নামের একটি মহাসংকলনগ্রন্থ রচনা করেন, যাতে তার জীবদ্দশার সময়কার গ্রিক,
মিশরীয়, রোমান ও ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের সার লিপিবদ্ধ হয়েছে। তিনি
দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত ও জনপ্রিয় বিজ্ঞানীদের অন্যতম।
জ্যোতির্বিজ্ঞান ছাড়াও গণিতশাস্ত্র, পূর্তবিদ্যা, আবহবিদ্যা, এবং স্থাপত্যবিদ্যায়
পণ্ডিত ছিলেন। তিনি কলা ও বিজ্ঞানের প্রায় সমস্ত শাখায় ব্যাপক অবদান
রাখেন। উদ্ভিদবিদ্যা থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞান, সামরিক বিজ্ঞান থেকে পুরাকৌশল
— জ্ঞানের সমস্ত ক্ষেত্রেই ছিল তাঁর স্বচ্ছন্দ পদচারণা।
ভারতের নয়াদিল্লীতে অবস্থিত সংসদ ভবনে বরাহমিহিরের সম্মানে একটি দেয়ালচিত্র অঙ্কিত হয়েছে।
জীবন ও কর্ম
এই মনীষীর জন্ম ভারতের অবন্তিনগরে (বর্তমান উজ্জয়িনী)। গুপ্ত রাজা বিক্রমাদিত্যের সভার নবরত্নের অন্যতম হিসেবে তিনি স্বীকৃত। ভারতীয় পঞ্জিকার অন্যতম সংস্কারক ছিলেন তিনি। তিনিই বছর গণনার সময় বৈশাখকে প্রথম মাস হিসেবে ধরার প্রচলন করেন। আগে চৈত্র এবং বৈশাখকে বসন্ত ঋতুর অন্তর্গত ধরা হতো। পৃথিবীর আকার এবং আকৃতি সম্বন্ধে তার সঠিক ধারণা ছিল। তার জন্ম ৫৮৭ ধরা হলেও কারও কারও মতে তা ৫৭৮।
বরাহমিহির ছিলেন শক জাতিভুক্ত। সেসময় আফগানিস্তান, পাঞ্জাব, সিন্ধু ও
রাজপুতানা (বর্তমান রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশ) নিয়ে গঠিত এক বিরাট এলাকা
জুড়ে শকস্তান নামের এক রাজ্য অবস্থিত ছিল। শকরা ছিল মূলত পূর্ব ইরান
থেকে আগত একটি গোত্র। মিহির নামটি ফার্সি “মিথ্রা” শব্দ থেকে এসেছে।
ভারতের প্রাচীন মথুরা রাজ্যের নামও এই ফার্সি শব্দটি থেকে এসেছে।
বরাহমিহির তাঁর রচিত বৃহজ্জাতক গ্রন্থে বলেছেন, তিনি আদিত্যদাসের সন্তান, তিনি তাঁর পিতার কাছ থেকে শিক্ষালাভ করেছিলেন কাপিত্থক নামক স্থানে এবং অবন্তি নামক স্থানে বসবাস করার সময় তিনি এই (বৃহজ্জাতক) গ্রন্থটি রচনা করেন। [২]
গ্রন্থাবলি
বরাহমিহির তিনটি বিষয়ের উপর গ্রন্থ রচনা করেন, যথা – তন্ত্র বা গাণিতিক
জ্যোতির্বিদ্যা, হোরা(জাতক) বা কুন্ডলী এবং সংহিতা বা সাধারণ
জ্যোতিষবিদ্যা।[৩] বরাহমিহির তিনটি প্রধান গ্রন্থ রচনা করেন: পঞ্চসিদ্ধান্তিকা, বৃহৎসংহিতা ও বৃহজ্জাতক।
- পঞ্চসিদ্ধান্তিকা: ৫৫০ খ্রিস্টাব্দে রচিত হয়। পাঁচটি খণ্ড নিয়ে গঠিত এই বইটিকে জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং জ্যোতিষশাস্ত্রের
সংক্ষিপ্তসার বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে। পাঁচটি খণ্ড হচ্ছ:
সূর্যসিদ্ধান্ত, রোমকসিদ্ধান্ত, পৌলিশসিদ্ধান্ত, পৈতামহসিদ্ধান্ত এবং
বাশিষ্ঠসিদ্ধান্ত। আরব দার্শনিক আল খোয়ারিজমি সূর্যসিদ্ধান্ত দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আল জাবর ওয় আল মুকাবলা রচনা করেন বলে মনে করা হয়। - বৃহৎসংহিতা:
একটি প্রসিদ্ধ জ্যোতিষ গ্রন্থ যা পদ্য আকারে লিখা। এতে তিনি জ্যোতিষী
দৃষ্টিকোণ থেকে বহু পাথরের বিবরণ এবং পাক-ভারতের ভৌগোলিক তথ্য সন্নিবেশিত
করেন। এছাড়াও এতে সূর্য ও চন্দ্রের গতি ও প্রভাব, আবহবিদ্যা, স্থাপত্য এবং পূর্তবিদ্যার নানা বিষয় প্রসঙ্গে জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তার কথা আলোচিত হয়েছে। এই বইয়েই তিনি ব্রজলেপ নামে একটি বস্তুর প্রস্তুতপ্রণালী ব্যাখ্যা করেছেন যা আধুনিককালের সিমেন্টের সমগোত্রীয় ছিল। সে সময় ভারতে বরাহমিহির উদ্ভাবিত এই ব্রজলেপ দিয়েই বড় বড় দালান কোঠার ইটের গাঁথুনি তৈরীতে ব্যবহৃত হতো। - বৃহজ্জাতক: জ্যোতিষবিদ্যার উপর একটি গ্রন্থ।
এছাড়া ওনার অন্যান্য গ্রন্থগুলি হল, –
- লঘুজাতক: এটি বৃহজ্জাতক-এরই সংক্ষিপ্ত সংস্করণ
- বিবাহপতল: এটি বৈবাহিক কুন্ডলীর বিষয়ে রচিত।
- মহাযাত্রা: এটি সামরিক জ্যোতিষবিদ্যা বিষয়ক গ্রন্থ
- স্বল্পযাত্রা: এটি সামরিক জ্যোতিষবিদ্যা বিষয়ক গ্রন্থ
- যোগযাত্রা: এটি সামরিক জ্যোতিষবিদ্যা বিষয়ক গ্রন্থ
জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিষবিদ্যায় অবদান
বরাহমিহিরকে আধুনিক ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের জনক বলা হয়। তাঁর আগে ভারতবর্ষের জ্যোতিবির্জ্ঞানের মূল গ্রন্থ ছিল বেদাঙ্গ জ্যোতিষ,
যা খ্রিস্টপূর্ব ১৪শ শতকে রচিত হয়েছিল। এটি অনুসারে ৬৭টি চান্দ্র মাস
নিয়ে গঠিত পাঁচ বছরে একটি যুগ হয় এবং এটিতে রাহু ও কেতু নামের দুইটি
ধারণা দিয়ে সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। বেদাঙ্গ জ্যোতিষ
প্রায় ১৫০০ বছর ধরে দক্ষিণ এশিয়ার জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রধান আকরগ্রন্থ
(reference) ছিল। কিন্তু বরাহমিহির তাঁর সূর্যসিদ্ধান্ত নামক রচনাতে যে
সূর্যকেন্দ্রিক ব্যবস্থার কথা বর্ণনা করেন, তা ছিল অনেক বেশি সঠিক। ফলে এর
পর থেকে ভারতে তাঁর বর্ণিত ব্যবস্থাটিই প্রচলিত হয়ে যায়।
পশ্চিমা জ্যোতির্বিজ্ঞানে বরাহমিহিরের জ্ঞান ছিল অনুপুঙ্খ। তার মহাগ্রন্থ পঞ্চসিদ্ধান্তিকায়
তিনি প্রথমে ভারতীয় স্থানীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের ধারাগুলির বর্ণনা দেন এবং
শেষের দুইটি খণ্ডে পশ্চিমা জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করেন। এগুলিতে
গ্রিক ও আলেকজান্দ্রীয় ঘরানার গণনা, এমনকি টলেমীয় গাণিতিক সারণি ও ছকের
পূর্ণাঙ্গ রূপ স্থান পেয়েছে।
বরাহমিহিরের রচনাবলিতে খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের ভারতবর্ষের একটি বিস্তারিত
বর্ণনা পাওয়া যায়। তবে তাঁর মূল আকর্ষণ ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞান ও
জ্যোতিষবিদ্যার প্রতি। তিনি বারংবার জ্যোতিষীবিদ্যার গুরুত্বের উপর লেখেন
এবং এই বিষয়ে বহু নিবন্ধ রচনা করেন, যেমন শকুন-বিষয়ক রচনাবলি এবং
রাশিগণনার উপর দুইটি বিখ্যাত গ্রন্থ বৃহজ্জাতক ও লঘুজাতক।
গণিতশাস্ত্রে অবদান
বরাহমিহির গণিতের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সূত্র আবিষ্কার করেন। এদের মধ্যে রয়েছে নিচের ত্রিকোণমিতিক সূত্রগুলি:
তিনি ১ম আর্যভট্টের প্রদত্ত সাইন সারণীগুলির উন্নতি সাধন করেন; তার
দেয়া মানগুলি ছিল অধিকতর নিখুঁত। এর ফলে ভারতীয় জ্যোতির্বিদেরা আরও
নিখুঁতভাবে গণনা করার সুযোগ পান।
বরাহমিহির n সংখ্যক বস্তু থেকে r সংখ্যক বস্তু পছন্দ করার সমস্যা তথা
“সমাবেশ”-এর (Combination) সমস্যাটিকে ভিন্নভাবে সমাধান করার প্রয়াস নেন। এ
কাজ করতে গিয়ে তিনি এক ধরনের সারণী নির্মাণ করেন। এই সারণীটিই বহু
শতাব্দী পরে ইউরোপে “‘পাস্কালের ত্রিভুজ” (Pascal’s triangle) নাম নিয়ে
পুনরাবিষ্কৃত হয়।