মাদ্রাসা ও টোল শিক্ষা নিয়ে কিছু কথা। ইংরেজ আসার আগে মুসলমানদের যেমন ছিলো মাদ্রাসা হিন্দুদের ছিলো তেমন টোল। টোল হচ্ছে মাদ্রাসার মত শিক্ষাকেন্দ্র যেখানে সংস্কৃত ভাষা শিখে পুরোহিত বা পুজারী ঠাকুর তৈরি হয়।
সেই টোল ভারত স্বাধীন হবার পর সরকারীভাবে পরিত্যাগ করা হয়। ইংরেজ আসার পর ভারতীয় হিন্দু বুদ্ধিজীবীরা মত প্রকাশ করেন, আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান অধ্যায়ন না করে এইসব টোলে সংস্কৃত পড়ে কোন উন্নতি করা যাবে না।
বাংলার সত্যিকারের মহানায়ক বিদ্যাসাগর সরাসরি টোলের বিরোধীতা করে সবাইকে ইংরেজ প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থায় পাঠ নেয়ার কথা বলেন।
নদীয়া হচ্ছে হিন্দু পন্ডিত তৈরির কারখানা। সেটাই ছিলো প্রসিদ্ধ। সেই নদীয়াতে টোল কমতে কমতে এখন ২৫টিতে গিয়ে ঠেকেছে।
এসব টোল সরকারের অনুদান বা বিশেষ কোন কিছু পায় না। হিন্দুরা টোল পরিত্যাগ করে যে উন্নতি করেছিলো তার সঙ্গে মাদ্রাসা কেন্দ্রিক মুসলমানরা শুধু পিছিয়েই নয়- চরমমাত্রায় অজ্ঞ অসভ্য রয়ে গেছে।
যে কারণে প্রতিযোগিতায় পারবে না বলে তাদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের দাবী উঠেছিলো। ভারত স্বাধীন হবার পর আমার যদি ভুল না হয় জহরলাল নেহরু টোল শিক্ষা উঠিয়ে দেন।
কিন্তু স্পর্শকাতর মুসলিম সমাজ নিয়ে সেরকম কিছু করার জন্য দশবার ভাবতে হয়। কংগ্রেসে তখন মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ছিলেন। তিনিও মাদ্রাসা শিক্ষা উঠিয়ে দেয়ার জন্য কিছু বলেননি।
সম্ভবত সেই যুক্তি, এত বছর ধরে যে শিক্ষা চলছে সেটাকে রাতারাতি উঠিয়ে দিলে সাধারণ ধার্মীকরা মানবে না।
যদিও হিন্দুদের টোল মুসলিমদের মাদ্রাসার চাইতে আরো পুরোনো ঐতিহ্য ছিলো। সেই টোল হিন্দুরা পরিত্যাগ করেছে। সরকারী পৃষ্ঠাপোষকতা হারিয়েছে। তাতে কোথাও কোন শব্দ হয়নি।
ভারতের সংবিধান প্রণেতারা তাই ঠিক করল মুসলমানরা কি ধরণের শিক্ষা চায় সেটা তারাই ঠিক করে নিক। এ জন্য সংবিধানে ৩০ নং ধারা যুক্ত করা হয় যেখানে তারা কি ধরণের শিক্ষাক্রম গ্রহণ করবে সেটা তারাই ঠিক করবে সরকার কেবল সেই শিক্ষায় অর্থদান করে যাবে।
ভারতীয় মুসলিম সমাজ মাদ্রাসা শিক্ষাকে গ্রহণ করে নেয়। মুসলিমদের মধ্যে যারা বুদ্ধিজীবী প্রগতিশীল ছিলো তারাও সেই মত দেয়। সেই থেকে ভারতীয় সরকার মাদ্রাসা শিক্ষায় অর্থ দিচ্ছে আর সংবিধান মতে মাদ্রাসাগুলিতে মুসলিমরা পরিচালনা করছে।
সংবিধান মতে ভারতীয় সরকার মাদ্রাসা পরিচালনায় কোন হস্তক্ষেপ করতে পারবে না…। অর্থ্যাৎ ভারতীয় মুসলমান তাদের উন্নতি ও প্রতিযোগীতাময় বিশ্বে নিজেদের পশ্চাদ্দেশ নিজেরাই কাঁচি দিয়ে কেটে নিয়েছিলো।
দ্বিতীয়ত ভারতীয় মাদ্রাসাগুলিতে কি সেলেবাস পড়ানো যাবে সেটি সরকার নয় মৌলবীরা ঠিক করবে। নিয়ন্ত্রণও সরকার নয় মুসলিম নেতাদের হাতে। সে হিসেবে ভারতেরও মাদ্রাসা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। মাদ্রাসা যে জিহাদ শিক্ষা চলে, অমুসলিম ঘৃণা বিদ্বেষ, নারীদের প্রতি বৈষম্য ও ইসলামিক রাষ্ট্র গড়ার মত রাজনীতি শিক্ষা চলে সেখানে ভারতীয় সরকার কোন হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
ভারতে বসবাস করে এই মুসলিম সমাজ গজনোহীনের মাধ্যেমে ভারতকে ইসলামী করণের মতন কাজে উৎস করতে পারে। এটা এমন যে ভারতকে ভাঙ্গা মুসলিমদের ধর্মও অধিকার। এ নিয়ে কেউ কিছু বললে সেটা মুসলিমদের ধর্ম অনুভূতিতে আঘাতের সামিল।
পাকিস্তান হবার পর বাংলাদেশী মুসলমানদের মধ্যে যারা প্রগতিশীল বলে যাদেরকে আমরা চিহিৃত করি তারা সবাই মাদ্রাসা শিক্ষা টিকিয়ে রাখার জন্য তাদের রক্ষণশীল মতামত দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ হবার পর মাদ্রাসা শিক্ষা উঠিয়ে দিয়ে একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার কথা হয়েছে অনেকবার।
কিন্তু তথাকথিত প্রগতিশীলদের বিরোধীতা পেয়েছে। যেমন আহমদ ছফা মাদ্রাসা শিক্ষা যে মুসলমানদের পিছিয়ে পড়ার পিছনে ভূমিকা রাখে সেটা বলেও তিনি হুট করে এই শিক্ষা ব্যবস্থা উঠিয়ে দেয়ার বিপক্ষে।
এক সাক্ষৎকারে তিনি বলেছিলেন, তিনিও চান মাদ্রাসা ব্যবস্থা উঠে যাক কিন্তু শত শত বছর ধরে যে ব্যবস্থা চলে আসছে তা হুট করে বন্ধ করে দিলে হীতে বিপরীত হয়ে যাবে। বলতে গেলে তাই বাংলাদেশে ‘কুদরত-ই খোদা শিক্ষা ব্যবস্থা’ নামের একমুখি শিক্ষা বাস্তবায়ন করা যায়নি এইসকল রক্ষণশীল মানুষদের কারণে।
বিদ্যাসাগর যখন বলেছিলেন এইসব মন্ত্রতন্ত্র শেখা টোলে পড়ে কিচ্ছু হবে না, তারচেয়ে পাশ্চত্যের আধুনিক বস্তুবাদী শিক্ষা গ্রহণ করো, তখন মুসলমান সমাজের শিক্ষিত লোকজন মাদ্রাসা উঠিয়ে দিলে হিতে বিপরীত হয়ে যাবে ভেবে অস্থির! তফাতটা এখানেই।
সলিমুল্লাহ খানদের মাদ্রাসা প্রীতি কিন্তু জাতীয়তাবাদী দিক থেকে। মাদ্রাসার হুজুরদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিক্ষক জ্ঞানে যুক্তিতে পারবে না- তার এই বক্তব্য মাদ্রাসা শিক্ষা টিকিয়ে রাখার জন্য তার দৃঢ় অবস্থান প্রমাণ করে।
মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেছিলেন রামমোহন- এরকম জিনিস তুলে ধরে সত্যকে বিকৃত করে প্রতিষ্ঠা করে মাদ্রাসাকে টিকিয়ে রাখার সুযোগ করে দিয়ে তারা যে বিশাল বিপদ খাড়া করে যাচ্ছেন এতে তাদের উদ্দেশ্য আবিস্কার করতে গিয়ে মুসলিম জাতীয়তাবাদের হাস্যকর ছায়ার সঙ্গে লড়াই করা মত সত্য আবিস্কার হয়।
এখনো পূর্ববঙ্গের (বাংলাদেশ) মুসলমান হিন্দুদের সঙ্গে রেষারেষি করে। যেটার আসলে ভৌগলিক কোন বাস্তবতা নেই।
দেশভাগের পর বাংলাদেশের হিন্দুদের ধনী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিলোপ ঘটে। সংখ্যার কারণে বাংলাদেশে হিন্দুরা তাই কোনদিনই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে মুসলিমদের প্রতিযোগিতায় ফেলতে পারবে না।
পাকিস্তান করাই হয়েছিলো এরকম ছক কষে। তবু সলিমুল্লাহ খান, ফরহাদ মজহারদের হিন্দুদের বিরুদ্ধে যত ক্ষোভ। আহমদ ছফারা বাঙালী মুসলমানদের আলাদা সাহিত্য ভাষা নির্মাণ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
এই ধরণের জাতীয়তাবাদ উগ্রভাবে কবি গোলাম মুস্তফা, কায়কোবাদ, ফরুক আহমদদের মাধ্যমে পাকিস্তান আমলে চেষ্টা হয়েছিলো। দেশ স্বাধীন হবার পর ছফাদের অতি মুসলিম আইডেন্টি চর্চা মুসলিম জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশের লেখক শিবিরকে সাম্প্রদায়িকভাবে আচ্ছন্ন করে তোলে।
আজকের সলিমুল্লাহ, বাত্য রাইসুদের জন্ম হয়েছিলো এই আত্মঘাতি মুসলিম জাতীয়তাবাদের চর্চার কারণে। মুসলমানদের শত্রু হচ্ছে তাদের ধর্মীয় শিক্ষা। মাদ্রাসা তাই মুসলিম অধুষ্যিত যে কোন দেশের জন্য অভিশাপের মত।
টোল উঠিয়ে দিয়ে বাঙালী হিন্দুসহ ভারতবর্ষের অন্যান্য জাতির হিন্দুদের কোন ক্ষতি হয়নি। বরং আধুনিক শিক্ষাদীক্ষায় তারা এগিয়ে গিয়েছে।
সেখানে আজো নানা রকম অনুভূতি আর হিতে বিপরীতের যুক্তি তুলে ধরে যারা মাদ্রাসাকে টিকিয়ে রাখতে চায় তারাই তো মুসলমানদের প্রকৃত শত্রু!
আসাম রাজ্য সরকার সেখানকার সরকারি মাদ্রাসা ও সংস্কৃতি কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দিচ্ছে। আগামী ছয় মাসের মধ্য এ প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণ স্কুলে পরিণত হবে।
২০১৭ সালে মাদ্রাসার পাশাপাশি সংস্কৃত কেন্দ্র বোর্ডকে মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সঙ্গে একীভূত করা হয়েছিল। এবার তা পুরোপুরি বন্ধ করে দিচ্ছে রাজ্য সরকার।
অনেক দিন ধরে চলা ধর্মীয় সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এভাবে বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্তের সমালোচনা করছেন অনেকে। কিন্তু এই সমালোচকরা কখনোই বলছে না যে শুধু মাদ্রাসা নয় আসাম সরকার সংস্কৃতি শিক্ষাও বন্ধ করেছে।
প্রতিবেশি দেশের বেশির ভাগ মিডিয়া এই ঘটনাকে ভারতে মুসলিমদের উপর এক ধরণের নিপিড়ন হিসাবে তুলে ধরার চেস্টা করেছে।
লেখক- Susupto Pathok
আরো পড়ুন…