১৯৯২ সালে, সম্ভবত জানুয়ারি মাসে, রামজন্মভূমি আন্দোলনের প্রেক্ষিতে তপনদা একটা লিফলেট লিখেছিলেন যার শীর্ষক ছিল- ‘ভারতীয় মুসলমানদের শরীরে কার রক্ত বইছে, রামের না বাবরের?’। লিফলেটটা অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল। জনপ্রিয়তার মাত্রা এতটাই ছিল কেউ সেই লিফলেট নিয়ে ফটোকপি করাতে গেলে দোকানদার আগে থেকেই কপি করে রাখা লিফলেট তাকে দিয়ে দিতো।
২৫ বছর আগে তোলা তপনদার সেই প্রশ্ন আজও সমান প্রাসঙ্গিক। এদেশে বসবাসকারী প্রায় সব মুসলমান ও খ্রিষ্টানরা কয়েক প্রজন্ম আগেও এদেশের হিন্দু জাতি ও সংস্কৃতিরই অঙ্গ ছিল। কেউ অস্ত্রের ভয়ে আর কেউ অর্থের লোভে ধর্মান্তরিত হয়েছে। আদতে তারা প্রত্যেকেই এই হিন্দু সমাজেরই অঙ্গ ছিল কিন্তু আজ তাদের সাথে হিন্দুদের সহাবস্থানের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিদেশী সংস্কৃতি।
মুসলমানরা যদি মহম্মদকে পয়গম্বর মেনে বা খ্রিষ্টানরা যদি যীশুকে ঈশ্বর মেনে তাদের উপাসনা করতো তাহলে সহাবস্থানের ক্ষেত্রে কোন অসুবিধার সৃষ্টিই হতনা কারণ সনাতন ধর্ম কখনই উপাসনা পদ্ধতির ভিত্তিতে ভেদাভেদে বিশ্বাসী নয়। সনাতন ধর্মানুসারে, সাকার বা নিরাকার- ঈশ্বরের কোন রূপই পরিত্যাজ্য নয়। বিশেষ উপাসনার জন্যে কে শুক্রবার কে বাছবে আর কে রবিবার, সেটা সনাতন ধর্মে বিচার্য নয়। এমনকি কেউ যদি ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসই না রাখে তাকেও সমাজের অঙ্গ হিসাবে সেই স্বাধীনতা দিয়ে সনাতন ধর্মের অনুসারী হিন্দু সমাজ।
কিন্তু সহাবস্থান সম্ভব হলনা বিদেশী ধর্মমতগুলির সংকীর্ণ মনোভাবের কারণে। আর এই মনোভাবের কারণেই একজন মুসলমান বা খ্রিষ্টান নিজেদের কখনই হিন্দু জাতির অংশ হিসাবে ভাবতে পারেনা। তাদের কাছে সনাতন ধর্ম অতি নিকৃষ্ট। আমাদের মুনিঋষিরা তাদের কাছে শয়তানের উপাসক আর তাদের স্থান কেবল নরকে। আমাদের উপাস্য অবতারগণ তাদের কাছে হীন চরিত্রের প্রতীক। এই দেশের ভূমি তাদের কাছে ‘জাহিলিয়া’ ও দার-উল-হারব আর তাকে দার-উল-ইসলাম বানানো তাদের পবিত্র দায়িত্ব। এই সংকীর্ণ ধর্মীয় ভাবধারার কারণেই এদেশের মুসলমান ও খ্রিষ্টানরা কখনই হিন্দু সমাজের সাথে একাত্ম হতে পারেনি। আর এই ভাবধারাকে প্রশ্রয় দেয়ার জন্যেই তৈরি করা হয়েছে ‘সেকুলারিজম’ বা ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশ।
মুশকিল হল যে আর কয়েকবছরের মধ্যে তথাকথিত স্বাধীনতা লাভের ৭৫ বছর হতে চললেও হিন্দু জাতি প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতা আজও পায়নি। শাসকের পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু স্বাধীনতা পাওয়া যায়নি কথাটা বোধহয় একটু কঠিন হয়ে গেল, উদাহরণ দিলে কিছুটা সহজ হতে পারে। ১৭৫৭ সালে, পলাশীর যুদ্ধের পরে শাসনক্ষমতা মুসলমানদের থেকে ব্রিটিশদের কাছে গিয়েছিল কিন্তু সেটা কি আমাদের স্বাধীনতা ছিল? অনেকেই এবার বলবেন যে ১৯৪৭ সালের পরে আমাদের দেশের শাসনক্ষমতা আমাদের দেশীয় ব্যক্তিদের কাছে আছে, তাই আমরা স্বাধীন কিন্তু সেই যুক্তিতে তো ইদি আমিনের শাসনে উগান্ডা, চেসেস্কুর শাসনে রোমানিয়া বা স্ট্যালিনের শাসনে USSR-ও দেশীয় ব্যক্তিদের শাসনাধীন ছিল, কিন্তু প্রকৃত স্বাধীনতা ছিল কি?
১৯৪৭ সালে নেহরুর নেতৃত্বে যারা ক্ষমতা দখল করেছিল তাদের অধিকাংশই এদেশে হিন্দু জাতির অস্তিত্ব ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলনা। নেহরুর ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল হিন্দু বিরোধিতারই নামান্তর। মজার ব্যাপার হল যে সেই হিন্দু বিরোধিতাকেই এমন পবিত্র বিষয় বলে মেনে নেয়া হল যে সেটাকে অস্বীকার করে কেউ নির্বাচনে অংশগ্রহণ পর্যন্ত করতে পারবেনা। কোন প্রার্থী যদি হিন্দুদের হয়ে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তাহলে সাম্প্রদায়িক প্রচারের অজুহাতে তার নির্বাচন লড়ার অধিকার কেড়ে নেয়া যেতে পারে। এমনকি সে যদি জিতেও যায় সেক্ষেত্রেও সেই নির্বাচনকে অবৈধ ঘোষণা করার অধিকার আদালতের আছে। এমতাবস্থায়, স্ট্যালিনের রাশিয়ায় যেমন জনগণের ভোটের নামে কম্যুনিস্ট পার্টি চিহ্নিত দুইজন প্রার্থীর মধ্যে একজনকে নির্বাচন করার অধিকার ছিল, এখানেও তেমনি আমাদের অধিকার হিন্দু বিরোধীদের মধ্যে একজনকে নির্বাচন করার।
এমতাবস্থায়, রাজনীতির দ্বারা সমাজকে বদলানোর স্বপ্ন দেখা মানে ভাবের ঘোরে চুরি করা। হিন্দু সমাজকে প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন করতে হলে সেই দায়িত্ব সম্পূর্ণ সমাজকেই নিতে হবে। ধর্মগুরু, শিক্ষকসম্প্রদায়, ছাত্রসমাজ, কৃষক, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, চাকুরীজীবী – এই দায়িত্ব সকলের। হিন্দুজাতির নবজাগরণ ক্ষমতার অলিন্দ থেকে নয়, অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের কুঁড়েঘর থেকেই হবে। রাজনৈতিক স্লোগান দিয়ে নয়, মা কালীর জয়ধ্বনি দিয়েই হবে।