নতুন বন্ধুদের জন্য আবার দিলাম।
যুদ্ধ /দেবাশিস লাহা
যুদ্ধ যুদ্ধ রব উঠলেই আমার মেজো পিসির কথা মনে পড়ে। কৃষ্ণবর্ণের এমন দৃষ্টিনন্দন নারী সত্যি-ই কম দেখেছি। আলপথ দিয়ে এমন কারও পা হেঁটে যায় বলেই কৃষ্ণকলি নামের এক অবিস্মরণীয় কবিতার জন্ম হয়। পিসির দুই মেয়ে আর এক ছেলে। মুক্তি, ভক্তি আর মধু। মধু শুধু আমার পিসতুতো ভাই নয়, সবচেয়ে প্রিয় একজন বন্ধু। পাশের গ্রাম বিনসিড়া থেকে যখনই ও বেড়াতে আসত, আনন্দে লাফিয়ে উঠতাম। মাছ ধরা থেকে শুরু করে সাঁতার কাটা, চাকা চালানো, যাত্রা দেখতে যাওয়া— মধু ছাড়া সব কিছুকেই বড় মিথ্যে মনে হতো। ওদের কোনো বাবা ছিল না।
পিসিকে কেন্দ্র করেই ‘বিধবা’ শব্দটির সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয় । তখনও জানতাম না ‘ধব’ শব্দটির অর্থ স্বামী এবং ‘ধব’এর মৃত্যু হলে সেই অভাগিনী নারীটিকে বিধবা বলা হয়। আমার তখন ক্লাস থ্রী কিম্বা ফোর। একটু একটু একটু করে বড় হচ্ছি। কোনো কিছুতেই আটকায় নি। খাওয়া, দাওয়া, খেলাধূলা, ছাগলের পেছনে ছোটা অথবা দলছুট হাঁসকে ধাওয়া করে বাড়ি ফিরিয়ে আনা। শুধু বাবাকে দেখে ও খুব মনমরা হয়ে যেত। উপর দিকে মুখ তুলে বলত, “জানিস, আমারও বাবা আছে। ওই যে আকাশে। রাতে দেখাব। তারা হয়ে গেছে তো। তাই দিনের বেলা দেখা যায় না।
প্রত্যেক রাতে তিন জন মিলে দেখি।” পড়াশোনায় বেশি ভাল ছিলাম । তাই সারল্যকেও বোকামো বলে ভাবতে শুরু করেছি। জানতাম কেউ মরে গেলে কখনও তারা হয় না। তবু ওকে দুঃখ দিতে চাইতাম না। অন্ধকার নামতেই ওর বাবার খোঁজে পাড়ি জমাতাম। মধুসূদন দাসের বাবা মহেন্দ্র কুমার দাস তখন জামগাছের সবচেয়ে উপরের ডালে। মনে নেই কোন তারা। হয়ত রোহিণী, কৃত্তিকা, পৌলমী অথবা মৃগশিরা ! তর্জনী উঁচিয়ে বলত, “ওই দ্যাখ আমার বাবা !”
মেজো পিসেমশাই মহেন্দ্র কুমার দাসের সঙ্গে এভাবেই আমার আলাপ। একটু বড় হলে জেনেছিলাম পিসতুতো দিদির বাবা মহেন্দ্র দাস নন, আরেক জন। বিস্মিত হয়েছিলাম। কাউকে জিজ্ঞাসা করার সাহস পাইনি। কৌতূহল বাড়ছিল। সঙ্গে বয়সও। ইতিমধ্যে গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি জমিয়েছি। আমার তখন ক্লাস সেভেন।জীবনকে আরও কিছুটা বুঝেছি। গ্রীষ্মের ছুটিতে কলকাতা থেকে আবার উত্তরবঙ্গ। প্রশ্নটা করেই ফেললাম। কাকে করেছিলাম ঠিক মনে নেই। হয়ত বিস্ময়ে ।
অথবা স্বগতোক্তি। কিম্বা নিছক হাওয়াতেই ভাসিয়ে দিয়েছিলাম সেই সযত্নলালিত জিজ্ঞাসা। সেদিনই সন্ধে বেলায় দাদু আমাকে ডেকে পাঠালেন। প্রখর ব্যক্তিত্ব এবং গম্ভীর ব্যারিটোনের অধিকারী মানুষটির সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুব অসহায় মনে হলো। বৃত্তাকারে উড়তে থাকা একটা মথের দিকে তাকিয়ে নিজেকে অন্যমনস্ক করার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলাম। লন্ঠনের চারপাশে যতটা আলো উপরে ঠিক ততোটাই অন্ধকার। আরাম কেদারায় বসে থাকা মানুষটার চোখ তখনও বন্ধ। ইশারায় বসতে বললেন। উল্টোদিকে রাখা একটা কাঠের চেয়ার। বেশ উঁচু। দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় সফল হলাম।
শূন্যে দুলতে থাকা পাদুটোর দিকে তাকিয়ে নিজেকে আরও একটু বেশি অসহায় মনে হল। কে কথা বলে উঠবে কে জানে ! ততোদিনে জেনে গেছি এই দশাসই ব্যক্তিত্বের মানুষটা বিশ্বামিত্র থেকে শুরু করে মহিষাসুর পর্যন্ত অনেক পৌরাণিক তথা ঐতিহাসিক চরিত্রে অভিনয় করেছেন। যাত্রাভিনেতা হিসেবে ওপার বাংলায় যথেষ্ট সুনাম ।
কোথাও কোনো শব্দ নেই। পিন পড়লেও আওয়াজ শোনা যাবে। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি।দেওয়ালে দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হলো সেই মেঘমন্দ্রিত কন্ঠস্বর। দাদু শুরু করলেন, শেষও করলেন। কতক্ষণ হবে ? বড় জোড় পাঁচ মিনিটের গল্প। কিন্তু তারপরও বসে রইলাম। কোথাও যেন ভেসে যাচ্ছিলাম ! সেদিনই প্রথম দাদুর চোখে জল দেখেছিলাম । প্রথম এবং শেষ। জেনেছিলাম জীবনটা গল্পের চেয়েও রোমাঞ্চকর, হোরর মুভির চেয়েও ভয়াবহ।
আমার পিসি মল্লিকা লাহা ওরফে জোনাকির বিয়ে হয় মাত্র সতের বছর বয়সে। পাত্র প্রবীর লাহা। ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক মেজর। বিয়ের পর এক বছর যেতে না যেতেই চীন ভারত যুদ্ধ শুরু হল। সালটা ১৯৬২। পিসি তখন গর্ভবতী। এক সকালে তিনি যখন তাঁর এক মাসের মেয়েকে আদর করছিলেন, আচমকা এক সেনা জওয়ানের আভির্ভাব ঘটে। সঙ্গে একটি ট্রাঙ্ক। জওয়ানরা যেমন ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু এটির উপরে প্রবীর লাহার নাম লেখা ছিল। কথোপকথনে জানা যায় আগন্তুক সৈন্যটিও একজন মেজর।নাম মহেন্দ্র দাস।
তাঁর সহকর্মী প্রবীর লাহা মর্টারের আঘাতে গুরুতর আহত হন এবং সেনা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। চলে যাবার আগে তিনি তাঁর অবিবাহিত বন্ধুকে অনুরোধ করে যান তিনি যেন তাঁর বিধবা স্ত্রীকে পুনরায় বিবাহ করেন। যদি কোনো আপত্তি না থাকে। এই মর্মে একটি চিঠিও দেখান। পিসিকে উদ্দেশ্য করে লেখা। যদিও সেটা ঠিকঠাক পড়া যায়নি। রক্ত আর অক্ষর একাকার হয়ে গিয়েছিল। দাদু আপত্তি করেন নি।
পিসিও না। তাই ভারত-চীন যুদ্ধ শেষ হতেই পিসির সঙ্গে শ্রীযুক্ত মহেন্দ্র কুমার দাসের বিবাহ বেশ ধূমধাম সহকারেই সম্পন্ন হয়। পিসির কোল আলো করে আরও দুটি সন্তান আসে। হরিণ চোখের কালো মেয়েটি তখনও জানত না যুদ্ধের পরেও একটা যুদ্ধ থাকে, তারপর আরও অনেক যুদ্ধ। না, এবার আর কোনো সেনা জওয়ান আসেনি। শুধু একটা টেলিগ্রাম এসেছিল—উই আর স্যাড টু ইনফর্ম ইউ————
সালটা ১৯৭১। বাংলাদেশের জন্ম হচ্ছে।
ক্লাস সেভেন থেকে এলেভেন।আবার উত্তরবঙ্গ। তখনও আমাকে কেউ তাড়া করে বেড়াচ্ছিল। সেটা ঠিক কী, তখনও বুঝে উঠতে পারিনি।কখনও ক্রোধ, কখনও আক্রোশ, আবার কখনও সমুদ্রপ্রতিম অসহায়তা। কাল্পনিক একটি শত্রু খুঁজে বেড়াতাম। পরণে সৈনিকের পোশাক। হাতে রাইফেল অথবা মেসিন গান। কিন্তু ইউনিফর্মে ভারতের নয়, পাকিস্তান কিম্বা চীনের প্রতীক। হাতের কাছে পেলে—- কী-বা করার ছিল ! War বোঝার আগেই যে War widow দেখে ফেলেছিলাম।
এই সময়েই পল বোমারের সঙ্গে আলাপ।পুরনো হয়ে যাওয়া হলুদ রঙের পাতাও যে এমন জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা এরিক মারিয়া রেমার্কের All Quiet on the Western Front না পড়লে বুঝতেই পারতাম না। পল বোমারই জানিয়ে দিয়ে গেল আঠেরো মাসে 2.5 মিলিয়ন কপি বিক্রি হওয়া বইটিকে হিটলার কেন নিষিদ্ধ করেছিলেন। তখন আমি সক্রিয় রাজনীতি করছি। মূল স্রোতের বাইরে থাকা একটি ছাত্রসংগঠন। হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন। নকশালপন্থী ।
পল বোমার আমার বুকে ঢুকে পড়ল। যেখানে যেতাম সেখানেই নিয়ে যেতাম ওকে। নদীর ধার, সুকুমারের চায়ের দোকান, অথবা শুনশান হয়ে যাওয়া মাঝরাত্তিরের শহর—পেপারব্যাকটা আমার পিছু ছাড়ত না। দু তিনটে পাতাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়তাম।তারই কিছু অংশ আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই। [ইংরেজি থেকে অনুবাদ । আপনাদের জন্য। যদিও কতটা সুখপাঠ্য হবে জানি না] জার্মান বাহিনীতে যোগ দেওয়া পল বোমার নিছক আত্মরক্ষার জন্য এক মিত্র পক্ষের সৈনিককে হত্যা করেন। সেটিই তাঁর প্রথম ‘hand to hand combat’ —
“আমি একা । কে কোন দিকে ছিটকে গেছে জানি না। মেশিনগানের শব্দে কান পাতা দায়। একটা ট্রেঞ্চের মধ্যে গুঁড়ি মেরে বসে আছি। আচমকা একটা পায়ের শব্দ। কে যেন আসছে। না, চলে গেলো। একটু পরে আবার ! গুলিগোলার শব্দটা বাড়ছে। মাঝে যতটুকু বিরতি ছিল, সেটাও আর নেই। কিন্তু পায়ের শব্দটা শোনা যাচ্ছে আবার। এদিকেই আসছে । হ্যাঁ এদিকেই ! সরে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তার আগেই কিছু একটা যেন হোঁচট খেল ! হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেল।
ঠিক আমার উপর ! মানুষের মত কিছু একটা । বেশ বড় সড়। আমার পিঠের উপর দিয়ে গড়িয়ে —এক মুহূর্তও ভাবলাম না। ছুরি চালালাম। পাগলের মত। এক দুই তিন চার—-অসংখ্যবার ! খিঁচুনি দিয়ে উঠল লোকটা। হাত পা সব কেঁপে উঠল ! মুরগীর মাথা কেটে নেবার পর যেমন সারা শরীরটা তড়পাতে থাকে। কয়েকটা মুহূর্ত। তারপর থেমে গেল । এই প্রথম খেয়াল করলাম আমার হাতদুটো কেমন আঠাল হয়ে গেছে । আঠাল এবং ভেজা।
একী লোকটা তো থামে নি। গর গর করছে ! মুখ দিয়ে ফেনা ! শ্বাস নেবার আপ্রাণ চেষ্টা ! আটকে যাওয়া শ্বাস প্রশ্বাসগুলো আর্তনাদ, শুধুই আর্তনাদ হয়ে ফেটে পড়ছে। ইচ্ছে হল পালিয়ে যাই। কিন্তু কোথায় ? মাথা বের করলেই গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাব। কিন্তু লোকটা এত শব্দ করছে কেন ? চুপ করে থাকতে পারছে না ? ইচ্ছে হল ওর মুখ বন্ধ করে দিই।
মাটি ঢুকিয়ে দিই দাঁতের ফাঁকে। অথবা আর একবার ছুরি চালাই। ও কেন চুপ করছে না ! না লোকটা এবার প্রতিশোধ নিচ্ছে। বিশ্বাসঘাতকতা করছে। চুপচাপ মরে গেলেই তো পারে। না, আর নয়। এবার ওকে থামিয়েই দিতে হবে। চিরকালের জন্য। কিন্তু একী ! আমার হাতগুলো এমন ঠাণ্ডা কেন ? বুঝলাম আমি আর কোনদিন ওর উপর ছুরি চালাতে পারব না !”
এখানেই শেষ নয়। আরও আছে। ছাপাখানার কর্মী ডুভালকে [হ্যাঁ বোমার যাকে হত্যা করেছিলেন, তিনি পেশায় প্রিন্টার ছিলেন।মৃতদেহের পকেট থেকে পাওয়া একটি নোটবই থেকে সেটি জানা যায়। ] হত্যা করার পর পল বোমারের মানসিক যন্ত্রণা ঠিক কোন উচ্চতায় পৌঁছেছিল নিম্নলিখিত অংশটুকু পড়লেই সেটা পরিষ্কার হয়ে যাবে—
“মৃতদেহটিকে আমি ফিসফিস করে বললাম । তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমোতে যাও। আমি তোমার স্ত্রীকে চিঠি লিখব। আমি তাকে সব কিছু শোনাব। তোমার সঙ্গে যা যা কথা হল। আমি দেখব ওর যাতে কোনো কষ্ট না হয়। আমি তোমার স্ত্রীকে সাহায্য করব। তোমার বাবা-মাকেও। আর তোমার ছোট্ট বাচ্চাটা ! তাকেও কোনো কষ্ট পেতে দেব না !”
——————–
———————
বিড়বিড় করে বললাম —ছাপাখানার কর্মী ডুভালকে আমি হত্যা করেছি।আমিও প্রিন্টার হব, প্রিন্টার !”
বইটা বন্ধ করে নদীর দিকে তাকালাম। দুটো মুখ ভেসে এল । একজন আমার প্রথম পিসেমশাই প্রবীর লাহার হত্যাকারী। আর একজন দ্বিতীয় পিসেমশাই মহেন্দ্র দাসের হন্তারক। ওদের কাউকেই আমি চিনি না। শুধু এইটুকু জানি একজন চীনা আর একজন পাকিস্তানী। নদীর ছলাত কানে আসতেই দুটো মুখ যেন একাকার হয়ে গেল !আবছাও নয়, কাল্পনিকও নয়। এখন স্পষ্ট দেখতে পাই ওদের ! চোখ, মুখ, চিবুক। একটা নামও দিয়ে ফেলেছি—-পল বোমার !
তারপর—-তারপর—-তারপর—
যুদ্ধ নিয়ে অনেক ভেবেছি। আপনারাও যেমন ভাবছেন। চারদিকে শুধু যুদ্ধ যুদ্ধ রব। তাই আরও ভাবছি। কত লেখা চোখে পড়ছে। বামপন্থী, ভামপন্থী, গেরুয়া, ভেড়ুয়া হরেক রকম ! কেউ যুদ্ধের পক্ষে, কেউ বিপক্ষে ! দুটো লাইন বারবার কানে আসছে—“জনতা যখনই চায় বস্ত্র ও খাদ্য/ সীমান্তে বেজে ওঠে যুদ্ধের বাদ্য !” কেউ কেউ বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলে দাবী করলেও যতটা জানি এটি শৈবাল মিশ্রের সঙ্গেই সম্পর্কিত। যাক, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। বামপন্থীদের খুব প্রিয় এই লাইনদুটিকে ভিত্তি করেই একটু গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করব।
যুদ্ধকে কেন্দ্র করে যত অতি সরলীকরণ আছে, বলাই বাহুল্য এটিও তার অন্যতম। মূলত ধনতন্ত্র এবং সাম্রাজ্যবাদকে আঘাত এবং ব্যঙ্গ করার জন্যই এই লাইনদুটির ঘন ঘন উদ্ধৃতি দেওয়া হয়। Imperialism is the highest state of capitalism—মহান লেনিনের এই বিশেষ পর্যবেক্ষণকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই যেন এই পঙক্তিদুটির জন্ম। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়। ধনতন্ত্র অথবা সাম্রাজ্যবাদ জন্ম নেওয়ার আগেও কী যুদ্ধ ছিল না ? আদিম সাম্যবাদী সমাজেও কী রক্তপাত ঘটেনি ?
এক সিংহীকে করায়ত্ত করার জন্য যখন একাধিক সিংহ পরস্পরকে রক্তাক্ত করে, সেটা কী যুদ্ধ নয় ? তবে সেটা কোন সাম্রাজ্যবাদ ? অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, যৌনতান্ত্রিক নাকি নিছকই এক আর্কিটাইপ ? যার নাম হিংসা ? তাছাড়া শুধু ধনতন্ত্রই কী সাম্রাজ্যবাদের জন্ম দেয় ? ১৯৭০ এবং ১৯৮০-এর প্রথমদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের কার্যকলাপকে কিভাবে চিহ্নিত করবেন ? আফগানিস্তানে পেশী আস্ফালন করা !সব কিছু গুঁড়িয়ে দিয়ে নজিবুল্লা সরকারের প্রতিষ্ঠা। যার ফলশ্রুতি হিসেবে আমারিকার পরোক্ষ হস্তক্ষেপ এবং মুজাহিদের নেতা হিসেবে ওসামা বিন লাদেনের আভির্ভাব।
আমারিকান গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি-ই তাকে সমস্ত রকম প্রশিক্ষণ এবং সহায়তা দিয়েছিল। কাঁধে ঝোলান স্টিঙ্গার মিশাইলের যথেচ্ছ সরবরাহ নিয়ে লাদেনের মুজাহিদিন বাহিনী এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল যে প্রায় পঞ্চাশ হাজার সেনা খুইয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। হ্যাঁ আফগানিস্তানেই আমরা প্রথম দুটো ভিন্ন সাম্রাজ্যবাদের সংঘাত দেখি— পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদ এবং সমাজতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদ !
তাই বামপন্থীরা যখন যুদ্ধের বিরোধিতা করেন, একবারও ভাববেন না, ওঁরা আপাদমস্তক শান্তিকামী। বাস্তব অন্য কথা বলে। কম্বোডিয়ার খেমের রুজ নেতা killing fields খ্যাত নৃশংস পল পট, ‘the great purger” জোসেফ স্তালিন কিম্বা great leap forward-এর মাও জে ডং—এদের কাউকেই তো আমরা ভুলিনি। পরে আসছি এঁদের কথায়। মূল অনেক গভীরে বন্ধু।
আসুন এবার ভাবি যুদ্ধের ভিত্তি কী ? কিসের বলে আমরা একে অপরকে রক্তাক্ত করি। কারণ যাই ঘটুক, চালিকা শক্তি কিন্তু সেই হিংস্রতা। প্রাগৈতিহাসিক এবং আদিম ! ইংরেজিতে যাকে violence বলে। না, বন্ধু এটা কোন ধনতন্ত্র বা সাম্রাজ্যবাদ মানে না।এ আমাদের রক্তের অন্তর্গত এক আর্কিটাইপ।যারা এই শব্দটির সঙ্গে পরিচিত নন,তাঁদের জানাই প্রখ্যাত মনস্তাত্ত্বিক C.G. Jung এর মতে Archetype হল উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত বিশেষ কিছু বোধ,অভিজ্ঞতা বা প্রতীতি যা জন্মগতভাবে প্রতিটি মানুষ অবচেতনভাবে সঙ্গে নিয়ে চলেছে।
[an inherited idea or mode of thought in the psychology of C. G. Jung that is derived from the experience of the race and is present in the unconscious of the individual—]
এই হিংস্রতার উত্তরাধিকার কবি জীবনানন্দ দাশকেও গভীর যন্ত্রণা দিয়েছে—
“সৃষ্টির মনে কথা মনে হয় দ্বেষ——–তাই বাঘ হরিণের পিছু আজও ধায় !”
শুধু কী এইটুকু ? না বন্ধু,অবিশ্বাস্য হলেও যুদ্ধের সঙ্গে যৌনতার অদ্ভুত একটি সম্পর্ক আছে। অবশ্যই male sexuality অর্থাৎ পুরুষ যৌনতা। সিগমণ্ড ফ্রয়েড থেকে শুরু করে ওয়েবার পর্যন্ত অনেক তাবড় তাবড় মনস্তাত্ত্বিক এ ব্যাপারে কম বেশি একমত। আধুনিক গবেষণায় বলা হচ্ছে—When men go to war, blame their sex drive; Males evolved to be ‘aggressive to outsiders’
কী, বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে ? স্বাভাবিক। আসুন একটু বোঝার চেষ্টা করি। প্রথমেই বলি এই হিংস্রতার প্রবণতা সবার মধ্যে সমান পরিমাণে নেই।
বিভিন্ন বিষয়ের উপর এর তীব্রতা নির্ভর করে। বিশদ আলোচনার অবকাশ এখানে নেই। sadist শব্দটি সঙ্গে নিশ্চয় চেনা। এর অর্থ হল যে অন্যকে যন্ত্রণা দিয়ে আনন্দ অনুভব করে। কুখ্যাত হূণ নেতা তোরমানের কথা মনে পড়ছে। যুদ্ধের অবসরে যখন মন খারাপ করত, পাহাড়ের কিনারায় বেশ কিছু হাতিকে নিয়ে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হত। বিশাল প্রাণী। সঙ্গে সঙ্গে মরত না। আর্তনাদ করতে করতে কয়েক ঘণ্টা তো বেঁচে থাকতই। আর সেই আর্তনাদ শুনে তোরমানের মন স্ফুর্তিতে ভরে উঠত।
ধর্ষকাম শব্দটিও নিশ্চয় অচেনা নয়। বেশ কিছু মানুষ যৌন সম্পর্ক করার সময় মাত্রাতিরিক্ত হিংস্র হয়ে ওঠেন।অশ্লীল খিস্তি থেকে শুরু করে চাবুক পর্যন্ত ব্যবহার করেন। কেউ কেউ আবার অত্যাচারিত না হলে উত্তেজিতও হন না। এঁদেরকে ধর্ষকামী বলা হয়। কী বন্ধু ? আপনি নিশ্চয় ভাবছেন আমি তো এমন নই। অতএব আমার মধ্যে হিংস্রতা নামক কোনো আর্কিটাইপ নেই। ধৈর্য রাখুন বন্ধু। আছে, অল্প মাত্রায় হলেও আছে। ফ্রয়েডের মতে আমাদের ব্যক্তিত্ব চার বছরের মধ্যেই মূলগতভাবে তৈরি হয়ে যায়। এরপর নিছক বাহ্যিক কিছু পরিবর্তন হয়।
অর্থাৎ cosmetic change হয়, elemental change হয় না। এবার কিছু বাচ্চাকে লক্ষ্য করুন। দেখবেন বেশ কিছু ছেলেমেয়ে [মূলত ছেলে] কুকুর অথবা বিড়ালকে ঢিল ছুঁড়ে বা মেরে আনন্দ পাচ্ছে। কোন কারণ নেই আচমকা একটা পাখির দিকে ইট ছুঁড়ে মারছে। অথবা হাঁটতে হাঁটতে কচু গাছের জঙ্গলে লাঠি চালিয়ে দিচ্ছে। এই তো পেয়ে গেছেন। শেক্সপীয়রের লেখা দুটো অসাধারণ লাইন মনে পড়ছে —As flies are to wanton boys, are we to the gods–”
হ্যাঁ বন্ধু এই wanton boys অর্থাৎ দুষ্টু ছেলেরা হিংস্রতার আর্কিটাইপটি-ই প্রতিষ্ঠিত করে। কিন্তু এরা সবাই যে পরবর্তীকালে তোরমান, হিটলার, মুশোলিনি অথবা পল পট হয়ে উঠবে তা নয়। সুপ্ত থাকা আর্কিটাইপটির বিকশিত হবার জন্য কিছু উদ্দীপক তো লাগবেই।
আর একটি উদাহরণ নেওয়া যাক। যেমন ধরুন আপনার পাড়ার পাল অথবা মিত্তিরবাবু। এমন নিরীহ মানুষ দুটি হয় না। জীবনে মশা ছাড়া কিছুই মারেন নি। ঠিক সময়ে কাজে যান, নিয়মমতো বাজার করেন, বউ বাচ্চাকে ভালবাসেন। ভাল মানুষই বলা যায়। কিন্তু সেদিন কী দেখলেন? একটা চোরকে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে গণধোলাই দেওয়া হচ্ছিল। ক্লাবের কিছু ছেলের কাজ। সে এক অমানুষিক দৃশ্য। পালবাবু কী একটা কাজে ওদিক দিয়ে যাচ্ছিলেন। সোজা পথেই পা চলছিল।
আচমকাইই ওঁর পা-দুটো খুঁটির দিকে বেঁকে গেল। বলা নেই কওয়া নেই, হাত পা বাঁধা মানুষটাকে দুমদাম দুটো ঘুষি আর লাথি বসিয়ে দিলেন। কী! অবাক হচ্ছেন? উঁহু বন্ধু! এমন দৃশ্য আপনি আমি অনেকেই দেখেছি। গণধোলাইয়ের দৃশ্যে যে গণ হারে ‘ভদ্রলোক ‘ ও অংশগ্রহণ করে থাকে, সেটা প্রমাণিত। তাই না?
অথচ কী আশ্চর্য দেখুন, এই হিংস্রতা একান্ত প্রয়োজনীয় ছিল। শ্বাপদসংকুল অরণ্যে অসংখ্য দাঁত আর নখের সঙ্গে মোকাবিলা করেই মানুষকে বাঁচতে হয়েছিল। নিছক মস্তিষ্ক নয়, কেনাইন টুথগুলিও যথেষ্ট ধারাল ছিল বলেই প্যালিওলিথিক এবং মেসোলিথিক যুগ অতিক্রম করে সে তার হোমো স্যাপেন্স আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল। ইংরেজী ইডিওম–Fight tooth and nail অর্থাৎ প্রাণপণ লড়াই করা এই ইতিহাসটিকেই চিহ্নিত করে।
আগুন এবং চাকা আবিষ্কারের পর মানুষ অনেকটা সভ্য হল। গুহার দেওয়ালে ছবিও এঁকে ফেলল। আলতেমিরার কথা নিশ্চয় শুনেছেন। সময় এগিয়ে চলল। এলো ভাষা, এলো সাহিত্য। সবার আগে কবিতা। জন্ম নিল অবিস্মরণীয় সব মহাকাব্য। ইলিয়াড, ওডিসি, রামায়ণ, মহাভারত। কিন্তু যুদ্ধকে বাদ দেওয়া গেল না। যে হিংসা মূলত আত্মরক্ষা এবং গোষ্ঠী আধিপত্য বজায় রাখার জন্য ব্যবহৃত হতো, সেটা ক্রমে ক্রমে Machismo বা বীরত্ব হয়ে আত্মপ্রকাশ করল।
মানুষের বীরের দরকার হয়ে পড়ল। ওদের একিলিস, এগামেমনন, হেক্টর আমাদের রাম, অর্জুন এবং কর্ণ। যুদ্ধে যাবার আগে পুরুষের কপালে জয়টিকা পড়ানো হল। কারা পরাল? অবশ্যই নারীরা। ওদেশের নাইট এদেশের ক্ষত্রিয় –এদের কাজই হল যুদ্ধ করা। পৃথিবী জুড়ে বীরপূজার প্রচলন হল। যুদ্ধ তখন এক মহান কার্যক্রম। ভার্জিল তাঁর মহাকাব্য Aenrid [খ্রিষ্ট পূর্ব ২৯ থেকে ১৯] –এ লিখলেন Arma Virangue keno যার ইংরাজি তর্জমা Arms and the man I sing! এনিয়াস নামক এক ট্রোজান যিনি ট্রয় থেকে ঘুরতে ঘুরতে ইটালি পৌঁছে যান এবং অমিত বিক্রমে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন,
তাঁকে কেন্দ্র করেই এই মহাকাব্য। পারস্যবাসীর কাছে মূর্তিমান শয়তান বলে পরিচিত আলেকজান্ডার অবশিষ্ট বিশ্বের কাছে বীরপূজা পেলেন। নাম হল মহাবীর আলেকজান্ডার! এই ভাবে একের পর এক বীর জন্মাতে শুরু করল। একটি জনগোষ্ঠীর কাছে শয়তান বলে পরিগণিত একটি মানুষ অন্য একটি জনগোষ্ঠীর কাছে বীর আখ্যা পেল। যেমন ধরুন শ্রীরামচন্দ্র ! আর্যদের দ্বারা পূজিত এই মহান চরিত্রটির নাম একবার দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড়দের কানে কানে বলে ফেলুন ! হাতে নাতে ফল পাবেন ! শ্রীলঙ্কা যাবার দরকার পড়বে না।
এই ভাবে আমরা একের পর এক বীর পেতে থাকলাম–জুলিয়াস সিজার, হানিবল, শার্লেমান, নাদির শাহ, সুলতান মামুদ, তৈমুরলঙ, চেঙ্গিস খান –ইতিহাস ঘেঁটে দেখুন এই সব রথী মহারথীর যাত্রাপথে কত রক্ত লেগে আছে। প্রাচীন যুগ থেকে শুরু হওয়া এই বীরের মহামিছিল কি মধ্যযুগ পর্যন্ত এসেই থেমে গেছে? না বন্ধু এ মিছিল থামবার নয়। তাই আধুনিক কালেও এই সব মহা বীরেরা ইতিহাস দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। আপনারা চেনেন এঁদের। হিটলার, স্ট্যালিন, মাও জে ডঙ, পল পট, ব্রেজনেভ, ওসামা বিন লাদেন, জর্জ ডাব্লিউ বুশ, বিল ক্লিনটন –ইত্যাদি ইত্যাদি।
স্কুল পাঠ্যে নিশ্চয় পড়েছেন –Columbus discovered America! এবার ঠিক করে নিন। ওটা হবে—Columbus invaded America ! হ্যাঁ বন্ধু দোয়েল অথবা ডোডো পাখির যেমন আবিষ্কৃত হবার প্রয়োজন নেই। তেমনই রেড ইণ্ডিয়ান অথবা আপাচে উপজাতিদের আবিষ্কৃত হবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না। তাছাড়া আবিষ্কার কথাটা ভীষণ বিভ্রান্তিকর ! এটা টেলিভিশন কিম্বা ঘড়ি আবিষ্কারের গল্প নয় ! একটা দেশ অথবা জনগোষ্ঠী যারা নিজের মত করে ভালই ছিল।
শাদাদের চাপিয়ে দেওয়া আবিষ্কারের পর কী হয়েছিল জানেন ? একটার পর হত্যা একটা হত্যা ! আমেরিকান আদিবাসীদের কচুকাটা করে ভূখণ্ডের পর ভূখণ্ড দখল করা হয়।কত মানুষকে যে হত্যা করা হয় তার নির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। অথচ কী অদ্ভুত এই গণহত্যা নিয়ে তেমন কোনো আলোচনাই হয় না ! যেহেতু বিগ ব্রাদার আমেরিকা থেকে শুরু করে ইউরোপের রথী মহারথীরা এর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। তাই একে বলা হয়—The least discussed genocide in history !
অথচ দেখুন হিটলারের গণহত্যা নিয়ে গবেষণা এবং তথ্যের কোনো অভাব নেই। এ ব্যাপারে এই আমেরিকা সহ মিত্র পক্ষের দেশগুলি যে আগ্রহ দেখায়, তা এক কথায় অভাবনীয় ! হিটলার যে ৬০ লক্ষ ইহুদীকে নৃশংসভাবে খুন করেছিলেন এই তথ্য এরাই সংগ্রহ করেছে। শুধু তাই নয় ওয়ার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সমস্ত নাজি হর্তাকর্তার বিচারও হয়েছে। বলাই বাহুল্য প্রায় সবারই প্রাণদণ্ড হয়েছে।
প্রশ্ন আসতেই পারে সভ্যতার পত্তন হবার পরও হিংসার এই ধারাবাহিকতা কেন অক্ষুণ্ণ থাকল। কারণ আছে বন্ধু। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে Consequentialism অথবা অন্তিমতাবাদ আবির্ভূত হবার অনেক আগে থেকেই আমরা বিশ্বাস করে এসেছি লক্ষ্যটাই শেষ কথা। অর্থাৎ লক্ষ্য যদি ভাল হয় তার জন্য যে কোন পথ বেছে নেওয়া যেতে পারে–End justifies the means!
অর্থাৎ আপনি যদি কোনো কাজকে ভাল বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন সেটা বাস্তবায়িত করার জন্য আপনি যে কোনো পথ অবলম্বন করতে পারেন। এ প্রসঙ্গে মেকিয়াভেলির লেখা The Prince বইটি পড়ে দেখতে পারেন। একজন শাসক প্রয়োজনে কী কী করতে পারেন, তার একটা ধারণা পেয়ে যাবেন। অবাক হবেন, শিউরেও উঠতে পারেন।
তবে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? খুব সোজা। মহৎ অভীষ্টের জন্য যে কোনো পন্থা নেওয়া যাবে। ধরুন কোনো নেতা বা বীর হওয়ার পোটেনসিয়াল আছে এমন একজন মানুষ বা জনগোষ্ঠী ঠিক করল তাঁর অথবা তাঁদের ধর্মটিই সর্বাপেক্ষা উন্নত এবং বিজ্ঞানসম্মত। সমস্ত পৃথিবী জুড়ে যদি সেই ধর্মটিই প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে স্বর্গ নেমে আসবে। অতএব সেটি প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যে কোনো পথ আপনি নিতেই পারেন। রক্তগঙ্গাও বইয়ে দিতে পারেন। আপনার মতটির সঙ্গে বেশিরভাগ মানুষ একমত না হলেও কিছু যায় আসে না। আপনি বলবেন ওরা অবোধ তাই এই ধর্মের মাহাত্ম্য উপলব্ধি করতে পারছে না। অতএব ঘাড় ধরে বোঝাও, না শুনলে কোতল করো। কারণ End justifies the means! আপনার লক্ষ্য মহৎ যে!
শুধু কী ধর্ম? না বন্ধু! এবার ধরুন কোন মহাপুরুষ বলে গেছেন পৃথিবীতে এমন একটা দিন আসবে যখন ধনী, নির্ধন কেউ থাকবে না, শোষণ থাকবে না, অত্যাচার থাকবে না, সবাই সমান সুযোগ পাবে। অর্থাৎ সমগ্র পৃথিবী জুড়ে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হবেই। এটাই ভবিতব্য। হতেই হবে! কারণ ডায়ালেক্টিস তাই বলে, হতেই হবে কারণ মর্গ্যান তাঁর Ancient Society নামক বইয়ে এই ইঙ্গিতই দিয়েছেন, হতেই হবে কারণ মহান কার্ল মার্ক্স এবং এঞ্জেলস এই কথা বলেছেন।
তা হবেই যখন, সময় নষ্ট করে কী হবে। লক্ষ্যটা মহৎ। সবার জন্য খাদ্য, বস্ত্র বাসস্থান, জীবিকা, স্বাস্থ্য। সবার জন্য সাম্য! এর চেয়ে ভাল কিছু হয়? হয় না। অতএব চলো নতুন ভোর নিয়ে আসি। আর এই নতুন ভোর আনতে গিয়ে যদি রক্তগঙ্গাও বইয়ে দিতে হয়, কুছ পরোয়া নেহি। যদি বাকিরা একমত না হয়? ধুত্তেরিকা! ওরা যে অবুঝ! বোঝাতে হবে। যদি শোনে ভাল না হলে কোতল!
After all, end justifies the means!
আমার বামপন্থী বন্ধুরা আশা করি ভুল বুঝবেন না। আমি যথাসম্ভব নিরপেক্ষভাবে একটি দৃষ্টিকোণ তুলে ধরার চেষ্টা করছি মাত্র। ইতিহাস আপনারাও পড়েন। সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে প্রভূত নৃশংসতা অবলম্বন করতে হয়েছে সেটা আপনিও জানেন। শ্রেণিশত্রু খতম থেকে শুরু করে যৌথ খামার, সর্বহারার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা সর্ব ক্ষেত্রেই আগাছা উৎপাটন, ইংরেজিতে যাকে purging বলা হয়, প্রতিনিয়তই করতে হয়েছে। যদিও আপনারা একে একটা মিষ্টি নাম দিয়ে থাকেন –excess! অর্থাৎ মহান কাজ করতে গেলে এমন একটু বাড়াবাড়ি হয়েই থাকে!
‘একটু’? আসুন দেখে নেওয়া যাক এই ‘একটুর’ মাত্রাটা ঠিক কেমন! প্রথমে পল পটের [Pol Pot] কথায় আসি। 1975 সালে আমেরিকা ভিয়েতনাম থেকে সেনা তুলে নেবার পর এই মহান কম্যুনিস্ট গেরিলা কম্বোডিয়ার ক্ষমতা দখল করেন। তার আগে অবশ্য এক দীর্ঘ গেরিলা লড়াইয়ের ইতিহাস আছে । একসময় প্রিন্স সিংহানুকও তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। সে অন্য প্রসঙ্গ।
ক্ষমতায় এসেই এই খেমের রুজ [তাঁর গেরিলা বাহিনীর নাম—অর্থ লাল কম্বোডিয়ানস] নেতা তাঁর কল্পরাজ্য বাস্তবায়নের কাজে হাত দিলেন। কী সেটা ? অবশ্যই তাঁর প্রিয় নেতা মাও জে ডঙের ‘গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড’ এবং মহান সাংস্কৃতিক বিপ্লব । তিনি নাম দিলেন সুপার গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড। দেশের নামটাও বদলে দিলেন । হল Democratic Republic of Kampuchea. সমগ্র দেশটিকে একটি যৌথ খামারে রূপান্তরিত করার স্বপ্ন তাঁকে এমন ভাবে পেয়ে বসেছিল যে হিতাহিত জ্ঞানটুকু পর্যন্ত বিসর্জন দিয়েছিলেন। তিনি যখন বুঝেছেন এর চেয়ে মহান কোনো লক্ষ্য নেই, অতএব এটাই হতে হবে।
তিনি কী কী করলেন ? ১৯৭৫ সালটিকে zero year ঘোষণা করে বললেন এই মুহূর্ত থেকে বুর্জোয়া সংস্কৃতির সব কিছু সমূলে উৎখাত করতে হবে। অতএব সমস্ত বিদেশীকে তাড়িয়ে দেওয়া হল, দূতাবাস বন্ধ করে দেওয়া হল, বিদেশী সাহায্য এমন কী বিদেশী ভাষার ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হল, খবরের কাগজের আপিস, টেলিভিশন কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হল।
সমস্ত রেডিও এবং বাইসাইকেল বাজেয়াপ্ত করা হল। সমস্ত ব্যবসা বাণিজ্য এমন কী টাকার ব্যবহার পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা হল। শিক্ষা বাধাপ্রাপ্ত হল, স্বাস্থ্য পরিষেবা বন্ধ আর ধর্ম ? সে তো সবার আগে ডাষ্টবিনে। এক কথায় কম্বোডিয়াকে বহির্বিশ্ব থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করা হল। এর পর কী হল ? নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত লক্ষ লক্ষ কম্বোডিয়ানকে বন্দুক ঠেকিয়ে গ্রামে পাঠান হল। খুব আরাম না ? যাও গ্রামে কৃষিকাজ কর। যত সব বুর্জোয়ার দল ! হ্যাঁ বন্ধু পায়ে হেঁটে ! যা হবার তাই হল পথেই মারা গেল প্রায় ২০০০০ মানুষ।
কেমন ছিল সেই যৌথ খামার। ভোর ৪ টে থেকে রাত দশটা পর্যন্ত খেতে কাজ করতে হত। দুদিন অন্তর এক টিন করে খাবার । পরিমাণ ? ১৮০ গ্রাম মাথা পিছু। দশ দিন অন্তর একদিন বিশ্রাম। দশ থেকে পনের জনের পরিবার পিছু একজন করে চেয়ারম্যান থাকতেন। তিনিই ছিলেন হর্তা কর্তা বিধাতা। কাজে সামান্য বিচ্যুতি দেখলেই —-আশা করি বুঝেছেন ! হ্যাঁ বন্ধু, ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ এই চার- পাঁচ বছরে প্রায় কুড়ি লক্ষ মানুষ মারা যান।
পল পটের এই কৃষি খামার ‘killing fields’ নামে কুখ্যাতি অর্জন করে। এমনই কুখ্যাতি যে মহা বামপন্থী নেতারাও তাঁর নাম উচ্চারণ করেন না। তারা লেনিনের নাম বলেন, মাওয়ের নামও বলেন , কিন্তু পল পট ! নৈব নৈব চ ! আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনারাও অনেকে এই নামটি প্রথম শুনছেন।
জোসেফ স্তালিন ! হ্যাঁ বন্ধু নাজি সাম্রাজ্যবাদ প্রতিরোধে এই মানুষটির অবদান চরম নিন্দুকেও অস্বীকার করতে পারবে না।
যদিও হিটলারের সঙ্গে অনাক্রম চুক্তি থাকায় উনি দূর থেকে মজাই দেখছিলেন। হিটলার যদি রাশিয়া আক্রমণ না করতেন তবে ইনি এগিয়ে আসতেন কি না যথেষ্ট সন্দেহ আছে। যাক এই মহান মানুষটির বিরুদ্ধেও নরহত্যার অভিযোগ আছে। ট্রটস্কির মত কেউকেটাকে বাদই দিলাম, দেশকে শ্রেণি শত্রু মুক্ত করার মহান উদ্দেশ্য নিয়ে ইনি প্রায় ৭০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছিলেন। কিভাবে ? ভাতে মারা বোঝেন ? হ্যাঁ আক্ষরিকভাবে ইনি তাই করেছিলেন। ইউক্রেনের নাম নিশ্চয় শুনেছেন। হ্যাঁ এই মুহূর্তে একটি স্বাধীন দেশ। কিন্তু ইতিহাসটা বড় নির্মম।
কাশ্মীরের স্বাধীনতার জন্য যারা গলা ফাটান, তাঁদের একবার ইউক্রেনের কথা জিজ্ঞাসা করুন। যদিও এঁরা সেই সময় ছিলেন না এবং স্তালিনবাদী বিচ্যুতির অজুহাত দেখিয়ে বেশ কিছু বামপন্থী রাজনৈতিক দল এই মানুষটি থেকে মুখ ফিরিয়েছেন। ১৯১৭ সালের বলশেভিক বিল্পবের সময় থেকেই ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়নে যোগ দিতে অস্বীকার করে। লেনিন লাল ফৌজ পাঠান। চার বছর ধরে যুদ্ধ চলে। ১৯২১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন এই যুদ্ধে জয়ী হয়।
শুধু তাই নয় ইউক্রেনের পশ্চিম অংশকে পোল্যান্ড, রোমানিয়া এবং চেকোস্লোভাকিয়ার মধ্যে ভাগ করে দেন। তারপর উর্বর ইউক্রেন থেকে সমস্ত খাদ্যশস্য মস্কোর মানুষের জন্য জাহাজ ভর্তি করে নিয়ে আসতে থাকেন। শুধু মস্কো নয় সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যান্য অংশেও সেই খাদ্য সরবরাহ করা হতে থাকে। যা হবার তাই হয়। ইউক্রেনের মানুষ চরম খাদ্য সমস্যায় পড়েন। তাঁদের উৎপাদিত দ্রব্যে তাঁদেরই কোনো অধিকার ছিল না। লেনিনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ বাড়ে। আঁচ পেয়ে তিনি খাদ্য পাচার কমিয়ে দেন । শুধু তাই নয় ইউক্রেনকে বেশ কিছুটা স্বায়ত্বশাসনও দেন।
এভাবে ইউক্রেনে মোটামুটি শান্তি ফিরে আসে। কিন্তু স্তালিন ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া। তিনি ক্ষমতায় এসেই সমস্ত স্বাধীনতা কেড়ে নেন। এবং ইউক্রেনে সামগ্রিক সোভিয়েত আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চান। সমস্ত জমি কেড়ে নিয়ে রাষ্ট্রের অধীনে আনা হয়। কুলাক অর্থাৎ জমিদার শ্রেণিকে নির্মূল করা হয়। বিক্ষোভ আরও বেড়ে যাওয়াতে ইউক্রেন থেকে সমস্ত খাদ্য শস্য ছিনিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হয়। ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ এক কৃত্রিম দুর্ভিক্ষের শিকার হয়ে মৃত্যুবরন করেন। একটি সভায় তাঁর পার্টিরই এক কমরেড এই মৃত্যুর পরিসংখ্যান নিয়ে হাজির হন। উত্তরে এই মহান নেতা কী বলেছিলেন জানেন?
The death of a single man is a tragedy, the death of a million is a statistics.
[এই সব পরিসংখ্যান নিয়ে বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরা চিরকালই বিতর্ক করেছেন, করবেন। তাঁদের একটাই বক্তব্য এই সব বুর্জোয়া মিডিয়ার চক্রান্ত ! কম্যুনিস্ট বিরোধি আমারিকা্র ষড়যন্ত্র ! ছাত্রাবস্থায় অতি বাম রাজনীতি করার সময় আমিও স্তালিনের হয়ে লড়াই করেছি। বক্তব্য রেখেছি। পড়াশোনাটা কম ছিল বলে রক্তের গরমটাই তখন প্রাবল্য পেয়েছিল। যাক এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে সমাজতান্ত্রিক অথবা জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হবার পর পরই সমস্ত দেশগুলিতে লৌহার পর্দার [iron curtain] নেমে আসত। ফলে কোন তথ্য পাওয়া যেত না।
কত মানুষ মরছে আর কতই বা বেঁচে আছে, তার সঠিক সংখ্যা বাইরের পৃথিবীতে প্রকাশই পায় না। এই যেমন ধরুন উত্তর কোরিয়া ! কোনো খবর পান ? ওদেশে ঠিক কী হচ্ছে ? মাঝে মধ্যে জাল গলে দু এক পিস বেরিয়ে আসে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতেও সমাজতন্ত্র শেষ হয়ে যায়। অনেক পরিসংখ্যান তার পরেই পাওয়া যায়। যদিও একেবারে নিখুঁত হিশেব পাওয়া সম্ভব নয়। শুধু একটি কথা মনে রাখবেন লেনিন,
ফিদেল কাস্ত্রো, চে গুয়েভারা এমন কী হো চি মিনের বিরুদ্ধেও এ জাতীয় গনহত্যার কোনো অভিযোগ নেই। ফিদেলের বিরুদ্ধে তাঁর চরম নিন্দুক আমেরিকা পর্যন্ত একটিও নেতিবাচক কথা বলার সাহস পায় নি। বে অফ পিগস-এর চূড়ান্ত ব্যর্থতার পর মুখ পোড়া বিগ ব্রাদার কেবল অবরোধই চালিয়ে গেছে। কিন্তু কিউবার গায়ে একটি আঁচড় পর্যন্ত দিতে পারেনি। এই মহান মানুষটিকে আমি শ্রদ্ধা করি।]
যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রথম [আধুনিক কালে] আন্দোলন শুরু হয় ১৮১২ সাল নাগাদ। আমেরিকায়। আমেরিকান সিভিল ওয়ার সদ্য শুরু হয়েছে। pacifist অর্থাৎ যুদ্ধ-বিরোধী বলে অভিহিত এই আন্দোলনে অনেক কবি সাহিত্যিক সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। যেমন রালফ উইল্ডো এমার্সন, হেনরি ডেভিড থরিউ, উইলিয়াম এলেরি ইত্যাদি।
এঁদের কলমে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়। ক্রমে ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়ে পরে। যুদ্ধবিরোধী কবিতা, গল্প, উপন্যাস এবং প্রবন্ধে প্রতিবাদের পর প্রতিবাদ ধ্বনিত হতে থাকে। বার্নার্ড শ [Arms and the Man থেকে শুরু করে উইলফ্রেড ওয়েন [Strange Meeting, Spring Offensive etc], সিজফ্রিড সাসুন, এরিক মারিয়া রেমার্ক [All Quiet on the Western front] মেরি এগনেস হ্যামিল্টন [Dead yesterday খ্যাত] আরনেস্ট হেমিংওয়ে [A Farewell to Arms, For whom the bell tolls] গুন্টার গ্রাস [The Tin Drum] , স্টিফেন ক্রেইন[Red Badge of Courage] ইত্যাদি। সবার নাম উল্লেখ করা অসম্ভব। তবে বার্নার্ড শ-এর নাটক Arms and the Man তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ভার্জিলের আনিদ থেকে নেওয়া ফ্রেজটিকে [Arma viranque keno] ব্যঙ্গার্থে প্রয়োগ করে যুদ্ধবাজদের মুখোশ খুলে দিয়েছিলেন ।
সার্জিয়াস নামক একটি চরিত্রের মুখ দিয়ে [আধুনিক] যুদ্ধের সার সত্যটিকেই তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন—Soldiering, dear madam, is a coward’s art of attacking mercilessly when you are strong and keeping out of harm’s way when you are weak.” কী অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ! একটু ভাবলেই বুঝতে পারবেন বন্ধু। প্রতিপক্ষ দুর্বল হলে তীব্র গতিতে আক্রমণ করো। কিন্তু সবল হলে সমঝে চলো। প্রমাণ আপনার সামনে ।উত্তর কোরিয়া এবং ইরাক দুজনেই সম্মলিত জাতিপুঞ্জের শর্ত লঙ্ঘন করেছিল।
আমেরিকা ইরাক আক্রমণ করল, কিন্তু নর্থ কোরিয়া ! বাপ রে ! ওদের যে ইন্টার কন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিশাইল আছে। দশ হাজার কিলোমিটার অতিক্রম করে আঘাত হানতে পারে। অতএব সমঝে চলো। মহাকাব্যের রথী মহা রথীরা তবু অনেক ভাল ছিলেন। এঁরা দুর্বল অথবা নিরস্ত্র মানুষকে আঘাত করতেন না। গদার সঙ্গে গদা, তরবারির সঙ্গে তরবারি, তীরন্দাজের সঙ্গে তীরন্দাজ –হ্যাঁ ঠিক এই নিয়ম মেনেই যুদ্ধ হতো ! তখন তবু ‘বীর’ ছিল।
নির্দিষ্ট জায়গায় যুদ্ধ হত। কোন প্রান্তর অথবা খোলা জায়গা। নামগুলো পড়লেই বুঝবেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ, পানিপথের যুদ্ধ, পলাশির যুদ্ধ, বক্সারের যুদ্ধ। তাই সাধারণ মানুষের প্রাণহানি অনেকটাই এড়ানো যেত ! মামুদ অথবা তৈমুরের কথা আলাদা। এরা লুটপাট করতেই এসেছিলেন। আর আধুনিক যুদ্ধ ? কিছুই দরকার নেই—শুধু হিরোশিমা আর নাগাসাকির কথা ভাবুন ! উত্তর পেয়ে যাবেন।
কিন্তু এমন হবার তো কথা ছিল না। হিংস্রতা থেকে মানবিকতার দিকে চলতে থাকাই তো সভ্যতা। অথচ গত একশ বছরে সভ্য মানুষ যত নরহত্যা করেছে সমস্ত প্রাচীন এবং মধ্যযুগ মিলিয়ে তার কয়েক শতাংশও ঘটেনি। কারণ একটাই –অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রের ব্যবহার। সভ্য মানুষের হাতে কী নেই ? রাইফেল, মেসিন গান এখন খেলনা। পরমাণু বোমা, হাইড্রোজেন বোমা, নিউট্রন বোমা, গনবিধ্বংসী রাসায়নিক এবং জীবাণু অস্ত্র ! গাল ভরা নাম –Weapons of mass destruction ! একটা বোতাম টিপেই কোটি কোটি মানুষকে হত্যা করা যায় !
না, বন্ধু সত্যি-ই এমন হবার কথা ছিল না। End cannot and shouldnot justify the means ! এটা মহাত্মা গাঁধির অনেক আগেই গৌতম বুদ্ধ এবং মহাবীর জৈন বলে গেছেন। বিশুদ্ধ অহিংসার [বুদ্ধ যদিও আত্মরক্ষার জন্য পরিমিত হিংসার সমর্থন করেছেন। মার্শাল আর্টস অর্থাৎ খালি হাতে আত্মরক্ষার কৌশলটি তিনিই উদ্ভাবন করেছিলেন] উপর প্রতিষ্ঠিত এই ধর্মদুটি নিছক বর্ণ বৈষম্যের প্রতিক্রিয়া হিসেবে গড়ে ওঠেনি।গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যবাদের বলি প্রথাকেও তাঁরা বর্জন করেছিলেন। এভাবেই একটি বার্তা দেওয়া হয়েছিল— লক্ষ্য মহৎ হলেই হবে না, পথটিও মহৎ হতে হবে। ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানো অথবা মোক্ষলাভ নিঃসন্দেহে একটি মহান কাজ। কিন্তু নিরীহ প্রাণিকে হত্যা করেই সেই লক্ষ্য অর্জন করতে হবে ? না, কারণ —End should not justify the means !
দুঃখের বিষয় একটাই। এই মহৎ দর্শনটিকে উপলব্ধি করার মত মানুষ পৃথিবীতে খুব বেশি নেই। কিন্তু কেন ? এতগুলো শতাব্দী পেরিয়ে যাবার পরও আমরা কেন এমন হিংস্রই রয়ে গেলাম ! আসুন এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি !
সালটা ২০০৩। মার্চ মাস। আমেরিকা ইরাক আক্রমণ করেছে। শুরু হয়েছে দ্বিতীয় উপসাগরীয় যুদ্ধ। কী কাজ ছিল ঠিক মনে নেই। তবে রাত করেই বাড়ি ফিরছিলাম। হাতে সিগারেট, ঠোঁটে কবিতা। মাঝরাত্তিরের রাস্তাগুলো সত্যি-ই যাদুময়। হঠাত একটা চিৎকার ! ডাকাত পড়ল নাকি ! দাঁড়িয়ে পড়লাম। কেউ কোথাও নেই। তবে চিৎকারটা এলো কোথা থেকে !
দু পা এগোতেই আবার ! হ্যাঁ ওই তো ! একটা ছায়া । না ছায়া নয়। মানুষ। বয়স কমপক্ষে সত্তর। কংকালসার চেহারা। গেঞ্জির ওপার থেকে সব কটা হাড়ই প্রায় গোনা যাচ্ছে। হাতে একটা বিড়ি ! মুখে আলো পড়েছে। কিন্তু কিসের আলো ? জানালার কাছে এগিয়ে গেলাম। লোকটার সামনে একটা টিভি সেট। এক ঝলক তাকিয়েই বুঝলাম গালফ ওয়ারের লাইভ টেলিকাস্ট ! বাগদাদের আকাশে তখন ঝাঁকে ঝাঁকে এফ-১৬ উড়ছে । একটার পর একটা বোমা নেমে আসছে। আমেরিকান স্মার্ট বম্ব ! ছাদের উপর রাশি রাশি কামান !সেখান থেকেই উড়ে যাচ্ছে এন্টি এয়ার ক্র্যাফটের শেল !
ভেঙে পড়ছে বাড়ি। শুধু আলোর ফুলকি দেখা যাচ্ছে। কত মানুষ যে মরছে, কত ঘর যে ভাঙছে ! কে জানে ! অথচ কী আশ্চর্য ! এর মধ্যেও বিড়িটা বেশ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে ! টিভির পর্দায় চোখ ! কিন্তু সুখটান থেমে নেই !চারদিকে কেবল ধোঁয়া আর ধোঁয়া ! এরই ফাঁকে ফাঁকে মানুষটা চিৎকার করে উঠছে!
মার ! মার শালাকে !
মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে যাওয়া মানুষটা ঠিক কার সমর্থনে গলা ফাটাচ্ছিল বুঝিনি। কোনো আগ্রহও ছিল না। অন্ধকার ক্রমশ গাঢ় হচ্ছিল ! ল্যাম্প পোষ্টের অল্প আলোয় চারপাশটা আরও ভুতুড়ে হয়ে উঠল। নিজের ছায়াটাও কেমন লম্বা হয়ে গেল ! মনে হল একটা দৈত্য আমার পিছু নিয়েছে। একটা ভয় ! না, ভূতের নয়, দৈত্যেরও নয় ! নিজেকে ! কারণ আমার আঙুলগুলো হঠাত দাঁত ছুঁয়ে ফেলেছিল । শাকাহারি দাঁতের পাশে বসে থাকা কুকুরে দাঁতগুলো এখনও আলাদা করে চেনা যাচ্ছে। ক্ষয়ে গেছে। তবু এখনও কী ধার !
দৌড় শুরু করলাম। নিজের কাছ থেকে পালানোর দৌড় ! কত শতাব্দী পরে থামব জানি না। আদৌ থামা হবে কি না তাও জানি না। তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস আরও একশ বছর পর আমার মত আরও অনেক অনেক মানুষ তাঁদের কুকুরে দাঁতগুলো ছুঁয়ে দেখবে।এক, দুই, তিন, চার। মোট চারটে। শুরু হবে আর একটা দৌড় ! হয়ত অন্যরকম, হয়ত নয় !
———–