প্রিয়রঞ্জনকে নিয়ে একটা দেওয়াল লিখন করেছিল সিপিএম হাওড়ায়, নব্বইয়ের দশকে। টিকিটটা আমি পেয়ে গেছি দীপা শুনছ, প্রিয় হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইছেন সেই কার্টুনে। অঞ্জনের মত গীটারই থাকা উচিত ছিল, কিন্তু হারমোনিয়ামে ভালো ক্যারিকেচার হয় সম্ভবত। প্রিয়কে নিয়ে আজ আনন্দবাজারে প্রকাশিত সুব্রতর অবিচুয়ারি পড়লে কে বলবে, এই সুব্রত একদা প্রিয়রঞ্জনের নাম দিয়েছিলেন মিথ্যারঞ্জন। প্রিয় কেন অনর্গল মিথ্যে কথা বলেন, আর মমতা কেন নতুন শাড়ি ছিঁড়ে পরেন, সেটা একটা রহস্য, সুব্রত প্রায়ই বলতেন।
এই ঈষৎ মোঙ্গোলয়েড মুখের বাঙালি রাজনীতিবিদ আমাদের ছোটবেলায় প্রণব, গণিখান, সোমেন – এদের মত সর্বেসর্বা ছিলেন না বাংলা কংগ্রেসে। কিন্তু উত্তমযুগে সৌমিত্রের মত একটা ইন্ডিপেন্ডেন্ট উপস্থিতি ছিল এই নেতার।
প্রিয় আসলে প্রিয়বাক্য বলতেন। সত্য সর্বদাই অপ্রিয়, তাই প্রিয় অনৃতভাষণ করতেন। একবার রায়গঞ্জের বিশাল মুসলিম ভোটকে বাগে আনতে বলেছিলেন, ভাইয়েরা, আবার যদি কোনওদিন রামরথ নিয়ে আদবানি বেরোন (তখনও মোদি লাইমলাইটে আসেন নি), সবার আগে আপনাদের এই প্রিয়রঞ্জন সেই রথের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়বে, নিজে শহীদ হয়ে যাবে, কিন্তু সেই রথকে থামিয়ে তবে মরবে। প্রিয় এইরকম ছিলেন। তাই প্রিয় ছিলেন অনেকের। দিল্লির বাঙালিদের মুখে হা হুতাশ শুনেছি, সেই যে প্রিয় গেলেন, আর দিল্লির বাঙালিদের হয়ে দুটো কথা বলার আর কেউ রইল না। কথাটা এই দিকে অন্তত সত্যি যে এখন সত্যিই বলার মত কেউ নেই, আমি গত ন-দশ বছরে দেখিনি।
এখানে আমাদের একটি বিহারী ছাত্র সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলাকালীন অতিরিক্ত উৎসাহে চেয়ারের ওপরে উঠে নাচতে গিয়ে চেয়ারটি ভাঙে, ফলস্বরূপ একবছরের জন্য বহিষ্কৃত হয়। বছর পাঁচেক আগের কথা। সে ছোকরার জন্য শরদ যাদবের ফোন এসেছিল, এবং ছাত্রজীবনের অমূল্য এক বছর বেঁচে যায় তার। নিতান্তই নিম্নমধ্যবিত্ত বিহারী, সাধারণ ঘরের ছেলে। কিন্তু গরীব বিহারীর পাশে ধনী বিহারী, ক্ষমতাহীন বিহারীর পাশে রাজনীতিবিদ বিহারী দাঁড়ায়।
এই কাজটা বাঙালির জন্য আর কেউ করার নেই বহুদিন যাবত। এককালে প্রিয় এ কাজটা করতেন, দিল্লির বাঙালিরা বলেন। আমি দেখি নি। আমি দুহাজার আটের শেষের দিক থেকে এখানে অধ্যাপনা করছি। যারা দেখেছেন তারা বলেন।
এই বাংলার চারটি দ্বীপ, প্রিয় সুব্রত সোমেন প্রদীপ, শুনেছি সত্তরের দশকে এশিয়ার মুক্তিসূর্যের ছানাপোনারা স্লোগান দিতেন। দ্বীপ কেন, জানি না, সম্ভবত নকশাল কুমীর এবং সিপিএম হাঙরের উৎপাত বাংলার জলে, তার মধ্যে এই চারটি দ্বীপ উঁচু হয়ে জেগে ছিল। বাংলায় বামবিরোধী রাজনীতি বড় জটিল। প্রিয় নিজেই সোভিয়েতঘেঁষা ছিলেন, বুদ্ধদেবের সঙ্গে তুইতোকারির সম্পর্ক ছিল (নন্দীগ্রাম বিতর্কের সময় জানা গেছিল)। সোমেন আর সুব্রত সম্পর্কে তো তরমুজ অপবাদ বহু পুরোনো।
প্রিয় একবার খুব বীতশ্রদ্ধ হয়ে নিজেরই কংগ্রেস দলের এক কর্মীকে বাঁশ দিয়ে পেটাচ্ছিলেন, সে ছবি দেখেছিলাম সংবাদপত্রে। এগুলো বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের অবিস্মরণীয় মুহূর্ত।
দীপা দাশমুন্সির টিপের মত বড়সড় রাজনীতিবিদ ছিলেন প্রিয়রঞ্জন। ওই টিপ হয়ত দীপা আর পরবেন না।