যোগেন মন্ডলের মোহভঙ্গ এবং পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ।

যোগেন মন্ডলের মোহভঙ্গ এবং পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
এটা তো ঠিক সদ্য স্বাধীন ‘বাংলাদেশ’ হতাশ করেছিলো এদেশের ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের। এমনকি আন্তর্জাতিক মিত্র ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়নকেও। বাংলাদেশের ধর্মীয় চেহারা গ্রহণ এর একমাত্র কারণ নয়, নামে বা পরিচয়ে কি আসে যায় যদি কর্মে সৎ থাকে। ‘মুসলমানদের দেশ পাকিস্তানকে’ নিন্মবর্ণের হিন্দুদের নেতা যোগেন মন্ডল সমর্থন করে ১৯৪৬ সালে বলেছিলেন, ‘হিন্দুদের আওতায় থাকিয়া ঘৃণিত জীবন যাপন করার চেয়ে মুসলমান অথবা অন্য কোন জাতির আওতায় স্বাধীন ও সম্মানের সহিত বাস করিতে তফসিলি জাতি বেশী পছন্দ করে’।

উঁচু বর্ণের হিন্দুদের শিক্ষা দীক্ষা ও প্রভাবে তফসিলি সমাজের পিছিয়ে থাকার আশংকায় তারা যদি নিজেদের আলাদা করতে চায় সেটা দোষের কিছু নয়। একইভাবে মুসলমানরা হিন্দুদের সঙ্গে থাকলে তাদের সঙ্গে পেরে উঠবে না- এই আশংকায় যদি আলাদা করে ‘মুসলমানদের দেশ’ চায় তো সেটাও দোষের কিছু না। সেভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের দেশ গঠিত হয়েছিলো। পূর্ব পাকিস্তানে যে অবশিষ্ঠ হিন্দুরা থেকে গিয়েছিলো তাদের বেশির ভাগই নিম্নবর্গের মানুষ। ব্রাহ্মণ্যবাদের হাতে কম-বেশি তারা নিপীড়িত, অসন্মানিত ছিলো। পাকিস্তানে তারা ভাল থাকবে। যোগেন মন্ডল পাকিস্তানে মন্ত্রী হয়েছিলেন। ইতিহাস বড়ই জটিল। #পশ্চিম_পাকিস্তানীদের_বৈষম্যের_শিকার_বাঙালী_মুসলমানদের_হাতেই_আবার_সংখ্যালঘু_বাঙালী #হিন্দুরা_নিপীড়িত_শোষিত_হচ্ছিল।

#১৯৪৭_সালের_পর_১৯৫০_সালে_হিন্দুদের_উপর_আরেক_দফা_যে_দাঙ্গা_চালানো_হয়েছিলো_তাতে_যোগেন_মন্ডলও_জান #বাঁচাতে_ভারতে_পালিয়ে_বেঁচেছিলেন। তার পাকিস্তানের মোহ ঘুচে গিয়েছিলো সেটা পাঞ্জাবী পাঠানদের কারণে নয়। নিজ দেশের মানুষের ভয়াবহ চেহারা দেখে।

তিনি তার পদত্যাগপত্রে লিখেছিলেন, ‘আমার পক্ষে এটা বলা অন্যায্য নয় যে পাকিস্তানে বসবাসকারী হিন্দুদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ‘নিজভূমে পরবাসী’ করা হয়েছে, আর এটাই এখন হিন্দুদের কাছে পাকিস্তানের পূর্ণাঙ্গ চিত্র। হিন্দুধর্মে বিশ্বাস করাটাই এদের একমাত্র অপরাধ।…সুদীর্ঘ ও উদ্বেগময় সংগ্রামের পর শেষ পর্যন্ত আমাকে একথাই বলতে হচ্ছে যে পাকিস্তান আর হিন্দুদের বাসযোগ্য নয়। তাঁদের ভবিষ্যতে প্রাণনাশ ও ধর্মান্তরকরণের কালো ছায়া ঘনিয়ে আসছে। অধিকাংশ উচ্চবর্ণের হিন্দু ও রাজনৈতিক সচেতন তফসিলি জাতির লোকেরা পূর্ববঙ্গ ছেড়ে চলে গেছে। যে সমস্ত হিন্দুরা এই অভিশপ্ত দেশে অর্থাৎ পাকিস্তানে থেকে যাবে, আমার দৃঢ বিশ্বাস ধীরে ধীরে এবং সুপরিকল্পিত ভাবে তাদের মুসলমানে পরিণত করা হবে বা নিশ্চিহ্ন করা হবে’ (মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ, জগদীশ মণ্ডল, ১ম খন্ড)।

যোগেন মন্ডলকে সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদী বলে কষে একটা গালি দিয়ে আসুন নিজেদের পাপটাকে ঢাকি। এছাড়া আর কোন উপায় নেই কিন্তু! ইতিহাস মুছে ফেলা যায় না- শুধু গোপন করা যায়। যে ভারতে থাকাকে যোগেন মন্ডল ঘৃণিত মনে করতেন তার শেষ জীবনের নিরাপদ আশ্রয় হয়েছিলো সেখানেই এবং তিনি দেখেছিলেন দেশভাগের পর ভারত থেকে কোন ধর্মীয় সংখ্যালঘুর পাশ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নেয়ার কোন রেকর্ড নেই। উপরন্তু পাকিস্তান শুরু থেকেই ছিলো ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য এক নরক। ১৯৬৫ সালে ফের ভয়াবহ হিন্দু বিরোধী দাঙ্গা ঘটে পূর্ব পাকিস্তানে। হাজার হাজার হিন্দু বাড়িঘর দখল হয়ে যায় রাতারাতি। ‘এনিমি প্রপার্টি’ আইনটি সেসব পাকিস্তান সরকার পাশ করেছিলো। এটি পরবর্তীকালে, এমনকি আজকের সময় এসেও হিন্দু সম্পত্তি দখলের একটা ফাঁদ হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে।

৬৫ সালে দেশত্যাগ করা হিন্দুদের বাংলাদেশ গ্রহণ করতে যে অনিচ্ছুক সেটা এম আর আখতার মুকুল স্পষ্ট করে তার বই ‘আমি বিজয় দেখেছি’-তে বলেছেন। সে সময় দেশত্যাগ করা হিন্দুদের দায় বাংলাদেশ নিবে না। তারা বাংলাদেশের নাগরিক নয়…। এর মাত্র ৬ বছর পর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। এক কোটি মানুষ শরণার্থী হয়ে ভারতে পালিয়ে জীবন বাঁচিয়েছিলো। নিমর্ম সত্য হলো তার ৯৫ ভাগই ছিলো হিন্দু সম্প্রদায়। ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১ কোটি শরণার্থীর মধ্যে হিন্দু শরণার্থীর সংখ্যা ছিলো ৬৯ লাখ ৭১ হাজার এবং মুসলিমসহ অন্যান্য শরণার্থীর সংখ্যা ছিলো ৬ লাখ মাত্র (সূত্র: প্রথম আলো, একাত্তরের শরণার্থী, আশফাক হোসেন, ০৭-১২-২০১০ তারিখে প্রকাশিত)। এর কারণও ছিলো। পাকিস্তানী সোলজারদের বলাই হয়েছিলো, এদেশের কাফের হিন্দুরা পাকিস্তান ভাঙ্গার মূল উশকানিদাতা। তাই এদের ঝাড়ে নির্বংশ করে দিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধে হিন্দু নারীদের প্রতি ঘটেছিলো চরম নির্মমতা। বলছি না মুসলমান দেখে তারা নির্যাতন করেনি। করেছে। কিন্তু এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না কতখানি ভয়াবহতা হিন্দুদের উপর চালানো হয়েছিলো।

যাই হোক, অনেক রক্ত আর চোখের জল ফেলে জন্ম হলো বাংলাদেশের। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম কিংবা সংবিধানে বিসমিল্লাহ বসানোতে কি আসে যায় যদি আদতে বাংলাদেশ হতো সব সম্প্রদায়ের জন্য শান্তিতে বসবাসের স্থান। যোগেন মন্ডল তো ‘মুসলমানদের দেশে’ তার সম্প্রদায়দের থাকতে বলেছিলেন। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হওয়াতে হিন্দুসহ বাংলাদেশের ধর্মীয় জাতিগত সংখ্যালঘুদের কিছু যায় আসেনি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর মাথার কাছে আরবীতে কলেমা খচিত ওয়ালমেট কেন লাগানো থাকে- এরকম কোন হীনমন্যতাও তাদের মধ্যে দেখিনি কোনদিন। একটু ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা পেলেই তাদের আর রাষ্ট্রের কাছে চাওয়ার কিছু নেই। কিন্তু দেশ স্বাধীন হবার পরও ‘শত্রু সম্পত্তি’ বহাল থাকল। রমনা কালি মন্দির হাতছাড়া হলো। ভাবুন তো, বাইতুল মোকাররম মসজিদ বন্ধ করে দিয়ে বলা হলো অন্য কোথাও এই মসজিদ বানিয়ে নাও- কেমন হবে কথাটা? শত শত হিন্দু সম্পত্তি দখল করে রাখল স্বাধীনতার স্বপক্ষেরই লোকজনরা! নিরবে দেশত্যাগই হলো স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের নিয়তি…। সত্যি করে একটা প্রশ্ন নিজের বিবেকের কাছে করেন তো, বাঙালী মুসলমান হিসেবে পাঞ্জাবীদের কাছে বৈষম্যের শিকার না হলে দ্বিজাতি তত্ত্ব ছেড়ে দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি ধরত কি পূর্ব পাকিস্তানের নেতারা? ইয়াহিয়া-ভুট্টো গণতান্ত্রিক রীতি মেনে, জনগণের রায় স্বীকার করে নিয়ে যদি পূর্ব পাকিস্তানের নেতাদের সরকার গঠন করতে দিতো- তাহলে কি মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হতো?

বাংলাদেশের কোন হিন্দু পরিচয়ের বিশিষ্ট ব্যক্তি যখন হিন্দুদের উপর নিপীড়ন, নির্যাতনের ইতিহাস তুলে ধরেন, প্রশ্ন তুলেন বাংলাদেশের সেক্যুলার নেতাদের চরিত্র নিয়ে তখন একদল প্রগতিশীল লোক তাকে বা তাদেরকে হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক হিসেবে চিহিৃত করে ফেলেন। সংখ্যাগরিষ্ঠের অংশ হিসেবে তিনি তা তারা সেটা করতেই পারেন। কিন্তু তার আগে রাষ্ট্রের ইসলামী চরিত্র নিয়ে কথা বলুন। ওআইসি, মদিনা সনদ নিয়ে আগে কথা বলনু। ওগুলো হিন্দুত্ববাদী হলে এগুলোকে কি বলব? জামাতে ইসলাম কিংবা হেফাজত ইসলামকে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সঙ্গে একই তালে সাম্প্রদায়িক সংগঠন বলার চেষ্টাটা স্পষ্ট। পাপ ঢেকে রাখতে হবে…।
[প্রথম প্রকাশ: ১৫ সেপ্টম্বর, ২০১৭]

[“সুষুপ্ত পাঠক এর কলাম” থেকে নেওয়া]