন্দ এতে অনুপস্থিত।
মন্ত্র এ ধরণের সাহিত্য গ্রামের সাধারণ মানুষের বিশ্বাস, কুসংস্কার
এবং কতিপয় মানুষের প্রতিহিংসাবৃত্তি থেকে সৃষ্টি হয়েছে। যেমন, ‘আওলা চাল
বকের পাক/ যেমন পিঠা তেমন থাক’ এটি হলো পিঠা নষ্ট করার একটি মন্ত্র।
তৈরি খাবারে ‘নজর’ দিলে বদহজম হয় এ বিশ্বাসও গ্রামের মানুষের আছে এবং
সেজন্য নির্দিষ্ট ছড়াও আছে। বড়শি দিয়ে মাছ শিকারের জন্যও বিভিন্ন মন্ত্র
আছে। রোগ-ব্যাধিকে দীর্ঘস্থায়ী করা, আবার রোগ সারানোর জন্যও মন্ত্র আছে।
ফসলের ওপর যাতে কুলোকের কুদৃষ্টি না পড়ে সেজন্য কৃষক বীজ বুনে
ক্ষেতের চারপাশে পানি ছিটিয়ে দেয়, আর ক্ষেত-বন্ধনের মন্ত্র বলে: ‘জিও
জালা, জিও/ হাত ধুইয়া দিলাম পানি/ ধান হইস্ পোড়া খানি/… আমার ক্ষেত
দেখ্যা যে নজর লাগায়/ তার মা-পুলা ভাতে মারা যায়।’ চোর থেকে সম্পদ রক্ষার
জন্য ‘চোরবন্দী’ এবং ভূতপ্রেত থেকে মুক্ত থাকার জন্য ‘শরীরবন্ধন’ মন্ত্র
আছে। এরূপ বন্ধনমন্ত্র আরও আছে, যেমন ‘অগ্নিবন্ধন’, সর্পবন্ধন’, ‘বাঘ ও
সাপের মুখখিলানী’, ‘হাতিবন্ধন’, ‘বোলতাবন্ধন’, ‘বন্যা প্রতিরোধ’,
‘গৃহবন্ধন’ ‘বিষঝাড়া’ ইত্যাদি মন্ত্র। এর কতক মন্ত্র প্রতিরোধক এবং কতক
প্রতিষেধক। অন্যের ক্ষতি করার জন্য ‘বাণমারা মন্ত্র’ আছে, আবার নারী-পুরুষ
পরস্পরকে বশ করার জন্য আছে ‘বশীকরণ মন্ত্র’। কোনোটি ছড়ার মতো আবৃত্তি করা
হয়, আবার কোনোটি শ্লোকের মতো পাঠ করা হয়।
মন্ত্রের ভাষায় হিন্দু ও মুসলমানের ঐতিহ্য কোথাও আলাদাভাবে, কোথাও
মিশ্রভাবে আছে। কোনো কোনো দেবদেবী, পীর-পীরানি বা ধার্মিক ব্যক্তির দোহাইও
আছে। মন্ত্রগুলি দুই থেকে আট-দশ চরণে ছন্দোবদ্ধ ও চরণাশ্রিত কতগুলি
শব্দসমষ্টি; এর ভাষায় কোনো কবিত্ব নেই। উপলক্ষ বা প্রয়োজন ছাড়া যখন তখন
এবং যেখানে সেখানে এগুলি উচ্চারিত হয় না।
মন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত আছে কিছু লৌকিক ক্রিয়া, যাকে বলা হয়
মন্ত্রাচার। এতে জাদুর প্রভাবও আছে। শুভ-অশুভ, ইষ্ট-অরি সকল শক্তির অধিকারী
হওয়া বা তাকে বশে আনার চেতনা থেকেই জাদুর উদ্ভব। জাদু প্রধানত দুই প্রকার
শুক্ল জাদু (white magic) ও কৃষ্ণ জাদু (black magic)। প্রথমটি মঙ্গলজনক
এবং দ্বিতীয়টি অমঙ্গলজনক বা ধ্বংসাত্মক। ঝাড়-ফুঁক চিকিৎসাদিতে ব্যবহূত
জাদু মঙ্গলজনক; এসব প্রকাশ্যে অনুশীলিত হয়। মারণ, উচাটন, বশীকরণ ইত্যাদি
অনিষ্টকর; এগুলি গোপনে নিষ্পন্ন হয়। মন্ত্র হলো জাদুর বাঙ্ময় রূপ।
মন্ত্রের মধ্যে জাদুশক্তি আছে; মন্ত্রোচ্চারণ এবং তৎসংশ্লিষ্ট কিছু আচার
পালন করে জাদুশক্তির প্রকাশ ঘটানো হয়। মাদুলি, তাবিজ, তাগা, কবজ ইত্যাদি
বস্ত্তকে মন্ত্রপূত করে জাদুগুণ সম্পন্ন করা হয়। ওঝা, বৈদ্য, কবিরাজ,
পুরোহিত, সাধু-সন্ন্যাসী, পীর-ফকির, বেদে-বেদেনী, ধাত্রী, শিরালি প্রভৃতি
পেশাদার ও অপেশাদার ব্যক্তি মন্ত্রের প্রয়োগ করে থাকে। যেহেতু জাদুমন্ত্র
গুপ্তবিদ্যা, সেহেতু এর সবকিছুতে গোপনীয়তা রক্ষা করতে হয়। শিষ্য ছাড়া
অন্যকে মন্ত্রশিক্ষা দেওয়া যায় না। বার-তিথি, ক্ষণ-কাল, স্থান-পাত্র
ইত্যাদির বাছ-বিচার করে মন্ত্র প্রয়োগ করতে হয়; পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার
প্রতিও লক্ষ্য রাখতে হয়। মন্ত্রোচ্চারণে বা মন্ত্রাচারে ত্রুটি হলে লক্ষ্য
অর্জন দূরের কথা, প্রয়োগকারী নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হয় লোকসমাজে এরূপ
বিশ্বাস প্রচলিত আছে।
ব্যক্তি, গার্হস্থ্য ও সমাজজীবনের নানা ক্ষেত্রে জাদুমন্ত্রের ব্যবহার আছে। মধ্যযুগের কাব্য,
ব্রতকথা, লোককাহিনী, লোকবিশ্বাস, লৌকিক আচার-অনুষ্ঠান, চিকিৎসা, কৃষিকাজ ও
অন্যান্য পেশায় জাদুমন্ত্রের প্রভাব লক্ষ করা যায়। আসামের কামাখ্যা ছিল
মন্ত্রশিক্ষার কেন্দ্র; বাংলাদেশ থেকে বহু লোক সেখানে জাদু শিখতে যেতো।
পূর্বোক্ত গ্রামবন্ধনের মন্ত্রে ‘কামিখ্যা পর্বতে’র উল্লেখ আছে।
বাংলা লোককাহিনীতে কায়ার পরিবর্তন বা আত্মার রূপান্তর
(transformation of soul) একটি উল্লেখযোগ্য মোটিফ; স্টিথ থম্পসন একে ডি-৬৯৯
সংখ্যক মোটিফ-সূচির অন্তর্ভুক্ত করেছেন। গোপীচন্দ্রের গান থেকে জানা যায়
যে, রাজমাতা ময়নামতী মন্ত্রজ্ঞানী ছিলেন; মৃত স্বামীর প্রাণ ফিরে পাওয়ার
জন্য যমের সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্ব হয়।
মন্ত্র আসলে অজ্ঞ ও অসহায় মানুষের সান্ত্বনামাত্র; বিজ্ঞানের সঙ্গে
এর কোনো যোগসূত্র নেই। মন্ত্র মানুষের বিশ্বাস, দৈবনির্ভরতা ও অদৃষ্টবাদের
ওপর ভরসা বাড়িয়েছে, প্রকৃত মুক্তি দেয়নি। তবে কোনো কোনো মন্ত্রাচারে
রোগী সেবাজনিত উপকার পায়; তাতে কিছুটা মনস্তাত্ত্বিক উপকার হয়; অন্যথায়
মন্ত্র সম্পর্কিত আর যা কিছু সবই নিষ্ফল প্রয়াস মাত্র। মন্ত্রের ভাষায়
আল্লাহ, রসুল, চন্ডী,
মনসা, শিব, পার্বতীর দোহাই থাকলেও তাতে আধ্যাত্মিকতা নেই; ঐহিক চেতনা এবং
স্বাস্থ্য, সম্পদ, সুখ ও শান্তির বাসনাই মুখ্য। মন্ত্রের ভাব ও ভাষায়
হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলমান সংস্কৃতির প্রভাব পড়েছে।
ধাঁধা এক প্রকার রহস্যপূর্ণ রচনা। ‘ধন্দ’ শব্দ থেকে এর উৎপত্তি;
অর্থ সংশয়, দুরূহ সমস্যা ইত্যাদি। এর আরেক নাম ‘হেঁয়ালি’। এতে মূলত একটি
জিজ্ঞাসা থাকে এবং তার উত্তরটিও পরোক্ষভাবে এরই মধ্যে বিদ্যমান থাকে। মূল
বিষয়কে আড়াল করে শব্দের জাল বুনে তা রচনা করা হয়। তাই উত্তরদাতাকে
উপমা-রূপক-প্রতীকের রহস্যভেদ করে উত্তর দিতে হয়।
ধাঁধাচর্চায় কমপক্ষে দুজনের উপস্থিতির প্রয়োজন হয় একজন ধাঁধা
ধরে, অন্যজন উত্তর দেয়। ‘সাগরেতে জন্ম তার লোকালয়ে বাস/ মায়ে ছুঁলে
পুত্র মরে একি সর্বনাশ।’ এ ধাঁধাটির উত্তর ‘লবণ’। এখানে ‘সাগর’, ‘লোকালয়’,
‘মা’ ও ‘পুত্র’ প্রতীকী শব্দ। সমুদ্রের পানি শুকিয়ে লবণ তৈরি করা হয়,
আবার পানিতে দিলে সে লবণ গলে যায়। ধাঁধায় বর্ণিত এ চিত্রটি যেমন পরোক্ষ,
তেমনি রহস্যপূর্ণ। এটি নির্মাণে যেমন প্রতিভার প্রয়োজন, তেমনি উত্তর দিতেও
উপস্থিত বুদ্ধির প্রয়োজন।
ধাঁধা রচনায় বুদ্ধির সঙ্গে কল্পনার মিশ্রণ আছে, তবে আবেগের স্থান
নেই। এজন্য ধাঁধার অবয়ব দীর্ঘ হয় না। গদ্যে ও পদ্যে ধাঁধা রচিত হয়।
সাধারণত গদ্যাত্মক একটি বাক্যে অথবা ছন্দোবদ্ধ ও অন্ত্যমিলযুক্ত দুই থেকে
চার চরণে ধাঁধা সমাপ্ত হয়।
ধাঁধাকে লোকসাহিত্যের প্রাচীনতম শাখার একটি বলা হয়। গ্রিক পুরাণে
ধাঁধা আছে; স্ফিঙ্কস ইডিপাসকে মানুষ সম্পর্কীয় একটি ধাঁধা ধরেছিল এবং
ইডিপাস তার উত্তর দিয়ে থীবসের অভিশাপ থেকে জনগণকে রক্ষা করে। ভারতের আদি
গ্রন্থ ঋগ্বেদেও ধাঁধা আছে। অশ্বমেধযজ্ঞে হোতা ও ব্রাহ্মণগণ একে অপরকে
ধাঁধা জিজ্ঞেস করতেন। এছাড়া অথর্ববেদ, মহাভারত, জাতক, কথাসরিৎসাগর, নাথসাহিত্য, চন্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, শিবায়ন, গোপীচন্দ্রের গান ইত্যাদিতেও প্রচুর ধাঁধার ব্যবহার আছে।
বাংলা ও ভারতের বিভিন্ন গোত্রের আদিবাসীরা বিবাহ, কৃষিকাজ, মৃতদেহ
সৎকার, মন্ত্রাচার ও ধর্মানুষ্ঠানে ধাঁধার অনুশীলন করে। ছোটনাগপুরের ওরাওঁ
উপজাতির বিবাহানুষ্ঠানে ধাঁধার মাধ্যমে পাত্র-পাত্রী নির্বাচন করা হয়।
মধ্যপ্রদেশের গড় উপজাতির লোকেরা মৃতের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানের একটি
অঙ্গ হিসেবে ধাঁধার চর্চা করে; তারা বিবাহানুষ্ঠানেও বরপক্ষকে ধাঁধাযুদ্ধে
নাজেহাল করে। আসাম ও বাংলাদেশের অরণ্যচারী নাগা, কুকি, গারো,
কোচ ও মুরং উপজাতির কৃষকরা ফসল পাকার সময় ধাঁধা বলে আনন্দ করে। বিশ্বের
অন্যান্য দেশের আদিবাসীদের মধ্যেও ধাঁধার প্রচলন আছে। বাংলাদেশে ধাঁধার
চর্চা হয় মূলত বিবাহোপলক্ষে বর ও কনে নির্বাচনে বুদ্ধি পরীক্ষায়,
বিবাহ-বাসরে বরপক্ষ ও কনেপক্ষের মধ্যে আমোদ-প্রমোদমূলক প্রতিযোগিতায়,
কিশোর ও তরুণদের মধ্যে অবসরযাপন এবং কখনো কখনো গৃহস্থালি কাজকর্মের অবসরে
চিত্তবিনোদনের অঙ্গ হিসেবে।
বাংলা ধাঁধাকে পৌরাণিক, ঐতিহাসিক, সামাজিক মানুষ ও তার অঙ্গবাচক,
প্রাণী ও তার অঙ্গবাচক, উদ্ভিদ ও ফলমূলবাচক, প্রকৃতি ও নিসর্গবাচক,
খাদ্যদ্রব্য ও তৈজসপত্রবাচক, অক্ষর ও সংখ্যাবাচক, বাদ্যযন্ত্রবাচক, ভাব ও
ক্রিয়াবাচক ইত্যাদি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এসব বিচিত্র বিষয় নিয়ে রচিত
ধাঁধায় বাঙালি জাতির কল্পনাশক্তি, বুদ্ধিবৃত্তি, বিষয়জ্ঞান,
সৌন্দর্যচেতনা, কৌতুকবোধ ও চিত্তস্ফূর্তি প্রকাশ পেয়েছে।
একটি জাতি বা জনগোষ্ঠীর আত্মার মর্মস্থল থেকে ধাঁধার উদ্ভব হয় বলে
তাতে সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হয়। ‘এক বাড়ির তিন বউ/ এক পালাইলে
রান্না থোও।’ (উনুন) এটি একান্নবর্তী পরিবারের অন্তরঙ্গতার ছবি; ‘মামুরা
সিন্নি রান্ধে খায়/ আমাকে দেখ্যা দুয়ার দেয়।’ (শামুক) এখানে আত্মীয়তার
মধুর সম্পর্কে ফাটল ধরার কথা ব্যক্ত হয়েছে। অনুরূপভাবে ‘কালো বউয়ের কপালে
চিক/ জামাই এলে করে হিত।’ (মাসকলাই), ‘ছোট ইটা ছেমরি/ নায়না ধোয়না এতই
সুন্দরী।’ (রসুন), ‘তলে মাটি উপরে মাটি/ মধ্যে সুন্দরী বেটি।’ (হলুদ),
‘ঘরের মধ্যে ঘর/ নাচে কন্যা-বর।’ (মশারি) ইত্যাদি ধাঁধা পারিবারিক জীবনের
বিভিন্ন চিত্রকে ধারণ করে আছে।
প্রবাদ লোকসাহিত্যের শাখাগুলির মধ্যে প্রবাদ অতীতের বিষয়
হয়েও সমকালকে সবচেয়ে বেশি স্পর্শ করেছে। আধুনিক যুগে প্রায় সব ধরণের
রচনায় প্রবাদ ব্যবহূত হয়। কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, নাটক, সংবাদপত্র,
বিজ্ঞাপন, বক্তৃতা, দৈনন্দিন কথাবার্তা ইত্যাদিতে প্রবাদের ব্যবহার অহরহ
লক্ষ করা যায়। লোকসাহিত্যধারায় প্রবাদ হলো ক্ষুদ্রতম রচনা। একটি
সংক্ষিপ্ত বাক্য থেকে ছন্দোবদ্ধ দুই চরণ পর্যন্ত প্রবাদের অবয়বগত
ব্যাপ্তি।
প্রবাদ মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতাপ্রসূত বৌদ্ধিক রচনা। যেকোনো প্রবাদ
মানুষের ব্যবহারিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থেকে জন্ম নেয়। ‘অতি সন্ন্যাসীতে গাজন
নষ্ট’, ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে’, ‘জোর যার, মুল্লুক তার’, ‘লাগে টাকা
দেবে গৌরীসেন’ ইত্যাদি প্রবাদের গঠন অত্যন্ত সংহত, অথচ ভাবার্থ অত্যন্ত
ব্যাপক; স্বল্প কথায় এত বেশি অর্থবহনক্ষমতা প্রবাদ ছাড়া লোকসাহিত্যের
অন্য শাখায় নেই।
প্রবাদের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ বিশেষ উক্তি বা কথন। যে উক্তি লোকপরম্পরায় জনশ্রুতিকে নির্ভর করে চলে আসছে তাই প্রবাদ।
প্রবাদ সমাজমানসে জন্ম নিয়ে পাথরের নুড়ির মতো জীবনস্রোতের অনেকখানি পথ
অতিক্রম করে একটি নিটোল রূপ লাভ করে। পরে আর তেমন কাঠামোগত পরিবর্তন হয়
না। উল্লেখ্য যে, প্রবাদ ও বাগ্ধারার মধ্যে পার্থক্য আছে। প্রবাদ হচ্ছে
একটি অর্থপূর্ণ সংক্ষিপ্ত বাক্য, আর বাগ্ধারা হচ্ছে অর্থপূর্ণ একটি
বাক্যাংশ বা শব্দগুচ্ছ।
দেশের প্রকৃতি-পরিবেশ-পারিপার্শ্বিকতা, প্রাণী, সম্পদ, উৎপাদন ও
জাতীয় জীবনের নানা ধারা, তার ইতিহাস, সংস্কৃতি, ধর্ম, সমাজ, পরিবার,
ঘর-সংসার ইত্যাদি বিষয় নিয়ে প্রবাদ রচিত হয়। এগুলি খন্ড হলেও দেশ ও
জাতির খাঁটি চিত্র; কারণ প্রবাদ লোকমনের সত্যরূপ বহন করে।
প্রবাদ বহু প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত আছে। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে
মিশরের প্যাপিরাসের গল্পে প্রবাদ আছে। ভারতীয় বেদ-উপনিষদ এবং বাংলা
সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদেও প্রবাদ আছে। ‘আপনা মাসে হরিণা বৈরি’
প্রবাদটি চর্যাপদকর্তা ভুসুকু ব্যবহার করেন, তাঁর আবির্ভাবকাল এগারো শতক;
চৌদ্দ শতকে বড়ু চন্ডীদাস
শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে এবং ষোলো শতকে মুকুন্দরাম চন্ডীমঙ্গলে একই প্রবাদ
ব্যবহার করেন। আধুনিক যুগে বাংলা সাহিত্যের প্রভূত উন্নতি ও প্রসার ঘটলে
প্রবাদের ব্যবহারও ব্যাপক হয়। [ওয়াকিল আহমদ]
গ্রন্থপঞ্জি দীনেশচন্দ্র সেন, মৈমনসিংহ-গীতিকা, কলকাতা,
১৯২৩, পূবর্ববঙ্গ-গীতিকা, ১৯২৬; আশুতোষ ভট্টাচার্য, বাংলার লোকসাহিত্য, ১ম
খন্ড, কলকাতা, ১৯৬৩; শীলা বসাক, বাংলা ধাঁধার বিষয়বৈচিত্র্য ও সামাজিক
পরিচয়, কলকাতা, ১৯৯০; আশরাফ সিদ্দিকী, লোকসাহিত্য (২খন্ড), ঢাকা, ১৯৯৪;
Maria Edward Leach (ed.), Standard Dictionary of Mythology, Folklore and
Legends, Vols. 1 & 11, New York, 1949; Antti Arne and Stith
Thompson, The Types of Folktales, Helsinki, 1964।
অভিজ্ঞতাকে আশ্রয় করে রচিত হয়। একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক পরিমন্ডলে একটি
সংহত সমাজমানস থেকে এর উদ্ভব। সাধারণত অক্ষরজ্ঞানহীন পল্লিবাসীরা স্মৃতি ও
শ্রুতির ওপর নির্ভর করে এর লালন করে। মূলে ব্যক্তিবিশেষের রচনা হলেও
সমষ্টির চর্চায় তা পুষ্টি ও পরিপক্কতা লাভ করে। এজন্য লোকসাহিত্য সমষ্টির
ঐতিহ্য, আবেগ, চিন্তা ও মূল্যবোধকে ধারণ করে। বিষয়, ভাষা ও রীতির ক্ষেত্রে
প্রচলিত ধারাই এতে অনুসৃত হয়। কল্পনাশক্তি, উদ্ভাবন-ক্ষমতা ও পরিশীলিত
চিন্তার অভাব থাকলেও লোকসাহিত্যে শিল্পসৌন্দর্য, রস ও আনন্দবোধের অভাব থাকে
না।
লোকসাহিত্য লোকসংস্কৃতির একটি জীবন্ত ধারা; এর মধ্য দিয়ে জাতির আত্মার স্পন্দন শোনা যায়। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একে ‘জনপদের হূদয়-কলরব’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। লোকসাহিত্যকে প্রধানত লোকসঙ্গীত, গীতিকা, লোককাহিনী, লোকনাট্য, ছড়া, মন্ত্র, ধাঁধা ও প্রবাদ এই আটটি শাখায় ভাগ করা যায়।
লোকসঙ্গীত ঐতিহ্যগতভাবে বিশেষ সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত
গান; সাধারণত পল্লীর অনক্ষর জনগণ এর প্রধান ধারক। বিষয়, কাল ও উপলক্ষভেদে
এ গানের অবয়ব ছোট-বড় হয়। ধুয়া, অন্তরা, অস্থায়ী ও আভোগ সম্বলিত
দশ-বারো চরণের লোকসঙ্গীত আছে; আবার ব্রতগান, মেয়েলী গীত, মাগনের গান, জারি গান, গম্ভীরা গান ইত্যাদি আকারে অপেক্ষাকৃত বড় হয়। কবির লড়াই, আলকাপ গান, লেটো গান এবং যাত্রাগান হয় আরও দীর্ঘ, কারণ সারারাত ধরে এগুলি পরিবেশিত হয়।
লোকসঙ্গীতের গায়করা পেশাদার ও অপেশাদার উভয়ই হতে পারে। পেশাদার
কোনো গায়েন বা বয়াতি দল গঠন করে অর্থের বিনিময়ে গান গায়; কবিয়াল দলবল
নিয়ে কবির লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করে। আলকাপ গানের ছোকরা এবং ঘাটু গানের ঘাটু
পেশাদার নটী ও গায়ক; উদাস বাউল নিজেই গান করে তার অধ্যাত্মপিপাসা নিবৃত্ত করে। বৈরাগী-বৈরাগিণী বা বোষ্টম-বোষ্টমী গান গেয়ে ভিক্ষা করে। বিবাহাদি অনুষ্ঠানে মেয়েলি গীত
গাওয়ার জন্য পেশাদার গিদাল থাকে; তবে সাধারণ মেয়েরাও গান গায়।
ক্ষেত-খামারে কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষ, মাঠে-ঘাটে রাখাল এবং নদী-হাওরে
মাঝি-মাল্লারাও চিত্তবিনোদন, অবসরযাপন বা শ্রম লাঘবের জন্য গান গায়।
বাংলা লোকসঙ্গীত নাম ও প্রকারভেদে বিচিত্র; অঞ্চলভেদে এর প্রায়
শতাধিক নাম রয়েছে এবং প্রকারভেদে প্রায় পঞ্চাশোর্ধ্ব শ্রেণির গান চিহ্নিত
করা যায়। কেউ কেউ আঞ্চলিক ও সর্বাঞ্চলীয়, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক,
সাধারণ ও তত্ত্বপ্রধান, তালযুক্ত ও তালহীন এরূপ স্থূলভাবে ভাগ করে সেগুলির
আবার নানা উপবিভাগ করেছেন। আশুতোষ ভট্টাচার্য
লোকসঙ্গীতকে আঞ্চলিক, ব্যবহারিক, আনুষ্ঠানিক (ritual), কর্মমূলক ও
প্রেমমূলক এই পাঁচটি ভাগে ভাগ করেছেন। বিষয়গত দিক থেকে একে প্রেম,
ধর্ম-আচার-সংস্কার, তত্ত্ব ও ভক্তি, কর্ম ও শ্রম, পেশা ও বৃত্তি, ব্যঙ্গ ও
হাস্যকৌতুক এবং মিশ্র এরূপ সাতটি ভাগ করা যায়।
নর-নারীর প্রেম অবলম্বন করে রচিত বাংলা লোকসঙ্গীতে লৌকিক বা পার্থিব
প্রেম এবং তত্ত্ব-ভক্তিমূলক গানে অলৌকিক বা অপার্থিব প্রেমের কথা আছে।
রাধাকৃষ্ণের আখ্যান অবলম্বনে রচিত আলকাপ, কবিগান, ঘাটু গান, ঝুমুর, বারমাসি, মেয়েলি গীত, যাত্রাগান, সারি গান,
হোলির গান ইত্যাদিতে দেহজ কামনা-বাসনা, মান-অভিমান, মিলন-বিরহ ইত্যাদি
ব্যক্ত হয়। যেমন ‘বনে কানুর বাঁশি বাজিল রে’ (আলকাপ), ‘কি হেরিলাম যমুনায়
আসিয়া গো সজনি’ (ঘাটু গান), ‘শুন গো রাই, বলি তোরে’ (ঝুমুর), ‘মাঘ না
মাসেতে মাধব মতুরায় গমন’ (বারোমাসি), ‘তুই মোরে নিদয়ার কালিয়া রে’
(ভাওয়াইয়া), ‘মন দুঃখে মরিবে সুবল সখা’ (বিচ্ছেদি গান), ‘সুন্দরী লো
বাইরইয়া দেখ, শ্যামে বাঁশি বাজাইয়া যায় রে’ (সারিগান), ‘নিধুবনে শ্যাম
কিশোর সনে খেলব হোলি আয়’ (হোলির গান) ইত্যাদি। এ গানগুলিতে রাধা, কৃষ্ণ, সুবল, মথুরা, যমুনা, বাঁশি
ইত্যাদি শব্দ থাকলেও তাতে ধর্মীয় ভাব বা আধ্যাত্মিকতা নেই, আছে মানবিকবোধ
ও বৈষয়িক চেতনা। গাড়িয়াল, মৈষাল, মাহুত, মাঝি, সওদাগর, বানিয়া, নদী,
হাওর প্রভৃতি বাংলার পেশাজীবী মানুষ ও প্রকৃতি নিয়েও এ ধরণের গান রচিত
হয়। ‘ও কি গাড়িয়াল ভাই, কত রব আমি পন্থের দিকে চায়া রে’ (ভাওয়াইয়া),
‘আরে গেইলে কি আসিবেন মোর মাহুত বন্ধু’ (ওই), ‘আমার বাড়ি যান ও মোর
প্রাণের মৈষাল রে’ (চটকা), ‘ও মোর বানিয়া বন্ধু রে’ (ওই), ‘সুজন মাঝি রে,
কোন ঘাটে লাগাইবা তোর নাও’ (ভাটিয়ালি), ‘সুন্দইর্যা মাঝির নাও উজান চলো
ধাইয়া’ (সারিগান) ইত্যাদি গানে রূপক-প্রতীক নেই, আছে নিত্য পরিচিত মানুষ,
প্রাণী ও প্রকৃতির চিত্র।
জীবনের খন্ড খন্ড চিত্র কথায় ও সুরে অবলীলায় রূপ দিয়েছেন
লোকশিল্পীরা। ‘গাও তোল গাও তোল কন্যা হে, কন্যা পিন্দো বিয়ার শাড়ি’,
‘ঘাটে ডিঙ্গা লাগাইয়া মাঝি পান খেয়া যাও’, ‘কত পাষাণ বাইন্দ্যাছ পতি
মনেতে’, ‘জল ভর সুন্দরী কন্যা জলে দিয়া মন’, ‘লাল নীল চউর বাইয়া, হাটে
যাও রে সোনার নাইয়া’ ইত্যাদি প্রেমসঙ্গীতে জীবনের খন্ডচিত্র আবেগের ভাষায়
রূপ পেয়েছে।
দেহতত্ত্ব, আত্মতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব, দয়ালতত্ত্ব ও ভাবতত্ত্ব নিয়ে
রচিত হয় বাউল, মুর্শিদি, মারফতি, মাইজভান্ডারি প্রভৃতি আধ্যাত্মিক গান।
প্রধানত বাউল, ফকির, বৈরাগী ও ভক্তশিষ্যগণ এসব গানের চর্চা করে থাকে। জীবন,
সংসার ও জগৎকে অনিত্য এবং দুঃখময় ভেবে তারা আধ্যাত্মিক জগতে শান্তি ও
মুক্তি খোঁজে। কেউ সরাসরি ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করে, কেউ বা
গুরু-মুর্শিদের নিকট আবেদন-নিবেদন করে। ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে
যায়’ (বাউল), ‘মনমাঝি তোর বইঠা নেরে আমি আর বাইতে পারলাম না’ (ভাটিয়ালি),
‘ভবনদী পার করে দাও দয়াল মুর্শিদ আমারে’ (মুর্শিদি), ‘ও কি চমৎকার,
ভান্ডারে এক আজব কারবার’ ( মাইজভান্ডারি গান) ইত্যাদি এরূপ তত্ত্বসঙ্গীত। এগুলিতে সংসারবিমুখ ভাবের প্রতিফলন ও বিবাগী সুরের প্রতিধ্বনি আছে।
ধর্ম-সংস্কার-আচার-ব্যবহারমূলক বিচিত্র লোকসঙ্গীত প্রচলিত আছে।
প্রেমসঙ্গীতে জাতির চিরন্তন সত্তা আর অনুষ্ঠাননির্ভর সঙ্গীতে জাতির বিশিষ্ট
সত্তা প্রকাশিত। ‘আল্লাহ ম্যাঘ দে পানি দে, ছায়া দে রে তুই’ গানে বৃষ্টির
জন্য আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করা হয়েছে। এমন আবেদন সরাসরি মেঘের কাছেও
করা হয়েছে, যেমন: ‘মেঘ রাজারে তুইনি সুদর ভাই/ এক ঝাড়ি মেঘ দে ভিজ্যা ঘরে
যাই।’ রংপুরের রাজবংশী
কৃষকদের মধ্যে ‘হুদমার গান’ নামে এক ধরণের লোকসঙ্গীত প্রচলিত আছে। হুদমা
হচ্ছে মেঘের দেবতা; কৃষক রমণীরা রাত্রিবেলা নগ্ন হয়ে কৃষিক্ষেতে নাচ-গান
করে এবং পানি ঢেলে নকল চাষের অভিনয় করে।
পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় অঞ্চলের ভাদু, টুসু ও জাওয়া গান মূলত
ব্রতকেন্দ্রিক। জাওয়া শস্যোদ্গমের, আর ভাদু শস্য তোলার উৎসব। প্রাচীন যুগে
লোকের দৃষ্টিতে ভূমির শস্যবতী ও নারীর সন্তানবতী হওয়া ছিল অভিন্ন। কুমারী
মেয়েরা নিজেদের সফল জীবনের আশায় ভাদু ব্রত পালন করে। এছাড়া হিন্দু
নারীসমাজে আরও অনেক ব্রত আছে। সেসব ব্রতে সন্তান, সম্পদ ও জাগতিক
সুখসমৃদ্ধি কামনা করে গান করা, ছড়া বলা ও আলপনা অাঁকা হয়। কৃষির দেবতা শিবকে কেন্দ্র করে শিবের গাজন
ও গম্ভীরা উৎসব পালিত হয়। শিব-পার্বতীর গার্হস্থ্য জীবন নিয়ে রচিত গাজন
গানে আসলে কৃষকজীবনেরই ছায়াপাত ঘটেছে। এ গানের দুটি ধারা একটিতে থাকে
শিবের পারিবারিক জীবনচিত্র এবং অপরটিতে থাকে শিবের কাছে সাংসারিক জীবনের
নানাবিধ অভাব-অভিযোগের বিবরণ। ‘ধান লাড় ধান লাড়, গোরী, আউলাইয়া মাথার
কেশ’ এটি প্রথম ধারার এবং ‘শিব, তোমার লীলাখেলা কর অবসান/ বুঝি বাঁচে না আর
জান’ এটি দ্বিতীয় ধারার গান। বর্তমানে গম্ভীরার এই ধারায় ‘নানা-নাতি’র
গান ও অভিনয়ের মাধ্যমে রাজনীতি, সমাজ, শিক্ষা, অর্থনীতি, প্রাকৃতিক
দুর্যোগ, দুর্নীতি এবং ব্যক্তিচরিত্র সম্পর্কেও আলোকপাত করা হয়। এটি
গম্ভীরার রূপান্তরিত নতুন আঙ্গিক।
ঝড়বৃষ্টি ও বজ্রপাত থেকে ফসল রক্ষার জন্য ওঝা শ্রেণির শিরালিরা
শিঙ্গা বাজিয়ে ও মন্ত্রধর্মী গান গেয়ে মেঘ তাড়ায়। এ প্রথা এক সময় ময়মনসিংহ ও সিলেট
অঞ্চলে প্রচলিত ছিল। এ ধরণের কাজ করতে গিয়ে শিরালিরা বজ্রাঘাতে প্রাণ
হারিয়েছে এমন দৃষ্টান্তও আছে। বর্তমানে অবশ্য এ জাতীয় গান লুপ্তপ্রায়।
গোসম্পদ রক্ষার উদ্দেশ্যে গোয়াইলার শিরনি ও গোরক্ষনাথের শিরনি আচার
পালিত হয়। কৃষিকাজে গরুর ব্যবহার অপরিহার্য, তাই গরুর নিরাপত্তা কামনা
করে শির্নী
মানত করা হয়। এ উপলক্ষে রাখাল বালক ও অন্যান্য ছেলেমেয়ে দল বেঁধে ঘরে
ঘরে যায় এবং গান গেয়ে শির্নীর চাল-ডাল-অর্থ সংগ্রহ করে; একে মাগনের গানও
বলে।
হিন্দুসমাজে দেবদেবীর উদ্দেশে যেমন ব্রতের গান আছে, তেমনি মুসলমান সমাজেও আছে পীর-পীরানির উদ্দেশে জাগগান।
পীরের মাহাত্ম্যসূচক এ গান দীর্ঘরাত্রি জেগে গাওয়া হয়। গাজী পীর, মাদার
পীর, খোয়াজ-খিজির, মানিক পীর, সোনা পীর ও বদর পীর লোকদৃষ্টিতে অলৌকিক
ক্ষমতার অধিকারী; তাঁরা সন্তানহীনাকে সন্তানদান, রোগব্যাধি দূরীকরণ,
ধনসম্পদ দান এবং গরুবাছুর রক্ষা করতে সক্ষম বলে বিশ্বাস করা হয়। মাগনের
গানের মতো জাগগান গেয়েও শির্নীর চাল-ডাল সংগ্রহ করা হয়। জাগগানে
পীরমাহাত্ম্য বর্ণিত হলেও তাতে ধর্মভাব আছে সামান্যই; বৈষয়িক চেতনা ও
কল্যাণবুদ্ধিই মুখ্য। এগুলি আখ্যানধর্মী ও বিবৃতিমূলক বলে আকারে দীর্ঘ হয়।
গাজী পীরের উদ্দেশে নিবেদিত গান গাজীর গান
নামে পরিচিত। সন্তান, স্বাস্থ্য ও সম্পদ কামনায় মানত করে গাজীর গানের
পালা দেওয়ার রীতি আছে। শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীচৈতন্যের লীলাসংক্রান্ত জাগগানও
আছে।
মুসলমান সমাজে প্রচলিত জারিগান বা শোকসঙ্গীত মুহররম উপলক্ষে গাওয়া হয়। কারবালার বিষাদময় কাহিনী অবলম্বনে ছোট ও বড় আকারের জারিগান প্রচলিত আছে। জারি গান ও নাচে শিয়া সম্প্রদায়ের মুহররমের মিছিল, তাজিয়া, দরগাহ, দুলদুল, ইমামবারা,
মাতম, মর্সিয়া ইত্যাদির প্রভাব পড়েছে। বিষয়বস্ত্ততে মৃত্যু, শোক, বিলাপ
ও বিরহ থাকায় জারিগানে করুণ রসের প্রাধান্য থাকে। মুহররম ধর্মীয়
অনুষ্ঠান হলেও জারিগানে ধর্মীয় কোনো প্রভাব নেই; মানবহূদয়ের চিরন্তন
আর্তি ও বেদনার সুরই এতে ধ্বনিত হয়।
জারিগান দলীয় সঙ্গীত; গায়েন ও দোহাররা মিলিতভাবে এ গান পরিবেশন
করে। বাংলাদেশের নানা অঞ্চলে আজও জারিগানের প্রচলন আছে। তবে বর্তমানে এর
বিষয়বস্ত্তর বিস্তার ঘটেছে; ‘ইসমাইলের কোরবানির জারি’, ‘ইউসুফের জারি’,
‘আনাল হকের জারি’, ‘স্বাধীনতা দিবসের জারি’ ইত্যাদি নামে বিচিত্র বিষয়
অবলম্বনে জারিগান রচিত হচ্ছে। নারীরা মুহররম উপলক্ষে অন্তঃপুরে বসে যে মাতম
করে এবং গীত গায় তাকে বলে মর্সিয়া। এতে পতিহারা সখিনার বিরহ-যাতনা ও
আর্তনাদ গীতের ভাষা ও সুরে প্রকাশ পায় এবং তা সাধারণ বিধবার অন্তর্বেদনার
সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
কর্মসঙ্গীতের নামই প্রমাণ করে যে, এগুলি শ্রম ও কর্মের সঙ্গে জড়িত
লোকসঙ্গীত। কর্মে উৎসাহ দান, শ্রমভার লাঘব এবং চিত্তবিনোদনের উদ্দেশ্যে এ
সঙ্গীতের আয়োজন করা হয়। ক্ষেত নিড়ানো, ধান-পাট কাটা, ধান ভানা ইত্যাদি
কৃষিকাজ ছাড়াও দাঁড় টানা, ছাদ পেটানো, জাল বোনা, তাঁত বোনা, মাটি কাটা,
ভারি বস্ত্ত টানা ইত্যাদি কাজেও কর্মসঙ্গীতের প্রচলন আছে। কর্মের সঙ্গে
সঙ্গীতের কথা ও সুরের সরাসরি সম্পর্ক আছে। যেমন ‘আয় রে তরা ভুঁই নিড়াইতে
যাই’, ‘আমরা ধান ভানিরে ঢেকিতে পার দিয়া’, ‘রঙের নাও রঙের বৈঠা রঙে রঙে
বাও’ যথাক্রমে ক্ষেত নিড়ানো, ধান ভানা ও নৌকা বাইচের গান। এসব গানের কথা,
ছন্দ ও সুরে ছড়িয়ে আছে জীবনের সাধ-আহ্লাদ, রস-রসিকতা, আনন্দ-উল্লাস
ইত্যাদি। শ্রমসঙ্গীতে শাস্ত্রকথা ও নীতিকথার কোনো স্থান নেই।
নিম্নশ্রেণীভুক্ত পেশাজীবী পটুয়ারা কাগজ ও মাটির পাত্রে পট অাঁকে
এবং পটের চিত্র অনুযায়ী গান রচনা করে। গ্রামে-গঞ্জে পট দেখানোর সময় তারা
এই গানগুলি গেয়ে অর্থোপার্জন করে। তাদের পটের বিষয়বস্ত্ত রাধাকৃষ্ণ,
রামসীতা, নিমাই সন্ন্যাস, গাজী পীর ইত্যাদি। ময়মনসিংহ থেকে সংগৃহীত
‘পঞ্চকল্যাণী’ নামক একটি পটে শিব, শ্যাম, সীতা, নিমাই ও অসতী নারীর চিত্র আছে। পটুয়া গানে ভাব নয়, ঘটনার বর্ণনা থাকে। পটের চিত্র অনুযায়ী কথা সাজাতে হয় বলে এরূপ গানে শিল্পীর স্বাধীনতা থাকে অল্পই।
পটুয়াদের মতো বেদেরাও বর্ষাকালে নৌকায় করে গ্রামগঞ্জে গিয়ে
ছোটখাটো ব্যবসাদ্বারা জীবিকা নির্বাহ করে। সাপ ধরা, সাপ খেলানো ও ওঝাগিরি
তাদের প্রধান জীবিকা। এ উপলক্ষে তারা মন্ত্র ও গান রচনা করে। ‘সাপ খেলা
দেখবি যদি আয় রে সোনা বউ/ এমনি খেলা সাপের খেলা দেখেনি তো কেউ’ ঢাকা থেকে
সংগৃহীত ও রেকর্ডকৃত এই গানে সাপ খেলানোর চিত্র আছে। মনসা ও বেহুলা-লক্ষীন্দর প্রসঙ্গ তাদের গানের প্রধান বিষয়।
পুতুলনাচ দেখিয়ে ও গান গেয়ে জীবিকা অর্জন করে অপর এক শ্রেণির পেশাজীবী মানুষ। পুতুলনাচের প্রকৃতি ও বিষয় অনুযায়ী এর গান হয় ছোট-বড়। পাঁচালি, কীর্তন
ও মালসী সুরে এ গান পরিবেশিত হয়। মাঝেমধ্যে গদ্য সংলাপও থাকে। এতে অনেক
সময় মানবজীবনের খন্ডচিত্র ফুটে ওঠে, যেমন: ‘ও লো সুন্দরি! কার কথায়
কইরাছো তুমি মন ভারি/ আমি যেখানে সেখানে থাকি অনুগত তোমারি’ গানটিতে
দাম্পত্য জীবনের একটি সরস চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে।
ফেরিওয়ালারা ফেরি করতে করতে গান করে, আবার ফকির-বৈরাগীরা গান গেয়ে
ভিক্ষা করে। হাতিখেদার গান হাতি ধরার উদ্দেশ্যে রচিত ও গীত হয়। কর্ম ও
পেশার সঙ্গে এসব গানের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। খেমটা নাচ ও গান
ব্যবসায়বৃত্তির সঙ্গে জড়িত; এ উদ্দেশ্যে নাচের দলও আছে। প্রধানত
নপুংসকেরা এ ধরণের নাচ-গান করে জীবিকা নির্বাহ করে। বিবাহ, অন্নপ্রাশন
ইত্যাদি উৎসবে খেমটাওয়ালারা নাচ-গান করে দর্শকদের মনোরঞ্জন করে। এদের
গানের বিষয় সাধারণত লঘু রঙ্গরসাত্মক ও অশ্লীল হয়ে থাকে। রাধাকৃষ্ণের
লৌকিক প্রেম খেমটা গানের প্রধান বিষয়। চটকা, বোলান,
লেটো ইত্যাদি গানেও রঙ্গ-ব্যঙ্গ, ঠাট্টা-বিদ্রূপ ও অশীলতা আছে। এছাড়া
আলকাপ, কবির লড়াই, খেমটা, মেয়েলি গীত, সারি, ঘাটু ইত্যাদি গানও অংশত
ব্যঙ্গরসাত্মক। মূলত লোকমনোরঞ্জনই এ ধরণের গানের উদ্দেশ্য। গ্রামজীবনের
অভাব-অনটন, দুঃখ-শোক ও বঞ্চনার মধ্যেও হাসির ঈষৎ রেখাটি যে এখনও বিলীন হয়ে
যায়নি, এসব গানে তার পরিচয় পাওয়া যায়। অবৈধ ও পরকীয়া প্রেম, অবাঞ্ছিত
ব্যক্তি ও ঠাট্টা-মস্করার পাত্রকে অবলম্বন করে হাস্যরসের গান রচিত হয়।
সাময়িক উত্তেজনা ও লঘু রসিকতা এসব গানের মুখ্য আবেদন।
কবিগানে পৌরাণিক, ঐতিহাসিক, সামাজিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও
শিক্ষাবিষয়ক কাহিনী বা সমস্যাদি স্থান পায়। দাঁড়া কবিগানে তাৎক্ষণিকভাবে
প্রস্তাবিত বিষয় আলোচিত হয়। পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক আখ্যানগুলি ধর্মীয় ও
নীতিবিষয়ক হয়ে থাকে। রাধাকৃষ্ণের প্রেমাখ্যানকে ‘সখী সংবাদ’ এবং শ্যামার
ভক্তিমূলক গানকে ‘ভবানী বিষয়’ বলে। কবিগানের ‘খেউড়’ অংশ আদি রসাত্মক ও
রুচিহীন। ‘খিস্তি-খেউড়’ কথাটির এখান থেকেই উৎপত্তি। দুই দলের মধ্যে
প্রশ্নোত্তরের ধারায় কবির লড়াই চলে। উনিশ শতকে কলকাতা
শহরকে কেন্দ্র করে কবিগানের উৎপত্তি হয়। পরে তা দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে
পড়ে। কবিগানের আসরে ভাব, ভাষা, ছন্দ, সুর, বাদ্য ও ভঙ্গি সংযোগে একটি
সাঙ্গীতিক আবহ সৃষ্টি হয়। শ্রোতারা সারারাত ধরে তা শুনে মুগ্ধ হয় ও আনন্দ
উপভোগ করে।
সারিগানের সঙ্গে নদী, নৌকা,
মাঝি-মাল্লা, পারাপার ইত্যাদি বিষয় জড়িত। রাধা-কৃষ্ণ, গৌরী-মেনকা ও
রাম-সীতার লীলাবিষয়ক পুরাণাশ্রিত গান, নিমাই সন্ন্যাসমূলক ইতিহাসাশ্রিত
গান এবং নর-নারীর প্রেম-বিরহমূলক বাস্তব জীবনাশ্রিত গান সারিগানের
অন্তর্ভুক্ত। নৌকাবাইচ
উপলক্ষে গীত সঙ্গীতসমূহ সারিগানের প্রধান অংশ, তবে সাধারণভাবে দাঁড়-গুণ
টানা বা পাল তুলে নৌকা চালানোর সময়ও এ গান গাওয়া হয়। নৌকাবাইচের গান বেশ
জীবনরসসিক্ত, তাত্ত্বিক ও উদ্দীপনামূলক। ‘আষাড়িয়া নয়া পানি আইল রে ভাই
দেশেতে/ আয় রে ও ভাই আয় রে সবাই আয়রে ডিঙ্গা বাইতে’, ‘মন পবনে বেগ
উঠ্ঠ্যাছে ভক্তির বাদাম দেও নৌকায়’, ‘শ্যাম কালিয়া তোর পিরীতে মইলাম
জ্বলিয়া/ ডিঙ্গা সাজাও মাঝিভাই যমুনাতে যাই’ ইত্যাদি গানে বিষয়, সুর, তাল ও ছন্দোবৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়। সারিগান বাংলাদেশে এখনও জনপ্রিয় লোকসঙ্গীত।
মেয়েলী গীত নারীসমাজের অন্তর্জীবন ও বহির্জীবনের বিচিত্র
ভাব-আলেখ্য। কন্যা-জায়া-জননীরূপে পরিবারে নারীর অবস্থানকে কেন্দ্র করে
সংসার-সাগরে যে ভাবরাশি উত্থিত হয়, মেয়েলি গীত তার বাঙ্ময় প্রকাশ।
কুমারী জীবন, বিবাহিত জীবন ও সংসার জীবনের সুখ-দুঃখময় নানা ঘটনা ও বিচিত্র
ভাব নিয়ে মেয়েলি গীত রচিত হয়। বিবাহ উপলক্ষে রচিত মেয়েলি গীতের সংখ্যা
সর্বাধিক। কনে দেখা থেকে শুরু করে বিবাহের শেষ অনুষ্ঠান ফিরানি পর্যন্ত
প্রায় সবস্তরের আচার-অনুষ্ঠানে এ গান গাওয়া হয়। এ সময় পল্লিরমণীরা ঢেঁকি,
যাঁতা ও পাটায় কাজ করে এবং গান গেয়ে সারারাত কাটিয়ে দেয়। গর্ভাধান,
অন্নপ্রাশন, উপনয়ন, খতনা, কান ফোঁড়ানো, সখি পাতানো ইত্যাদি উপলক্ষেও
মেয়েলি গান রচিত ও গীত হয়। স্বামী-স্ত্রীর প্রেম-বিরহ ও নাইয়রকেন্দ্রিক
গীতও আছে। এসব গীতে বৈষয়িক চাওয়া-পাওয়া ও আশা-আকাঙ্ক্ষার চিত্র ফুঠে
ওঠে। মেয়েলি গীত বাংলার প্রায় সব অঞ্চলেই প্রচলিত।
গীতিকা গীতোপযোগী ছন্দোবদ্ধ রচনা এবং লোকসাহিত্যের নবীনতম শাখা। অন্তঃমধ্য যুগ এর রচনাকাল। নাটকীয়তা গীতিকার একটি প্রধান গুণ। গীতিধর্মী রচনা হলেও এটি পাঠ করে সাধারণ কাব্যপাঠের মতোই আনন্দ পাওয়া যায়।
গীতিকায় সাধারণত পাত্র-পাত্রীর নাম থাকে না; রাজপুত্র,
মন্ত্রিপুত্র, রাজকন্যা, পরীকন্যা, রাক্ষস, জাদুগিন্নী, সওদাগর, ধোপা,
মালিনী, সন্ন্যাসী, পীর-ফকির ইত্যাদি নৈর্ব্যক্তিক নামে তারা পরিচিত হয়।
তাদের রাজ্য ও আবাসগৃহ থাকে বটে, কিন্তু সেসবের ভৌগোলিক অস্তিত্ব থাকে না।
বাংলা গীতিকার প্রধান বিষয় নরনারীর প্রেম। মৈমনসিংহ-গীতিকার দশটি
পালার মধ্যে নয়টিই প্রেমমূলক, একটি দস্যুতামূলক। প্রেমগাথার
নায়ক-নায়িকারা বর্ণ-বিত্ত-কূল-ধর্মের দিক থেকে কেউ সমস্তরের, কেউ বা
অসমস্তরের। নায়ক-নায়িকার প্রেমে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে সামন্তপতি, তার
প্রতিনিধি, বিত্তশালী ও অন্যান্য ক্ষমতাধর ব্যক্তির রূপতৃষ্ণা,
প্রণয়বাসনা, কামপ্রবৃত্তি ইত্যাদির কথা আছে। দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার,
শোষণ, নির্যাতন, উচ্চবর্গের ইন্দ্রিয়াসক্তি, সম্ভোগপ্রিয়তা,
প্রতিহিংসাপরায়ণতা, সমাজের রক্ষণশীলতা, আভিজাত্যের অহঙ্কার, বহুবিবাহ,
যুদ্ধবিগ্রহ ইত্যাদিও গাথাগুলিতে স্থান পেয়েছে। সমাজের নিষ্ঠুর
বিধিনিষেধের কারণে কিছু কিছু গাথা, যেমন ‘কঙ্ক ও লীলা’, ‘শ্যামরায়’,
‘ধোপার পাট’, ‘দেওয়ানা মদিনা’, ‘ফুলকুমারী’, ‘চন্দ্রাবতী’, ‘মহুয়া’
ইত্যাদি বিয়োগান্তক পালায় পরিণত হয়েছে। গীতিকাসমূহের কয়েকটি সংকলন
গ্রন্থ হচ্ছে মৈমনসিংহ-গীতিকা, পূবর্ববঙ্গ-গীতিকা, মোমেনশাহী গীতিকা (১৯৭১), সিলেট গীতিকা (১৯৭২), রংপুর গীতিকা (১৯৭৭) ও বাংলার লোক-গীতিকথা (১৯৮৬)।
লোককাহিনী পুরুষানুক্রমে মুখে মুখে প্রচলিত বর্ণনামূলক গল্প। এর
মূল ভিত্তি কল্পনা। স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল পর্যন্ত গল্পের আখ্যানের সীমানা
বিস্তৃত। দেব-দৈত্য, জ্বীন-পরী, রাক্ষস-খোক্ষস, রাজা-প্রজা,
সাধু-সন্ন্যাসী, পীর-ফকির, কৃষক-তাঁতি, কামার-কুমার, ধোপা-নাপিত, পশু-পাখি,
নদী-সাগর, পাহাড়-পর্বত, চন্দ্র-সূর্য, দিন-রাত্রি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে
গল্প রচিত হয়। একক ও সরলরৈখিক গল্প যেমন আছে, তেমনি বিচিত্র শাখাসম্বলিত
জটিল গল্পও আছে। প্রথম শ্রেণির গল্প সাধারণত আকারে ছোট হয় এবং দ্বিতীয়
শ্রেণির গল্প হয় বড়।
বিষয় ও আঙ্গিক বিচারে লোককাহিনীগুলিকে বারোটি ভাগে ভাগ করা যায়,
যথা: রূপকথা, পুরাণকথা, ব্রতকথা (religious tale), রোমাঞ্চকথা, বীরকাহিনী,
সন্তকাহিনী (sage tale), পুরাকাহিনী, স্থানিক কাহিনী (legend), পশুকাহিনী,
নীতিকথা (fables), হাস্যরসাত্মক কাহিনী ও ব্যাখ্যামূলক কাহিনী। বাংলা
ভাষায় প্রায় সবশ্রেণীর লোককাহিনীই রচিত হয়েছে। রোমাঞ্চ কাহিনীর উর্বর
ভূমি হচ্ছে আরব-পারস্য। আলিবাবা ও চল্লিশ চোর, হাতেম তাই, সিন্দাবাদ,
আলাউদ্দীনের আশ্চর্য প্রদীপ ইত্যাদি কাহিনী আরব-পারস্য থেকে আগত; আরবি আলেফলায়লা-ওয়া-লায়লা গ্রন্থ এসব কাহিনীর উৎস। মধুমালা, রূপভান, চন্দ্রাবতী ইত্যাদি দেশীয় কাহিনী।
লোককাহিনীর নায়ক-নায়িকারা সাধারণত দৈব বা অদৃষ্টের ওপর বেশি
নির্ভরশীল, কর্মের ওপর নয়। তারা জাদুবিদ্যার ওপরও নির্ভর করে। ভোগবাদী
কর্মকুণ্ঠ চেতনা থেকেই এমন মনোভাবের জন্ম।
বাংলা লোককাহিনীতে সকল স্তরের মানবজীবন ও সমাজের অজস্র ছবি আছে।
সেসব বিশ্লেষণ করলে জাতির অনেক অজানা ইতিহাস বেরিয়ে আসে। বাল্যবিবাহ,
বহুবিবাহ, যৌতুকপ্রথা, জন্মান্তরবাদ, সতীন-বিদ্বেষ, সৎমার ঈর্ষাকাতরতা,
সবলের অত্যাচার, ধনীর ধনলিপ্সা, দুর্বল ও দরিদ্রের দুর্ভোগ, ধন ও
বর্ণবৈষম্য, জাতি ও ধর্মভেদ, কৌলীন্যবিচার, দাম্পত্য-প্রেম, ভ্রাতৃপ্রেম,
গুরুভক্তি, অতিথিসেবা, দান-ধ্যান ইত্যাদির অসংখ্য চিত্র লোককাহিনীতে পাওয়া
যায়। প্রাচীনকাল থেকেই লোককাহিনী লোকসাহিত্যের একটি জনপ্রিয় শাখা ছিল, কিন্তু আধুনিক শিক্ষা ও নগরসভ্যতা বিস্তারের ফলে এর চর্চা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।
লোকনাট্য লোকসমাজে প্রচলিত ঐতিহাসিক, ধর্মীয় ও লোককাহিনী
ভিত্তিক নাট্যাভিনয়। আশুতোষ ভট্টাচার্যের মতে: ‘গ্রামীণ সমাজে জনসাধারণের
জীবন অবলম্বন করে যে নাটকধর্মী রচনা মুখে মুখে রচিত হয়ে মুখে মুখে
প্রচারিত হয় তা-ই লোকনাট্য।’ উন্মুক্ত বা ঈষৎ আচ্ছাদিত আসরে নাচ, গান,
বাদ্য, সংলাপ ও অভিনয় সহযোগে এগুলি পরিবেশিত হয়, যেমন: ভাসান, যাত্রা, পালাগান,
ঘাটু, গম্ভীরা, আলকাপ, কবিগান, পুতুলনাচ ইত্যাদি। এগুলির কোনোটিতে থাকে
গানের প্রাধান্য, কোনোটিতে নাচের, আবার কোনোটিতে থাকে অভিনয়ের প্রাধান্য।
বিষয়, আঙ্গিক, পরিবেশনরীতি ও সময়কালের দিক দিয়েও একটি অপরটি থেকে পৃথক।
লোকনাট্যের উপস্থাপনায় দুটি স্তর থাকে প্রস্ত্ততিপর্ব ও মূলপর্ব। লপ্রস্ত্ততিপর্বে মূল কাহিনীর পূর্বে প্রস্তাবনা, সমবেত যন্ত্রসঙ্গীত
ও বন্দনা পরিবেশিত হয়; আর মূলপর্বে অভিনয়, নৃত্যগীত, কথা ও সংলাপ,
বাদ্য, সঙ বা ভাঁড় ইত্যাদি সহযোগে মূলকাহিনী পরিবেশিত হয়। রাম-সীতা,
অর্জুন-দ্রৌপদী, রাধা-কৃষ্ণ, নিমাই সন্ন্যাস, বেহুলা-লক্ষীন্দর, ঈসা খাঁ
দেওয়ান, ফিরোজ দেওয়ান, জয়নব-হাসান, সখিনা-কাসেম, হানিফা-জয়গুন, রহিম
বাদশা, রূপবান, বাইদ্যানি ইত্যাদি পৌরাণিক, ঐতিহাসিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও
লৌকিক বিষয় নিয়ে লোকনাট্য রচিত ও পরিবেশিত হয়। গ্রামের সাধারণ মানুষ
সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, অত্যাচার-পীড়ন, সংগ্রাম-বিরোধ, প্রেম-ভালোবাসা,
লোভ-লালসা ইত্যাদি মিশ্রিত এসব কাহিনী থেকে আনন্দলাভের পাশাপাশি সৎ-অসৎ,
ধর্মাধর্ম, পাপ-পুণ্য ইত্যাদি সম্পর্কেও শিক্ষালাভ করে থাকে।
পুরাণ,
ইতিহাস, লোককাহিনী ও পালাগানভিত্তিক যাত্রা দেশের প্রায় সর্বত্র অনুষ্ঠিত
হয়। উত্তরবঙ্গে প্রচলিত আলকাপে পৌরাণিক ও সামাজিক উভয় বিষয় স্থান পায়।
যাত্রার মতো আলকাপ সারারাত ধরে চলে; নাচ, গান ও বাদ্য সহযোগে তা
দীর্ঘায়িত করা হয়। রাজশাহী ও পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলায় প্রচলিত গম্ভীরা
মূলে ছিল শিব-শিবানীর গার্হস্থ্য জীবনের আলেখ্য; শিবের গাজন উপলক্ষে তা
অনুষ্ঠিত হতো। বর্তমানে সমাজ, শিক্ষা, অর্থনীতি, রাজনীতি, পরিবার যেকোনো
বিষয় নিয়ে তা রচিত হয় এবং দুজন অভিনেতার (নানা-নাতি) মাধ্যমে
নাচ-গান-বাদ্য-সংলাপ সহকারে পরিবেশিত হয়। ব্যঙ্গ-কৌতুক এর মুখ্য রস। এটি
একাঙ্কিকা নাটকের মতো; স্বল্পায়তনে স্বল্প সময়ের মধ্যে পরিবেশিত হয়।
যাত্রা ও আলকাপ থেকে গম্ভীরার এখানেই পার্থক্য।
লোকমনোরঞ্জক ঘাটু গান ও নাচ মূলত গীতিনাট্য। গায়েন ও দোহার গান
করে, বাদক বাজনা বাজায় আর ‘ঘাটু’ নামে এক বালক কিশোরীবেশে নাচে; নৌকার
পাটাতনে এর আসর বসে। তার গান ও নাচের মাধ্যমে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা অভিনীত
হয়। আলকাপেও ‘ছোকরা’ নামে এক তরুণ যুবতীবেশে নাচ-গান করে। উভয়ের
বিষয়বস্ত্ত ও পরিবেশনায় অশ্লীলতা আছে, তাই এর আসর বসে সাধারণত লোকালয়ের
বাইরে। তবে এখন শহরেও পেশাদার গায়েন ঘাটুগান পরিবেশন করে। ঘাটু
ময়মনসিংহ-সিলেট জেলায় প্রচলিত। বর্ধমানের লেটোগানের পালা অংশে গান, নাচ ও
অভিনয়ের মিশ্রণ আছে; কবিগানের লড়াই অংশ উত্তর-চাপানের আঙ্গিকে সংলাপের
ভাষায় রচিত। উত্তরবঙ্গে প্রচলিত ভাসানযাত্রার বিষয় বেহুলা-লক্ষিন্দরের
জনপ্রিয় কাহিনী; সমতল ভূমিতে নির্মিত বৃত্তাকার মঞ্চে এটি অভিনীত হয়।
কারবালার বিষাদময় কাহিনী অবলম্বনে রচিত জারিগানও নৃত্য, বাদ্য ও
অভিনয় সহযোগে পরিবেশিত হয়। জারিগানের স্থান প্রধানত দরগাহ। মুহররম
উপলক্ষে দশ-বারোজন তরুণ যুবক জারিদল গঠন করে বৃত্তাকারে নেচে নেচে গানের
অভিনয় করে। একজন থাকে মূল গায়েন, অন্যরা দোহার হিসেবে ধুয়া গায় ও
হাততালি দেয়। অভিনয়গুণের জন্য জারিগানকে রংপুরে ‘জারিযাত্রা’ বলা হয়।
কারবালার কাহিনীকে ইমামচুরি, জয়নাবের বিলাপ, সখিনার বিবাহ ও বিলাপ, জয়নাল
উদ্ধার ইত্যাদি পালায় বিভক্ত করে পরিবেশিত হয়। ইসলামি ভাবের জারিগানের
উদ্ভাবক স্বাভাবিকভাবেই মুসলিম সমাজ। বাংলা একাডেমীর লোকসাহিত্য সংকলনে
(১৮শ খন্ড) ‘জারিযাত্রা’ শিরোনামে কারবালার বিষাদময় কাহিনী অবলম্বনে রচিত
এরূপ একটি লোকনাট্য প্রকাশিত হয়েছে। এর মূল সংলাপ গদ্যে রচিত, মাঝে মাঝে
গান আছে। ঘটনার ক্রমধারায় রচিত গানগুলি কাহিনীকে গতিশীল করে। এদিক থেকে
জারিযাত্রার গানই হচ্ছে মূল কাহিনীর প্রাণস্বরূপ।
গীতাভিনয় সম্বলিত পালাগানকেও লোকনাট্যের অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
ধর্মীয়, সামাজিক ও ঐতিহাসিক জনপ্রিয় আখ্যান নিয়ে পালাগান রচিত হয়।
বাইদ্যানির পালা, গাজীর পালা, বনবিবির পালা, সখিনার পালা ইত্যাদি মূল
গায়েন, দোহার ও বাদক সহযোগে পরিবেশিত হয়। পালাগান বিষয়-রস-রুচির দিক
থেকে উন্নত মানের রচনা। সকল স্তরের নরনারী দিনের প্রকাশ্য আসরে এ ধরণের
লোকনাট্য উপভোগ করে।
পুতুলনাচ লোকনাট্যের একটি জনপ্রিয় মাধ্যম। পুরাণ, লোককথা ও
সমাজ-আশ্রিত যেকোনো কাহিনীকে পুতুলের অভিনয়দ্বারা ফুটিয়ে তোলা হয়।
চরিত্র অনুযায়ী পুতুলগুলির অবয়ব, রূপ ও অঙ্গসজ্জা নির্মাণ করা হয়।
পুতুলনাচের জন্য বিভিন্ন ধরণের শিল্পী থাকে। সূত্রধর সুতার সাহায্যে
পুতুলের অঙ্গভঙ্গি প্রকাশ করে, কথক সংলাপ বলে, গায়ক গান গায় এবং বাদক
বাদ্য বাজায়। এ সব কিছুই নেপথ্য থেকে করা হয়, যার জন্য বিশেষ ধরণের মঞ্চ ও
মঞ্চসজ্জার প্রয়োজন হয়।
ছড়া সাধারণত শিশুতোষ রচনা হিসেবে পরিচিত। শিশুর মনোরঞ্জন,
অবসরযাপন, জ্ঞানবৃদ্ধি ও নীতিশিক্ষার উদ্দেশ্যে এর চর্চা হয়ে থাকে। তবে
কিছু কিছু ছড়া সকল বয়সের লোকদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বাংলা ছড়াগুলিকে
বিষয়ভিত্তিতে নিম্নলিখিত ভাগে ভাগ করা যায়: ছেলেভুলানো ও শিশুতোষ ছড়া,
খেলার ছড়া, সামাজিক ছড়া, ঐতিহাসিক ছড়া, আচার-অনুষ্ঠানমূলক ছড়া,
ঐন্দ্রজালিক ছড়া, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপাত্মক ছড়া, পেশাভিত্তিক ছড়া ও
নীতিশিক্ষামূলক ছড়া।
অল্পবয়স্ক শিশুদের ভুলানো বা আনন্দ দেওয়ার জন্য মা-বোন, দাদী-নানী
প্রমুখ যেসব ছড়া আবৃত্তি করে, সেসব ছেলেভুলানো ছড়া। অনেক সময়
শিশু-কিশোররা নিজেরাই ছড়া আবৃত্তি করে আনন্দ উপভোগ করে। এগুলিকে শিশুতোষ
ছড়ার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিশোর-তরুণ-যুবক যেসব ছড়া বলে খেলা করে বা
খেলা উপলক্ষে ছড়া বলে, সেসব খেলার ছড়া নামে পরিচিত। হাডুডু, কানামাছি ইতাদি খেলায় এরূপ ছড়ার প্রচলন আছে।
শিশু-কিশোরদের মধ্যে লঘু হাস্যরস সৃষ্টির উদ্দেশ্যে
ব্যঙ্গ-বিদ্রূপাত্মক ছড়া রচিত হয়। এতে প্রধানত সমবয়সী ছেলেমেয়ে,
বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, জামাতা, পশু-পাখি ইত্যাদিকে ব্যঙ্গ বা সমালোচনা বা হেয়
প্রতিপন্ন করা হয়। কোনো কোনো কাজে শ্রমলাঘব করা ও প্রেরণা দেওয়া বা
চিত্তবিনোদনের জন্যও ছড়া রচিত হয়। বাইস্কোপ দেখানোর সময় ছড়া কেটে
চিত্রের বর্ণনা দেওয়া হয়; এটি জীবিকার সঙ্গে যুক্ত। নীতি-উপদেশ,
অঙ্ক-জ্যোতিষ ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান দানের জন্যও ছড়া আছে।
সামাজিক ছড়াগুলি রচিত হয় পিতা-মাতা, পুত্র-কন্যা, ভাই-বোন, শাশুড়ি-বধূ, জামাতা, ধোপা, নাপিত, মালী, তাঁতি, কামার, কুমার,
দারোগা, পেয়াদা, জমিদার, রাজা প্রভৃতিকে কেন্দ্র করে। ঐতিহাসিক
ছড়াগুলিতে জাতীয় জীবনের অনেক অলিখিত ইতিহাস লিপিবদ্ধ থাকে। ‘ছেলে ঘুমালো
পাড়া জুড়ালো, বর্গী এলো দেশে’ এ ছড়াটিতে বর্গী কর্তৃক বাংলা আক্রমণের
কথা আছে। ‘জাত মারলে পাদ্রী ধরে/ ভাত মারলে নীল বাঁদরে। বিড়াল চোখে হাঁদা
হেমদো/ নীলকুঠির নীল মামদো।’ এ ছড়াটিরও ঐতিহাসিক পটভূমি আছে। খ্রিস্টান
পাদ্রি অসহায় মানুষের ধর্মনাশ করে, আর নীলকর সাহেব কৃষকের ভূমি ও রুজি
গ্রাস করে। ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর-টুপুর নদে এলো বান/ শিব ঠাকুরের বিয়ে হল
তিন কন্যা দান।’ এ ছড়ায় এক পাত্রে তিন কন্যা সম্প্রদান তথা বহুবিবাহের
চিত্র আছে। গোপীচন্দ্রের গান
নাথগীতিকায় রাজপুত্র গোপীচন্দ্র রাজকন্যা অদুনাকে বিয়ে করে পদুনাকে দান
হিসেবে লাভ করে; এখানে আছে শ্যালিকাকে পত্নীরূপে লাভ করার দৃষ্টান্ত।
মন্ত্রের ছড়ায় প্রাচীন বিশ্বাস-সংস্কারের বীজ আরও সজীব ও প্রকট।
বৃষ্টি আবাহনের জন্য বলা হয়, ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে, ধান দিব মেপে’; আবার
বৃষ্টি বারণের জন্য বলা হয় ‘লেবুর পাতায় করঞ্চা, এই মেঘখান উড়ে যা’
ইত্যাদি। বৃষ্টির আবাহনে ছড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু আচার পালনেরও ব্যাপার আছে।
ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা মাথায় কুলা নিয়ে বাড়ি বাড়ি যায় এবং ছড়া বলে
মাগনের চাল-ডাল সংগ্রহ করে; গৃহস্থরা তখন কুলায় পানি ঢালে আর সেই পানি গা
বেয়ে মাটিতে পড়ে। এটি হলো বৃষ্টির নকল। ব্রতের ছড়ায় আরাধ্য দেবতার কাছে
মনস্কামনা ব্যক্ত করে ফলের প্রত্যাশা করা হয়। দশপুত্তল ব্রতে সুস্থ,
সুন্দর ও আদর্শ জীবন কামনা করা হয়; ভাইফোঁটা
ব্রতে সহোদর ভাইয়ের সৌভাগ্য ও মঙ্গল কামনা করা হয়; লক্ষ্মীর ব্রতে
পিতা-ভ্রাতার নিরাপদ বাণিজ্য-যাত্রা কামনা করা হয়। এছাড়া সন্তান, ভালো
ফসল, নীরোগ জীবন ইত্যাদি লাভের উদ্দেশ্যে আরও অনেক ব্রত আছে যাতে ছড়ার
মাধ্যমে মনস্কামনা ব্যক্ত করা হয়। এসব ছড়ায় ধর্মের আড়ালে বিষয়বুদ্ধিই
প্রধান থাকে; পরকালের সুখ-স্বপ্ন-আনন্দ এতে অনুপস্থিত।
মন্ত্র এ ধরণের সাহিত্য গ্রামের সাধারণ মানুষের বিশ্বাস, কুসংস্কার
এবং কতিপয় মানুষের প্রতিহিংসাবৃত্তি থেকে সৃষ্টি হয়েছে। যেমন, ‘আওলা চাল
বকের পাক/ যেমন পিঠা তেমন থাক’ এটি হলো পিঠা নষ্ট করার একটি মন্ত্র।
তৈরি খাবারে ‘নজর’ দিলে বদহজম হয় এ বিশ্বাসও গ্রামের মানুষের আছে এবং
সেজন্য নির্দিষ্ট ছড়াও আছে। বড়শি দিয়ে মাছ শিকারের জন্যও বিভিন্ন মন্ত্র
আছে। রোগ-ব্যাধিকে দীর্ঘস্থায়ী করা, আবার রোগ সারানোর জন্যও মন্ত্র আছে।
ফসলের ওপর যাতে কুলোকের কুদৃষ্টি না পড়ে সেজন্য কৃষক বীজ বুনে
ক্ষেতের চারপাশে পানি ছিটিয়ে দেয়, আর ক্ষেত-বন্ধনের মন্ত্র বলে: ‘জিও
জালা, জিও/ হাত ধুইয়া দিলাম পানি/ ধান হইস্ পোড়া খানি/… আমার ক্ষেত
দেখ্যা যে নজর লাগায়/ তার মা-পুলা ভাতে মারা যায়।’ চোর থেকে সম্পদ রক্ষার
জন্য ‘চোরবন্দী’ এবং ভূতপ্রেত থেকে মুক্ত থাকার জন্য ‘শরীরবন্ধন’ মন্ত্র
আছে। এরূপ বন্ধনমন্ত্র আরও আছে, যেমন ‘অগ্নিবন্ধন’, সর্পবন্ধন’, ‘বাঘ ও
সাপের মুখখিলানী’, ‘হাতিবন্ধন’, ‘বোলতাবন্ধন’, ‘বন্যা প্রতিরোধ’,
‘গৃহবন্ধন’ ‘বিষঝাড়া’ ইত্যাদি মন্ত্র। এর কতক মন্ত্র প্রতিরোধক এবং কতক
প্রতিষেধক। অন্যের ক্ষতি করার জন্য ‘বাণমারা মন্ত্র’ আছে, আবার নারী-পুরুষ
পরস্পরকে বশ করার জন্য আছে ‘বশীকরণ মন্ত্র’। কোনোটি ছড়ার মতো আবৃত্তি করা
হয়, আবার কোনোটি শ্লোকের মতো পাঠ করা হয়।
মন্ত্রের ভাষায় হিন্দু ও মুসলমানের ঐতিহ্য কোথাও আলাদাভাবে, কোথাও
মিশ্রভাবে আছে। কোনো কোনো দেবদেবী, পীর-পীরানি বা ধার্মিক ব্যক্তির দোহাইও
আছে। মন্ত্রগুলি দুই থেকে আট-দশ চরণে ছন্দোবদ্ধ ও চরণাশ্রিত কতগুলি
শব্দসমষ্টি; এর ভাষায় কোনো কবিত্ব নেই। উপলক্ষ বা প্রয়োজন ছাড়া যখন তখন
এবং যেখানে সেখানে এগুলি উচ্চারিত হয় না।
মন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত আছে কিছু লৌকিক ক্রিয়া, যাকে বলা হয়
মন্ত্রাচার। এতে জাদুর প্রভাবও আছে। শুভ-অশুভ, ইষ্ট-অরি সকল শক্তির অধিকারী
হওয়া বা তাকে বশে আনার চেতনা থেকেই জাদুর উদ্ভব। জাদু প্রধানত দুই প্রকার
শুক্ল জাদু (white magic) ও কৃষ্ণ জাদু (black magic)। প্রথমটি মঙ্গলজনক
এবং দ্বিতীয়টি অমঙ্গলজনক বা ধ্বংসাত্মক। ঝাড়-ফুঁক চিকিৎসাদিতে ব্যবহূত
জাদু মঙ্গলজনক; এসব প্রকাশ্যে অনুশীলিত হয়। মারণ, উচাটন, বশীকরণ ইত্যাদি
অনিষ্টকর; এগুলি গোপনে নিষ্পন্ন হয়। মন্ত্র হলো জাদুর বাঙ্ময় রূপ।
মন্ত্রের মধ্যে জাদুশক্তি আছে; মন্ত্রোচ্চারণ এবং তৎসংশ্লিষ্ট কিছু আচার
পালন করে জাদুশক্তির প্রকাশ ঘটানো হয়। মাদুলি, তাবিজ, তাগা, কবজ ইত্যাদি
বস্ত্তকে মন্ত্রপূত করে জাদুগুণ সম্পন্ন করা হয়। ওঝা, বৈদ্য, কবিরাজ,
পুরোহিত, সাধু-সন্ন্যাসী, পীর-ফকির, বেদে-বেদেনী, ধাত্রী, শিরালি প্রভৃতি
পেশাদার ও অপেশাদার ব্যক্তি মন্ত্রের প্রয়োগ করে থাকে। যেহেতু জাদুমন্ত্র
গুপ্তবিদ্যা, সেহেতু এর সবকিছুতে গোপনীয়তা রক্ষা করতে হয়। শিষ্য ছাড়া
অন্যকে মন্ত্রশিক্ষা দেওয়া যায় না। বার-তিথি, ক্ষণ-কাল, স্থান-পাত্র
ইত্যাদির বাছ-বিচার করে মন্ত্র প্রয়োগ করতে হয়; পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার
প্রতিও লক্ষ্য রাখতে হয়। মন্ত্রোচ্চারণে বা মন্ত্রাচারে ত্রুটি হলে লক্ষ্য
অর্জন দূরের কথা, প্রয়োগকারী নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হয় লোকসমাজে এরূপ
বিশ্বাস প্রচলিত আছে।
ব্যক্তি, গার্হস্থ্য ও সমাজজীবনের নানা ক্ষেত্রে জাদুমন্ত্রের ব্যবহার আছে। মধ্যযুগের কাব্য,
ব্রতকথা, লোককাহিনী, লোকবিশ্বাস, লৌকিক আচার-অনুষ্ঠান, চিকিৎসা, কৃষিকাজ ও
অন্যান্য পেশায় জাদুমন্ত্রের প্রভাব লক্ষ করা যায়। আসামের কামাখ্যা ছিল
মন্ত্রশিক্ষার কেন্দ্র; বাংলাদেশ থেকে বহু লোক সেখানে জাদু শিখতে যেতো।
পূর্বোক্ত গ্রামবন্ধনের মন্ত্রে ‘কামিখ্যা পর্বতে’র উল্লেখ আছে।
বাংলা লোককাহিনীতে কায়ার পরিবর্তন বা আত্মার রূপান্তর
(transformation of soul) একটি উল্লেখযোগ্য মোটিফ; স্টিথ থম্পসন একে ডি-৬৯৯
সংখ্যক মোটিফ-সূচির অন্তর্ভুক্ত করেছেন। গোপীচন্দ্রের গান থেকে জানা যায়
যে, রাজমাতা ময়নামতী মন্ত্রজ্ঞানী ছিলেন; মৃত স্বামীর প্রাণ ফিরে পাওয়ার
জন্য যমের সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্ব হয়।
মন্ত্র আসলে অজ্ঞ ও অসহায় মানুষের সান্ত্বনামাত্র; বিজ্ঞানের সঙ্গে
এর কোনো যোগসূত্র নেই। মন্ত্র মানুষের বিশ্বাস, দৈবনির্ভরতা ও অদৃষ্টবাদের
ওপর ভরসা বাড়িয়েছে, প্রকৃত মুক্তি দেয়নি। তবে কোনো কোনো মন্ত্রাচারে
রোগী সেবাজনিত উপকার পায়; তাতে কিছুটা মনস্তাত্ত্বিক উপকার হয়; অন্যথায়
মন্ত্র সম্পর্কিত আর যা কিছু সবই নিষ্ফল প্রয়াস মাত্র। মন্ত্রের ভাষায়
আল্লাহ, রসুল, চন্ডী,
মনসা, শিব, পার্বতীর দোহাই থাকলেও তাতে আধ্যাত্মিকতা নেই; ঐহিক চেতনা এবং
স্বাস্থ্য, সম্পদ, সুখ ও শান্তির বাসনাই মুখ্য। মন্ত্রের ভাব ও ভাষায়
হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলমান সংস্কৃতির প্রভাব পড়েছে।
ধাঁধা এক প্রকার রহস্যপূর্ণ রচনা। ‘ধন্দ’ শব্দ থেকে এর উৎপত্তি;
অর্থ সংশয়, দুরূহ সমস্যা ইত্যাদি। এর আরেক নাম ‘হেঁয়ালি’। এতে মূলত একটি
জিজ্ঞাসা থাকে এবং তার উত্তরটিও পরোক্ষভাবে এরই মধ্যে বিদ্যমান থাকে। মূল
বিষয়কে আড়াল করে শব্দের জাল বুনে তা রচনা করা হয়। তাই উত্তরদাতাকে
উপমা-রূপক-প্রতীকের রহস্যভেদ করে উত্তর দিতে হয়।
ধাঁধাচর্চায় কমপক্ষে দুজনের উপস্থিতির প্রয়োজন হয় একজন ধাঁধা
ধরে, অন্যজন উত্তর দেয়। ‘সাগরেতে জন্ম তার লোকালয়ে বাস/ মায়ে ছুঁলে
পুত্র মরে একি সর্বনাশ।’ এ ধাঁধাটির উত্তর ‘লবণ’। এখানে ‘সাগর’, ‘লোকালয়’,
‘মা’ ও ‘পুত্র’ প্রতীকী শব্দ। সমুদ্রের পানি শুকিয়ে লবণ তৈরি করা হয়,
আবার পানিতে দিলে সে লবণ গলে যায়। ধাঁধায় বর্ণিত এ চিত্রটি যেমন পরোক্ষ,
তেমনি রহস্যপূর্ণ। এটি নির্মাণে যেমন প্রতিভার প্রয়োজন, তেমনি উত্তর দিতেও
উপস্থিত বুদ্ধির প্রয়োজন।
ধাঁধা রচনায় বুদ্ধির সঙ্গে কল্পনার মিশ্রণ আছে, তবে আবেগের স্থান
নেই। এজন্য ধাঁধার অবয়ব দীর্ঘ হয় না। গদ্যে ও পদ্যে ধাঁধা রচিত হয়।
সাধারণত গদ্যাত্মক একটি বাক্যে অথবা ছন্দোবদ্ধ ও অন্ত্যমিলযুক্ত দুই থেকে
চার চরণে ধাঁধা সমাপ্ত হয়।
ধাঁধাকে লোকসাহিত্যের প্রাচীনতম শাখার একটি বলা হয়। গ্রিক পুরাণে
ধাঁধা আছে; স্ফিঙ্কস ইডিপাসকে মানুষ সম্পর্কীয় একটি ধাঁধা ধরেছিল এবং
ইডিপাস তার উত্তর দিয়ে থীবসের অভিশাপ থেকে জনগণকে রক্ষা করে। ভারতের আদি
গ্রন্থ ঋগ্বেদেও ধাঁধা আছে। অশ্বমেধযজ্ঞে হোতা ও ব্রাহ্মণগণ একে অপরকে
ধাঁধা জিজ্ঞেস করতেন। এছাড়া অথর্ববেদ, মহাভারত, জাতক, কথাসরিৎসাগর, নাথসাহিত্য, চন্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, শিবায়ন, গোপীচন্দ্রের গান ইত্যাদিতেও প্রচুর ধাঁধার ব্যবহার আছে।
বাংলা ও ভারতের বিভিন্ন গোত্রের আদিবাসীরা বিবাহ, কৃষিকাজ, মৃতদেহ
সৎকার, মন্ত্রাচার ও ধর্মানুষ্ঠানে ধাঁধার অনুশীলন করে। ছোটনাগপুরের ওরাওঁ
উপজাতির বিবাহানুষ্ঠানে ধাঁধার মাধ্যমে পাত্র-পাত্রী নির্বাচন করা হয়।
মধ্যপ্রদেশের গড় উপজাতির লোকেরা মৃতের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানের একটি
অঙ্গ হিসেবে ধাঁধার চর্চা করে; তারা বিবাহানুষ্ঠানেও বরপক্ষকে ধাঁধাযুদ্ধে
নাজেহাল করে। আসাম ও বাংলাদেশের অরণ্যচারী নাগা, কুকি, গারো,
কোচ ও মুরং উপজাতির কৃষকরা ফসল পাকার সময় ধাঁধা বলে আনন্দ করে। বিশ্বের
অন্যান্য দেশের আদিবাসীদের মধ্যেও ধাঁধার প্রচলন আছে। বাংলাদেশে ধাঁধার
চর্চা হয় মূলত বিবাহোপলক্ষে বর ও কনে নির্বাচনে বুদ্ধি পরীক্ষায়,
বিবাহ-বাসরে বরপক্ষ ও কনেপক্ষের মধ্যে আমোদ-প্রমোদমূলক প্রতিযোগিতায়,
কিশোর ও তরুণদের মধ্যে অবসরযাপন এবং কখনো কখনো গৃহস্থালি কাজকর্মের অবসরে
চিত্তবিনোদনের অঙ্গ হিসেবে।
বাংলা ধাঁধাকে পৌরাণিক, ঐতিহাসিক, সামাজিক মানুষ ও তার অঙ্গবাচক,
প্রাণী ও তার অঙ্গবাচক, উদ্ভিদ ও ফলমূলবাচক, প্রকৃতি ও নিসর্গবাচক,
খাদ্যদ্রব্য ও তৈজসপত্রবাচক, অক্ষর ও সংখ্যাবাচক, বাদ্যযন্ত্রবাচক, ভাব ও
ক্রিয়াবাচক ইত্যাদি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এসব বিচিত্র বিষয় নিয়ে রচিত
ধাঁধায় বাঙালি জাতির কল্পনাশক্তি, বুদ্ধিবৃত্তি, বিষয়জ্ঞান,
সৌন্দর্যচেতনা, কৌতুকবোধ ও চিত্তস্ফূর্তি প্রকাশ পেয়েছে।
একটি জাতি বা জনগোষ্ঠীর আত্মার মর্মস্থল থেকে ধাঁধার উদ্ভব হয় বলে
তাতে সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হয়। ‘এক বাড়ির তিন বউ/ এক পালাইলে
রান্না থোও।’ (উনুন) এটি একান্নবর্তী পরিবারের অন্তরঙ্গতার ছবি; ‘মামুরা
সিন্নি রান্ধে খায়/ আমাকে দেখ্যা দুয়ার দেয়।’ (শামুক) এখানে আত্মীয়তার
মধুর সম্পর্কে ফাটল ধরার কথা ব্যক্ত হয়েছে। অনুরূপভাবে ‘কালো বউয়ের কপালে
চিক/ জামাই এলে করে হিত।’ (মাসকলাই), ‘ছোট ইটা ছেমরি/ নায়না ধোয়না এতই
সুন্দরী।’ (রসুন), ‘তলে মাটি উপরে মাটি/ মধ্যে সুন্দরী বেটি।’ (হলুদ),
‘ঘরের মধ্যে ঘর/ নাচে কন্যা-বর।’ (মশারি) ইত্যাদি ধাঁধা পারিবারিক জীবনের
বিভিন্ন চিত্রকে ধারণ করে আছে।
প্রবাদ লোকসাহিত্যের শাখাগুলির মধ্যে প্রবাদ অতীতের বিষয়
হয়েও সমকালকে সবচেয়ে বেশি স্পর্শ করেছে। আধুনিক যুগে প্রায় সব ধরণের
রচনায় প্রবাদ ব্যবহূত হয়। কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, নাটক, সংবাদপত্র,
বিজ্ঞাপন, বক্তৃতা, দৈনন্দিন কথাবার্তা ইত্যাদিতে প্রবাদের ব্যবহার অহরহ
লক্ষ করা যায়। লোকসাহিত্যধারায় প্রবাদ হলো ক্ষুদ্রতম রচনা। একটি
সংক্ষিপ্ত বাক্য থেকে ছন্দোবদ্ধ দুই চরণ পর্যন্ত প্রবাদের অবয়বগত
ব্যাপ্তি।
প্রবাদ মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতাপ্রসূত বৌদ্ধিক রচনা। যেকোনো প্রবাদ
মানুষের ব্যবহারিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থেকে জন্ম নেয়। ‘অতি সন্ন্যাসীতে গাজন
নষ্ট’, ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে’, ‘জোর যার, মুল্লুক তার’, ‘লাগে টাকা
দেবে গৌরীসেন’ ইত্যাদি প্রবাদের গঠন অত্যন্ত সংহত, অথচ ভাবার্থ অত্যন্ত
ব্যাপক; স্বল্প কথায় এত বেশি অর্থবহনক্ষমতা প্রবাদ ছাড়া লোকসাহিত্যের
অন্য শাখায় নেই।
প্রবাদের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ বিশেষ উক্তি বা কথন। যে উক্তি লোকপরম্পরায় জনশ্রুতিকে নির্ভর করে চলে আসছে তাই প্রবাদ।
প্রবাদ সমাজমানসে জন্ম নিয়ে পাথরের নুড়ির মতো জীবনস্রোতের অনেকখানি পথ
অতিক্রম করে একটি নিটোল রূপ লাভ করে। পরে আর তেমন কাঠামোগত পরিবর্তন হয়
না। উল্লেখ্য যে, প্রবাদ ও বাগ্ধারার মধ্যে পার্থক্য আছে। প্রবাদ হচ্ছে
একটি অর্থপূর্ণ সংক্ষিপ্ত বাক্য, আর বাগ্ধারা হচ্ছে অর্থপূর্ণ একটি
বাক্যাংশ বা শব্দগুচ্ছ।
দেশের প্রকৃতি-পরিবেশ-পারিপার্শ্বিকতা, প্রাণী, সম্পদ, উৎপাদন ও
জাতীয় জীবনের নানা ধারা, তার ইতিহাস, সংস্কৃতি, ধর্ম, সমাজ, পরিবার,
ঘর-সংসার ইত্যাদি বিষয় নিয়ে প্রবাদ রচিত হয়। এগুলি খন্ড হলেও দেশ ও
জাতির খাঁটি চিত্র; কারণ প্রবাদ লোকমনের সত্যরূপ বহন করে।
প্রবাদ বহু প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত আছে। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে
মিশরের প্যাপিরাসের গল্পে প্রবাদ আছে। ভারতীয় বেদ-উপনিষদ এবং বাংলা
সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদেও প্রবাদ আছে। ‘আপনা মাসে হরিণা বৈরি’
প্রবাদটি চর্যাপদকর্তা ভুসুকু ব্যবহার করেন, তাঁর আবির্ভাবকাল এগারো শতক;
চৌদ্দ শতকে বড়ু চন্ডীদাস
শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে এবং ষোলো শতকে মুকুন্দরাম চন্ডীমঙ্গলে একই প্রবাদ
ব্যবহার করেন। আধুনিক যুগে বাংলা সাহিত্যের প্রভূত উন্নতি ও প্রসার ঘটলে
প্রবাদের ব্যবহারও ব্যাপক হয়। [ওয়াকিল আহমদ]
গ্রন্থপঞ্জি দীনেশচন্দ্র সেন, মৈমনসিংহ-গীতিকা, কলকাতা,
১৯২৩, পূবর্ববঙ্গ-গীতিকা, ১৯২৬; আশুতোষ ভট্টাচার্য, বাংলার লোকসাহিত্য, ১ম
খন্ড, কলকাতা, ১৯৬৩; শীলা বসাক, বাংলা ধাঁধার বিষয়বৈচিত্র্য ও সামাজিক
পরিচয়, কলকাতা, ১৯৯০; আশরাফ সিদ্দিকী, লোকসাহিত্য (২খন্ড), ঢাকা, ১৯৯৪;
Maria Edward Leach (ed.), Standard Dictionary of Mythology, Folklore and
Legends, Vols. 1 & 11, New York, 1949; Antti Arne and Stith
Thompson, The Types of Folktales, Helsinki, 1964।