আর্যরা বহিরাগত

আর্যরা বহিরাগত নয়, আর্য দ্রাবিড় বরং একক জনগোষ্ঠী (দেবযানী ঘোষ) প্রথম পর্ব..।।।

আর্যরা বহিরাগত আক্রমণকারী- একটি ভুল ইউরোপীয় তত্ত্ব । অষ্টাদশ শতাব্দীতে এই তত্ত্বের উদ্ভব হয়। এই তত্ত্ব অনুযায়ী আর্য হলো ককেসিয় পার্বত্য অঞ্চল থেকে আসা গৌরবর্ণ, উন্নত নাক, নীল চোখের মানুষ যারা খ্রী:পূ: 1500 শতকে ভারত আক্রমণ করে। এরা ঘোড়ার ব্যবহার জানতো। ঘোড়ায় টানা রথ এদের প্রধান যোগাযোগের ব্যবস্থা ছিল।

 

এরা লোহার ব্যবহার জানতো। এরা এদের সঙ্গে বেদ নিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছিল। সংস্কৃত এদের ভাষা ছিল।এদের আক্রমণে হরপ্পা মহেঞ্জোদারোর উন্নত নগর সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যায়।

 

কারণ আর্যরা লোহার ব্যবহার জানতো কিন্তু হরপ্পা সভ্যতার মানুষ তাম্র ও ব্রোঞ্জের ব্যবহার জানলেও লোহার ব্যবহার জানতো না। হরপ্পা সভ্যতার মানুষের গায়ের রঙ কালো ছিল। এরা আর্যদের কাছে পরাজিত হয়ে বিন্ধ্য পর্বত পেরিয়ে দাক্ষিণাত্যে চলে যায় ও কালক্রমে এদের থেকেই দ্রাবিড় জনজাতির উৎপত্তি হয়।

এই আর্যরা আসলে যাযাবর জাতি ছিল। এরা নাগরিক নয় গ্রামীণ সভ্যতার সৃষ্টি করে যা হরপ্পা সভ্যতার থেকে অনুন্নত ছিল। এই আর্যরা ইউরোপ থেকে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। এক অংশ ইরান বা পারস্যে যায়। একটি অংশ পশ্চিম ইউরোপে যায়।

একটি অংশ দক্ষিণে হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করে। তাই সংস্কৃত, পারসী ও ইউরোপীয় ভাষার আকারগত মিল খুঁজে পাওয়া যায়। প্রাচীন এই ভাষার মিলের জন্য এদের এক ভাষা গোষ্ঠীর মধ্যে রাখা হয়, ‘প্রোটো ইন্ডো ইউরোপীয়’ ভাষা গোষ্ঠী।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠা করার এটি ছিল এক ঘৃণিত ষড়যন্ত্র। ইতিহাসের বিকৃতি করা হয়, সাহায্য হিসাবে বেদের ইংরেজি অনুবাদ করা হয় ও অর্থ সুবিধামত করা হয়। তৎকালীন ভারতীয়দের অজ্ঞতা, অজ্ঞানতা এবং বিদেশীদের উপর অন্ধ ভরসা এই কাজ সহজ করে দেয়। নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য তারা এত নীচে গেছিল ভাবতে অবাক লাগে। আসলে উপনিবেশ স্থাপনের মূল ভিত্তিই তো পরাজিত জাতিকে হেয় করা, তার সংস্কৃতিকে হেয় করা। এই তত্ত্বের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি বা প্রামাণিকতা ছিল না। কিভাবে এই তত্ত্ব সৃষ্টি হলো, এর পর সেটাই আলোচনা করবো।

আর্যরা বহিরাগত আক্রমণকারী -এই তত্ত্বের উদ্ভাবক ইউরোপীয় পণ্ডিতরা ‘আর্যরা বহিরাগত আক্রমণকারী’ এই তত্ত্ব প্রধানতঃ Abbe Dubois এবং Max Muller এর লেখায় বহুল প্রচলিত হয়। Abbe Dubois এর লেখা ফ্রেঞ্চ বই এর ইংরেজি অনুবাদ ‘Hindu Manners Customs And Ceremonies’ (1897), এই বইতে তিনি আরব ও মিশরের মানুষদের ভারতে আসার পরিবর্তে ককেসিয় অঞ্চলের মানুষের ভারতে আগমনের সপক্ষে বলেন।

ষোড়শ শতাব্দীতে ফ্লোরেন্সের এক ব্যবসায়ী Filippo Susseti প্রথম সংস্কৃত ও ইউরোপীয় প্রধান ভাষার সাথে মিল খুঁজে পান। পরে 1786 সালে বেঙ্গল এশিয়াটিক সোসাইটিতে স্যার উইলিয়াম জোন্স এই তত্ত্বকে সমর্থন করেন।

পরবর্তী কালে ভাষাতত্ত্ববিদ ম্যাক্স মুলার এই তত্ত্বকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যান। তার ‘Lecture On The Science Of Languages’ এ এই তত্ত্বকে আরো প্রামাণ্য করে তোলেন এই বলে যে সংস্কৃত, পারসি, গ্রীক, ল্যাটিন, জার্মান, গথিক ও সেলটিক, এই সাতটি ভাষাকে ইন্ডো আর্য ভাষা বলা হয় এদের মধ্যে ভাষাগত মিলের জন্য। এদের ‘প্রোটো ইন্ডো ইউরোপীয়’ ভাষা গোষ্ঠী বলে চিহ্নিত করা হয় যার মধ্যে মাত্র দুটো ভাষা ইউরোপের বাইরের ভাষা।

 

কাজেই ম্যাক্স মুলার এই সিদ্ধান্তে আসেন যে যেহেতু এরা একটিই প্রাচীন ভাষা গোষ্ঠীর অন্তর্গত ভাষা, কাজেই তাদের পূর্ব পুরুষ সবাই এক জায়গায় বসবাস করতো। আর মাত্র দুটো এশিয় ভাষা বলে ধরে নেওয়া হয় এদের আদি বাসস্থান ইউরোপ ছিল।

 

অষ্টাদশ শতাব্দীতে আর্যদের খুব উন্নত বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় 1920 সালে হরপ্পা মহেঞ্জোদারোর সভ্যতা আবিষ্কারের পর। কারণ পুরাতাত্ত্বিক ভাবে প্রমাণিত হয়ে যায় যে হরপ্পা সভ্যতা অত্যন্ত উন্নত ছিল। তখন এই তত্ত্বকে বদলে দেওয়া হয়, আর্যদের যাযাবর জনজাতি বলে উল্লেখ করা
হয়। কোনো তত্ত্বের প্রামাণিকতা বা বৈধতা ছিল না।

 

হরপ্পা সভ্যতার আবিষ্কারের পর নতুন আর এক ঘৃণ্য চক্রান্ত হলো। বলা হলো বহিরাগত আর্যরা উন্নত অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে নাগরিক কিন্তু অনুন্নত হরপ্পা সভ্যতাকে ধ্বংস করে। পরাজিত হরপ্পা সভ্যতার মানুষ তাদের আদি বাসভূমি ছেড়ে দক্ষিণে প্রস্থান করে ও এই ভাবে কালক্রমে দ্রাবিড় জনজাতির উদ্ভব হয়। তাই এদের ভাষা গোষ্ঠী আলাদা, গায়ের রঙ আলাদা, সংস্কৃতি ভিন্ন। এদেরকেই আর্যরা নিম্ন বর্ণ শূদ্র বলে অভিহিত করে বেদে। এখানে এক সাথে ভারতে দুই আলাদা জনজাতির উদ্ভব করা হলো, জাতিভেদের উৎপত্তি দেখানো হলো। এই ইতিহাস বিকৃত করার পিছনে খ্রীস্টান মিশনারীদের অবদান বিরাট।

বাইবেলের সময়পঞ্জী অনুসরণ করে এই তত্ত্ব তৈরি করা হয়। বাইবেল অনুযায়ী পৃথিবীতে সভ্যতার সূত্রপাত 4000 খ্রী: পূ: সময়ে হয়। বন্যার সময় 2500 খ্রী: পূ: বলে উল্লেখ করা আছে। তাই আর্যদের ভারতে আগমনের সময় ধরা হয় 1500 খ্রী: পূ: নাগাদ। কিন্তু কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ কেউ দিতে পারেনি। সবটাই নিজেদের মস্তিষ্ক প্রসূত কল্পনা। এই তত্ত্বের উদ্ভাবনের পিছনে আসল কারণ ছিল, আর সেটা রাজনৈতিক। এর পরের পর্বে সেই কারণের খোঁজ করবো আমরা।

ক্রমশঃ
© দেবযানী ঘোষ

সূত্র:-

1. T. Kivisild et. al, Current Biology, Vol 9, No 22, pp 133-134
2. Ancient Cities of the Indus Valley Civilization, by Jonathan Mark
Kenoyer, Oxford University Press, Karachi/American Institute of Pakistan
Studies, 1998.
3. Myth of the Aryan Invasion of India by David Frawley
4. Koenaard Elst
5. Indian Gods and Kings, the story of a living past by Emma Hawkridge, Houghton Miffin Company 1935
6. Concise History of the World, An Illustrated Time Line by National Geographic
7. Racial Elements in the Population by DrB S Guha

8. ‘বহিরাগত’ নন আর্যরা! এই প্রথম ডিএনএ পরীক্ষা করে দাবি গবেষকদের

 

 

আর্যরা বহিরাগত নয়…. আর্য দ্রাবিড় বরং একক জনগোষ্ঠী (দেবযানী ঘোষ)দ্বিতীয় পর্ব ..।।।
আর্যরা বহিরাগত নয়….. আর্য দ্রাবিড় বরং একক জনগোষ্ঠী।। (দেবযানী ঘোষ) শেষপর্ব