কবি, প্রাবন্ধিক, চিত্রসমালোচক এবং শিল্পানুরাগী
বিষ্ণু দে (জন্মঃ- ১৮ জুলাই, ১৯০৯ – মৃত্যুঃ- ৩ ডিসেম্বর, ১৯৮২)
১৯২৩ সালে কল্লোল পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে যে সাহিত্য আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল কবি বিষ্ণু দে তার একজন দিশারী। ১৯৩০ সালে কল্লোলের প্রকাশনা বন্ধ হলে তিনি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের পরিচয় পত্রিকায় যোগদান করেন এবং সেখানে একজন সম্পাদক হিসাবে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কাজ করেন। ১৯৪৮ সালে চঞ্চল কুমার চট্টোপাধ্যায়ের সহায়তায় তিনি সাহিত্য পত্র প্রকাশ করেন। তিনি নিরুক্তা নামের একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করেছিলেন। কবি টি এস এলিয়টের কায়দা এবং ভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি ছড়ানো এই জীবন নামে একটি আত্মজীবনী লিখেছিলেন।
বিষ্ণু দের সঙ্গে শিল্পী যামিনী রায়ের বন্ধুত্ব ছিল। এর কারনে তিনি অঙ্কন শিল্পের উপর কিছু বই রচনা করেন। যেমন আর্ট অফ যামিনী রায়, দ্য পেন্টিংস অফ রবীন্দ্রনাথ টেগোর (১৯৫৮), ইন্ডিয়া অ্যান্ড মডার্ন আর্ট (১৯৫৯)। তিনি ক্যালকাটা গ্রুপ সেন্টার, সোভিয়েত ফ্রেন্ডশিপ অ্যাসোসিয়েসন, প্রগতি লেখক শিল্পী সঙ্ঘ, ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েসন (আইপিটিএ বা ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ) প্রভৃতি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ছবিও আঁকতেন।
১৯৫৯ সালে বিষ্ণু দে’কে কবি-সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। সাহিত্য কৃতির জন্য তিনি সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার (১৯৬৬), নেহেরু স্মৃতি পুরস্কার (১৯৬৭) ও রাষ্ট্রীয় জ্ঞানপীঠ পুরস্কার (১৯৭১) লাভ করেন। তিনি ‘রুশতী পঞ্চশতী’র জন্য ‘সোভিয়েত ল্যান্ড পুরস্কার’ পেয়েছেন। ক্যালকাটা গ্রুপ সেন্টারের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। সোভিয়েট সুহূদ সমিতি, প্রগতি লেখক শিল্পী সংঘ, ভারতীয় গণনাট্য সংঘ প্রভৃতি সংগঠনের সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন।
জন্ম
তাঁর পিতা অবিনাশ চন্দ্র দে ছিলেন একজন অ্যাটর্নী। বিষ্ণু দে কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউট এবং সংস্কৃত কলিজিয়েট স্কুলে পড়াশোনা করেন। ১৯২৭ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর বঙ্গবাসী কলেজে আইএ পড়তে যান। তিনি সাম্মানিক ইংরাজি বিষয়ে স্নাতক হন সেন্ট পল্স কলেজ থেকে। এরপর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজিতে এম এ করেন। ১৯৩৫ সালে তিনি রিপন কলেজে যোগদান করেন। এরপর তিনি ১৯৪৪ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্সি কলেজে এবং ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি মৌলানা আজাদ কলেজে পড়ান। এরপর তিনি কৃষ্ণনগর কলেজেও পড়িয়েছিলেন।
কিছু রচনা
উর্বশী ও আর্টেমিস (১৯৩২)
চোরাবালি (১৯৩৮)
পূর্বলেখ (১৯৪০)
রুচি ও প্রগতি (১৯৪৬)
সাহিত্যের ভবিষ্যৎ (১৯৫২)
সন্দীপের চর (১৯৪৭)
অন্বীষ্টা (১৯৫০)
নাম রেখেছি কোমল গান্ধার (১৯৫০)
তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ (১৯৫৮)
রবীন্দ্রনাথ ও শিল্প সাহিত্য আধুনিকতার সমস্যা (১৯৬৬)
মাইকেল রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য জিজ্ঞাসা (১৯৬৭)
ইন দ্য সান অ্যান্ড দ্য রেন (১৯৭২)
উত্তরে থাকে মৌন (১৯৭৭)
সেকাল থেকে একাল (১৯৮০)
আমার হৃদয়ে বাঁচো (১৯৮১)
জল দাও
তোমার স্রোতের বুঝি শেষ নেই, জোয়ার ভাঁটায়
এ-দেশে ও-দেশে নিত্য ঊর্মিল কল্লোলে
পাড় গড়ে পাড় ভেঙে মিছিলে জাঠায়
মরিয়া বন্যায় যুদ্ধে কখনো-বা ফল্গু বা পল্বলে
কখনো নিভৃত মৌন বাগানের আত্মস্থ প্রসাদে
বিলাও বেগের আভা
আমি দূরে কখনো-বা কাছে পালে-পালে কখনো-বা হালে
তোমার স্রোতের সহযাত্রী চলি, ভোলো তুমি পাছে
তাই চলি সর্বদাই
যদি তুমি ম্লান অবসাদে
ক্লান্ত হও স্রোতস্বিনী অকর্মণ্য দূরের নির্ঝরে
জিয়াই তোমাকে পল্লবিত ছায়া বিছাই হদৃয়ে
তোমাতেই বাঁচি প্রিয়া
তোমারই ঘাটের কাছে
ফোটাই তোমারই ফুল ঘাটে-ঘাটে বাগানে-বাগানে।
তুমিই মালিনী
বিষ্ণু দে
তুমিই মালিনী, তুমিই তো ফুল জানি।
ফুল দিয়ে যাও হৃদয়ের দ্বারে, মালিনী,
বাতাসে গন্ধ, উৎস কি ফুলদানি,
নাকি সে তোমার হৃদয়সুরভি হাওয়া ?
দেহের অতীতে স্মৃতির ধূপ তো জ্বালি নি
কালের বাগানে থামে নি কো আসা যাওয়া
ত্রিকাল বেঁধেছ গুচ্ছে তোমার চুলে,
একটি প্রহর ফুলহার দাও খুলে,কালের মালিনী ! তোমাকেই ফুল জানি,
তোমারই শরীরে কালোত্তীর্ণ বাণী,
তোমাকেই রাখী বেঁধে দিই করমূলে
অতীত থাকুক আগামীর সন্ধানী –
তাই দেখে ঐ কাল হাসে দুলে দুলে
সুজলা সুফলা
বিষ্ণু দে
সুজলা সুফলা সেই মলয়শীতলা ধরণীভরণী
বন্দনীয় মাতৃভূমি ঋষি (ও হাকিম) বঙ্কিমচন্দ্রের
সেই গণ-স্তোত্রগান এখনও হয়তো আনন্দের
শীর্ষ-চূড়ে কোনো সভায় স্বয়ম্ রবিঠাকুরের
সুরে সর্বাঙ্গ শিহরে অচৈতন্য শব্ দব্রহ্মে ধনী
সমকণ্ঠে ওঠে সহস্রের গান, পাশের দূরের
দেহমনে সমভাব, মৈত্রী — রাখীবন্ধনে শপথে।
সে-গান প্রাণের রন্ধ্রে, মন জাগে ধ্রুব ছন্দে, গানে
ভাবের সমুদ্র থেকে ভাষা ওঠে দোঁহে একাকার,
ষেমন অন্তরে দেহ জাগে, দেহে স্বপ্নের প্রয়াণে
ভাষা ওঠে সফেন চঞ্চল নৃত্যে। পরমুহূর্তে আবার
কাশীমিত্রঘাটে দেখ, যিনি ভব্য সুশোভন সদা
অসামান্য দিব্যকান্তি কবি, আমাদের ভাগ্য গণি,
নগ্নবক্ষে সদ্যস্নাত ! — সুখদা বরদা দেশে, পথে।
বাংলাই আমাদের
বিষ্ণু দে
আমরা বাংলার লোক,
বাংলাই আমাদের, এদের ওদের সবার জীবন।
আমাদের রক্তে ছন্দ এই নদি মাঠ ঘাট
এই আমজাম বন,
এই স্বচ্ছ রৌদ্রজলে অন্তরঙ্গ ঘরোয়া ভাষার
হাস্যস্নাত অশ্রুদীপ্ত পেশল বিস্তার।
চোখে কানে ঘ্রাণে প্রাণে দেহমনে কথায় স্নায়ুতে
গঙ্গার পদ্মার হাসি একাকার, সমগ্র সত্তার
অজেয় আয়ুতে নিত্য মৃত্যুত্তীর্ণ দুঃখে হর্ষে
ছন্দে বর্ণে বেঁধে দেবে কোমল কঠিন স্পর্শে।
যতই বর্বর হও শক্তিলোভে কূটবুদ্ধি
আজ শতাধিক রাবিন্দ্রিক পুণ্য বর্ষে
তুমি পাবে কোথায় নিস্তার?
……………….