এই ছবিটি মারাঠা দিবসের র্যা লির। মারাঠি নারীরা তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে বাইক চালাচ্ছে। ছবিটি কবি মলয় রায়চৌধুরীর টাইম লাইন থেকে নেয়া। কথা সেটা নয়, কথা হচ্ছে মারাঠিদের কথা আসলেই যে লোকটির কথা প্রথম মনে পড়ে সে বাল থ্যাকার। লোকটাকে অত্যন্ত অপছন্দ করি মৌলবাদী হিন্দুত্ববাদী বলে। ভারতের বাইরে সবাই তাকে হিন্দু মৌলবাদী হিসেবেই জানে। আজ এই মারাঠা দিবসের ছবিটির দিকে চেয়ে ভাবছি, আমার নিজের দেশ ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক ব্যক্তি ও দলের প্রতি ততটুকু কি দিতে পেরেছি যতটুকু ঘৃণা সমালোচনা বাল থ্যাকার তার প্রাপ্য হিসেবে পেয়েছে?
বাল থ্যাকার আসলে যতখানি হিন্দুত্ববাদী তার চাইতে বেশি মারাঠা জাতীয়তাবাদী। তাদের দল ‘শিবসেনা’ মারাঠা কেন্দ্রিক একটি মৌলবাদী দল। বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার পিছনে এদের অবশ্যই বড় ভূমিকা ছিলো। শুরুতেই বলেছি একজন হিন্দুত্ববাদী নেতা যতটুকু সাম্প্রদায়িকতা ও তার চিন্তার জন্য ঘৃণ্যিত ততখানি কি একই চিন্তা চেতনার লোকজন সমানভাবে পাচ্ছে? নাকি এখানেও পিছলে বেরিয়ে যাচ্ছে রুই কাতলাগুলো? অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড সারা ভারতের প্রতিটি জেলায় মুসলমানদের জন্য একটি করে দারুল কাজা বা শরীয়া আদালত স্থাপনের দাবী জানিয়েছিলো। ভারতের প্রচলিত আইনে নয়, তারা তাদের ইসলামিক আইনে নিজেদের ফয়সালা চান। এরা কি বাল থ্যাকারের চাইতে ভালো মানুষ? যারা মুসলমানদের ইসলামিক রাষ্ট্র চায় যেখানে রাষ্ট্র পরিচালনার অধিকার থাকবে মুসলমানদের হাতে- এরকম চিন্তার লোকজন বাল থ্যাকারের চেয়ে ভালো?
বাল থ্যাকারের বাবা ছিলেন ব্রাহ্মণ্যবাদ ও জাতপাতের বিরোধী সোচ্চার একজন মানুষ। তবে প্রবলভাবে মারাঠা জাতীয়তাবাদী। আমাদের মধ্যে যেমন প্রবলভাবে বাঙালী জাতীয়তাবাদী, কেউ বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী, কেউ বা মুসলিম জাতীয়তাবাদী আছে তেমন। সেরকম জাতীয়তাবাদের জন্য কেউ কোনদিন সামালোচিত হয় না। বরং জাতীয়তাবাদী বীরদের সবাই ব্যক্তিপুজা করে থাকে। বাল থ্যাকারের বাবা ছিলেন একজন লেখক। তিনি ‘প্রবোধন’ নামের একটা পত্রিকা বের করে এবং ‘প্রবোধঙ্কর’ ছদ্মনামে লেখালেখি করেন। এটাই শেষতক নাম হয়ে যায় সকলের কাছে। তারই ছেলে বাল থ্যাকার হলেন একজন কার্টুনিস্ট। ১৯৬০-এর দশকে ভারতে মারাঠা ও গুজরাটি জাতীয়তাবাদ জেগে উঠে। এই দুই জাতি নিজেদের জন্য আলাদা রাজ্যের দাবীতে আন্দোলন শুরু করে। বাল থ্যাকার পাশাপাশি ‘মার্মিক’ নামের একটা পত্রিকা খুলে সেখানে লেখালেখি করেন যার প্রধান বক্তব্য হচ্ছে মারাঠীরা কি করে বঞ্চিত হচ্ছে অন্যান্য জাতিদের কাছে। মুম্বাই তথা তখনকার বোম্বাইয়ে সমস্ত ব্যবসা বাণিজ্য চাকরির বাজার দখল করে আছে অমারাঠিরা। আজকের পশ্চিমবঙ্গের কত স্বজ্জন প্রগতিশীল লোক ঠিক এরকম করে বাঙালীর জন্য আক্ষেপ করেন। এরকম জাতীয়তাবাদ তুলে পূর্ববঙ্গে মুসলমানরা ভারতই ভাগ করে পাকিস্তানের দাবী তুলেছিলো। ঠ্যাকার যদি এরকম জাতীয়তাবাদের জন্য উগ্র সংক্রীর্ণ হোন তাহলে বাকীরা কেন ইতিহাসের মহানায়ক হবেন? ‘শিবসেনা’ সাঘাতিক উগ্র মানসিকতার কর্মী তৈরি করে ভারতসুদ্ধ সবাইকে ভীত করে তুলেছে। একবার পাকিস্তান ভারতের ম্যাচ পন্ড করতে এরা মুম্বাইয়ের পিচ খুড়ে নষ্ট করে দেয়! ভারতে এর চাইতে বড় রকমের সন্ত্রাস করেছে নকশাবাড়ীর কমিউনিস্টরা। রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙ্গে, লোকজনকে খুন করে গোটা ভারত তোলপাড়া করে ফেলে। তাতে কিন্তু শিবসেনার অন্যায় জাস্টিফাই হয় না। খারাপ সে খারাপই, কম খারাপ আর বেশি খারাপ এই পরিমাপ এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য আপনাদের পক্ষপাতিত্বটাকে একটু আয়নায় তুলে ধরা যাতে নিজের প্রতিবিম্বটা দেখে নিতে পারেন।
বাল থ্যাকারের মত ধর্মীয় পরিচয় মিশ্রিত নৃতাত্ত্বিক জাতীয়তাবাদী বাংলাদেশের অতিত বর্তমানের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কয়েকজনের নাম আমি করতে পারি যারা স্বজ্জন মানুষ হিসেবে আমাদের কাছে পরিচিত। ডক্টর আহমদ শরীফ তার একটা প্রবন্ধে এদের সম্পর্কে বলেছিলেন, এরা মুসলমানদের ভালো চায়, মুসলমান ছাড়া অন্য কারো ভালো মন্দ নিয়ে তাদের চিন্তা নেই, অমুসলিমদের খারাপ চাইছে বা করছে সেটা নয়, তবে তারা মুসলিমদের স্বার্থই দেখেছে।… বাংলা ভাষায় আহমদ শরীফের আগে আর কেউ বাংলাদেশের মণিষিদের নিয়ে এরকম বক্তব্য রাখতে সাহস করেননি কারণ তারা সকলেই আমাদের দেশে বিরাট মানুষ হিসেবে গোণ্য। বাল থ্যাকারও অসংখ্য মারাঠী মানুষের কাছে পুজনীয়। তার মৃত্যুতে তারা শোকবিহ্বল হয়ে পড়েছিলো। গোলাম আযমের জানাজায় যেমন কয়েক লক্ষ বাংলাদেশী মুসলমান অংশগ্রহণ করেছিলো।
‘বাঙালী মুসলমান’ বাঙালী মুসলমান সাহিত্যিক’ বাঙালী মুসলিম নেতা’ এরকম চিন্তার সঙ্গে বাল থ্যাকারের মিল গভীর। থ্যাকার ঠিক এ্রভাবেই ভাবতেন, ‘মারাঠি হিন্দু’ ‘মারাঠি হিন্দু সাহিত্যিক’ ‘মারাঠি হিন্দু নেতা’। কারণ গুজরাটি হিন্দুদেরও থ্যাকার প্রত্যাখান করেছিলো তার মারাঠী জাতীয়তাবাদের জন্য। তবু আমাদের দেশের ‘বাঙালী মুসলমান’ চিন্তা কখনই সাম্প্রদায়িক হিসেবে গোণ্য হয়নি। সারা দেশে শরীয়া আদালত প্রতিষ্ঠার জন্য কেউ শিবসেনার মত আতংকিত হয়নি। এই বৈপরিত্যগুলো খুব পীড়া দেয়…।
এখনই সবাই হামলে পড়বে আমাকে ‘শিবসেনার এজেন্ট’ প্রমাণ করতে! ওলামা লীগ আমাকে সহ আমাদের কয়েকজন ব্লগারকে ‘শিবসেনার বাংলাদেশী এজেন্ট’ ঘোষণা করে বিচার দাবী করেছিলো। লেখা পছন্দ না হলেই আমাদের শিবসেনা বলাটা বামপন্থিদেরও একটা অভ্যাস। কাজেই সত্য বলতে গিয়ে কে কি ট্যাগ দিবে সেই চিন্তা করে তো বিরত থাকা যাবে না। বাল থ্যাকার মারাঠিদের মহান নেতা হবার পরও তাদের নারীদের মারাঠা দিবসের ছবি, আর মুসলিম পারসোনাল ল’ নেতাদের স্বপ্নে দেশে কি নারীদের এমন ছবি আমার কল্পনা করতে পারি? বাংলাদেশের ইসলামিক দলগুলো বাংলা নববর্ষকে হারাম, শিরক, বৈশাখী মেলা বন্ধের হুমকি, মঙ্গলশোভাযাত্রাকে হিন্দুয়ানী বলে এসব পালন থেকে মুসলমানদের বিরত থাকার জন্য চাপ, এই দিনে নারীদের বর্ণিল অংশগ্রহণের প্রতি তাদের যে উশকানি- তার সঙ্গে মারাঠা নারীদের র্যা লির ছবিটা মিলিয়ে নিবেন প্লিজ…।
আপনি বেশি করে হিন্দু হলে অন্য জন বেশি করে মুসলমান হবে। আপনি বেশি করে বাঙালী হলে অন্যজন বেশি করে বিহারী হবে। কাজেই জাতীয়তাবাদের চর্চা অশান্তিই ডেকে আনবে। সব রকম জাতীয়তাবাদকে এক পাল্লায় মাপুন। আমি এটাই বলতে চেয়েছি লেখায়।