চিনা মন্দিরে হলদে জোব্বা পরে রোবট বলেছে ‘বুদ্ধং শরণং’। হাতে রং
তুলি ধরে সে ছবি এঁকেছে। সেনাবাহিনীর কাজ ভাগ করে নিয়েছে, চাষের কাজে হাত
লাগিয়েছে, এমনকী রোবো-রাঁধুনি প্যান কেক অবধি বানিয়ে আপনার ডাইনিং টেবিলে
হাজির করেছে সক্কাল সক্কাল। এ বার এই রোবটই মেজাজ বিগড়ে গেলে বলবে, ‘আমাকে
এখন বিরক্ত কোরো না।’ খেলতে ইচ্ছা হলে আবদার করবে খেলতে নিয়ে যাওয়ার। কখনও
আবার আপনার বকাঝকা শুনে মুষরেও পড়তে পারে। অর্থাত্ মানুষের মতোই আবেগী
হয়ে পড়বে সে। আর যন্ত্রমানবের মধ্যে আবেগের এই বীজটি পোঁতার কাজ করছেন
শ্রীদত্তা চট্টোপাধ্যায়।

হাওড়ার শ্রীদত্তা চট্টোপাধ্যায় ইজরায়েলের বেন গুরিয়োঁ বিশ্ববিদ্যালয়ে
হিউম্যান রোবট ইন্টার‌্যাকশন নিয়ে গবেষণা করছেন। তার গবেষণার বিষয়বস্তু হল
রোবটের ভিতরে কী ভাবে ইমোশন স্থাপন করা যায়। শ্রীদত্তার বাবা এবং দাদা
দুজনেই পেশায় ইঞ্জিনিয়র। ছোট থেকেই তাঁদের মুখে রোবট-এর কথা শুনে এই বিষয়
নিয়ে বড়ই কৌতুহল ছিল তাঁর। মনস্থিরই করে নেয় যে সে রোবট নিয়েই কাজ করবে।

কলকাতার বেথুন কলেজে সাইকোলজি নিয়ে পড়াশুনা করেছেন শ্রীদত্তা।
সাইকোলজিতেই স্নাতকোত্তর করেছেন বারাণসী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কিন্তু
রোবটের প্রতি ভালবাসা ছাড়তে পারেননি কোনও দিনই। এই পড়াশোনার মধ্যে দিয়েই
একটা নতুন বিষয় তিনি জানতে পারেন— ‘হিউম্যান রোবট ইন্টার‌্যাকশন’। “এই
বিষয় নিয়ে যখনই কাজ করব বলেছি, কারও কাছেই বিশেষ পাত্তা পাইনি। সবাই বলত,
সাইকোলজির ছাত্রী রোবট নিয়ে কী করবে?”— সুদূর ইজরায়েলের বিয়ারশেভা থেকে
বললেন শ্রীদত্তা।

এক জন দক্ষ সহকারীর কাছ থেকে মানুষ কী আশা করে? কাজে সাহায্য করা তো
বটেই, বসের না বলা কথাগুলিও যেন সে বুঝতে পারে, ভাল সহকারীর কাছে আশা থাকে
সেটাই। বসের সঙ্গে সহকারীর সম্পর্কের গোড়ার কথাটাই হল এই ‘নন-ভার্বাল
কমিউনিকেশন’। গবেষণায় দেখা গেছে ৮২ শতাংশ বার্তা আদান প্রদান হয় অমৌখিক
বার্তা বা ‘নন-ভার্বাল কমিউনিকেশন’ এর মাধ্যমে। আপনি কখন রেগে আছেন, কখন
একটু একা থাকতে চাইছেন, ভাল সহকারী এগুলি বুঝবেন খুব সহজেই। কেমন হয় যদি এই
সহকারী এক জন যন্ত্রমানব হয়?

একটি রোবট হাত।

শ্রীদত্তার কাজটা ঠিক সেখানেই। মানুষ আর তার হাতে গড়া রোবটের মধ্যে
ভাবের আদান প্রদানের ভাষা বা ‘নন-ভার্বাল কমিউনিকেশন’ এর ভাষাকে খুঁজে বার
করা। খুঁজে বার করা বলা ভুল হবে। কেননা শ্রীদত্তা সেই ভাষাটাকেই তৈরি
করছেন। একটা ‘রোবট আর্ম’ কে যদি মানুষের অ্যাসিস্ট্যান্ট হতে হয় তা হলে তার
মধ্যে কী কী দরকার হবে? না বলা কথাগুলি কী ভাবে বুঝবে রোবট সহকারী? এটাই
শ্রীদত্তার গবেষণার বিষয়।

কিন্তু কী করে সম্ভব তা? রক্তমাংসে গড়া মানুষকে চিমটি কাটলে তার ব্যথা
হয়। দুঃখের সময় সে কেঁদে ওঠে। আনন্দে সে হাসিতে ফেটে পড়ে। যন্ত্রমানব বা
রোবট, সে তো কম্যান্ডের ভিত্তিতে চলাফেরা করে। না আছে তার শরীর, না আছে
হৃদয়। সেই যন্ত্রমানবের আবার আবেগ? মানুষের ভেকরূপ ধারণকারী রোবট যাকে বলা
হয় ‘হিউম্যানয়েড রোবট’(humanoid robot), তাদের ভিতরে আবেগ এবং বিবেক স্থাপন
নিয়ে এযাবৎ অনেক গবেষণা হয়েছে। তবে সেইসব রোবট অনেক বেশি ব্যয়বহুল। ‘বডি
ল্যাঙ্গুয়েজ’ এর গবেষণায় বলা হয়, মানুষ চাইলে নিজের হাতটুকু নাড়িয়েও অনেক
ভাব ব্যক্ত করতে পারে। এই বিষয়টাই শ্রীদত্তা একটা রোবট হাতের উপর পরীক্ষা
করে দেখেছে। একটা যান্ত্রিক হাতও নিজের নড়াচড়া দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করতে
পারে। সেরকম ভাবে এই নিয়ে এখনও অবধি কেউ ভেবে দেখেনি। শ্রীদত্তার মতে, ‘এই
রোবট হাত অনেক বেশি সস্তা। আর এরা অনেক বেশি কাজও করে ফেলতে পারে আবার যে
কোনও জায়গায় বহনও করা যায়। তাই আমাদের উচিৎ রোবট হাত নিয়ে আরও বেশি করে
গবেষণা করা।’ 

বেন গুরিয়োঁ বিশ্ববিদ্যালয়ের মোবাইল রোবট ল্যাব ইঞ্জিনিয়ার জোসেফ জাহাবি(Yoseph Zahavi) রোবট হাত নিয়ে পরীক্ষা করে দেখছেন।

আবেগ মানেই হাসি-কান্না বা আরও যে যে উপায়ে মানুষ তার আবেগের বহিঃপ্রকাশ
করে থাকে। কিন্তু আবেগের ইংরেজি শব্দ ইমোশন এর ব্যাখ্যা একটু আলাদা।
অ্যানিমেশন-এর ভাষায় বলা হয়, ইমোশনের বহিঃপ্রকাশ হয় মোশন এর মাধ্যমে।
অর্থাৎ বিভিন্ন ধরনের গতির মাধ্যেমেই আবেগের প্রকাশ করা হয়ে থাকে। কিন্তু
রোবট হাত, যার মাথা নেই, পা নেই, চোখ নেই, দেহ নেই, সে আবেগের প্রকাশ কী
গতি দিয়ে বোঝাবে?

মূলত দু’রকম ভাবে রোবট তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বোঝাতে পারে।

এক, অ্যানিমেটড ফিল্মে যেরকম ভাবে নকশা তৈরি করে চরিত্রদের চলন-বলন
দেখানো হয়। সিনেমা চলাকালীন কিন্তু দর্শক তা দেখে বুঝতে পারেন। কিন্তু
দর্শক জানেন না যে এই কার্টুন এরপর কী করতে পারে। তা কেবলমাত্র জানে সেসব
চরিত্রের নির্মাতারা।

রোবট হাতের বডি ল্যাঙ্গুয়েজের জন্য অ্যানিমেটড ফিল্মের মতোই নকশা তৈরি
করতে হয়। আর এই নকশা দিয়েই তৈরি হবে রোবট হাতের এক একটা মোশন বা গতি। এক
একটা ডিজাইন রোবট হাতের এক একটা মুভমেন্ট। আর শ্রীদত্তার হাতে তৈরি এই
নকশার ভিত্তি হচ্ছে মানুষ এবং অন্য প্রাণীদের ‘বডি ল্যাঙ্গুয়েজ’।

ব্যাক্সটার মডেল। ছবি সৌজন্যে ফোর্বস।

দ্বিতীয়টি হল ব্যাক্সটার মডেল।

ব্যাকস্টার নামে একটা বড় মাপের ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবট আছে। বিরাট দুটো
রোবটিক্স আর্ম আছে তার। আছে দুটো চোখও। আর তার সামনে রয়েছে একটা ট্যাবলেট।
তার মাধ্যমেই ব্যাকস্টার বিভিন্ন সংকেতের সাহায্যে জানিয়ে দেয় যে সে খুশি
নাকি রেগে, তিতিবিরক্ত নাকি বিরহের সুর গুনগুন করছে। তার চোখ দুটো আছে
কেবলই সামনে কোনও মানুষের উপস্থিতি বোঝানোর জন্য। কারণ ওর সামনে কোনও মানুষ
থাকলে ব্যাকস্টার নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে না। বিষয়টা অনেকটা ইমোজির মাধ্যমে
হাসি-কান্না বোঝানোর মতো।

কিন্তু এই ইমোজি নির্ভর আবেগের বহিঃপ্রকাশ না পসন্দ অনেক বিজ্ঞানীরই।
সেই তালিকায় আছেন শ্রীদত্তাও। পাশাপাশি বিশালাকায় ব্যাকস্টারকে দিয়ে সব কাজ
করানোও যায় না।

দেখুন ভিডিও

শ্রীদত্তার কোনও বড়সড় ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবটের প্রয়োজন ছিল না। একটা
ছোট্ট রোবট নিয়েই তার পরীক্ষা চালিয়েছেন তিনি। ছোট একটা ‘রোবটিক আর্ম’ বা
রোবট হাতই হতে পারে শ্রীদত্তার সহকারী। এই সহকারী তার প্রভুর বডি
ল্যাঙ্গুয়েজ বুঝতে সক্ষম হবে বলে দাবি শ্রীদত্তার। প্রভুও বুঝতে পারবে তার
যান্ত্রিক সহকারীর না বলা কথাগুলো। তবে এই মুহূর্তে একমাত্র সেই জানে যে
তার রোবট হাত কী কী বডি ল্যাঙ্গুয়েজ জানে।

‘ডগস প্লে বাও’ বলে কুকুরদের একটি বিখ্যাত অঙ্গ বিন্যাসের ধরন আছে।
খেলার ইচ্ছা হলে কুকুর সাধারণত এই বিশেষ ভঙ্গি করে। হুবহু এরকমই একটা
ভঙ্গির নকশা তৈরি করে ফেলেছেন শ্রীদত্তা। আর তা ওই রোবট হাতের মধ্যে দিয়ে
সফল পরীক্ষাও করেছেন তিনি।

‘ডগস প্লে বাও’ নামক কুকুরদের অঙ্গ বিন্যাসের ধরন। ছবি: সংগৃহীত

বডি ল্যাঙ্গুয়েজের কাজ শ্রীদত্তা ইতিমধ্যেই তৈরি করে ফেলেছেন। অর্থাৎ
নকশাগুলো রেডি। ২০১৮ সালের অক্টোবরে তার এই রিসার্চ শেষ হবে। এখন তার কাজ
হচ্ছে এই রোবটের ভিতরে কন্ট্রোলস্ স্থাপন করা। যে কন্ট্রোলস্গুলো স্ক্রিনে
দেখাবে। মোট দুই প্রকারের কন্ট্রোলস্ সিস্টেম থাকবে বলে জানালেন তিনি,
স্ক্রিন কন্ট্রোল এবং ভয়েস কন্ট্রোল। স্ক্রিন কন্ট্রোলের মাধ্যমে বোতাম
টিপে রোবট হাতের থেকে কাজ হাসিল করা হবে। ভয়েস কন্ট্রোলের সাহায্যে রোবট
হাতকে কী কম্যান্ড দেওয়া হবে তার ভিত্তিতে সে চলাফেরা করবে।

কিছুদিন আগেই বিল গেটস বলেছেন মানুষের কাজখেকো রোবটের উপর কর চাপানো
হোক। শ্রীদত্তার মতে, “রোবট মানুষের কাজ অনেক কমিয়েছে। কিন্তু কর্মসংস্থান
কমে যাওয়ার জন্য কেবলমাত্র রোবটকে দোষ দেওয়াটা বোধহয় উচিত নয়। আগে
টেলিফোনের অফিসে এক একটা ফোন কল কানেক্ট করবার জন্য প্রচুর লোক এক সঙ্গে
কাজ করতেন। টেলিগ্রামের জমানা তো শেষ। টেলিফোনের বাজারও প্রায় শেষ হওয়ার
মুখে। কিন্তু কাজ যেরকম চলে যাবে, আবার নতুন কাজের সংস্থানও হবে। আমার মনে
হয় ছোট থেকেই কম্পিউটার প্রোগ্রামিং-এর উপর নজর দেওয়া একটু বেশি দরকার।
বাংলা বা ইতিহাস পড়ি বলে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং বুঝে কী করব তা বললে আগামী
দিনে আর চলবে না।”