সারা পৃথিবী জুড়ে কতবার ইহুদী নিধন হয়েছে আপনারা জানেন। আপনারা জানেন কিভাবে হিটলার লক্ষ লক্ষ ইহুদী নিধন করেছে, আপনারা এও জানেন সারা বিশ্ব কিভাবে ইহুদীদের ভয় পায় ও ঘৃণা করে। বলতে গেলে সাংস্কৃতিকভাবে একমাত্র ভারত ইহুদীদের আশ্রয় দিয়েছে। ‘I am proud to belong to the religion which has sheltered and is still fostering remnant Zoroasterian nation.’ আরেকটি খুব পুরানো ধর্ম অর্থাৎ ইসলাম এবং খ্রীষ্টানের অনেক আগে, মোটামুটি ধরে নেওয়া হয় যীশুর ধর্মের প্রায় পৌনে দুশো বছর আগে পারস্যে (আজকের ইরানে) জরাথুষ্ট নামে একজন বিশিষ্ট গুরু, আচার্য এবং আধ্যাত্মিক নেতা ছিলেন। সেই জরাথুষ্ট্রের এক দিব্য দর্শন হয় এবং তিনি এক নতুন ধর্ম প্রচার করতে শুরু করেন যার নাম আহুরা মজদা। পরবর্তীকালে ওনার শরীর ছাড়ার একশ বছর পর ইহুদী, ইসলাম এবং খ্রীষ্টান অর্থাৎ সেমেটিক ধর্মগুলো যখন পৃথিবীতে খুব শক্তিশালী হয়ে উঠতে আরম্ভ করল তখন চারদিকে মুসলমানরা প্রভাব বিস্তার করল। সেইসময় পারস্যে জরাথুষ্টের যত অনুগামী ছিল মুসলমানরা তাদের হাজারে হাজারে লক্ষ লক্ষতে কচুকাটা করেছে। অল্প কিছু পার্সিয়ান যারা পালিয়ে আসতে পেরেছিল, যারা অন্য কোথাও স্থান পায়নি, যখন মুসলমানদের প্রতাপে সবাই তাদের স্থান দিতে ভয় পেয়েছিল, তখন তাদের একমাত্র স্থান দিয়েছিল ভারতবর্ষ। পৃথিবীতে এখন যত জরাষ্ট্রিয়ান আছে তার মধ্যে এই মুহূর্তে ৮০% ভারতবর্ষে আছে। এই যে জামসেদজি টাটা, হোমি ভাবা – এরা সব পার্সিয়ান বা জরাষ্ট্রিয়ান মানুষ। স্বামীজী বলছেন আমি গর্বিত যে আমি সেই ধর্মের প্রতিনিধি হয়ে আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছি যে ধর্ম একসময় জরাষ্ট্রিয়ানদের আশ্রয় দিয়ে তাদের পোষণ করেছে অর্থাৎ মায়ের মত তাদের বড় হতে সাহায্য করেছে। এটা ধরা যাক স্বামীজীর কথায় মাতৃত্বের একটা দিক।
এছাড়া আরেকটা বিষয় স্বামীজীর জীবনাবসানের অনেক পরে ঘটেছিল, তাই তাঁর পক্ষে বলা সম্ভব নয় যে ১৯৫৯ সালে যখন চিনে প্রচণ্ড কমিউনিজমের হাওয়া এবং তার ফলস্বরূপ সেখানকার বৌদ্ধ প্রভাবকে একদম গুঁড়িয়ে, শেষ করে দিতে উদ্যোগী হয়েছিল, যখন ঘরে ঘরে বুদ্ধের ছবি রাখা নিষিদ্ধ ছিল এবং তার বদলে যখন মাও-জে-তুং এর ছবি রাখতে হত, সেই অবস্থায় তন্ত্র এবং বৌদ্ধ ধর্মের পীঠস্থান তিব্বতে চিনারা প্রচণ্ড আগ্রাসন চালাতে থাকে। কারণ ওরা জানত যে শুধু রাজনৈতিক শক্তি দিয়ে একটা দেশকে ধরে রাখতে পারবে না, ওদের দরকার ধর্মের শক্তি। তাই তিব্বতে যত পুরানো মন্দির, লামা, বিহার ও স্তূপ ছিল সব ধ্বংস করতে আরম্ভ করল এবং চেষ্টা করতে লাগল যেভাবে হোক দলাই লামাকে খুঁজে বার করে শেষ করতে।
১৯৫৯ সালে দলাই লামা কিছু লোকজনকে নিয়ে অনেক রাস্তা পেরিয়ে (CIA তাঁকে সাহায্য করেছিল) ভারতবর্ষে চলে আসেন যে দলাই লামা এখনও ভারতবর্ষের ধর্মশালায় বাস করেন। বর্তমানে সারা পৃথিবীতে যে বৌদ্ধ ধর্মের একটা ভাল প্রভাব শুরু হয়েছে তা দলাই লামাকে কেন্দ্র করেই হচ্ছে। এবং তিনি যে নতুন ভাবে বৌদ্ধ ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছেন সেই প্রয়াসকে তো ভারতবর্ষ বাধা দেয়নি বরং তাঁকে উৎসাহ দিয়েছে। এটা কোন সালে দিয়েছে? -১৯৫৯ সালে। যার তিন বছর পরেই কিন্তু চিনের সাথে ভারতের যুদ্ধ হবে এবং যেখানে ভারত সম্পূর্ণ পর্যুদস্থ হয়ে যাবে। অর্থাৎ স্বাধীনতার মাত্র বারো বছর পর (১৯৫৯ সালে) যখন ভারতবর্ষ খুবই দুর্বল, সারা পৃথিবীর কারুর যখন সাহস নেই চিনকে চটিয়ে দলাই লামাকে আশ্রয় দেওয়ার, সেই চিনকে চটিয়ে চোখে চোখ রেখে ভারতবর্ষ নিজস্ব পরম্পরা অক্ষুন্ন রেখে কিন্তু দলাই লামাকে আশ্রয় দিয়েছে। আর শুধুমাত্র আশ্রয় দিয়েছে তাই নয়, সেই তিব্বতি জেনারেশনের তিন জেনারেশন হয়ে গেল এখনও তারা ভারতবর্ষে আছে। তারা সংখ্যায় বৃদ্ধি হয়েছে, তারা ধর্মশালা, কাশ্মীর, দিল্লি – সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে, নিজের নিজের মত করে তারা জীবন যাপন করছে এবং একদিন আবার তিব্বতে ফিরে যাবার স্বপ্ন দেখে, যে তিব্বত স্বাধীন, যে তিব্বত চিন থেকে মুক্ত, যে তিব্বত বৌদ্ধ তিব্বত।
তাহলে স্বামীজী তাঁর কথায় মায়ের যে ভূমিকা, তার একটা দিক ছুঁলেন প্রথম দিন। এবার মায়ের যে আরেকটা দিক যা আমরা একটু আগে আলোচনা করলাম যে তিনি গর্ভে ধারণ করেন এবং জন্ম দেন সেই বিষয় নিয়ে দু’একটা কথা আমি বলছি। এটা তিনি প্রথম দিনের বক্তৃতায় কিছু বলেননি, কিন্তু পরবর্তীকালে আমেরিকায় এবং ইউরোপে অনেকবার সেসব নিয়ে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন।
একটু আগেই যীশুর কথা হচ্ছিল। আজ থেকে দুহাজার বছর আগে যীশু ক্রুশবিদ্ধ হন এবং তার পরে রোমানরা যারা এই জেরুজালেমের মন্দির ধ্বংস করেছিল তারা যেখানে যেখানে যীশুর অনুগামী ও ভক্ত ছিল তাদের খুঁজে বার করতে আরম্ভ করল। আপনারা জানেন তাঁর প্রধান শিষ্য ছিলেন বারোজন। তার মধ্যে একজন হচ্ছেন জুদাস যিনি যীশুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাঁর ক্রুশবিদ্ধ হবার আগেই আত্মহত্যা করেছিলেন। বাকি থাকল এগারো জন। এই এগারো জনের মধ্যে দশজনকে রোমানরা কচুকাটা করেছে। যীশুকে যেমন ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল তেমনই তাঁর প্রত্যেক শিষ্যকে উল্টো করে (পা উপরে, মাথা নিচে) ক্রুশবিদ্ধ করা হয়। এগুলো আমি ইতিহাস বলছি, কোনটা গল্প নয়। এটা হয়েছিল শিষ্যদের অনুরোধেই। শিষ্যরা বলেছিলেন যেহেতু যীশুর পা নিচের দিকে ছিল তাই আমাদের উল্টো করে ক্রুশবিদ্ধ করুন যাতে আমরা তাঁর চরণে মাথা রেখে তাঁর মতনই ক্রুশবিদ্ধ হতে পারি। তাই তাঁদেরই অনুরোধে মাথা নিচের দিকে ও পা উপরের দিকে করে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল। একমাত্র বেঁচে গিয়েছিলেন থমাস কারণ যীশু তাঁকে বলেছিলেন তুমি ভারতবর্ষে গিয়ে সেখান থেকে ধর্মপ্রচার করবে। সেই থমাস জাহাজে করে ভারতবর্ষে অর্থাৎ আজকের দক্ষিণ ভারতের কেরলে চলে এসেছিলেন। ঐখানেই তিনি যীশুর ভাবধারা নিয়ে লোকের সাথে কথা বলতে শুরু করেন এবং পৃথিবীতে প্রথম খ্রীষ্টান চার্চ তিনিই স্থাপন করেন। কিন্তু আমরা কি জানি? – রোমান ক্যাথলিক। অর্থাৎ ইতালীয়ানরা, অর্থাৎ যে রোমানরা এত ইহুদীদের মেরেছে, যে রোমানরা যীশুর শিষ্যদের মেরেছে তারা নাকি খ্রীষ্ট ধর্মের প্রবর্তক! এই ঘটনা ঘটেছে যীশুর শরীর ছাড়ার পাঁচশ বছর পরে। যখন রোমান সেনাপতি পল প্রচণ্ড খ্রীষ্টান বিরোধী হয়ে প্যালেস্টাইনে যীশুর কোন অনুরাগী আছে কিনা খুঁজে বার করে মারার উদ্দেশ্যে নিয়ে মরুভূমি পেরোচ্ছিল তখন সেই মরুভূমির মাঝখানে সে দেখল একজন দিব্যকান্তি মহাপুরুষ তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনি এতটাই থতমত খেয়ে গিয়েছিলেন যে ঘোড়া থেকে নেমে তাঁর সামনে দাঁড়ালেন। তাঁর হাতে তরোয়াল। সেই তরোয়ালটা তিনি নিয়ে নিজের হাঁটু দিয়ে ভাঙলেন। সেই তরোয়ালটাকে ক্রশচিহ্ন করে তিনি বললেন কতদিন এইভাবে তুমি আমায় আঘাত করবে? পল তখন সেই দিব্যকান্তি পুরুষটির সামনে নতজানু হলেন এবং তিনি বুঝতে পারলেন যে তিনিই যীশু। তিনি রোমে ফিরে গিয়ে রোমের সম্রাট কনস্ট্যানটাইনকে পুরো ঘটনা জানালেন। সেই সম্রাট তখন নিজে খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করলেন এবং একে একে সম্রাটের পরিবার, মন্ত্রী থেকে শুরু করে আস্তে আস্তে পুরো রোম ক্রীশ্চান হয়ে গেল। এটা মাত্র পনেরোশো বছর আগেকার কথা অর্থাৎ যীশুর ক্রুশবিদ্ধ হবার পাঁচশ বছর পরের ঘটনা।
রোমানরা যেহেতু পলিটিকালি খুব powerful ছিল তার পর থেকে তারা সারা পৃথিবীতে রাজনীতি বা গায়ের জোরে খ্রীষ্টধর্ম প্রচার করতে আরম্ভ করল। এটা স্বাভাবিক যে যার যত রাজনৈতিক ক্ষমতা সে তত বেশি ধর্ম প্রচার করবে। এই কথাগুলো কেন বললাম? বললাম কারণ এর পর থেকে কখনও ভাববেন না খ্রীষ্টধর্ম শুরু হয়েছে ইউরোপ থেকে বা ইজরায়েল থেকে। খ্রীষ্টধর্ম শুরু হয়েছে ভারতবর্ষ থেকে। এবং শুধু তাই নয়, যদি আপনারা বাইবেল দেখেন তাহলে যীশুর জীবনের বারো বছর বয়স থেকে চব্বিশ বছর বয়স পর্যন্ত তার জীবনের ঘটনার কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না। এখন এই নিয়ে প্রচুর গবেষণা হয়েছে এবং অনেক প্রমাণও পাওয়া গেছে যে এই বারো থেকে চব্বিশ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি ভারতবর্ষের হিমালয়ে এসেছিলেন সাধনা করতে। এবং তিনি একজন বৌদ্ধ গুরুর কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন। তাঁর গুরুর নাম ছিল জন। আমাদের গুরুমহারাজের কাছেই শুনেছি এই জন শব্দ “জনঃ” বা “জনক” -এর অপভ্রংশ।
[জিয়াগঞ্জের রামকৃষ্ণ সংঘের উদ্যোগে আয়োজিত স্বামী বিবেকানন্দের ১২৫’তম শিকাগো ধর্মসভা পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে জয়দীপ মহারাজের বক্তব্য]
তারিখ :- 11.09.2017(পর্ব – ৩)
সারা পৃথিবী জুড়ে কতবার ইহুদী নিধন হয়েছে আপনারা জানেন। আপনারা জানেন কিভাবে হিটলার লক্ষ লক্ষ ইহুদী নিধন করেছে, আপনারা এও জানেন সারা বিশ্ব কিভাবে ইহুদীদের ভয় পায় ও ঘৃণা করে। বলতে গেলে সাংস্কৃতিকভাবে একমাত্র ভারত ইহুদীদের আশ্রয় দিয়েছে। ‘I am proud to belong to the religion which has sheltered and is still fostering remnant Zoroasterian nation.’ আরেকটি খুব পুরানো ধর্ম অর্থাৎ ইসলাম এবং খ্রীষ্টানের অনেক আগে, মোটামুটি ধরে নেওয়া হয় যীশুর ধর্মের প্রায় পৌনে দুশো বছর আগে পারস্যে (আজকের ইরানে) জরাথুষ্ট নামে একজন বিশিষ্ট গুরু, আচার্য এবং আধ্যাত্মিক নেতা ছিলেন। সেই জরাথুষ্ট্রের এক দিব্য দর্শন হয় এবং তিনি এক নতুন ধর্ম প্রচার করতে শুরু করেন যার নাম আহুরা মজদা। পরবর্তীকালে ওনার শরীর ছাড়ার একশ বছর পর ইহুদী, ইসলাম এবং খ্রীষ্টান অর্থাৎ সেমেটিক ধর্মগুলো যখন পৃথিবীতে খুব শক্তিশালী হয়ে উঠতে আরম্ভ করল তখন চারদিকে মুসলমানরা প্রভাব বিস্তার করল। সেইসময় পারস্যে জরাথুষ্টের যত অনুগামী ছিল মুসলমানরা তাদের হাজারে হাজারে লক্ষ লক্ষতে কচুকাটা করেছে। অল্প কিছু পার্সিয়ান যারা পালিয়ে আসতে পেরেছিল, যারা অন্য কোথাও স্থান পায়নি, যখন মুসলমানদের প্রতাপে সবাই তাদের স্থান দিতে ভয় পেয়েছিল, তখন তাদের একমাত্র স্থান দিয়েছিল ভারতবর্ষ। পৃথিবীতে এখন যত জরাষ্ট্রিয়ান আছে তার মধ্যে এই মুহূর্তে ৮০% ভারতবর্ষে আছে। এই যে জামসেদজি টাটা, হোমি ভাবা – এরা সব পার্সিয়ান বা জরাষ্ট্রিয়ান মানুষ। স্বামীজী বলছেন আমি গর্বিত যে আমি সেই ধর্মের প্রতিনিধি হয়ে আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছি যে ধর্ম একসময় জরাষ্ট্রিয়ানদের আশ্রয় দিয়ে তাদের পোষণ করেছে অর্থাৎ মায়ের মত তাদের বড় হতে সাহায্য করেছে। এটা ধরা যাক স্বামীজীর কথায় মাতৃত্বের একটা দিক।
এছাড়া আরেকটা বিষয় স্বামীজীর জীবনাবসানের অনেক পরে ঘটেছিল, তাই তাঁর পক্ষে বলা সম্ভব নয় যে ১৯৫৯ সালে যখন চিনে প্রচণ্ড কমিউনিজমের হাওয়া এবং তার ফলস্বরূপ সেখানকার বৌদ্ধ প্রভাবকে একদম গুঁড়িয়ে, শেষ করে দিতে উদ্যোগী হয়েছিল, যখন ঘরে ঘরে বুদ্ধের ছবি রাখা নিষিদ্ধ ছিল এবং তার বদলে যখন মাও-জে-তুং এর ছবি রাখতে হত, সেই অবস্থায় তন্ত্র এবং বৌদ্ধ ধর্মের পীঠস্থান তিব্বতে চিনারা প্রচণ্ড আগ্রাসন চালাতে থাকে। কারণ ওরা জানত যে শুধু রাজনৈতিক শক্তি দিয়ে একটা দেশকে ধরে রাখতে পারবে না, ওদের দরকার ধর্মের শক্তি। তাই তিব্বতে যত পুরানো মন্দির, লামা, বিহার ও স্তূপ ছিল সব ধ্বংস করতে আরম্ভ করল এবং চেষ্টা করতে লাগল যেভাবে হোক দলাই লামাকে খুঁজে বার করে শেষ করতে।
১৯৫৯ সালে দলাই লামা কিছু লোকজনকে নিয়ে অনেক রাস্তা পেরিয়ে (CIA তাঁকে সাহায্য করেছিল) ভারতবর্ষে চলে আসেন যে দলাই লামা এখনও ভারতবর্ষের ধর্মশালায় বাস করেন। বর্তমানে সারা পৃথিবীতে যে বৌদ্ধ ধর্মের একটা ভাল প্রভাব শুরু হয়েছে তা দলাই লামাকে কেন্দ্র করেই হচ্ছে। এবং তিনি যে নতুন ভাবে বৌদ্ধ ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছেন সেই প্রয়াসকে তো ভারতবর্ষ বাধা দেয়নি বরং তাঁকে উৎসাহ দিয়েছে। এটা কোন সালে দিয়েছে? -১৯৫৯ সালে। যার তিন বছর পরেই কিন্তু চিনের সাথে ভারতের যুদ্ধ হবে এবং যেখানে ভারত সম্পূর্ণ পর্যুদস্থ হয়ে যাবে। অর্থাৎ স্বাধীনতার মাত্র বারো বছর পর (১৯৫৯ সালে) যখন ভারতবর্ষ খুবই দুর্বল, সারা পৃথিবীর কারুর যখন সাহস নেই চিনকে চটিয়ে দলাই লামাকে আশ্রয় দেওয়ার, সেই চিনকে চটিয়ে চোখে চোখ রেখে ভারতবর্ষ নিজস্ব পরম্পরা অক্ষুন্ন রেখে কিন্তু দলাই লামাকে আশ্রয় দিয়েছে। আর শুধুমাত্র আশ্রয় দিয়েছে তাই নয়, সেই তিব্বতি জেনারেশনের তিন জেনারেশন হয়ে গেল এখনও তারা ভারতবর্ষে আছে। তারা সংখ্যায় বৃদ্ধি হয়েছে, তারা ধর্মশালা, কাশ্মীর, দিল্লি – সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে, নিজের নিজের মত করে তারা জীবন যাপন করছে এবং একদিন আবার তিব্বতে ফিরে যাবার স্বপ্ন দেখে, যে তিব্বত স্বাধীন, যে তিব্বত চিন থেকে মুক্ত, যে তিব্বত বৌদ্ধ তিব্বত।
তাহলে স্বামীজী তাঁর কথায় মায়ের যে ভূমিকা, তার একটা দিক ছুঁলেন প্রথম দিন। এবার মায়ের যে আরেকটা দিক যা আমরা একটু আগে আলোচনা করলাম যে তিনি গর্ভে ধারণ করেন এবং জন্ম দেন সেই বিষয় নিয়ে দু’একটা কথা আমি বলছি। এটা তিনি প্রথম দিনের বক্তৃতায় কিছু বলেননি, কিন্তু পরবর্তীকালে আমেরিকায় এবং ইউরোপে অনেকবার সেসব নিয়ে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন।
একটু আগেই যীশুর কথা হচ্ছিল। আজ থেকে দুহাজার বছর আগে যীশু ক্রুশবিদ্ধ হন এবং তার পরে রোমানরা যারা এই জেরুজালেমের মন্দির ধ্বংস করেছিল তারা যেখানে যেখানে যীশুর অনুগামী ও ভক্ত ছিল তাদের খুঁজে বার করতে আরম্ভ করল। আপনারা জানেন তাঁর প্রধান শিষ্য ছিলেন বারোজন। তার মধ্যে একজন হচ্ছেন জুদাস যিনি যীশুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাঁর ক্রুশবিদ্ধ হবার আগেই আত্মহত্যা করেছিলেন। বাকি থাকল এগারো জন। এই এগারো জনের মধ্যে দশজনকে রোমানরা কচুকাটা করেছে। যীশুকে যেমন ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল তেমনই তাঁর প্রত্যেক শিষ্যকে উল্টো করে (পা উপরে, মাথা নিচে) ক্রুশবিদ্ধ করা হয়। এগুলো আমি ইতিহাস বলছি, কোনটা গল্প নয়। এটা হয়েছিল শিষ্যদের অনুরোধেই। শিষ্যরা বলেছিলেন যেহেতু যীশুর পা নিচের দিকে ছিল তাই আমাদের উল্টো করে ক্রুশবিদ্ধ করুন যাতে আমরা তাঁর চরণে মাথা রেখে তাঁর মতনই ক্রুশবিদ্ধ হতে পারি। তাই তাঁদেরই অনুরোধে মাথা নিচের দিকে ও পা উপরের দিকে করে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল। একমাত্র বেঁচে গিয়েছিলেন থমাস কারণ যীশু তাঁকে বলেছিলেন তুমি ভারতবর্ষে গিয়ে সেখান থেকে ধর্মপ্রচার করবে। সেই থমাস জাহাজে করে ভারতবর্ষে অর্থাৎ আজকের দক্ষিণ ভারতের কেরলে চলে এসেছিলেন। ঐখানেই তিনি যীশুর ভাবধারা নিয়ে লোকের সাথে কথা বলতে শুরু করেন এবং পৃথিবীতে প্রথম খ্রীষ্টান চার্চ তিনিই স্থাপন করেন। কিন্তু আমরা কি জানি? – রোমান ক্যাথলিক। অর্থাৎ ইতালীয়ানরা, অর্থাৎ যে রোমানরা এত ইহুদীদের মেরেছে, যে রোমানরা যীশুর শিষ্যদের মেরেছে তারা নাকি খ্রীষ্ট ধর্মের প্রবর্তক! এই ঘটনা ঘটেছে যীশুর শরীর ছাড়ার পাঁচশ বছর পরে। যখন রোমান সেনাপতি পল প্রচণ্ড খ্রীষ্টান বিরোধী হয়ে প্যালেস্টাইনে যীশুর কোন অনুরাগী আছে কিনা খুঁজে বার করে মারার উদ্দেশ্যে নিয়ে মরুভূমি পেরোচ্ছিল তখন সেই মরুভূমির মাঝখানে সে দেখল একজন দিব্যকান্তি মহাপুরুষ তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনি এতটাই থতমত খেয়ে গিয়েছিলেন যে ঘোড়া থেকে নেমে তাঁর সামনে দাঁড়ালেন। তাঁর হাতে তরোয়াল। সেই তরোয়ালটা তিনি নিয়ে নিজের হাঁটু দিয়ে ভাঙলেন। সেই তরোয়ালটাকে ক্রশচিহ্ন করে তিনি বললেন কতদিন এইভাবে তুমি আমায় আঘাত করবে? পল তখন সেই দিব্যকান্তি পুরুষটির সামনে নতজানু হলেন এবং তিনি বুঝতে পারলেন যে তিনিই যীশু। তিনি রোমে ফিরে গিয়ে রোমের সম্রাট কনস্ট্যানটাইনকে পুরো ঘটনা জানালেন। সেই সম্রাট তখন নিজে খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করলেন এবং একে একে সম্রাটের পরিবার, মন্ত্রী থেকে শুরু করে আস্তে আস্তে পুরো রোম ক্রীশ্চান হয়ে গেল। এটা মাত্র পনেরোশো বছর আগেকার কথা অর্থাৎ যীশুর ক্রুশবিদ্ধ হবার পাঁচশ বছর পরের ঘটনা।
রোমানরা যেহেতু পলিটিকালি খুব powerful ছিল তার পর থেকে তারা সারা পৃথিবীতে রাজনীতি বা গায়ের জোরে খ্রীষ্টধর্ম প্রচার করতে আরম্ভ করল। এটা স্বাভাবিক যে যার যত রাজনৈতিক ক্ষমতা সে তত বেশি ধর্ম প্রচার করবে। এই কথাগুলো কেন বললাম? বললাম কারণ এর পর থেকে কখনও ভাববেন না খ্রীষ্টধর্ম শুরু হয়েছে ইউরোপ থেকে বা ইজরায়েল থেকে। খ্রীষ্টধর্ম শুরু হয়েছে ভারতবর্ষ থেকে। এবং শুধু তাই নয়, যদি আপনারা বাইবেল দেখেন তাহলে যীশুর জীবনের বারো বছর বয়স থেকে চব্বিশ বছর বয়স পর্যন্ত তার জীবনের ঘটনার কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না। এখন এই নিয়ে প্রচুর গবেষণা হয়েছে এবং অনেক প্রমাণও পাওয়া গেছে যে এই বারো থেকে চব্বিশ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি ভারতবর্ষের হিমালয়ে এসেছিলেন সাধনা করতে। এবং তিনি একজন বৌদ্ধ গুরুর কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন। তাঁর গুরুর নাম ছিল জন। আমাদের গুরুমহারাজের কাছেই শুনেছি এই জন শব্দ “জনঃ” বা “জনক” -এর অপভ্রংশ।
[জিয়াগঞ্জের রামকৃষ্ণ সংঘের উদ্যোগে আয়োজিত স্বামী বিবেকানন্দের ১২৫’তম শিকাগো ধর্মসভা পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে জয়দীপ মহারাজের বক্তব্য]
তারিখ :- 11.09.2017