হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ব্রিটিশ বাংলা প্রদেশের খুলনা জেলার কুমিরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তবে তাঁদের আদি নিবাস ছিল উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার নৈহাটিতে। তাঁর পারিবারিক পদবী ছিল ভট্টাচার্য। গ্রামের স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের পর হরপ্রসাদ কলকাতার সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুল ও প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশোনা করেন। কলকাতায় তিনি তাঁর বড়দা নন্দকুমার ন্যায়চঞ্চুর বন্ধু তথা বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক ও পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে থাকতেন।
কর্মজীবন
১৮৭৮ সালে তিনি হেয়ার স্কুলে শিক্ষকরূপে যোগদান করেন। ১৮৮৩ সালে তিনি সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। এই সময়ই বাংলা সরকার তাঁকে সহকারী অনুবাদক যুক্ত করে। ১৮৮৬ থেকে ১৮৯৪ সাল পর্যন্ত সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি বেঙ্গল লাইব্রেরিতে গ্রন্থাগারিকের দায়িত্বও পালন করেন। ১৮৯৫ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি লেজের সংস্কৃত বিভাগীয় প্রধান হন।
এরপর ১৯০০ সালে তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হন। ১৯০৮ সালে সংস্কৃত কলেজ থেকে অবসর নিয়ে তিনি সরকারের তথ্যকেন্দ্রে যোগ দেন। ১৯২১ থেকে ১৯২৪ পর্যন্ত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরবাংলা ও সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান। অধ্যাপনা ও সরকারি কাজের পাশাপাশি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দু বছর এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি, বারো বছর বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি এবং লন্ডনের রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির সাম্মানিক সদস্য ছিলেন।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর প্রথম গবেষণাপত্রটি ভারত মহিলা নামে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত বঙ্গদর্শনপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সেই সময় তিনি ছিলেন ছাত্র। পরে হরপ্রসাদ এই পত্রিকার নিয়মিত লেখকে পরিণত হন এবং নানা বিষয় নিয়ে লেখালিখি শুরু করেন। হরপ্রসাদকে ভারততত্ত্ব বিষয়ে আগ্রহী করে তোলেন বিশিষ্ট ভারততত্ত্ববিদ রাজেন্দ্রলাল মিত্র। তিনি রাজেন্দ্রলালের দ্য সংস্কৃত বুদ্ধিস্ট লিটারেচার অফ নেপাল গ্রন্থে সঙ্কলিত বৌদ্ধ পুরাণগুলির অনুবাদ শুরু করেন।
এশিয়াটিক সোসাইটিতে তিনি রাজেন্দ্রলালের সহকারী ছিলেন। রাজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর সোসাইটিতে সংস্কৃত পুঁথি অন্বেষণ বিভাগের পরিচালক হন। অল্প কয়েকজন সহকারী নিয়ে হরপ্রসাদ এশিয়াটিক সোসাইটির দশ হাজার পুঁথির ক্যাটালগ প্রস্তুত করেন।
এই ক্যাটালগের যে দীর্ঘ মুখবন্ধটি তিনি রচনা করেছিলেন, তা সংস্কৃত সাহিত্যের একটি মূল্যবান ইতিহাস। সংস্কৃত পুঁথি নিয়ে চর্চা করতে করতেই হরপ্রসাদ বাংলা পুঁথির বিষয়েও আগ্রহী হয়ে ওঠেন। পুঁথির সন্ধানে তিনি অনেকবার নেপাল গিয়েছিলেন। সেখানেই ১৯০৭ সালে তিনি আবিষ্কার করেন চর্যাগীতি বা চর্যাপদের পুঁথি। এই পুঁথিগুলি নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেন এগুলিই বাংলা সাহিত্যের আদিতম নিদর্শন।
রচনাসমগ্র
১৯১৬ সালে চর্যাপদের পুঁথি নিয়ে রচিত তাঁর গবেষণাপত্র হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় রচিত বৌদ্ধ গান ও দোঁহা নামে প্রকাশিত হয়। হরপ্রসাদ অনেক প্রাচীন গ্রন্থ সংগ্রহ করে প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বহু গবেষণাপত্রও রচনা করেন। তিনি ছিলেন এক তনামা হিস্টোরিওগ্রাফার। স্বীয় কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ লাভ করেছিলেন বহু পুরস্কার ও সম্মান।
তাঁর বিখ্যাত বইগুলি হল বাল্মীকির জয়, মেঘদূত ব্যাখ্যা, বেণের মেয়ে (উপন্যাস), কাঞ্চনমালা (উপন্যাস), সচিত্র রামায়ণ, প্রাচীন বাংলার গৌরব ও বৌদ্ধধর্ম। তাঁর উল্লেখযোগ্য ইংরেজি রচনাগুলি হল মগধান লিটারেচার, সংস্কৃত কালচার ইন মডার্ন ইন্ডিয়া ও ডিসকভারি অফ লিভিং বুদ্ধিজম ইন বেঙ্গল।
উল্লেখযোগ্য কীর্তি :
প্রাচীন সাহিত্য ও পুঁথির উপর তাঁর গভীর অনুরাগ তাঁকে প্রাচীন পুঁথি উদ্ধারে অনুপ্রেরণা দিয়েছে। এই ক্ষেত্রে তাঁর অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। রাজেন্দ্রলাল মিত্রের The Buddhist Sanskril literature গ্রন্থের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে চারবার নেপাল গমন করেন। সেখানকার রাজপ্রাসাদের রয়াল লাইব্রেরী থেকে চর্যাচর্যবিনশ্চয়, কৃষ্ণ ও সরহা বজ্রের দোহা, ডাকর্ণব আবিষ্কার করেন ১৯০৭ সালে। এগুলিকে তিনি বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদের্শন মনের করে ১৯১৬ খ্রীষ্টাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে “হাজার বছরের পুরানো বাংলা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা” নামে প্রকাশ করেন।
গ্রন্থটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষার নবদিগন্তের সূচনা হয়। আবিষ্কৃত চারটি পুঁথির মধ্যে চর্যাচর্যবিনশ্চয়কে গবেষকগণ বাংলা ভাষায় লেখা বলে মেনে নেন। ফলে হরপ্রসাদ বাংলা ভাষার প্রথম পুঁথি তথা নিদর্শন আবিষ্কারের অমর কৃতিত্বের অধিকারী হন। এই গ্রন্থটির আবিষ্কার ও সম্পাদনা বাংলা সাহিত্যের গবেষণায় তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি। এছাড়া তিনি বৃহদ্ধর্ম পূরাণ, সন্ধাকর নন্দীর রামচরিতন ও আর্যদেবের চতুঃশতকও তিনি উদ্ধার করেন।
তথ্যসূত্র:
বাংলা অনার্স পরিক্রমা –এন চৌধুরি
সাহিত্য টিকা- সনৎকুমার মিত্র
বাংলা পিডিয়া – ওয়েবসাইট
বাংলা সাহিত্যের ইতিকথা – ভুদেব চৌধুরী
আরো পড়ুন…