বাঙালি মুসলমান দায় এড়াতে পারেনা।

বাঙালি মুসলমান দায় এড়াতে পারেনা
——————————————-
অবিভক্ত বাংলার অধিকাংশ মুসলমান তাদের মুসলিম পরিচয়কে তাদের ভাষা ও সাংস্কৃতিক বাঙালি পরিচয়ের থেকে বড় করে দেখেছে | ঠিক মহাবদ মোহাম্মদের মতো তাদের নেতাদের দূরদৃষ্টির অভাব এবং ধর্মীয় জোশের বশে তারা ইসলাম ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের দিকে ঝুঁকেছিল | তাদের মধ্যে এই ধারণা শিকড় গেঁড়ে বসেছিল যে, বাঙালি, পাঞ্জাবি, বিহারি ইত্যাদি নির্বিশেষে তারা সকলেই ইসলামের অনুসারী, অতএব ভারতের সকল মুসলমান স্বতন্ত্র এবং অভিন্ন এক জাতি এবং তারা অভিন্ন ইসলামী সংস্কৃতি বহনকারী।

এক স্বতন্ত্র মুসলিম আবাসভূমি বা হোমল্যান্ড ‘পাকিস্তান’ই হবে তাদের আদর্শ রাষ্ট্র এবং যেন তেন প্রকারে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাই হলো উপমহাদেশের মুসলমানের একান্ত কর্তব্য। অবিভক্ত ভারতের মুসলমান জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি ছিল বাঙালি মুসলমান আর এই বাঙালি মুসলমানরাই পাকিস্তান আন্দোলনের সবথেকে সক্রিয় সমর্থক ছিল। পাকিস্তান আন্দোলনের পেছনে আবেগ থাকলেও যুক্তি ছিল না। যুগ যুগ ধরে মুসলমানরা অখন্ড অবিভক্ত ভারতে বিভিন্ন বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্ষিপ্তভাবে বাস করেছে । বাঙালি মুসলমানরা ভারতের অন্যান্য মুসলমানদের চেয়ে একেবারে আলাদা, এমনকি ভাষা-সংস্কৃতি, জীবনযাত্রার দিক দিয়ে বাঙালি মুসলমানরা বাঙালি হিন্দুদের অনেক কাছাকাছি।

বাঙালি জাতীয় চেতনা পাকিস্তান আন্দোলনের সময়ে অধিকাংশ বাঙালি মূসলমানদের রাষ্ট্রীয় চিন্তায় ছিলনা। বাঙালি মুসলমানদের এই মানসিকতা বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত তথাকথিত ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণীকে মূসলমানদের প্রতি বিরূপ করেছিল। বাঙালি মুসলমানদের ধর্মভিত্তিক বিচ্ছিন্নতাবাদী জাতীয়তাবাদ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রধান হাতিয়ার হয়েছিল । পকিস্তান হলো বহু রক্ত ঝরিয়ে, বহু নারীর ইজ্জতের বিনিময়ে, কিন্তু পাকিস্তানের মুসলমান তারপরে কি শান্তিতে বসবাস করলো অখণ্ড পাকিস্তানে ? নাহঃ, বাঁধ সাধলো জাতিগত ভাষাভিত্তিক কায়েমী স্বার্থ । 
১৯৫২ তে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটলো বাঙালি মুসলমানের পূর্ব পাকিস্তানে ‘ভাষা আন্দোলন’ এর রূপে । কেন হলো এই বিস্ফোরণ ‘৫২ তে ? কারণটা সিম্পল । ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানের অখণ্ড পাকিস্তানে শুরু থেকেই অটোনোমি বলে কিছু ছিলই না আর বেনিয়া অবাঙালি মুসলমানরা অখণ্ড পাকিস্তানের শাসনযন্ত্রকে কন্ট্রোল করছিলো, কারণ তাদের পথ প্রদর্শক জিন্নাহ তথা পাকিস্তানের মাস্টারমাইন্ডরা অধিকাংশই ছিল অবাঙালি । তাই জিন্নাহ দর্প ভরে ঘোষণা দিয়েছিল, অখণ্ড পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে । পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি মুসলমানের কায়েমী স্বার্থে ঝটকা লাগলো । আরে বাবাঃ, আমরা তো উর্দু জানিনা ! 
কি করে সরকারি পরীক্ষায় বসবো, কিভাবে সরকারি চাকরি পাবো ? হ্যা, এটাই বিখ্যাত ‘ভাষা আন্দোলন’ এর ভিত্তি ! কিন্তু উপমহাদেশের বাঙালি মুসলমান চিরকালের কবি কালিদাস, যে গাছের ডালে বসে, সেই ডালাটাই কাটে ! অতএব পূর্ব পাকিস্তানের ‘৫২ থেকে ‘৭১ এ উত্তরণ । উপমহাদেশের মুসলমানের পবিত্র বাসভূমি পাকিস্তানে ‘৭০ এর স্বাধারণ নির্বাচনে, পর্ব পাকিস্তানের ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ থেকে খোলস পাল্টে ‘আওয়ামী লীগ’ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলো কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের মাস্টারমাইন্ডরা এইবার বেনিয়া বুদ্ধি প্রয়োগ না করে, মাথামোটার মত কাজ করলো । শাসনের ভার থেকে আওয়ামী লীগকে বঞ্চিত করার প্রয়াসে লাগলো । 
পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি মুসলমানের বেতাজ বাদশা, তথাকথিত হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি মুজিবের বড় সাধ ছিল অখন্ড পাকিস্তানের মসনদে আসীন হবেন, কিন্তু পশ্চিমাদের মাথামোটামি হতে দিলো না ! নিদেনপক্ষে, স্বায়ত্বশাসনের অধিকারটুকু দিলেও মুজিব হয়তো ৭ই মার্চ রেসকোর্সে জ্বালাময় ভাষণ দিতো না !
পশ্চিমাদের, পাকিস্তানের শাসনভার হস্তান্তরের টালবাহানা, ছলচাতুরিই মুজিবকে ৭ই মার্চ ১৯৭১ ঢাকার রেসকোর্সে যেতে বাধ্য করলো । তারপরের ঘটনাবলী তো সকলের জানা ইতিহাস । তা নিয়ে আর নাই বা লেখা বাড়ালাম । যেটা অনেকেই জানেন কিন্তু এড়িয়ে যান , সেটা হলো মুজিবের নেতৃত্বে, আওয়ামী লীগের পৃষ্ঠপোষকতায় পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি মুসলমানের’ ৭১ এর পটভূমিতে হঠাৎ সাময়িক অসাম্প্রদায়িক হয়ে যাওয়া । ওটা যে সাময়িক ছিল, সেটা কি ‘৭৩ টি স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতি জেনে থাকলে, বুঝিয়ে বলতে হবে ?
ধর্মীয় জেহাদি জোশে উপমহাদেশের মুসলমানের জন্য আলাদা বাসভূমি ‘পাকিস্তান’ কায়েম করার রক্তক্ষয়ী জিঘাংসার দায়, বাঙালি মুসলমান, ‘৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সাময়িক অসাম্প্রদায়িকতা দিয়ে ঝেড়ে ফেলতে পারবেনা……
Scroll to Top