ঢৌলবাদী /দেবাশিস লাহা
দৃশ্য—১
মাস্টারমশাই ব্লাকবোর্ডে কিছু একটা লিখছেন। এমন সময় —টক !
টাকের একেবারে মাঝখানে একটা ঢিল এসে পড়ল। বাপ রে বলে তিনি পিছু ফিরে তাকালেন ! এক হাত মাথায় , আর এক হাত কোমরে দিয়ে কোনমতে ধুতি সামলে নিলেন। রাগের চোটে চোখ বেরিয়ে আসার জোগাড় !
“কোন উচ্চিংড়ে, বেয়াদপ ঢিল মারল রে ! বল কার এত সাহস !তোদের পিঠে যদি বেতের বাগান না বানাতে পারি তো আমার নাম যদু মিত্তির নয় !”
সবাই চুপ। কে ঢিলটা মেরেছে কিছুতেই বোঝা যাচ্ছে না। সব কটা উচ্চিংড়ে সুবোধ বালকের মত মুখ করে বসে আছে। ভাজা মাছটি কেউ যেন উলটে খেতে পারে না। বেশ কিছু ক্ষণ দাঁত কিড়মিড় করে যদুবাবু বললেন—
“ঠিক আছে তোরা সব কটা কান ধরে বেঞ্চের উপর দাঁড়া ! বলবি না তো ! এবার দ্যাখ কত ধানে কত চাল !”
এই দৃশ্যটির সঙ্গে আমরা সবাই কম বেশি পরিচিত। নিজের চোখে না দেখলেও বাংলা সাহিত্য বা চলচ্চিত্রে এটি একাধিক বার ফিরে ফিরে এসেছে।
দৃশ্য—২
এই মাস্টারমশাইয়ের নাম মধুবাবু। তিনি ছাত্রদের দিকে মুখ করে কিছু একটা বোঝাচ্ছেন। সামনে গুটিকয় পড়ুয়া। ধরা যাক তাদের নাম—হুদো, মুধো, বুধো, জুধো আর খিদো। আচমকা মুধো উঠে দাঁড়াল। তারপর মেঝে থেকে একটা ঢিল তুলে নিয়ে ঢাই করে স্যারের টাকে বসিয়ে দিল। ইয়াব্বড়া ঢিল। একেবারে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল। রুমাল দিয়ে কোনমতে রক্ত আটকানোর চেষ্টা করতে করতে মধুবাবু গর্জন করে উঠলেন।
“এত বড় সাহস। দাঁড়া দেখাচ্ছি। আমার বেতটা কোথায় ! এই তো পেয়েছি। এবার তোরা সবাই একে একে আমার সামনে আয় তো। পিঠ থেকে জামা তুলে দাঁড়াবি। দ্যাখ কেমন লাগে ! শিক্ষকের সঙ্গে বেয়াদপি !”
এ কেমন কথা ! ছাত্ররা তো অবাক। হুদো বলে উঠল—“স্যার ঢিলটা তো মুধো মেরেছে।সেটা তো নিজের চোখে দেখেছেন। আমরাও দেখেছি। আপনি ওকে শাস্তি দিন। আমাদের মারবেন কেন ?”
মধুবাবু সামান্য থতমত খেয়ে বললেন—“ হ্যাঁ সে একটা কথা বটে। কিন্তু তাতে একটা সমস্যা আছে। এটা ঠিক যে আমরা সবাই দেখেছি মুধো-ই ঢিলটা ছুড়েছে—কিন্তু ওকে তোরা উস্কানিও তো দিতে পারিস।তোরা তো আমেরিকার মত সাম্রাজ্যবাদীও হতে পারিস। পেছন থেকে কলকাঠি নাড়িস কি না জানব কি করে। মুধো তো মন্দ নাও হতে পারে !তোরাই ওকে বিপথে চালনা করেছিস। ”
এবার বুধো উঠে দাঁড়িয়ে বলল—“ সে কি কথা স্যার ! এটা তো প্রথম নয়। এই তো গত সপ্তাহে সবার সামনে মুধো আপনার ধুতি খুলে দিয়েছিল—ভুলে গেছেন !সেদিনও কি আমরা ওকে উস্কানি দিয়েছিলাম ? ঠিক আছে স্যার আপনি ওকেই জিজ্ঞাসা করুন আমরা কিছু বলেছি কি না ।”
এবার মধুবাবু মুধোর দিকে মিষ্টি করে তাকালেন।
“হে আমার মুধো, প্রিয় বাছাধন, মানিক আমার ! আমি কি তোমাকে একটি প্রশ্ন করিতে পারি ? যদি অনুমতি প্রদান কর—–”
অবিচল কন্ঠে মুধো বলল—“এত ভনিতা কেন স্যার—বলে ফেলুন”
“তবে বল বৎস, তুমি আমার মস্তকে কেন ওই প্রস্তরখণ্ড নিক্ষেপ করিলে ? কেহ কি তোমায় প্ররোচিত করিয়াছে ?”
“এত কঠিন ভাষা বুঝি না মাষ্টার !তবে হ্যাঁ ঢিলটা আমি-ই ছুঁড়েছি। কারণ আমার যিনি ঠাকুর্দা তার ঠাকুর্দার ঠাকুর্দা বলে গেছেন মাস্টারমশাই দেখলেই ঠেঙাবি।কারণ এই সব দুপেয়ে জীব সব সময় জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা বলে। এইসব শুনলে সৃষ্টিকর্তার উপর বিশ্বাস থাকে না। তাই বাগে পেলেই আপনাকে কড়কে দিই। ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে আবার ঠেঙাব। মানে ইয়ে যতদিন না আপনি পটল তুলছেন ।শুধু আপনি নন স্যার, এই এলাকার যত মাষ্টারমশাই আছেন, সবার নাম ঠিকানার লিস্টি বানিয়ে ফেলেছি। পঁচাশি জন । ব্যাটাদের বাড় বেড়েছে।জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা বলে। একে একে সব কটাকে সাবাড় করব।”
মধুবাবু একটা বড়সড় ঢোঁক গিলে ফাটা টাকের ফাঁকে রুমালটা আর একবার চেপে ধরলেন। তারপর তড়িঘড়ি দু পা পিছিয়ে গেলেন।
“দ্যাখ তোরা বললি বলেই মুধোর মতামতটা নিলাম। কিন্তু মুধো কি বলল সেটা বড় কথা নয়। আমি হলাম তোদের মাস্টারমশাই বুঝলি। ব্যাপারটা একটু গভীরে গিয়ে ভাবতে হবে। যেহেতু ছাত্র হিসেবে আমার কাছে তোরা সবাই সমান, তাই সমান শাস্তি-ই তোদের প্রাপ্য !শিক্ষক হিসেবে আমার একটা আদর্শ আছে—মানে একটা এথিকস মেনে চলতে হয়—বুঝলি কি না।”
এবার বাকিরা [অবশ্য মুধো বাদে] সমস্বরে বলল—“কিছুই বুঝলাম না স্যার। এ যে মুধোর পিণ্ডি আমাদের সবার ঘাড়ে !”
“বুঝলি না তো ! ঠিক আছে জলের মত করে বুঝিয়ে দিচ্ছি !আচ্ছা বল মুধো কি দিয়ে ঢিলটা ছুঁড়েছিল?”
“কেন স্যার-হাত দিয়ে—হাত দিয়েই তো লোকে ঢিল ছোঁড়ে !”
“ঠিক। এবার বল তোদের হাত আছে কি নেই ?
“একী কথা স্যার ! থাকবে না কেন? আমাদেরও দুটো করে হাত !”
“বেশ এই তো বুঝেছিস। এবার বল আশে পাশে আরও ঢিল পড়ে আছে কি নেই ?”
“হ্যাঁ স্যার সে তো আছেই। চারদিকে-ই ঢিল ।”
“এবার বল— যেহেতু তোদেরও হাত আছে, আর চারদিকেই যখন ঢিল— তোরাও যে কোনদিন হাতে ঢিল তুলে নিতে পারিস। পারিস কি না বল !”
“কিন্তু স্যার আমাদের ঠাকুর্দার ঠাকুর্দা তার ঠাকুর্দা কখনও বলে যান নি মাষ্টারমশাই দেখলেই ঠেঙাবি !আমরা তো আপনাকে খুব শ্রদ্ধা করি স্যার !”
“আমি কি দেখতে গেছি তোদের ঠাকুর্দা বলেছে কি বলে নি ! তোদের হাতও আছে—চার পাশে ঢিলেরও অভাব নেই। তাই তোরাও ঢৌলবাদি বুঝলি ! আর আমার কাছে সব ঢৌলবাদি-ই সমান !”
——–
এই দৃশ্যটিও কি কোথাও দেখেছেন ? ধুত্তেরি আমি যেমন পাগল। না, বন্ধু এটি একান্তই একটি কাল্পনিক দৃশ্য। এই দৃশ্যের সব কটি চরিত্রই মনগড়া। ঘটনাটির সঙ্গে বাস্তবের কোনই যোগাযোগ নেই।
————