রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে মিথ্যাচার: তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করেছিলেন?

রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে মিথ্যাচার: তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করেছিলেন?
…………………………………………………………………..
জানা যায় ইসলামী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত একটা বই থেকে প্রথম ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করেছিলেন’ বলে দাবী করা হয়। এই দাবীর কোন রেফারেন্স ছিলো না। পরে এই বইটিকে রেফারেন্স করেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল এমএ মতিন বীরপ্রতীক বই লেখেন ‘আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিকতা এবং প্রসঙ্গিক কিছু কথা’ নামে যেখানে একই কথা উল্লেখ করেন। অভিযোগ হচ্ছে, ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ মার্চ কলকাতায় গড়ের মাঠে রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে এক বিরাট জনসভা হয় যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই দাবীর পক্ষে তাদের কোন রেফারেন্স নেই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সেই সব মানুষদের একজন যার প্রতিটি দিনই বলতে গেলে ইতিহাসে ঠাই পেয়েছে। গবেষকদের ছুরির নিচে গিয়ে সেই ইতিহাসকে সত্যাসত্য নির্ণয় করে প্রতিষ্ঠা পেতে হয়েছে। এখানেও আমরা দেখি উল্লেখিত ১৯১২ সালের ২৮ মার্চ রবীন্দ্রনাথ কোলকাতাতেই ছিলেন না! এর সপক্ষে রেফারেন্স হচ্ছে ঐ সময়কার রবীন্দ্রনাথের লেখা চিঠি, কবিতা যার নিচে তারিখ ও সন লেখা ছিলো। এই সঙ্গে রবীন্দ্র পুত্রের স্মৃতিকথা থেকেও আমরা জানতে পারি তিনি কবিকে নিয়ে ২৮ মার্চের আগেই কোলকাতা ত্যাগ করে শিলাইদহ গিয়েছিলেন। ইতিহাস বলছে আগের দিন অধিক রাত পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ নিজের রচিত নাটক বাল্মীকি প্রতিভা মঞ্চস্থ দেখে শাররিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাই পরদিন ১৯ মার্চ ‘সিটি অব প্যারিস’ জাহাজে বুকিং থাকার পরও বিলেত যাত্রা করতে পারেননি। পরে ডাক্তারদের চিকিৎসায় ২৪ তারিখ পর্যন্ত কোলকাতা কাটিয়ে সেদিনই শিলাইদহ উদ্দেশ্যে কোলকাতা ছাড়েন। উল্লেখিত  ২৮ মার্চ তারিখে দেখা যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহ বোটে বসে কবিতা লিখছেন!

রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করবে আর তাঁকে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেকে এনে সংবর্ধনা দিবে তাও হয় নাকি? ঢাকার নবাব তাকে যে আতিথ্যতা দিয়েছিলেন সেকথা মনে করলে বুঝা যায় ঢাকার সঙ্গে কবির চমৎকার সম্পর্ক ছিলো। ১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঢাকা সফর করেন ‘ঢাকাবাসী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ এই দুই ব্যানারে। এই দুই গ্রুপ রবীন্দ্রনাথকে একান্তভাবে তাদের কাছে রেখে আতিথ্যতা দেয়া নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। বিষয়টি কবির কানে গেলে তিনি রমেশচন্দ্র মজুমদারকে লেখেন-
কল্যাণীয়েষু,
ঢাকার জনসাধারণের পক্ষ থেকে আজ আমাকে নিমন্ত্রণ করার জন্য দূত এসেছিলেন। তাঁদের বিশেষ অনুরোধে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই যাত্রা করতে প্রস্তুতি হয়েছি। ৬ই তারিখে রাত্রে রওনা হয়ে গোয়ালন্দ থেকে তাঁদেরই জলযানে ভেসে পড়ব। ১০ই তারিখ পর্যন্ত তাদের আতিথ্য ভোগ করে ওই কর্তব্য অন্তে তোমার আশ্রয়ে উঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিমন্ত্রণ পালন করব। নইলে আমাকে দীর্ঘকাল ঢাকায় থাকতে হয়। আমার সময় নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিঃস্থিত ঢাকার লোকের নিমন্ত্রণ কোনো মতেই উপেক্ষা করা উচিত বোধ করি নে। তাই দুই নিমন্ত্রণ ক্ষেত্রে আমার সময়কে বিভক্ত করে দিলুম। যে কয়দিন তোমাদের দেব স্থির করেছিলুম, সে কয়দিন সম্পূর্ণই রইল।
ইতি ১৬ই মাঘ ১৩৩২—
শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

এবার বলা দরকার ঠিক কি কারণে কোলকাতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধীতা সত্যি সত্যিই ঘটেছিলো। এটা সত্য কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধতা করেছিলেন। কিন্তু এই বিরোধীতা তিনি একা করেননি, অনেকেই করেছে। আলীগড় মাদ্রাসা পর্যন্ত এই বিরোধীতা করেছিলো। কারণটি ছিলো স্বার্থ। আশুতোষ মুখোপধ্যায় ভেবেছিলেন ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় হলে তার প্রভাব কমে যাবে। বাজেট ভাগ হয়ে যাবে। আলীগড় ভেবেছিলো এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে ইংরেজরা মুসলমানদের মাদ্রাসায় ইসলামী শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে ঢাকায় নতুন করে একটা বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে চাইছে। ইতিহাস বলছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় করতে যেমন ঢাকার নবাব পরিবার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তেমন করে পূর্ববঙ্গের হিন্দু জমিদাররাও সে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো। কোলকাতার যে বিরোধীতা তা ছিলো আঞ্চলিকতার। কারণ তখন পূর্ববঙ্গে মুসলমানদের ছেলেরা লেখাপড়া করত কতজন যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে তারা ভরিয়ে ফেলবে? তখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮০ ভাগই হিন্দু ছাত্র। শিক্ষকদের ৮০ ভাগই হিন্দু। ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় হলে সেই সময় পূর্ববঙ্গে হিন্দুদের বিরোধীতার কোন কারণই ছিলো না। কারণ ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হবার কথা তো কেউ তখন কল্পনাও করতে পারেনি। এই সাম্প্রদায়িক স্বার্থ এনেছিলো মুসলমানদের লাহোর প্রস্তাব। সেখান থেকে দ্বিজাতিতত্ত্ব…।

আহমদ ছফা সাহিত্যিক শওকত ওসমানকে ঢাকার ফুটপাথে পশ্চিম বাংলার লেখকদের বই দেখিয়ে বলেছিলো, এদেশে ইন্ডিয়ার বইয়ের বাজারই যদি হবে তাহলে বাল ফেলাইতে দেশ স্বাধীন করছি! এরকম জাতীয়তাবাদী উক্তি করেও আহমদ ছফা কিন্তু আমাদের কাছে অসাম্প্রদায়িক লেখকদের একজন! রবীন্দ্রনাথ এরকম উক্তি করলে আমরা তাকে কি বলতাম? দেশভাগের আগে পূর্ব বাংলা পশ্চিম বাংলা তো কখনই সাম্প্রদায়িকভাবে বিভক্ত ছিলো না। যা ছিলেন সম্পূর্ণ আঞ্চলিকতার স্বার্থ। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় আর ছফার বিরোধীতা কি আসলেই এক? পূর্ব বাংলা পূর্ব পাকিস্তান হয়েছিলেন ‘মুসলমানের দেশ’ হিসেবেই। সেখান থেকেই বাংলাদেশ। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় সেই ১৯১২ সালে কেমন করে ঢাকাকে মুসলমানদের দেশ ভাববেন? আশুতোষ মুখোপাধ্যায় শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধীতা করলেও পরে ঢাকায় শিক্ষক পাঠানোতে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। সাম্প্রদায়িক কীটগুলো কিন্তু এগুলোকে চেপে রাখে…।

কোন রকম যাচাই বাছাই ছাড়াই মনের মাঝে তীব্র রবীন্দ্র বিদ্বেষ, ভারত ও হিন্দুদের প্রতি ঘৃণা না থাকলে এই তথ্যটি (রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধীতা করেছিলেন) কেউ লুফে নিতে পারে না। মুসলমানের রবীন্দ্র এলার্জি নতুন নয়। আরবী নামের মুসলমানদের আত্মপরিচয় সংকট তার নামকরণেই শুরু। বাঙালী মুসলমান ধর্মান্তরিত না আরবী-তূর্কী-আফগান বংশজাত তা নিয়ে ঘোর মতবিরোধ থাকলেও বরাবরই বাঙালী মুসলমান তার দোঁআশ মানসিকতার সংকট প্রমাণ করেছে। রবীন্দ্র বর্জনকারীদের জন্ম আজকের নয়। বলা যেতে পারে আফগান দস্যু আর বণিকরা এসে স্থানীয় রমনীদের গর্ভে তাদের জেনিটিক চিহৃ রাখার পর থেকেই। রবীবন্দ্রনাথ স্বয়ং এদের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন। ‘কথা ও কাহিনী’ কাব্যগ্রন্থের মানি কবিতায় ‘আরঙজেব ভারত যবে/ করিতেছিল খান খান’ লাইনটি মুসলিমরা তাদের “পূর্বপুরুষদের” অপমানিত করা হয়েছে বলে দাবী করে রবীন্দ্রনাথকে ক্ষমা চাইতে বলেছিল। বলেছিল, ঐ লাইন তুলে নিতে হবে…।

রবীন্দ্রনাথের কবিতায় যাদের মুসলানুভূতিতে আঘাত লেগেছিলো তাদের উত্তর পুরুষরাই এখন রবীন্দ্রনাথের লেখা জাতীয় সংগীত বাতিল করার ডাক দিয়েছে। তারাই রবীন্দ্রনাথের নামে মিথ্যা অভিযোগ করছে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করেছিলেন। গত বছর ঢাকার একজন কবি এই মিথ্যাচারটা ফেইসবুকে উঠিয়েছিলো নতুন করে। তাকে যখন ধরিয়ে দিয়েছিলাম তথ্যগুলো অসত্য, আশ্চর্য তবু তিনি তার পোস্ট মুছে ফেলেননি! কি তীব্র বরীন্দ্র ঘৃণা ভাবা যায়! তিনি কিন্তু প্রগতিশীলদের একজন। হুমায়ূন আজাদের ঘনিষ্ঠ হিসেবে সবাই তাকে জানে। কিন্তু কোলকাতা বিদ্বেষ তাকে অন্ধ করে তুলেছে…।

এই অন্ধত্ব বাংলাদেশে আজ সবার! হোসে সারামাগোর ‘ব্লাইন্ডনেস’ উপন্যাসের মত গোটা জাতি আজ অন্ধ হয়ে গেছে…।