জিন্নার পূর্বপুরুষরা ছিলেন হিন্দু এবং তাঁরা ছিলেন গুজরাটের বাসিন্দা। ”কোন হিন্দুর মুসলমান হয়ে যাওয়ার মানে শুধু হিন্দু সমাজের একজন সদস্য কমে যাওয়া নয়, একজন শত্রু বৃদ্ধি পাওয়া,” স্বামী বিবেকানন্দের এই বাণী যে কতখানি সত্য, তা বুঝতে পারবেন জিন্না হিন্দুদের কী ধরণের শত্রু হয়ে উঠেছিলেন এবং তিনি হিন্দুদের কী পরিমাণ ক্ষতি করেছেন সে সম্পর্কে একটা ধারণা হলে।
ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত জিন্নার প্রিয় কাজ ছিল জলের মত মদ খাওয়া। জীবনে নামাজ রোজা করেছেন কি না সন্দেহ, শূকরের মাংস ছিল তাঁর প্রিয় খাদ্য। ভারতের মুসলমানদের জিন্না যথেষ্ট ঘৃণা করতেন। তবু তাঁর জ্ঞান ও বুদ্ধির কারণে, মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক আবাসভূমি পাকিস্তানএর স্বপ্ন দেখা রহমত আলী ১৯৩৩ সালে জিন্নাকে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের জন্য আন্দোলন করার প্রস্তাব দিলেন।
জিন্না তা প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, “এটি একটি অসম্ভব স্বপ্ন।”
কিন্তু রহমত কোরাণ খুলে জিন্নাকে দেখিয়ে বলেছিলেন, “এ অসম্ভব নয়, সম্ভব। মুসলমানদের জাগিয়ে পাকিস্তান আদায়ের জন্য সব রকম উপাদান কোরাণএর মধ্যে রয়েছে।”
জিন্না বিষয়টি নিয়ে ভাবতে লাগলেন এবং কোরাণএর তত্ত্ব জিন্নাকে এমনই প্রভাবিত করল যে, পাকিস্তানের স্বপ্নে বিভোর জিন্না কয়েক বছর পরেই বললেন, “কয়েক শতক আগে যেদিন প্রথম হিন্দুটি ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছিল, সেদিনই পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে।”
অর্থাৎ জিন্নার মতে পাকিস্তান রাষ্ট্র অলরেডি সৃষ্টি হয়েই আছে, এখন তা বাস্তবায়ণ শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪০ সালে ২৩শে মার্চ লাহোর প্রস্তাবে জিন্না বললেন, “ভারতবর্ষের সমস্যা সাম্প্রদায়িক নয়, বরং জাতিগত। এটা খুবই দুঃখের যে হিন্দুরা ইসলাম ও হিন্দুত্বের প্রকৃত স্বরূপ বুঝতে পারছেন না। ইসলাম এবং হিন্দুত্ব শুধুমাত্র আলাদা ধর্ম নয়, সম্পূর্ণ বিপরীত দুই জাতিসত্ত্বা। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, হিন্দু ও মুসলমানরা দুটি পৃথক ইতিহাস থেকে প্রেরণা পায়। এদের একজনের মহাপুরুষ অন্য জনের শত্রু। মুসলমানরা সংখ্যালঘু নয়, মুসলমানরা একটা আলাদা জাতি। জাতি গঠনের সমস্ত প্রয়োজনীয় উপাদান তাদের মধ্যে আছে। তাই তাদের অবশ্যই নিজের বাসভূমির অধিকার আছে।”
ভিপি মেনন, ট্রান্সফার অব পাওয়ার, পৃষ্ঠা-৮২
এর ১০ দিন পর ১৯৪০ সালের ৬ই এপ্রিল, গান্ধীজী মুসলিম লীগের দাবিকে সমর্থন করে হরিজন পত্রিকায় লিখলেন, “দেশের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মত মুসলমান দেরও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আছে। বর্তমানে আমরা একটা যৌথ পরিবারের মত বসবাস করছি। তাই এর কোন এক শরিক ভিন্ন হতে চাইতেই পারে।”
মূলত: এই দুটি ঘটনাতে ১৯৪০ সালেই ভারত ভাগ হয়ে গিয়েছিল, ১৯৪৭ সালে তা শুধু বাস্তবায়ণ হয়েছে মাত্র।
মুসলমানরা যাতে পাকিস্তানের দাবী ভুলে না যায়, সেইজন্য ১৯৪২ সালের ১৮ই এপ্রিল গান্ধীজী হরিজন পত্রিকায় আবার লিখলেন, “যদি ভারতের বেশীর ভাগ মুসলমান এই মত পোষণ করে যে মুসলমানরা একটা আলাদা জাতি, যাদের সঙ্গে হিন্দু ও অন্যান্য গোষ্ঠীর মিল নেই, তবে পৃথিবীর এমন কোন শক্তি নেই যে সেই চিন্তাভাবনা থেকে তাদের বিরত করতে পারে এবং সেই ভিত্তিতে তারা যদি বেশীর ভাগ চায়, তবে অবশ্যই দেশভাগ করতে হবে। তবে ইচ্ছা করলে হিন্দুরা তার বিরোধীতা করতে পারে।”
জিন্না দেখলেন তাঁর দাবীর তেমন কোন বিরোধীতা হিন্দুদের মধ্যে নেই, বরং হিন্দুদের প্রধান নেতা গান্ধীজীর তাঁর দাবীর ব্যাপারে যথেষ্ট অনুমোদন রয়েছে।
এরপর ১৯৪৪ সালে জিন্নার সাথে গান্ধীজীর বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎ হয়।
গান্ধীজী জিন্নাকে বললেন, “আমি আপনার বা ইসলামের শত্রু নই, আমি আপনাদের দীন সেবক মাত্র। আমাকে দয়া করে ফিরিয়ে দেবেন না।”
গান্ধীজীর এই অসহায় আত্মসমর্পণএর উৎফুল্ল জিন্না পাকিস্তান আদায়ের প্ল্যান তৈরি করে ফেললেন। কারণ জিন্না বুঝেছিলেন শুধু মুখে বলে কিছু আদায় হবেনা, এর জন্য এ্যাকশনে যেতে হবে। তাই ১৯৪৬ সালের ২৮শে জুলাই বোম্বেতে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের জাতীয় সভায় ১৬ই আগস্ট জিন্না, “ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে,” বা “প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস,” হিসেবে ঘোষণা করলেন।
এই সভায় জিন্না বললেন, “পাকিস্তান বাদ দিয়ে অন্য কোনকিছুর সঙ্গেই মুসলমান জাতি কোনপ্রকার আপোষ করবে না, এখন সময় হয়েছে সেই দাবী আদায়ে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার। আমরা আজ একটা ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত সব সময়ই আমরা নিয়মতান্ত্রিক পথেই দাবী জানিয়ে এসেছি। কিন্তু আজ সময় এসেছে সেই নিয়মতান্ত্রিক পথকে বিদায় জানাবার। আজ আমাদের কাছে একটি পিস্তল আছে এবং আমরা তা ব্যবহার করতে সমর্থ।”
পীরজাদা, ফাউন্ডেশন অব পাকিস্তান, পৃষ্ঠা-৫৬০
প্রস্তুতি: ১৯৪৬ সালে সমগ্র বাংলায় মুসলমান ছিল ৫৫%, হিন্দু ৪৫%। তাই খুব সহজেই কংগ্রেসকে হারিয়ে প্রাদেশিক নির্বাচনে জিতে বাংলায় ক্ষমতা দখল করে মুসলিম লীগ। সোহরাওয়ার্দী বা সুরাবর্দী হলেন মুসলিম লীগ সরকারের মূখ্যমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও ছিল তাঁর হাতে। জিন্নার ডাইরেক্ট এ্যকশন ডে বাস্তবায়ণএর দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেন এই জল্লাদ। ২৮শে জুলাই থেকে ১৬ই আগস্ট, সময় খুব কম। তাই খুব দ্রুত পরিকল্পনামাফিক এগোতে থাকলেন তিনি।
১৯৪৬ সালের ৫ই আগস্ট স্টেটসম্যান পত্রিকার এক নিবন্ধে সুরাবর্দী লিখলেন, “হিংসা এবং রক্তপাত অন্যায় নয়, যদি তা মহৎ উদ্দেশ্যে করা হয়। মুসলমানদের কাছে আজ পাকিস্তান আদায় করা ছাড়া অন্য কোন প্রিয় কাজ নেই।”
ওই দিনই খাজা নাজিমুদ্দিন যিনি পরে পূর্ব বাংলার মূখ্যমন্ত্রী হন, তিনি মুসলিম ইনস্টিউটে মুসলিম ন্যাশনাল গার্ডদের এক সমাবেশে বলেন, “মুসলিম লীগের এটা পরম সৌভাগ্য যে, এই রমজান মাসেই সংগ্রাম শুরু হবে। কারণ এই রমজান মাসেই জিহাদের নির্দেশ দিয়েছেন আল্লা।”
এই সঙ্গেই কলকাতার মুসলমান মেয়র ওসমান খান উর্দুতে একটি প্রচারপত্র বিলি করেন যাতে লেখা ছিল, “আশা ছেড়ো না, তরোয়াল তুলে নাও, ওহে কাফের, তোমাদের ধ্বংসের দিন বেশী দূরে নয়।”
এই লিফলেটে ছিল তরোয়াল হাতে জিন্নার ছবি। এ ছাড়া মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে হিন্দুদের কিভাবে ধ্বংস করা যাবে সেই রকম ২৩টি নির্দেশ সংক্রান্ত একটি লিফলেট বিলি করা হয়। নির্দেশগুলো এইরকম:
১। ভারতের সকল মুসলমান পাকিস্তানের দাবীতে প্রাণ দেবে।
২। পাকিস্তান জয়ের পর সারা ভারত জয় করতে হবে।
৩। ভারতের সব মানুষকেই ইসলামে ধর্মান্তরিত করতে হবে।
৪। সমস্ত মুসলিম রাষ্ট্রকেই বৃটিশ-আমেরিকার পৃথিবী শোষণের সাথে হাত মেলাতে হবে।
৫। একজন মুসলমানকে ৫জন হিন্দুর অধিকার পেতে হবে, অর্থাৎ একজন মুসলমান সমান ৫জন হিন্দু।
৬। যতদিন পর্যন্ত পাকিস্তান ও ভারত স্থাপিত না হয়, ততদিন পর্যন্ত নিম্নলিখিত কাজগুলি করে যেতে হবে।
৭। হিন্দুদের যত কলকারখানা ও দোকানপাট আছে, তা ধ্বংস করতে হবে এবং লুঠ করতে হবে এবং লুঠের মাল মুসলিম লীগ অফিসে জমা দিতে হবে।
৮। মুসলিম লীগের সব সদস্যকে অস্ত্র বহন করতে হবে।
৯। সকল জাতীয়তাবাদী মুসলমান যারা লীগের সাথে যুক্ত হবে না অর্থাৎ কংগ্রেসী, তাদের গুপ্তহত্যা করতে হবে।
১০। হিন্দুদের ক্রমাগত খুন করে যেতে হবে এবং তাদের সংখ্যা কমাতে হবে।
১১। সমস্ত মন্দির ধ্বংস করতে হবে।
১২। কংগ্রেস নেতাদের প্রতিমাসে ১জন করে খুন করতে হবে।
১৩। কংগ্রেসের অফিসগুলি মুসলমানদের দিয়ে ধ্বংস করাতে হবে।
১৪। করাচী, বোম্বাই, কলিকাতা, মাদ্রাজ, গোয়া ও বিশাখাপত্তনম ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে অচল করে দিতে হবে।
১৫। কোন মুসলমানকে হিন্দুদের অধীনে সামরিক বাহিনী, নৌবাহিনী, সরকারী, বেসরকারী কোথাও কাজ করতে দেওয়া হবে না।
১৬। মুসলমানদের সমস্ত ভারত ও কংগ্রেসকে অন্তর্ঘাত করে যেতে হবে, মুসলমানদের দ্বারা শেষ ভারত আক্রমণ হওয়া পর্যন্ত।
১৭। এসব ব্যাপারে প্রয়োজনীয় অর্থ দেবে মুসলিম লীগ।
১৮। সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র বোম্বাই, দিল্লী, কলিকাতা, মাদ্রাজ, ব্যাঙ্গালোর, লাহোর, এবং করাচির মুসলমানদের হাতে ভাগ করে দেওয়া হবে।
১৯। মুসলিম লীগের সব সদস্য অস্ত্র ব্যবহার করবে, এমনকি দরকার হলে পকেটে রাখার মতো ছোরা ব্যবহার করবে, যাতে ভারতবর্ষ থেকে সমস্ত হিন্দুদের তাড়িয়ে দেওয়া যায়।
২০। সমস্ত বাহন হিন্দুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যবহার করা হবে।
২১। সমস্ত হিন্দু নারী ও মেয়েদের ধর্ষণ করবে, লুঠ করবে, ইসলামে ধর্মান্তরিত করবে ১৬ই আগস্ট, ১৯৪৬ সাল থেকে।
২২। হিন্দু সংস্কৃতি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করতে হবে।
২৩। লীগের সমস্ত সদস্যরা হিন্দুদের প্রতি সব সময় নিষ্ঠুর ব্যবহার করবে এবং তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সব ব্যাপারে পরিত্যাগ করবে।
এর পাশাপাশি নোয়াখালি, ত্রিপুরা, চট্টগ্রাম, ঢাকা, মুর্শিদাবাদ, হুগলি, নদীয়া, ২৪ পরগনা প্রভৃতি জেলায় মুসলিম লীগের আহ্বানে অনুষ্ঠিত জনসভায় আকারে ইঙ্গিতে মুসলমানদের বুঝিয়ে দেওয়া হয় যে দেশে মুসলিম লীগের সরকার আছে, সুতরাং পাকিস্তান আদায়ের জন্য ১৬ই আগস্ট থেকে অগ্নিসংযোগ, লুঠ, নারী অপহরণ, ধর্ষণ, খুন এসবের জন্য কারও কোন প্রকার শাস্তি হবে না।
এসব প্রচারের সাথে সাথে বাইরে থেকে প্রচুর সংখ্যক মুসলমানকে কলকাতায় এনে বিভিন্ন মুসলমান বস্তিতে রাখা হয়।
এ্যাকশন শুরুর এক সপ্তাহ আগে থেকে চোখে পড়ছিল কিছু খণ্ডিত দৃশ্য:
১। বেলগাছিয়া, রাজাবাজার, কলাবাগান বস্তি, ক্যানাল ওয়েস্ট রোড, ধর্মতলা, পার্কসার্কাস, এন্টালি প্রভৃতি এলাকায় বেশ কিছুদিন ধরে মুসলমানরা বিভিন্নরকম অস্ত্রশস্ত্রে ধার দিচ্ছিল।
২। বেলগাছিয়া ও বি টি রোডে লাঠি, ছোরা ও তরোয়াল ভর্তি লরি দেখা যাচ্ছিল।
৩। মানিকতলায় ক্যানাল ওয়েস্ট রোডে অস্ত্র ভর্তি ঠেলাগাড়ি দেখা যাচ্ছিল।
৪। মুসলমানদের দোকানগুলোতে পাকিস্তান লিখে চিহ্নিত করা হচ্ছিল।
এ্যাকশনে ট্রাক/লরীর ব্যবহার: কলকাতার মেয়র ওসমান খান কর্পোরেশনের সব লরী মুসলিম লীগের নেতাদের ব্যবহারের জন্য দিয়ে দিয়েছিলেন, যাতে করে মুসলমানরা সে সব লরী ব্যবহার করে ইচ্ছেমত লুঠপাট করতে পারে আর হিন্দুদের মারার জন্য অস্ত্রশস্ত্র বহন করে বিভিন্ন এলাকার মুসলমানদের হাতে তা পৌঁছে দিতে পারে। এই লরীগুলো যাতে ঠিক মত চলতে পারে, সেই জন্য সুরাবর্দী সরকার সেই সময় পেট্রোলের যথেষ্ট অনটন থাকা সত্ত্বেও ঢালাও ভাবে লুঠপাট ও হিন্দু হত্যার কাজে নিয়োজিত লরীগুলোর জন্য পেট্রোলের কূপন ইস্যু করেছিল। এছাড়া বর্তমান বাংলাদেশে ব্যবসায়রত ইস্পাহানি মির্জাপুর চা কোম্পানির মালিক ইস্পাহানি ছিলেন সেই সময় সুরাবর্দী সরকারের চাল সরবরাহকারী। ইস্পাহানি নিজের সব লরী মুসলিম লীগের লোকজনদের ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডের সময় ব্যবহারের জন্য দিয়ে দিয়েছিলেন। এসব লরীতে মুসলিম লীগের পতাকা টাঙ্গিয়ে তা সন্ত্রাসের কাজে ব্যবহার করা হয়েছিল। যেসব লরীর পেট্রোলের কূপন ছিল না, তারা জোর করে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে বিভিন্ন পেট্রোল পাম্প থেকে পেট্রোল আদায় করেছিল।
এ্যাকশনের পূর্বরাত্রি: ১৮ দিন ধরে সমস্ত প্রস্তুতি নেওয়ার পর, ১৫ই আগস্ট ১৯৪৬ তারিখে মুসলিম লীগ ১৬ই আগস্ট বাংলা বন্ধের ডাক দেয়, আর কোন কারণ না থাকা সত্ত্বেও সুরাবর্দী ঐ দিন ঘোষণা করেন সরকারী ছুটি। উদ্দেশ্য, যাতে নিরাপদে এবং নিশ্চিন্তে মুসলমানরা হিন্দুদের হত্যা করতে পারে ও তাদের ধন সম্পত্তি লুঠ করতে পারে। এ্যাকশনে অংশগ্রহণএ ইচ্ছুক মুসলমানদের কলকাতা শহর বিভিন্ন সেক্টরে ভাগ করে, এক এক এলাকার দায়িত্ব এক এক এলাকার মুসলমানদের দেওয়া হয়। যেমন বেলগাছিয়ার মুসলমানদের উপর দায়িত্ব পড়ে পুরো বেলগাছিয়া এলাকা বিধ্বস্ত করার। রাজাবাজার এলাকার মুসলমানদের উপর দায়িত্ব পড়ে মানিকতলা থেকে শিয়ালদহ এবং বৌবাজার ও কলেজস্ট্রীট এলাকা। কলাবাগান বস্তির মুসলমানদের জন্য নির্দিষ্ট হয় হ্যারিসন রোড, বড়বাজার, ঠনঠনিয়া, মার্কাস স্কোয়ার ও ফলপট্টি অঞ্চল। কলুটোলা, জ্যাকেরিয়া স্ট্রীট, নাখোদা মসজিদ, টেরিটি বাজার, ফিয়ার্স লেন এলাকার মুসলমানদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয় লালবাজার থেকে চিৎপুর এবং ক্যানিং ও এজরা স্ট্রীট অঞ্চল। এছাড়া ধর্মতলা, তালতলা, ওয়েলেসলি, পার্কসার্কাস, বেলেঘাটা, বালিগঞ্জ, খিদিরপুর, ওয়াটগঞ্জ, মেটিয়াবুরুজের মুসলমানদের উপর ভার পড়ে স্ব স্ব এলাকার হিন্দুদের হত্যা করার ও তাদের ধনসম্পত্তি লুঠপাট করার।
এই হিন্দু হত্যার প্রত্যক্ষ পরিচালক রহমান আলী ১৫ই আগস্ট রাতে তার লোকজন নিয়ে কলকাতায় এসে পড়ে এবং মুসলমান গুণ্ডাদের খিদিরপুর, কলুটোলা, রাজাবাজার, ধর্মতলা, পার্কসার্কাস, তালতলার বিভিন্ন মুসলমান বস্তিতে থাকার ব্যবস্থা করে। রহমান আলী সবাইকে বলে দিয়েছিল লুঠের মালের ভাগ কাউকে দিতে হবে না। আর খুন, ধর্ষণ, অপহরণে পুলিশ কোন নাক গলাবে না, সরকার থেকে এসব দেখবে।
ভেতরে ভেতরে এসব প্রিপ্যারেশন নেওয়া হল আর মুখে বলা হল ১৬ই আগস্ট প্রত্যক্ষ সংগ্রামের দিন মুসলিম লীগের নেতাকর্মীরা এখানে সেখানে মিছিল মিটিং করে পাকিস্তানের পক্ষে জনমত গঠন করবে, এককথায় প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস হবে শান্তিপূর্ণ!
আগেই উল্লেখ করেছি মুসলিম লীগ ১৬ই আগস্ট বাংলা জুড়ে হরতালের/বন্ধের ডাক দেয় এবং সূরাবর্দীর সরকার সরকারী ছুটি ঘোষণা করে। মুসলিম লীগের এই যৌথ কর্মসূচীতে কংগ্রেস কিছুটা হৈচৈ করে বটে, কিন্তু আইনসভার চার দেওয়ালের মাঝেই তা আটকে থাকে, এর বিরুদ্ধে জনমত গঠন করে এটাকে প্রতিরোধের কোনো চেষ্টাই কংগ্রেস করেনি। একমাত্র ড: শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির হিন্দু মহাসভা জায়গায় জায়গায় প্রতিবাদ কর্মসূচী চালানোর চেষ্টা করে, কিন্তু কংগ্রেসের মত জনসমর্থন না থাকায় লোকজনের মাঝে তা বিশেষ প্রভাব ফেলতে পারেনি।
“প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস শান্তিপূর্ণ ভাবে পালন করা হবে,” জিন্না ও মুসলিম লীগের এই মিথ্যা আশ্বাসে ভুলে গান্ধীজী চুপ করে থাকেন।
আর নেহরু বললেন, “যারা বন্ধ সমর্থন করে না, তারা যেন প্রতিদিনের মতই হাট, বাজার, অফিস করে।”
মুসলিম লীগের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম নিয়ে সবচেয়ে অদ্ভুত স্ট্যান্ড নেয় কমিউনিস্ট পার্টি।
১৩ই আগস্ট, ১৯৪৬এ পার্টির নেতা জ্যোতি বসু এক প্রচার বিজ্ঞপ্তিতে জানালেন, “মূলত: আমাদের পার্টির চেষ্টা হবে মুসলিম লীগের ডাকা বাংলা বন্ধের দিন রাজ্যের শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখা। তাই যেখানে প্রয়োজন আমরা বন্ধ সমর্থন করব, আর যেখানে প্রয়োজন নয়, সেখানে বন্ধের বিরোধীতা করব।” কমিউনিস্টদের সিদ্ধান্ত ছিল যেখানে বন্ধের প্রয়োজন, অর্থাৎ মুসলিম এলাকায় ওরা বন্ধ সমর্থন করবে, আর যেখানে বন্ধের প্রয়োজন নেই, অর্থাৎ হিন্দু এলাকায় বন্ধ সমর্থন করবে না, বন্ধের প্রতিবাদ করবে। ১৪।৮।১৯৪৬ তারিখে অমৃতবাজার পত্রিকায় বেরিয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টির এই নীতির খবরটি।
কলকাতার মেয়র ওসমান খান এবং তাঁর সহযোগী শরীফ খান, সক্রিয়ভাবে ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডের এই হিন্দু হত্যা পরিচালনা করেন। রাজ্যের স্বরাষ্ট্রদপ্তর ছিল মূখ্যমন্ত্রী সুরাবর্দীর হাতে। এই এ্যাকশনে পুলিশ প্রশাসনের কোন সাহায্য যাতে হিন্দুরা না পায়, সেই জন্য রাজ্যের ২৪টি পুলিশ হেড কোয়াটার্সের সব কয়টি থেকে হিন্দু পুলিশ অফিসার সরিয়ে ২২টিতে মুসলিম পুলিশ অফিসার এবং ২টিতে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পুলিশ অফিসার নিয়োগ করেন সুরাবর্দী। শুধু তাই নয়, ১৬ই আগস্ট সকাল থেকে সুরাবর্দী এবং মেয়র ওসমান খান বসেছিলেন লালবাজার পুলিশ হেড কোয়ার্টার্সে এবং সেখান থেকেই তাঁরা নজর রাখছিলেন মুসলমানরা কোন এলাকায় কত হিন্দু মারতে পারল। এমনকি একটি থানা আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও সুরাবর্দী ঐ থানায় লালবাজার থেকে কোন পুলিশ ফোর্স পাঠাননি।
এ্যাকশন: মুসলিম শরীফের ৭৪৫ নং হাদিসে বলা আছে, “নবী যখন কোন জনপদ আক্রমণ করতেন তখন ভোরবেলায় করতেন।”
কলকাতাতেও এই সূত্র খাটিয়েছিলেন হিন্দু হত্যার খলনায়ক সুরাবর্দী এবং তাঁর অনুসারীরা। ১৫ই আগস্ট রাতে টার্গেট এলাকার সমস্ত মসজিদে মুসলমানদের জড় করা হয়েছিল। যাদের অস্ত্র ছিল না, মসজিদেই তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়েছিল। তারপর ফজরের (ভোরের) নামাজ শেষে খোলা তরবারি হাতে মুসলমানাদের নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল রাস্তায়। অন্যদিকে নির্বোধ হিন্দুরা মুসলমানদের দুই সপ্তাহের প্রস্তুতি দেখেও তার বিরুদ্ধে কোন রকম সাবধানতা না নিয়ে নিশ্চিন্ত ঘুমিয়ে ১৬ই আগস্ট সকালে যেই না রাস্তায় বেরিয়েছে, অমনি মুসলমানরা আক্রমণ করে তাদের খুন করতে শুরু করে ।
প্রথম ছুরিকাঘাত করা হয় ভোর ৪.৩০ মিনিটে, ভোরের হাওয়া খেতে বের হওয়া এক হিন্দুকে। এরপর সকাল সাড়ে ছটায় বিপুল সংখ্যক মুসলমান আক্রমণ করে মানিকতলা বাজার, ভাংচুর ও লুঠ করতে থাকে হিন্দুদের দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এসময় দুজন হিন্দু মহিলা মুসলমানদের হাতে আক্রান্ত হয়, একজন হিন্দু পুরুষ ছুরিকাঘাতে নিহত হয়।
এরপর থেকে ব্রেকিং নিউজ হিসেবে লালবাজার পুলিশ হেড কোয়াটার্সএ যেসব খুন জখম লুঠপাট ও অগ্নি সংযোগের খবর আসতে থাকে সেগুলো হল:
সকাল ৭ টা: মানিকতলা মুসলমানরা আক্রমণ করেছে।
সকাল ৭.৩০: লালবাজার টেলিফোন অফিসের কর্মকর্তা সার্জেন্ট ই উইয়লিয়াম থানায় রিপোর্ট করেন যে তিনি যখন তাঁর মহিলা সহকর্মীকে প্রহরা দিয়ে একটি পুলিশের গাড়িতে করে নিয়ে সেন্ট্রাল এভিনিউ দিয়ে যাচ্ছিলেন, সেই সময় তাঁর গাড়িতে মুসলমানরা হামলা করে এবং তাঁদের আহত করে।
সকাল ৭.৩৫: বউবাজার ও লোয়ার সার্কুলার রোডের সংযোগস্থল শিয়ালদহে বিরাটসংখ্যক মুসলমান লাঠি ও লোহার রড সহ বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে জমায়েত হয়েছে।
সকাল ৮.২৫: টেরিটিবাজার মুসলমানরা আক্রমণ করেছে।
সকাল ৮.৩০: লোয়ার চিৎপুরে সিটি সিনেমা হল এলাকায় মুসলমানরা আক্রমণ করেছে।
সকাল ৯টা: শিয়ালদহ এলাকার অবস্থা ভয়াবহ।
সকাল ৯.০৫: ওয়ার্ডস ইনস্টিউশন স্ট্রীটে মুসলমানরা আক্রমণ করেছে।
সকাল ৯.১২: রিপন স্ট্রীট, ওয়েলেসলি স্ট্রীট ও মল্লিকবাজার এলাকায় মুসলমানরা যাকে পাচ্ছে তাকেই ছুরিকাঘাত করে হত্যা করছে।
সকাল ৯.৩০: বড়তলা থানার পুলিশেরা মুসলমানদের দ্বারা আক্রান্ত। থানা থেকেই সশস্ত্র পুলিশের সাহায্য চাওয়া হয়েছে লালবাজার পুলিশ হেডকোয়াটার্সে।
সকাল ৯.৫৫: বড়তলা থানা থেকে আবার সাহায্যের অনুরোধ।
সকাল ১০.১০: দমদম রোডে কয়েক হাজার মুসলমান আক্রমণ করেছে। হিন্দুরা বাধা দেবার চেষ্টা করলে মুসলমানরা গুলি বর্ষণ করেছে।
সকাল ১০.১২: গড়পার যোগীপাড়া লেন অর্থাৎ ক্যানাল অঞ্চল মুসলমানরা আক্রমণ করেছে।
সকাল ১০.৩০: হ্যারিসন রোডে গোলমাল, রিপন কলেজের সামনে দুপক্ষের লড়াই চলছে।
বেলা ১১.০৮: ২১২, বিবেকানন্দ রোডের কমলা বস্ত্রালয়ে আগুন লাগান হয়েছে।
বেলা ১১.১৫: রিপন কলেজের সামনে সাংঘাতিক দাঙ্গা চলছে।
বেলা ১১.৫০: মুসলমানদের একটি বিরাট দল শিয়ালদহের দিক থেকে দোকান পাট লুঠ করতে করতে বউ বাজারের দিকে আগুয়ান। আর একটি দল হিন্দু বিরোধী শ্লোগান দিতে দিতে এবং দোকান লুঠ করতে করতে আপার সার্কুলার রোড ধরে ময়দানের দিকে এগিয়ে চলেছে। লাঠি ও খোলা তরবারি হাতে মুসলমানদের আর একটি দল শ্যামবাজার থেকে হাতিবাগান পর্যন্ত এগিয়ে আসছে।
দুপুর ১.৩০: ষষ্ঠীতলায় হিন্দুদের ঘরবাড়িতে অগ্নি সংযোগ, নারকেলডাঙ্গা মেইন রোডের কাছে পড়ে আছে ৫ টি মৃতদেহ।
বিকেল ৩টা: গড়পার এলাকায় ভয়ানক হত্যাকাণ্ড শুরু হয়েছে। খালের পশ্চিমপাড়ে হিন্দুদের পাইকারিভাবে হত্যা করা হচ্ছে। হিন্দুদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এই সময় ময়দানে মনুমেন্টের নিচে মুসলমানদের সমাবেশ চলছিল। সেখান থেকে হিন্দুবিরোধী বক্তৃতা দেওয়া হচ্ছিল, সমাবেশ শেষ হতে না হতেই মুসলমানরা হিন্দুদের দোকানে ভাঙচুর ও লুঠপাট করতে শুরু করে।
বিকেল ৪.০৫: লাইটহাউস সিনেমার পাশে সমস্ত হিন্দু মালিকানাধীন দোকান ভাঙা ও লুঠপাট চলছে।
বিকেল ৪.২০: মুসলমানরা বেঙ্গল ক্লাব আক্রমণ করেছে।
বিকেল ৪.৩০: মেট্রো সিনেমার পাশে কে সি বিশ্বাসের বন্দুকের দোকান ভেঙ্গে সমস্ত অস্ত্র লুঠ করে নিয়ে গেছে মুসলমানরা। ঐ অঞ্চলে আরও লুঠপাট চলছে।
বিকেল ৪.৪২: ধর্মতলা রোডের বিখ্যাত কমলালয় স্টোর্স সম্পূর্ণ লুঠ হয়ে গেছে।
বিকেল ৫.১০: কলকাতার সব বড় বড় রাস্তায় নৃশংস হত্যা ও লুণ্ঠন চলছে। ধর্মতলা স্ট্রীটে চাঁদনি চক বাজার মুসলমানদের দ্বারা লুণ্ঠিত। ইন্দ্র রায় রোডে সশস্ত্র মুসলমানরা বেরিয়ে আসছে।
মির্জাপুর স্ট্রীট ও আপার সার্কুলার রোডের সংযোগস্থল সশস্ত্র ও উত্তেজিত মুসলমানদের দ্বারা পরিপূর্ণ।
ওয়েলেসলি স্ট্রিটে বাটা সু কোম্পানি ও সেন এন্ড ল’র দোকান লুঠ করা হয়েছে।
৮ নং তারা চাঁদ দত্ত স্ট্রীটে গমের কলের হিন্দুদের খুন করা হয়েছে।
১৫২ নং লোয়ার সার্কুলার রোডে লক্ষীকান্ত দাসের সাইকেলের দোকান লুঠ করা হয়েছে এবং তাতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।
রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রীটের সমস্ত হিন্দু বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।
৫৫, ক্যানিং স্ট্রীটের এ্যালুমিনিয়ামের একটি দোকান লুঠ করা হয়। কয়েক শত মুসলমান ঐ দোকান লুঠ করে বিভিন্ন মাল নিয়ে যায় এবং যাওয়ার সময় ৬জন নিহত এবং ৭জন আহত হিন্দুকে তারা উঠিয়ে নিয়ে যায়।
মারকুইস স্ট্রীট, এলিয়ট রোড, কর্পোরেশন স্ট্রীট আর ওয়েলেসলি স্ট্রীটে হিন্দুদের পাইকারিভাবে হত্যা করা হয়েছে এবং তাদের বাড়িঘর লুঠ করা হয়েছে।
ডি.সি নর্থ খান সাহেব খলিলুর রহমান তাঁর রিপোর্টে ১৬ই আগস্ট সম্পর্কে লিখেছেন, “বিশৃঙ্খলা এবং অরাজকতা চলেছে ধর্মতলা স্ট্রীট, ওয়েলেসলি স্ট্রীট, মার্কেট স্ট্রীট, কর্পোরেশন স্ট্রীট এবং ফ্রি স্কুল স্ট্রীটে। দোকান লুঠ হয়েছে, খুন হয়েছে এবং হামলা এখনও চলছে। মিলিটারী মোতায়েন করা না হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন।”
উপরের এই বর্ণনা শুধু মাত্র ১৬ই আগস্টের। এরপর ১৭ তারিখ পুরো দিন এবং ১৮ আগস্ট দুপুর পর্যন্ত মুসলমানরা একইভাবে হিন্দুদের হত্যা, মেয়েদের ধর্ষণ, প্রাণের ভয় দেখিয়ে ধর্মান্তরের চেষ্টা, বাড়ি ঘরে অগ্নি সংযোগ এবং লুঠপাট করতে থাকে।
এভাবে গৃহহীন হয় হাজার হাজার হিন্দু। ধর্ষিতা এবং অপহৃতা মহিলাদের কোনো হিসেব ছিল না। কলকাতার রাস্তায় এখানে সেখানে জমে উঠেছিল লাশের পাহাড়। এই খুন হত্যার বীভৎসতা দেখে স্টেটসম্যান পত্রিকার বৃটিশ সাংবাদিক কিম ক্রিস্টেন লিখেছিলেন, “দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের(১৯৩৯-১৯৪৫) অভিজ্ঞতায় আমার স্নায়ু যথেষ্ট কঠিন হয়ে গিয়েছে। কিন্তু যুদ্ধও এত পৈশাচিক নয়, এ এক মধ্যযুগীয় বর্বর উন্মাদনা এবং এটাকে পৈশাচিক রূপ দেওয়া হয়েছিল।”
জ্যোতি বসু তাঁর লেখা এক বইয়ে কলকাতার এই ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডের কথা লিখতে গিয়ে লিখেছেন, “প্রথম তিন দিনে প্রায় ২০ হাজার লোক নিহত হয়।” অন্যান্য সূত্রে যে তথ্যগুলো পাওয়া যায় তা হল শহরের সমস্ত ড্রেন হিন্দুদের লাশে ভর্তি হয়ে গিয়েছিল, আর গঙ্গায় এত লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে দুর্গন্ধে মাঝিদের নৌকা চালান অসাধ্য হয়ে উঠেছিল। বাঁশের লগি দিয়ে লাশ সরিয়ে সরিয়ে রাস্তা তৈরি করে মাঝিদের নৌকা এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়েছিল। এই দৃশ্যগুলো কল্পনা করুন আর ভাবুন ১৯৪৬ সালে কলকাতায় মুসলমানরা হিন্দুদের ঠিক কত রক্ত ঝরিয়েছিল!
পরিস্থিতি কিছুটা শাস্ত হলে একই রকমের ছোরা বিভিন্ন এলাকায় পাওয়া গিয়েছিল, বেলগাছিয়া ও খিদিরপুর এলাকা থেকে বিপুল পরিমাণ অব্যবহৃত তরোয়াল, লাঠি ও ছোরা উদ্ধার করা হয়েছিল। এগুলো পুরোপুরি ব্যবহার হলে আরও কত হিন্দুর রক্ত ঝরত সেই বিষয়টি একবার কল্পনা করুন। আর একই জায়গা থেকে এরকম বিপুল পরিমাণ অব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার নিঃসন্দেহে এটাই প্রমাণ করে যে হিন্দু হত্যার এই পরিকল্পনা ছিলো সম্পূর্ণ পূর্বপরিকল্পিত এবং অস্ত্রগুলোও মুসলিম লীগ সরকারের পক্ষ থেকেই সরবরাহ করা হয়েছিল। আরও একটা উল্লেখযোগ্য লক্ষ্যণীয় বিষয় হল হত্যাকাণ্ডে কসাইখানার কসাইদের সক্রিয় ভূমিকায় লাগান হয়েছিল, যাতে কসাইদের জবাই করার দক্ষতাকে হিন্দুদের গলা কাটার জন্য ব্যবহার করা যায় এবং যত বেশী সম্ভব হিন্দুদের হত্যা করা যায়।
ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডের প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশের প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল শ্রী গোলক বিহারী মজুমদার আই.পি.এস, “ছেচল্লিশের আতঙ্কের দিনগুলো ভুলি নি,” শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন।
সেই প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেছেন, “রাত ১১/১২টা নাগাদ ( ১৬ আগস্ট, ১৯৪৬) পাড়ায় ওরা আবার আক্রমন করলো। দেখলাম একদল লোক – তাদের হাতে ছোরা, তরোয়াল ইত্যাদি নানা অস্ত্রশস্ত্র। তারা চিৎকার করে বলছে, ‘আজ তো এক এক হিন্দুকো কোরবানী করেগা।’ মা, বাবা, দিদি, আমি, ভাগ্নে সবাই সন্ত্রস্ত। যেকোনো মূহুর্তে আমরা আক্রান্ত হতে পারি। সবচেয়ে বেশি ভয় দিদিকে নিয়ে। দিদি দেখতে খুব সুন্দরী। ভাবলাম দিদিই হবে ওদের প্রথম টার্গেট। হিন্দু মেয়েদের ওপর ওদের বরবারই লোভ। চার পাঁচদিন পর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলেও আতঙ্ক কাটে নি। ইউনিভার্সিটি খোলা ছিল। রাজাবাজারের উপর দিয়ে আমাকে যেতে হত, একদিন দেখলাম গরু কেটে যেমন হুকের সাথে ঝুলিয়ে রাখে, তেমনিভাবে হাত পা কাটা হিন্দু মেয়েদের চুল বেঁধে সব ঝুলিয়ে রেখেছে। বীভৎস আর নৃশংস সেই দৃশ্য।”
দেবকুমার বসু, “১৯৪৬ এর দাঙ্গার কয়েকটা দিন” নামে একটি লেখা লিখেছেন ২০০৬ সালে, সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, “রাজাবাজারের সামনেই ভিক্টোরিয়া কলেজ ও স্কুল, মেয়েদের কলেজ ও হোস্টেল একদম ফাঁকা, সব পালিয়েছে। কেবলমাত্র রাস্তার দোতলার জানালায় চারটি মেয়েকে খুন করে রাস্তার দিকে ঝুলিয়ে রেখেছে কে বা কারা। এই নৃশংসতা ও বীভৎসতা যাঁরা দেখেছেন, তাঁরাই অনুভব করতে পারেন যে আমাদের মত যুবকরা কেন উত্তেজিত হয়ে ক্ষিপ্ত হবে। কেউ এই হোস্টেলের দিকে তাকালে রাস্তার দিকের জানালাগুলি ইট গেঁথে বন্ধ করে দেওয়া আছে দেখবেন। আজ ষাট বছর পরেও বন্ধ আছে। কাদের ভয়ে?”
তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়াভেল তাঁর ডায়েরিতে ৩।১১।১৯৪৬ তারিখে লেখেন, “পলাশীর যুদ্ধে যত লোক নিহত হয়েছে, তার চেয়েও বেশী লোক নিহত হয়েছে গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংএ!”
গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং সম্পর্কে লিওনার্ড মোসলে তাঁর বই, “দ্য লাস্ট ডেজ অব ব্রিটিশ রাজ,”এ লিখেছেন, “ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাওড়ার পোল পার হয়ে হাওড়া থেকে দলে দলে আসতে শুরু করলো মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত অবাঙ্গালি মুসলমান গুণ্ডারা এবং তারা মিশে গেল চৌরঙ্গী, চিৎপুরে অপেক্ষমাণ মুসলমানদের সঙ্গে, শুরু হলো প্রলয়কাণ্ড, কলকাতার মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলের হিন্দু এলাকাগুলিতে। ইসলামের বিশ্বপ্রেম গ্রাস করে নিল অরক্ষিত মুসলমান পরিবেষ্টিত হিন্দু পরিবারগুলোকে। আর্ত আহতদের আর্তনাদ, লাঞ্ছিত নারীর ভয়ার্ত ক্রন্দন চাপা পড়ল, “লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান,” এবং “আল্লা হো আকবর,” এর উন্মত্ত কোলাহলে। আগুনে জ্বলতে লাগল হিন্দুদের স্থাবর অস্থাবর সব কিছু, আকাশে উঠল কুণ্ডলায়িত কালো ধোঁয়া।”
মুসলমানদের এই আক্রমন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর “দ্বিখণ্ডিতা মাতা ধর্ষিতা ভগিনী” পুস্তিকায় লিখেছেন, “১৬ আগস্টের ২/৩ দিন আগে থেকেই কলিকাতার নিকটবর্তী জেলাগুলো থেকে নৌকাযোগে হায়নার দল গঙ্গার ঘাটে ক্রমে ক্রমে বাসা বেঁধেছিল। শ্রাবণের জমাট বাঁধা কালো মেঘের আড়াল ভেঙ্গে সেদিন সূর্য উঠেছিল কলিকাতার আকাশে, আর রাতের আঁধারেই তৈরি হয়েছিল শত শত ইসলামের বিশ্বস্ত সৈনিক সম্পূর্ণ অপ্রস্তত নিরীহ হিন্দুদের প্রাণ সংহার করতে।”
১৯৪৬ সালে কলকাতার হিন্দুদের রক্ষা করেন শ্রী গোপাল মুখার্জি : সূরাবর্দী সরকারের পুলিশ প্রশাসনের সহায়তায় মুসলমানদের হাতে হিন্দুরা যখন একের পর এক মার খাচ্ছিল, মরছিল আর ধর্ষিতা হচ্ছিল এবং এটা যখন লাগাতার তিন দিন ধরে চলল, তখন কিছু হিন্দু বুঝতে পারল যে হিন্দুদের বাঁচাতে সরকার বা পুলিশ কিছুই করবে না। অতএব যা করার নিজেদেরই করতে হবে। এই ভাবনা নিয়ে একজন কসাই, নাম গোপাল, পাঁঠার মাংস বিক্রি করতেন বলে যাঁর নাম হয়েছিল গোপাল পাঁঠা, সেই গোপাল পাঁঠা ১ দিনের মধ্যে ৮০০ হিন্দু ও শিখ যুবককে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন এক বাহিনী এবং পাল্টা মুসলমানদের হত্যা করতে শুরু করেন। এর পরই খুব দ্রুত পরিস্থিতি মুসলমানদের বিরুদ্ধে যেতে থাকে এবং সূরাবর্দী তাঁর বিপদ বুঝতে পারেন। তাই মুসলমানরা মার খেতে শুরু করতেই সূরাবর্দী দ্রুত পুলিশ প্রশাসনকে সক্রিয় করেন এবং দাঙ্গা থামাতে বাধ্য হন। গোপাল পাঁঠা নামক এক বীরের নেতৃত্বে ১৯৪৬এ রক্ষা পেল কলকাতার হিন্দুরা ।
হিন্দুরা নিজের জাতির লোকের প্রতি কেমন অকৃতজ্ঞ আর বেইমান, গোপাল পাঁঠার প্রতি হিন্দুদের দৃষ্টিভঙ্গীতে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। যাঁর জন্য কলকাতার হিন্দুরা রক্ষা পেল, তাঁকে পরবর্তীকালে কোন হিন্দু তাঁর মূল্যায়ণ করা তো দূরে থাক, তাঁর নাম পর্যন্ত মনে রাখেনি। গোপাল পাঁঠার জীবদ্দশায় একজন মাত্র সাংবাদিক তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। অথচ প্রতিবছর ১৬ই আগস্ট আসে যায়, কিন্তু তাঁকে নিয়ে তাঁর দ্বারা রক্ষিত অর্ধমৃত বৃদ্ধদের কারো কোন মাথাব্যথা নেই!
হিন্দুদের এই অকৃতজ্ঞতা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন বাংলাদেশ মাইনরিটি ওয়াচের শ্রদ্ধেয় রবীন্দ্র ঘোষও, তিনি বলেছিলেন, “অনেক কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে যখন কোন মেয়েকে মুসলমানদের হাত থেকে উদ্ধার করে তাদের পরিবারে পৌঁছে দিই, তখন অনেকেই ধন্যবাদ পর্যন্ত দেয়না। এই ক্ষোভ এবং লজ্জা আমারও, কিন্ত কাকে দোষ দেব? আমি নিজেই তো হিন্দু সমাজের একজন সদস্য। হিন্দুদের জন্য কাজ করতে হলে এদের নিয়েই কাজ করতে হবে আর অল্প অল্প করে সিস্টেমটাকে পাল্টাতে হবে। আজ আমি বুঝেছি, কাল আপনি বুঝবেন, পরশু আরেকজন বুঝবে এভাবেই হিন্দু সমাজের দুর্বলতাগুলো কেটে যাবে এবং সমাজ আস্তে আস্তে পরিবর্তনের পথে চলবে। হতাশ হওয়ার কিছু নেই, পরিবর্তন এক দিনে হয়না, আর এক দিনে বড় কিছু অর্জন করা যায় না। হিন্দু সমাজের যে ক্ষত ও দুর্বলতা সেই লজ্জা আমাদের পূর্ব পুরুষদের, কিন্তু এখন আমরা যদি সেই দুর্বলতাগুলো কাটানোর চেষ্টা না করি, তাহলে আমরা যেমন এখন পূর্বসূরীদের দায়ী করছি, তেমনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মও আমাদের দায়ী করবে আর গালি দেবে। এ ভুল আমি করতে চাই না, আর আমি বিশ্বাস করি, আপনিও নিশ্চয় চান না।”
মুসলমান হওয়ার প্রস্তাব: সেই সময়ের একটি ঘটনায় জানা গেছে, মুসলমানদের দ্বারা আক্রান্ত হিন্দু পরিবারের একটি অবিবাহিত যুবতী মেয়ে তার প্রতিবেশী মুসলমানের বাড়িতে গিয়ে সাহায্য ও আশ্রয় চাইলে, ওই বাড়ির মুসলমান মালিক মেয়েটিকে প্রকাশ্যে এই প্রস্তাব দেয় যে মুসলমান হলে তাকে সাহায্য ও রক্ষা করবে। মেয়ে?
(সংকলিত)