কুরআনের মৌমাছি বিদ্যা ও ফেইসবুক মোল্লাদের নোবলে চুরির দাবী!
……………………………………………………………………………..
কুরআন বর্ণিত মৌমাছির জীবনচক্র আর আধুনিক বিজ্ঞান আবিস্কৃত মৌমাছির জীবনচক্র মিলে গেছে অতএব কুরআন কোন অনন্ত বুদ্ধিমান সত্ত্বার লেখা এবং ইসলাম সেই সত্ত্বার একমাত্র মনোনীত ধর্ম!… আপনি যদি গুগলে মৌমাছি লিখে সার্চ দেন তাহলে এই ধরণের ‘ইসলামী বিজ্ঞানময়’ পোস্ট শত শত আসতে দেখবেন। এসব পোস্ট পড়লে আপনি যদি বিজ্ঞান সম্পর্কে বেশ ভাল ধারণা রাখেনও তবু বিব্রত হবেন কারণ এসব পোস্টে কার্ল ফন ফ্রিশ নামে এক অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানীর দোহাই দিয়ে মৌমাছির জীবনচক্র কুরআনের সঙ্গে প্রমাণের চেষ্টা করা হয়েছে।
কার্ল ফন ফ্রিশ মৌমাছির জীবনচক্রর উপর এই অসাধারণ আবিস্কারের জন্য ১৯৭৩ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ইসলামবাদীদের দাবী নাসারা কার্ল ফন যেটা আবিস্কার করে নোবেল পেয়েছে সেটাই আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে কুরআনে পরিস্কার করে লেখা! কেউ কেউ এক ধাপ এগিয়ে এসে দাবী করে ফন কুরআন পড়েই এটা আবিস্কার করেছিল ইত্যাদি ইত্যাদি…। ইন্টারনেটে এইরকম এন্টি-সায়েন্সমূলক ইসলামী পোস্টে ছয়লাব হয়ে গেলোও নাস্তিক-মুক্তমনাদের এই বিষয়ে কোন পোস্ট খুঁজে এক দুর্লভ ঘটনা। আমি অন্তত কিছু খুঁজে পাইনি। কারণটা সম্ভবত আমরা এখন নিজেদের নানা গোত্র আর তাঁবুতে ভাগ করে ‘আমি-আমি’ চাষে মত্ত। একটা তরুণ এইসব হাবিজাবি পোস্ট পড়ে কুনআনের মত হাজারটা বর্বর, অমানবিক আইন ও নির্দেশ লেখা বইকে মহা বিজ্ঞানময় কিতাব ভেবে সেগুলোকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করলে আমাদের কি-ই বা আসে যায়? দুই-তিন লাইনের একটা পোস্ট দিয়ে দেড় হাজার লাইক পেলে কষ্ট করে কে আর খাটতে চায়? যাক, বাদ দেন, মূল আলোচনায় আসি। মহা বিজ্ঞানময় কিতাবে আসলে কি লেখা আছে সেটাই বরং দেখি-।
ফেইসবুক মোল্লাদের দাবী কুরআনই সর্বপ্রথম মৌমাছিকে স্ত্রী লিঙ্গ সম্বধন করে তাদেরকে চাক বানতে নিদের্শ দেয়ার কথা বলা হয়েছে, এর আগে মানুষ জানত পুরুষ মৌমাছিই চাক বানানোসহ মধু সংগ্রহের কাজ করে থাকে। ফেইসবুক মোল্লাদের দাবী, কার্ল ফান এই সেদিন আবিষ্কার করে দেখিয়েছেন স্ত্রী মৌমাছিই আসলে সব কাজ করে থাকে, এখানে পুরুষ মৌমাছির কোন ভূমিকাই নেই। বেশ, খুব ভাল কথা। এবার আসুন একটু একটু করে এগুনো যাক। তার মানে কি আমরা ধরে নিবো কার্ল ফান গত শতকের চল্লিশের দশকে যে আবিস্কারটি করেছেন তার আগে গোটা পৃথিবীর মুসলিম বাদে বাকীরাই জানত মৌমাছিদের মধ্যে পুরুষরাই চাক ও মধু সংগ্রহের কাজ করে থাকে? মানে ফনের আবিস্কারের আগে সোয়াশো কোটি মুসলমান ঠিকই জানত স্ত্রী মৌমাছিই কর্মী মৌমাছি আর বাকী অমুসলিম জনগোষ্ঠি জানত এটি পুরুষ মৌমাছির কাজ? কারণ ফেইসবুক মোল্লারা কুরআনে সুরা নাহলের ৬৮ নম্বর আয়াত তুলে দিয়ে বলছেন এখানে পরিস্কার স্ত্রী মৌমাছির কথাই নাকি বলা হয়েছে। সুরা নাহলের ৬৮ নম্বর আয়াত বলছে, ‘ওয়া আওহা রাব্বুকা ইলান নাহলি আনিত্তাখিযি মিনাল জিবালি বুইঊতাও ওয়া মিনাশ শাজ্বারি ওয়া মিম্মা ইয়ারিশুন’। অর্থ্যাৎ, আপনার প্রতিপালক মৌমাছিকে ওর অন্তরের ইঙ্গিত দ্বারা নিদের্শ দিয়েছেন: তুমি গৃহ নির্মাণ করো পাহাড়ে, বৃক্ষে এবং মানুষ যে গৃহ নির্মাণ করে তাতে’। আমি আরবী ভাষার পন্ডিত নই। তবে ফেইসবুক মোল্লারা সম্ভবত তাফসিরকারকদের চেয়ে বড় ইসলামী পন্ডিত। এই উপমহাদেশেই মাওলানা মওদুদি, মাওলানা আকরাম খাঁসহ বহু ইসলামিস্ট কারোরই চোখে পড়ল না এত বড় আবিস্কারটি! গেল শতাব্দির চল্লিশের দশকে কার্ল ফন আবিস্কারে যখন চারদিকে সাড়া পড়ে গিয়েছিল তখন আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন মৌলবী সুরা নাহল দেখিয়ে কেন দাবী করল না ১৪০০ বছর আগেই এটা কুরআনে লেখা আছে? আরবী কি ফেইসবুক মোল্লাদের চেয়ে তারা কম বুঝত? আরবীতে পুরুষ মৌমাছিকে ‘ইত্তাখিজ’ আর স্ত্রী মৌমাছিকে ‘ইত্তাখিজি’ বলা হয়। এরকমটাই দাবী ফেইসবুক মোল্লাদের। বাংলায় অনেকটা জেলে আর জেলেনীর মত বোধহয়। তা আল্লাহ কি মাছ ধরতে জেলেনীকে নিদের্শ দিবে না জেলেকে? মাছ ধরে জেলে, জেলের বউ স্রেফ জেলেনী। তাহলে কুরআন মৌমাছি বলে কি কোন লিঙ্গকে নির্দিষ্ট করে কিছু বলেছে? এ জন্য আপনাদের প্রথমেই মৌমাছির জীবনচক্রকে জানতে হবে। আসলে মৌমাছি বলতে আমরা যাদের বুঝি তাদেরকে কর্মি মৌমাছি বলা হয়। চাকের ভেতর একটি রানী মৌমাছি ছাড়া কিছু পুরুষ মৌমাছিও বাস করে। এদের ভূমিকা কেবলই প্রজনন ছাড়া মৌমাছিদের চাক ও মধু সংগ্রহের কোন কাজই এরা আসে না। তার মানে মৌমাছি বলতে আসলে তথাকথিত কর্মী মৌমাছিদেরই বুঝিয়ে থাকে। এই কর্মী মৌমাছিরা আসলে ক্লীব অর্থ্যা কোন লিঙ্গের মধ্যে পড়ে না। রানী মৌমাছি এদের জন্ম থেকেই খোজা করে তুলে। একইভাবে রানী ও পুরুষ মৌমাছি জন্মের বিষয়েও তার প্রত্যক্ষ হাত রয়েছে। ডিম পাড়ার সময় হলে রানী মৌমাছি চাকের উপর প্রত্যেকটি শূন্য কুঠরিতে একটি করে ডিম পাড়ে। চাকে তিন ক্যাটাগরির কুঠরি তৈরি করা থাকে। ছোট, মাঝারী ও বড়। রানী মৌমাছি কর্মী অর্থ্যাৎ ক্লীব মৌমাছির জন্য ছোট কুঠরিতে ডিম পারে। মাঝারিতে পুরুষ ও বড় ঘরে ‘রানী’ উৎপাদন করার জন্য। বিষয়টি অলৌকিক কিছু নয়। ছোট কুঠরিতে ডিম পাড়ার সময় নারী মৌমাছির পশ্চাদ্ভাগ চাপ লেগে বা ইচ্ছাকৃত চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে অভ্যস্তরস্থ থলি থেকে পুং-রস নির্গত হয়ে ডিমকে নিষিক্ত করে দেয়। পুরুষ মৌমাছিকে জন্ম দেবার ঘরটা অপেক্ষাকৃত বড় বা ইচ্ছাকৃতভাবে পুংরস নির্গত না করার ফলে ডিমটি অনিষিক্ত থেকে যায়। এই অনিষিক্ত ডিম থেকেই পুরুষ মৌমাছির জন্ম হয়ে থাকে। রানী ও কর্মী মৌমাছি প্রজনন, আকৃতি ও বৈশিষ্টগত তফাত হলেও এদের দুজনকেই স্ত্রী জাতিতে ফেলা হয়। রানী মৌমাছির জন্ম পুংরসে নিষিক্ত ডিম থেকেই, কিন্তু প্রচুর পরিমাণে রয়েল জেলি ও বড় পরিসরের জায়গায় থাকার ফলে আকার ও প্রজনন ক্ষমতা তার অটুট থাকে। মৌচাকে মাত্র একটি রানী মৌমাছিই জীবিত থাকে। এই রানীকে শুক্রানুতে ভরিয়ে দেয়ার দায়িত্ব পুরুষ মৌমাছির। বাকী শত শত ‘কর্মী মৌমাছি’ তারাই চাক, খাদ্য সংগ্রহসহ সব রকম পরিচর্যা এমনকি নীতি নির্ধারক সব কিছুই করে থাকে। (বিস্তারিত:http://bigyan.org.in/bengali-science-article-online-archive-gopalchandra-bhattacharya-banglar-keet-ptongo/?print=print) কুরআন কি তাহলে এই তিন প্রকারের মৌমাছিকে আলাদা করে বুঝিয়ে কিছু নির্দেশ করেছে? তার আগে আপনি এটা মাথায় রাখুন আরবীতে যদি স্ত্রী মৌমাছিকে বুঝাতে আলাদা শব্দ থেকে থাকে তার মানে আরবরা মৌমাছিদের পুরুষ ও নারী এই দুইভাবে চিনত। শব্দটি তো আর কুরআন নিজে সৃষ্টি করেনি। যদি করত তাহলে সেটা তাফসিরকারকদের দৃষ্টি এড়াত না। যে শব্দ আরবী ভাষাতে নেই এরকম নতুন শব্দকে ব্যাখ্যা তাদের করতেই হতো। কিন্তু প্রসদ্ধি কোন তাফসিরকারক সুরা নাহলের তাফসির করতে গিয়ে এই বিষয়ে কোন কথাই বলেননি। তার মানে শব্দটি আরবরা ব্যবহার করত। আরবদের মৌমাছি সম্পর্কে জ্ঞান থাকাটাও খুব আশ্চর্য ঘটনা নয়। ইতিহাস বলছে প্রাচীন গ্রিসে হিপোক্রেটিস রোগীর ক্ষত সারানোর জন্য মধু ব্যবহার করতেন। খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ অব্দে অর্থ্যাৎ খ্রিস্টের জন্মের ৪০০ বছর আগে হিপোক্রেটিস চিকিৎসা বিজ্ঞানের উপর যে বইগুলো লিখেছিলেন সেগুলোই নবী মুহাম্মদের সময়কালে আলেকজান্দ্রিয়া শহরে চিকিৎসা বিদ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ে পাঠ্য ছিল। গেলেনের ২৬টি বই ঐ মেডিকেল বিদ্যালয়ে পড়ানো হতো। আগের একটা লেখায় বলেছি মুহাম্মদের চাচাতো ভাই হারিস ইনবে কালাদা কালেকজান্দ্রিয়ায় গিয়ে ঐ বিদ্যালয়ে পাঠ করে চিকিৎসক হয়ে ফিরে এসে মক্কায় প্র্যাক্টিসও করেছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ১২৩ অব্দে ভারতবর্ষে চিকিৎসাবিদ চরক মায়ের পেটে ভ্রণ সম্পর্কে বিস্তরিত আলোচনা করে ফেলেছেন। তাহলে কি আমাদের একথা মানতে হবে যে আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে পৃথিবী ঘোর অন্ধকাচ্ছন্ন ছিল? মৌমাছিদের চাকের ভেতরের জীবন সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না? মরুভূমির রাখালদের সে সম্পর্কে জ্ঞান না-ই থাকতে পারে কিন্তু আরবের শিক্ষিত লোক যারা হারিসের মত গ্রীক বিজ্ঞান সম্পর্কে পড়াশোনা করতেন তাদের তো কিছু অজানা ছিল না। সেই খ্রিস্টপর্ব কাল থেকে রোমানীয়দের কাছে মৌমাছিদের গায়ে লেগে থাকা পরাগ রেণুকে ‘জীবনদানকারী পরাগ’ বলে বিবেচিত হতো। মৌমাছির আবির্ভাব আদিম মানুষের জন্মের সাড়ে পাঁচ কোটি বছর আগে। আদিম জনগোষ্ঠির গুহা চিত্রেও তাদের মধু শিকারের চিত্র পাওয়া গেছে। খ্রিস্টপূর্ব কালে প্রাচীন মিশরে মৌমাছি পালনের কথা জানা যায় মধু সংগ্রহের জন্য। ব্যবিলনের সম্রাট প্রজাদের মৌচাষ করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। খ্রিস্ট জন্মের প্রথম শতকে এসেরিয়াককে ‘মধুর দেশ’ নামে ডাকা হতো। কিংবদন্তি আছে কবি ভার্জিল (খ্রিস্টপূর্ব) বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে মৌমাছিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। খ্রিস্টপূর্ব ভারত, চীন ও মিশরে মধুকে ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। মৌচাকে পাওয়া প্রপোলিস ছিল জনপ্রিয় এ্যান্টিসেপটিক। এসবই ঘটেছিল নবী মুহাম্মদের জন্মের শত শত বছর আগে। মানুষ যখন মৌমাছিকে চাষের কাজে লাগিয়ে ফেলেছিল সেখানে মানুষ মৌমাছির জীবনচক্র সম্পর্কে যে খুব ভাল ধারণা রাখত সেটা তো নিশ্চিত। আর সব প্রাণীর মত মৌমাছিদেরও নারী-পুরুষ মিলনে তাদরে বংশ বিস্তার ঘটে এটা জানতে তো কুরআন লাগেনি মানুষের। কাজেই মানুষ মুহাম্মদ ও তার কুরআন আসার হাজার বছর আগে থেকে মধু চাষ করতে গিয়ে দেখেছে মৌমাছিদের দুটো দলের একটি মধু সংগ্রহের কাজ করে থাকে এবং অন্যটি কোন কাজই করে থাকে না। পতঙ্গদের যৌন ক্রীড়া লক্ষ্য করে কোন মানুষেরই সন্দেহ থাকার কথা নয় কোনটি পুরুষ আর নারী। মৌচাকে তিন প্রকারের মৌমাছি তো সেই খ্রিস্টপূর্বকালেও ছিল। আমাদের কি এটুকু বুঝতে অসুবিধা হবে যে খ্রিস্টের জন্মের চারশো বছর আগেই মৌমাছিদের প্রজনন ক্রীড়া দেখে মানুষ বুঝতে পেরেছিল। যদি ধরে নেই মৌমাছিদের ডিটেইলস জীবনচক্র বুঝতে তথনো মানুষ ব্যর্থ ছিল, তবু মৌমাছিদের এত কাছাকাছি মানুষ যখন কৃষক হয়ে চলে এসেছিল সে অবশ্যই খুব কাছ থেকেই মৌচাকের জীবনকে দেখতে সক্ষম হয়েছিল। তার জন্য তাকে বিজ্ঞানী হতে হয়নি। তাহলে কার্ল ফন যে স্ত্রী মৌমাছি আবিস্কার করে নোবেল পেয়ে গেলেন তার কি হবে? হ্যাঁ, এখানেই আসল কথাটা রয়ে গেছে। আর সব ‘ইসলামী বিজ্ঞানের’ মত এখানেই ইতরামিটা করেছে ফেইসবুক মোল্লারা। কার্ল ফন আসলে স্ত্রী মৌমাছিই মধু সংগ্রহ ও চাক নির্মাণ করে সেটা আবিস্কার করেনি, তার মৌলিক আবিস্কার ছিল মৌমাছি আসলে কি করে বহু দূর থেকে মধু সংগ্রহ করে এসে ফের নির্ভুলভাবে চাকে ফিরে আসে। মৌমাছিদের এতটুকু পথ ভুল হয় না এই কাজটি করতে। ফন এই রহস্যটিই আবিস্কার করেছিলেন। কিন্তু ‘ইসলামী বৈজ্ঞানিকরা’ এটাকে সুরা নাহলের সঙ্গে জুড়ে একটা খিচুরী পাকিয়েছে বেশ কৌশল করে। এটি করতে গিয়ে অবশ্য সুরা নাহলের ৬৯ নম্বর আয়াতটির মান ইজ্জত খুইয়ে ফেলেছে। সেটা বলার আগে আমাদের নিশ্চয় এখন কোন সন্দেহ নেই কুরআনের পুরুষবাচক-স্ত্রীবাচক শব্দ আসলে কোন মৌলিক কথাই প্রকাশ করেনি। ইসলামপন্থিদের প্রলাপ ‘সেই ১৪০০ বছর আগে যখন পৃথিবীতে খালি গরু ছাগল বসবাস করত’ এই রকম ধারণা দেয়াটা যে কতখানি অসত্য তা গ্রীক সভ্যতার জ্ঞান ও বিজ্ঞানের আবিস্কারগুলো সম্পর্কে আপনার প্রাথমিক ধারণা থাকলেই বুঝতে পারবেন। তাহলেই ১৪০০ বছর আগে ভেড়া-ছাগল চড়ানো কোন জাতি চিন্তার বাইরে উন্নত জ্ঞান বিজ্ঞানের তখনকার পৃথিবী সম্পর্কে আর বিভ্রান্তি তৈরি হবে না।
সুরা নাহলের ৬৯ নম্বর আয়াত কি বলেছে দেখুন, ‘এরপর প্রত্যেক ফল হতে কিছু কিছু আহার কর, অতঃপর তোমার প্রতিপালকের সহজ সরল পথ অনুসরণ করো। ওর উদর হতে নির্গত হয় বিভিন্ন বর্ণের পাণীয় যা মানুষের জন্য রয়েছে বিবিধ রোগমুক্তি, অবশ্যই এতে রয়েছে নির্দশন চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য’।
কুরআন বলছে মৌমাছি প্রত্যেক ফল হতে কিছু কিছু খায় এবং তার পরবর্তীতে তাদের পেট থেকে মধু নিগৃত হয়। এই ধারণা সঠিক নয়। মৌমাছি ফল খায় না, তারা ফুলের রেণু থেকে মধু সংগহ করে। কুরআনের এই ছোটখাটো ভুল নিয়ে কথা বলার আপাতত কোন আগ্রহবোধ করছি না। বরং এই আয়াতকে কেন্দ্র করে ফেইসুক মোল্লাদের গাঁজায় দম দেযার কীর্তি প্রকাশ করাই বাঞ্ছনীয় মনে করি। মৌমাছিদের চাক থেকে দূর বনের কোন গাছের ফুলের সন্ধান পেয়ে নির্ভুল পথ পাড়ি দিয়ে চাকে ফিরে এসে দলের সদস্যদের সেই ফুলের সন্ধানের সংবাদ দেয়া এবং দল বেধে সেই পথ চিনে মধু সংগ্রহ করে ফের নির্ভুলভাবে চাকে ফিরে আসা দেখে মানুষ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছে হাজার হাজার বছর আগে থেকে। মানুষ ভাবত কে তাদের পথ চিনিয়ে দেয়? নিশ্চয় এমন কেউ একজন আছেন যিনি ওদের এই অলৌকিক ক্ষমতাটা দিয়েছেন। আর তিনি ঈশ্বর ছাড়া আর কে হবেন! এই রকম জীবজগতের বিস্ময়কে পৃথিবীর প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ থেকে শুরু করে তাওরাত-বাইবলে-কুরআন সবখানেই মহান ঈশ্বরের অলৌকিক জ্ঞান দানের কথা বলা হয়েছে। কুরআন যেমন নাহলের ৬৯ আয়াতে মৌমাছির পথ চিনে নেয়ার রহস্যকে ‘অতঃপর তোমার প্রতিপালকের সহজ সরল পথ অনুসরণ করো’ বলে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে ফেলেছে। এই ধরণের গাঁজাখুরি দাবী নিয়ে মানুষ সন্তুষ্ঠ থাকলে সভ্যতা এগুতো না। কার্ল ফনদের মত বিজ্ঞানীরা কোন ধর্মগ্রন্থের ঈশ্বরের বাকোয়াজে আস্থা রাখেন না বলেই চিন্তা করেছেন কিভাবে মৌমাছি পথ চিনে বাড়ি ফিরে? এগুলো যে অলৌকিক কিছুর নিদর্শন বা ব্যাখ্যাতিত কিছু নয় সেটাই গেল শতাব্দির ৪-এর দশকে তিনি আবিস্কার করে প্রমাণ করেছেন। ফেইসবুক মোল্লারা মৌমাছির এই নির্ভুল পথ চিনে আসাকে কুরআনের সুরা নাহলের ৬৯ আয়াতের ‘অতঃপর তোমার প্রতিপালকের সহজ সরল পথ অনুসরণ করো’ লাইনকে কার্ল আবিস্কৃত মৌমাছির নির্ভুল পথ চিনে আসার ইঙ্গিত বলে দাবী করেছে! এটা শুনে আপনি হাসবেন নাকি মাথার চুল ছিড়বেন সেটা নির্ভর করছে মৌমাছি কি করে পথ চিনে মধু সগ্রহ করে আবার নির্ভলভাবে চাকে ফিরে যায় তার বৈজ্ঞানিক কারণটি জানার উপর। সম্ভবত আপনি হাসতে হাসতেই মাথার চুল ছিড়বেন মানুষের চরম চিন্তা শক্তির অপচয় দেখতে পেয়ে…।
মৌমাছির এই পথ চিনে নির্ভুলভাবে বাড়ি ফেরা এমন কিছু কারণে ঘটে না যার কোন ব্যাখ্যা নেই। অর্থ্যাৎ তাদের জন্মগত কোন ক্ষমতা নেই যেটার কারণে যেখানে খুশি উড়ে গিয়ে আবার পথ চিনে বাড়ি ফিরে আসে। বরং পৃথিবীর ফিজিক্সের নিয়ম মনে মৌমাছি তার বাড়ি ফিরে আসে কোন ভুল ছাড়াই। কিন্তু ফেইসবুক মোল্লারা লাফাচ্ছে এর কারণ নাকি কুরআনের ‘অতঃপর তোমার প্রতিপালকের সহজ সরল পথ অনুসলণ করো’ এটা মধ্যে রয়েছে। কার্ল যেটা এই সেদিন আবিস্কার করেছে সেটাই ১৪০০ বছর আগে আল্লাহ কুরআনে লিখে দিয়েছে ‘আমার দেখানো পথ অনুসরণ করো’! কি প্যাথিটিক চিন্তাবিদ এরা ভাবলেই বিবমিষা খেতে হয়!… আসুন মৌমাছির পথ চিনে বাড়ি ফেরার আসল কারণটি জেনে লেখাটি শেষ করি।
ঘটনাটি এরকম, মধু সংগ্রহ করতে চাক থেকে প্রথমে কয়েকটা মৌমাছি কাছে-দূরের বন বা বাগান থেকে যথেষ্ঠ পরিমাণ ফুলের পরাগ রেণুর সন্ধান নিয়ে আসে। সেটি পাওয়ার পর মৌমাছিটি চাকের অবিশষ্ট সদস্যদের সামনে একটি বিশেষ নাচ নাচতে শুরু করে যাকে বিজ্ঞানীরা ‘Waggle Dance’ নামকরণ করেছেন। এই নাচ দেখে বাকী সদস্যরা বুঝে ফেলে ফুলের সন্ধান পাওয়া গেছে। তখন ফুলের সন্ধান পাওয়া মৌমাছিটি বাংলা ৪ সংখ্যার মত করে ঘুরে ঘুরে একটা নৃত্য করতে করতে উড়তে থাকলে (ছবি সূত্র: https://commons.wikimedia.org/wiki/File:Bee_dance.svg ) চাকের বাকীরা তাকে অনুসরণ করে তার বিশেষ কায়দার নাচটিকে লক্ষ্য করতে থাকে। বাংলা ৪ সংখ্যার আকারের নাচার পথে মাঝখানের অংশে মৌমাছিটি তার পিছনটি যেদিকে ঘুরিয়ে দেয়া সেটি দেখে বাকী মৌমাছিগুলো বুঝতে পারে ফুল গাছের অবস্থান ঐদিকে। ফুলের অবস্থান হচ্ছে ভেক্টর রাশি। এদিকে আলো হচ্ছে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ। তরঙ্গের একটি তড়িৎ ও চুম্বকীয় ভাগ থাকে আর এ দুটি ভেক্টর রাশি। তাই তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ একটি ভেক্টর তরঙ্গ তাই এর একটি দিকও থাকে। সূর্যের আলো আমাদের পৃথিবীর বায়ুমন্ডল ভেদ করে আসার সময় বায়ুমন্ডলের উপরিভাগের আয়নগুলির প্রভাবে একটি দিক তৈরি করে যা সূর্যের দিককে নির্দেশ করে। একে বলা হয় ‘polarized’। সাধারণত বৈদ্যুতিক ভাগের দিককে polarized বলে ধরা হয় তাই আলোর বৈদ্যুতিক ভাগের polarized হয় সূর্যের দিকে। বিস্তারিত যারা জানতে চান তারা ঘুরে আসুন (Asian Honey Bees: Biology, Conservation, and Human InteractionsBy Benjamin P. Oldroyd, Siriwat Wongsiri
)। সমস্যাটা হচ্ছে মানুষের চোখে এসব ধরা না পড়লেও মৌমাছিরা ঠিকই বুঝতে পারে। এরকম ঘটনা অবশ্য জীব জগতে বিচিত্র নয়। কুকুর-বেড়াল জাতীয় প্রাণীর শ্রবণ ক্ষমতা মানুষের চেয়ে বেশি থাকে। বাদুর রাতের আঁধারে তরঙ্গ অনুসরণ করে বহু দূরের গাছে ফলের সন্ধান করতে পারে। একইভাবে মৌমাছিরা সূর্যকে তাদের দিক নির্ণয়ের কম্পাস হিসেবে ব্যবহার করে। প্রাচীনকালে মানুষ আকাশের তারাকে কেন্দ্র করে তাদের দিক নির্ণয় করত। মৌমাছিরা ঠিক সেই কাজটিই করে থাকে। মৌমাছিরা পৃথিবীর অভিকর্ষ’র বিপরীত দিককে সূর্যর অবস্থান হিসেবে চিহিৃত করে থাকে। এটাই তাদের দিক নির্ণয়ের মূল কৌশল। এছাড়া পথের দুরত্ব বুঝাতে মৌমাছিরা একটি বিশেষ কৌশল ব্যবহার করে থাকে। যদি ফুলের জায়গাটি অনেক দূরের পথ হয় তাহলে মৌমাছিটি মাঝের অংশের নাচটি দীর্ঘক্ষণ ধরে নেচে সবাইকে বুঝিয়ে দেয় জায়গাটি বেশ দূরের পথ। বিজ্ঞানীরা বলেছেন এক সেকেন্ড ধরে নাচলে ফুলটির দুরত্ব এক কিলোমিটার পর্যন্ত হবে। কার্ল ফন এই মৌলিক আবিস্কারটিই তার গবেষণায় ব্যাখ্যা করেছিলেন। এবার খেয়াল করুন কুরআনের মহা বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ‘অতঃপর তোমার প্রতিপালকের সহজ সরল পথ অনুসরণ করো’ এটি চুরি করে কার্ল ফন মৌমাছির নির্ভুল পথ চিনে নেওয়ার রহস্য ভেদ করেছেন- যারা এরকম আজগুবি কল্পনা করতে পারে তাদের আহম্মক বলবেন কিনা আপনাদের বিষয় তবে নিশ্চিত হাসাহাসি করবেন তাতে কোন সন্দেহ নেই! এই পৃথিবীর খেজুর আঙ্গুর ফলনের সমস্ত কৃতিত্ব আল্লাহ। বিজ্ঞানীরা এসব ফলনের সমস্ত রহস্য ভেদ করেছেন এই সেদিন অথচ আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে এই রহস্য ভেদ করে বসে আছে কুরআন। কিভাবে? আল্লাহ বলেছেন হও আর হয়ে গেলো… সুবাহানাল্লাহ!… এইসব হাস্যকর ইসলামী ছাগলামী করে ফেইসবুক মোল্লারা প্রকৃত অর্থে বার বার এটাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন কুরবান কোন গন্ডমূর্খ বলদের লেখা আর ইসলাম সেই মূর্খের মনোনীতি একটা ধর্ম…।