শৈল্য চিকিৎসক জীবক: গৌতমবুদ্ধের চিকিৎসক, জীবক (শৈল্য চিকিৎসক, তক্ষশীলার শৈল্য চিকিৎসা বিদ্যায় জীবক ছিলেন আরেক অনন্য সৃাষ্টি। ইতিহাসবিদদের মতে তার জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৬ থেকে ৪৮৬ অব্দের কোন এক সময়ে। তিনি প্রায় ৭ বছর তক্ষশীলায় চিকিৎশাস্ত্রে অধ্যয়ন করেন।
শৈল্য চিকিৎসক জীবক:
ছাত্রবস্থায় চিকিৎসা শাস্ত্রে তাঁর প্রজ্ঞা নিয়ে একটি গল্প চালু আছে তা হলো- তক্ষশীলার জনৈক শিক্ষক তার ছাত্রদের একটি বাগানে নিয়ে বলেন সেখান থেকে গুন হীন উদ্ভিদ খুঁজে বের করতে। শুরু হল খোজা খুজির প্রতিযোগীতা কিন্তু জীবক বাদে অন্য শিষ্যরা তাদের মতে নির্গুণ উদ্ভিদ হাত বোঝাই করে এনে তুলে দেন গুরুর হাতে।
কিন্তু জীবক অনেক খোজা খুজি করে ক্লান্ত হয়ে ফিরে এলেন ভগ্ন হৃদয়ে শুন্য হাতে। ফিরে এসে তাঁর শিক্ষককে জানালেন তিনি এমন কোনো উদ্ভিদ খুঁজে পাননি যার ভেতরে কোন না কোন গুণ নেই। শিক্ষক যারপরনাই খুশি হয়ে বলল্লেন একমাত্র জীবকের শিক্ষাই সম্পূর্ণ হয়েছে।
এছাড়াও রাজা প্রসেনজিত, সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত, মোহালির মত আরো অসংখ্য ইতিহাসিক ব্যক্তিত্ব রাত-দিন নীরব নিভৃতে সুনিপুন ভাবে তৈরী করে গেছে এই মহান প্রতিষ্ঠানটি।চাণক্য, আত্রেয়, বিষ্ণু শর্মা, নাগার্জুনের মত ইতিহাস খ্যাত প্রথিযশা জ্ঞান তাপস পন্ডিত ব্যক্তিদের শিক্ষক রূপে পেয়ে তক্ষশীলার সুখ্যাতি পৌঁছে গিয়েছিল অনতিক্রম্য উচ্চতায়, দ্রুত নজর কেড়েছিল বিশ্ব দরবারে।
তক্ষশীলার খ্যাতির পরশ গ্রিক সেনাপতি আলেকজেন্ডারকে এতটাই তন্ময় করেছিল তিনি তক্ষশীলা দখল করার পর সাথে করে কিছু শিক্ষক বগল দাবা করে নিয়ে গিয়েছিলেন প্রাচীন শিল্প সভ্যতায় উন্নত গ্রীক সভ্যতাকে আরো গতিশীল করার মানসে।
ছাত্রদের সুশিক্ষা, পন্ডিত শিক্ষকদের সৎ,মানবিক, সুস্থ চিন্তা চেতনার বহিঃপ্রকাশ শুধু বাক সর্বস্ব ছিল না, তার প্রয়োগিক চর্চা করতেন তাদের ব্যবহারিক জীবনে। আমারা তার ঐতিহাসিক প্রমান পাই আলেকজেন্ডারের আগ্রাসী আক্রমনে যখন গৃহ, সহায়-সম্বল, ভিটা-মাটি অর্থ-বিত্ত সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে হাজার হাজার মানুষ জীবন বাঁচতে তক্ষশীলার কোলে আশ্রয় নেয়।
এই অনাকাঙ্খিত উদ্ভুত পরিস্থিতিতে কি করা উচিত তা নিয়ে তক্ষশীলার রাজা এক পরামর্শ সভার আয়োজন করে। সে সভায় তক্ষশীলার শিক্ষক মন্ডলি এই সব উদ্বাস্তু লোকদের তক্ষশীলায় ভূমি দানে তাঁদের পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন।
হাজার বছর ধরে ভারতীয় উপমহাদেশের শিক্ষা, শিল্প, সভ্যতাকে প্রগতির পক্ষে পরিচালিত করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিকে উৎপত্তি বিলয়ের জাগতিক ব্যতয়হীন নিয়ম রক্ষার্থে বোধহয় তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে গেছে সাম্রাজ্যবাদী পারস্য, গ্রীক, রোমান, শক, কুষান, আক্রমণ।
এই সব আক্রমনে সৃষ্ট অস্থির রাজনৈতিক ঘোর অন্ধকার পরিমন্ডলে আগুয়ান অনিশ্চিত ভবিষ্যতের নিরাপত্তাহীনতার দুশ্চিন্তায় ক্রমে ক্রমে হ্রাস পেতে শুরু করে শিক্ষক ও ছাত্র সংখ্যা। ৪৫০ খ্রীষ্টাব্দে সর্ব শেষ আক্রমণটি আসে হুন দের পক্ষ থেকে।
এভাবে বার বার সাম্রাজ্যবাদীর হিংস্র থাবার কবলে পড়ে ধীরে ধীরে মৃত্যু গ্রাস করে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন বিশ্ব বিদ্যালয়টিকে। স্তব্দ হয় তার পথ চলা। শোকের মাতমে যেন অব্যবহৃত ইট সুড়কির দালান কোঠা গুলোতে ধুলোর আস্তর ঢেলে স্মৃতি সমাধি তৈরী করে প্রকৃতি নিজের হাতেই।
যৌবনের সব গৌরব হারিয়ে ভগ্ন জীর্ণ শীর্ণ তক্ষশীলা ১৯৮০ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক world heritage site হিসাবে স্বীকৃতি পায়।
জীবক কুমারভচ্চ খ্রিস্টপূর্ব ৫৪০ সনে মগধের রাজধানী রাজগৃহ নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন।রাজগৃহের বর্তমান নাম রাজগীর। জীবক কুমারভচ্চ মগধ রেশ বিম্বিসার ও অজাতশত্রুর সমসাময়িক ছিলেন। জীবকের মাতা ছিলেন শালবতী নাম্নী গণিকা যিনি জন্মের পরই তাকে আস্তাকুঁড়ে ফেলে আসেন। মহারাজ বিম্বিসারের পুত্র অভয় কুমার তাকে কুড়িয়ে পান এবং নিজের প্রাসাদে নিয়ে লালন পালন করেন।
জীবনী
মহারাজ বিম্বিসারের পুত্র অভয় কুমার বনের মধ্যে এক পরিত্যাক্ত সদ্যোজাত শিশুকে কুড়িয়ে পেয়ে তাকে পরম যত্নে নিজ প্রাসাদে এনে লালন পালন করেন। মৃত্যুর জন্য পরিত্যক্ত হয়েও নবজাতক জীবিত রয়েছে, তাই তার নাম দেন জীবক। তিনি শিশুর লালন পালনের সাথে সাথে তাকে নানান শাস্ত্র ও শিক্ষায় পারদর্শী করে তোলেন।
মগধের পাঠ শেষ হলে অভয় কুমার জীবককে উচ্চশিক্ষার জন্য তক্ষশীলা পাঠান। তক্ষশিলাতে বিশ্ব বিখ্যাত আয়ুর্বেদ আচার্যের কাছে জীবক আয়ুর্বেদ শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। তার শিক্ষা প্রায় সমাপ্ত হলে আচার্য তাকে তক্ষশিলাকে কেন্দ্র করে এক যোজন দূরত্ব থেকে এমন একটি উদ্ভিদ সংগ্রহ করে আনতে বলেন যার মধ্যে কোন ঔষধী গুণ নেই।
জীবক সারাদিন বাদে ফিরে এসে আচার্য্যকে জানালেন যে তিনি এমন কোন উদ্ভিদ দেখেননি যার কোন প্রকার ঔষধী গুণ নেই। আচার্য অত্যন্ত প্রীত হয়ে বললেন যে জীবকের শিক্ষা সম্পুর্ণ হয়েছে। তিনি তাঁকে স্নাতক উপাধি ও প্রমাণপত্রের সাথে কিছু অর্থ দিয়ে মগধে ফিরে গিয়ে স্বতন্ত্রভাবে চিকিৎসা শাস্ত্র চর্চা করার নির্দেশ দেন।