প্রধান বিচারপতি দেশ ছাড়লেন, এরপর কে?
জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের সামরিক শাসনের জনক। তিনি ক্ষমতা দখল করেছিলেন বিচারপতি সায়েমকে ‘অসুস্থ’ বানিয়ে। দেশের দ্বিতীয় সামরিক স্বৈরাচার জেনারেল এরশাদ ক্ষমতাসীন হ’ন বিচারপতি সাত্তারকে ‘অসুস্থ’ বানিয়ে। সর্বশেষ প্রধান বিচারপতি সিনহা-কে ‘অসুস্থ’ ঘোষণা করলেন আইনমন্ত্রী এবং এটর্নি জেনারেল। আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের ব্যাপারটা বুঝি, উনি সরকারি লোক এবং দলীয় এমপি। কিন্তু এটর্নি জেনারেলের বিষয়টি বুঝলাম না, তিনি তো দলীয় ক্যাডার নন? যদিও সরকার এটর্নি জেনারেলের নিয়োগ দেন, যেমন রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেন প্রধান বিচারপতির। তবু, সিদ্ধান্তগুলো রাজনৈতিক, কিন্তু নিয়োগের পর ঐ পদে সমাসীন ব্যক্তিবর্গ রাষ্ট্রের সম্পত্তি হয়ে যান। প্রধান বিচারপতির পদটি সাংবিধানিক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এটর্নি জেনারেলকে মনোনয়ন দেন রাষ্ট্রপতি, এবার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিয়োগ দিয়েছিলেন জেফারসন সেশনস-কে। সিনেট অনুমোদন দেয়ার পরই তিনি প্রেসিডেন্টের বিরোধিতা করেন। ট্রাম্প ক্ষেপে যান। কিন্তু সেশন বুঝিয়ে দেন যে, রাষ্ট্রের পক্ষে যা ভালো, তিনি তাই করবেন।
বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা যে রায় দিয়ে কোনঠাসা সম্ভবত: তিনি সেটি দিয়েছিলেন দেশের কল্যানে। যারা রায়টি পড়েছেন তারা জানেন, ওতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু, সরকার বা সংসদের বিরুদ্ধে কোন কথা নেই। শুধু ধারাবাহিকতা টানতে গিয়ে বলেছেন, সংসদ কার্যকর নয়! কথাটি কি খুব মিথ্যা? পঁচাত্তরের পর ১৯৯১-২০০১ এবং ২০০৯-২০১৪ সময়কাল ছাড়া কোন সংসদ কি তেমন কার্যকর ছিলো? সংসদকে নিয়ে রাজনীতিবিদরা কি খুব কম গালিগালাজ করেছেন? বিএনপি যেমন রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজাকে কয়েক ঘন্টার নোটিশে বরখাস্ত করে দলের কপালে কলংক এঁকে রেখেছে, সিনহা নাটকের ‘মেলোডি’ পরিসমাপ্তি না ঘটলে মহাজোটের কপালেও একই কলংক আঁকা হয়ে যাবে। কথায় বলে, ‘নিয়তির লেখা না যায় খণ্ডন’। প্রধান বিচারপতি ইস্যুতে যতকথা হচ্ছে, জনগণ কিছুই বিশ্বাস করছে না এবং করার কোন কারণ নেই? এই ইস্যুতে যত কথা হয়েছে এবং হবে ততই সেটা সরকারের বিপক্ষে যাবে।
প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে এমুহুর্তে আমার দু’টি কথা মনে হচ্ছে। আগেই বলে রাখি, আমি ‘হরিদাস পাল, আমার কথায় কিচ্ছু আসে-যায় না, তবু বলা’ আরকি। প্রথমত: সরকার প্রধান বিচারপতিকে ‘হিরো’ বানিয়ে দিয়েছে। দ্বিতীয়ত: আবার প্রমান হলো, ‘বন্ধুকে শত্রূ বানাতে আওয়ামী লীগের জুড়ি নাই’। কে যেন বলেছেন, সিনহা কখনোই আওয়ামী লীগ, সরকার এবং বিশেষত: শেখ হাসিনার ক্ষতি করতেন না? তার একমাত্র লক্ষ্য ছিলো বিচার বিভাগকে স্বাধীন রাখা। প্রথম দফা ঝড়-ঝাপ্টার পর তিনি কন্যার কাছে কানাডায় এসেছিলেন। তার সাথে একান্তে কথা বলার জন্যে আমি কানাডা গিয়েছিলাম। কথা হয়েছে। আমার মনে হয়নি তিনি সরকারের জন্যে বিপদজনক? একান্তে অনেক কঠিন প্রশ্ন আমি করেছিলাম। তিনি সাবলীলভাবে এর উত্তর দিয়েছেন। বাংলাদেশের একজন সাধারণ মানুষের মনে যেসব প্রশ্ন উঠেছিলো, আমি তাই জানতে চেয়েছি। তিনি জানিয়েছেন। তিনি জানেন, আমি তার এবং সরকার উভয়ের শুভাকাঙ্খী, কথাবার্তা হয়েছে সেই আলোকেই।
ষোড়শ সংশোধনী রায়ের পর মন্ত্রী পরিষদ সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। সিদ্ধান্তটি ছিলো, রায় তারা মেনে নিয়েছেন, কিন্তু রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে আপিল করবেন। বিজ্ঞ সিদ্ধান্ত। হটাৎ কি ঘটলো যে সবকিছু পাল্টে গেলো? কারণ সিনহা পাকিস্তানের প্রসঙ্গ টেনেছিলেন। ব্যাস, উভয়পক্ষে টানাহেঁচড়া শুরু হলো। সরকার অহেতুক ভয় পেলো যে, সিনহা সরকার বাতিল করে দেবেন? বিএনপি খুশি হলো এই ভেবে যে, তাদের কাজ দেখি সিনহা-ই করে দিচ্ছে। সিনহা কিন্তু তখন একটি মন্তব্য করেছিলেন, যার মর্মার্থ হচ্ছে, ‘বিচার বিভাগকে রাজনৌতিক দল থেকে দূরে রাখতে হবে। কিন্তু ততক্ষনে সিনহার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। তাকে এমন সব উপাধি দেয়া হয়েছে যা একটি জাতির জন্যে দু:খজনক। আঘাতটা তাদের কাছ থেকেই এসেছে, যাদের তিনি আপন ভাবতেন। কাজেই সেটা লেগেছে বেশি।
টরোন্টোয় আমি সিনহাকে বলেছিলাম, ‘আপনাকে লম্বা ছুটিতে বিদেশ পাঠানো হবে; যদি দেশে থাকতেও পারেন, তাহলে আপনি আর সুপ্রীম কোর্টের বেঞ্চে বসতে পারবেন না? উনি বলেছিলেন, ‘না পারলে আর কি করা যাবে’? আমার কথা সত্যি হয়েছে। যখন সরকার তাকে ‘অসুস্থ’ বানাতে চেষ্টা করছে তখন আমি ফেইসবুকে পোস্টিং দিয়েছি, তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ। আমি এও বলেছি, তিনি কোন ছুটির আবেদনে স্বাক্ষর করেননি। সুপ্রিমকোর্ট বার এসোসিয়েশনের সভাপতি প্রধান বিচারপতিকে দেশ না ছাড়ার আহবান জানিয়েছেন। সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, জিও-তে স্বাক্ষর করার জন্যে সিন্হার ওপর চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। সিন্হার বাড়িতে প্রথম দফায় যে ক’জন সশস্ত্র ঢুকেছিলেন তাদের একজন ভাই নিউইয়র্ক শহরে থাকেন। এই ভাই তার দেশের বাড়ির ভাইয়ের বরাত দিয়ে জানিয়েছেন, ছুটির আবেদনে স্বাক্ষর করাতে শুধু জোর-জবরদস্তি নয়, ওনারা আরো কিছু বেশিই করেছে।
আমার মনে আছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রথম দিকে একজন বিচারকের প্রতি ‘অশোভন’ উক্তি করেছিলেন, পুরো আমেরিকা তার বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরে, তিনি চুপ হয়ে যান। এমনকি পাকিস্তানে সুপ্রিমকোর্ট নওয়াজ শরীফকে ষড়যন্তমূলকভাবে বরখাস্ত করলে তিনি বলেছিলেন, ‘এটা অন্যায়, তবে বিচার বিভাগের সম্মানে আমি পদত্যাগ করলাম। কিন্তু আমি আবার জনগণের সমর্থনে ক্ষমতায় ফিরে আসবো’। সামনের নির্বাচনে সেটাই হতে যাচ্ছে। অথচ আমাদের গর্বের বাংলাদেশে আমরা কি করলাম? তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেই, প্রধান বিচারপতি ১৫৩জন সংসদকে বাতিল করে দিলেন। তাতে কি হতো? ক্ষমতায় তো আওয়ামী লীগই থাকতো। মহাজোট জনগণের কাছে বিচার চাইতো। সিন্হা হিরো থেকে জিরো হয়ে যেতো। আওয়ামী লীগ একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পুনরায় ক্ষমতাসীন হতো।
এখন আর সেই সুযোগ নেই? সদ্য দেশ থেকে এসে একজন হিন্দু ভদ্রলোক বললেন, ‘শিতাংশু, আপনার আওয়ামী লীগ দেশে কোথাও নেই, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন লাগবে না, পঁচিশ শতাংশ ফেয়ার ইলেকশন হলেও আওয়ামী লীগের খবর থাকবে না’। ভদ্রলোকের বাড়ি ফরিদপুর, সেখানকার ভয়াবহ চিত্রটিও তুলে ধরলেন। তাকে বলেছি, রাজাকার জাতীয় বেয়াই যেখানে নেতা সেখানে এরচেয়ে আর কি ভালো আশা করা যায়? ভদ্রলোক আমায় স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, আওয়ামী লীগ জিতলে হাইব্রিডরা জেতে আর আওয়ামী লীগ হারলে দেশবাসী হারে। দেশশুদ্ধ লোক সবাই জানে, অবাধ নির্বাচন হলে ক্ষমতাসীনরা হারবেন। গোয়েন্দা রিপোর্টও নিশ্চয় তাই বলছে। কেউ কিন্তু একথা বলেনা যে এত উন্নয়নের পরও কেন আওয়ামী লীগ হারবে? হারার অসংখ্য কারণের সর্বশেষটি হচ্ছে, ‘সিন্হা নাটক’। এর কোন প্রয়োজন ছিলোনা।
একটা সময় ছিলো যখন আমাদের দেশে সরকার পরিবর্তন হতো হত্যার মধ্যে দিয়ে। রক্তপাত খারাপ। তাই সেটা বন্ধ হলো, কিন্তু ‘অসুস্থ’ সিন্ড্রোম চালু হলো। তারপর আন্দোলন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এরপর আবার কিছুটা গণতন্ত্র গণতন্ত্র ভাব? আবার সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। আবার গণতন্ত্র। পুনরায় ‘অসুস্থতার’ বাতিক? দেশ আর কতকাল এই গোলক ধাঁধায় থাকবে? কেন দেশে একটি সুস্থ ‘নির্বাচনী ব্যবস্থা চালু হয়নি এর দায় কি আওয়ামী লীগ বা বিএনপি’র ছিলোনা? যাকগে, সিন্হা দেশ ছেড়েছেন বা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। কিছু খুনীকে শাস্তি দেয়ার প্রয়োজনে সিন্হার আবির্ভাব, তিনি বিব্রত হননি। তার প্রয়োজন শেষ.? সুতরাং বিদায়। ইমরান এইচ সরকারের প্রয়োজন শেষ হলে তাকেও বিদায় দেয়া হয়েছে। এমনকি শহীদ জননী জাহানারা ইমামকেও ছুড়ে ফেলা হয়েছে। রাজনীতি বড় নিষ্ঠূর। আমাদের দেশে এর চেহারা বড় কদর্য। যেদেশে বঙ্গবন্ধুর মত নেতাকে নিয়ে কুৎসা হয়, সেদেশে প্রধান বিচারপতি তো নস্যি! দুর্ভাগ্য কেউ কবির সেই বিখ্যাত উক্তিটি মনে রাখেনা, ‘হে দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছো অপমান, অপমানে হতে হবে তাদের সবার সমান’।
শিতাংশু গুহ, নিউইয়র্ক।
৬৪৬-৬৯৬-৫৫৬৯