#আমি_অদৃশ্য_৪
বশ্যতা স্বীকার করানোর জন্য এক পাশা রাজা জয়চাঁদ ফেলে ছিল দুতের মাধ্যমে। এক যুদ্ধের চুনৌতি রাজা পৃথ্বী গ্রহন করেন। নিজ দুতের মাধ্যমে নয়। বরং কৌনজ এর দূতের মাধ্যম দিয়ে। এবার দেখার বিষয় এটা ছিল যে , এই বিতর্কিত মুহূর্তে কে পরের পাশার দান ফেলে এবং কি দান ফেলে?
এত যুদ্ধ, এত প্রতিহিংসা, এত লড়াই, এত কূটনীতি, এত রাজনীতির মধ্যেও আমার জীবনের মধুরতম অধ্যায় ছিল পৃথ্বী ও সংযুক্তার প্রেম । হ্যা, দেবী লক্ষীর সমান সুন্দরী , দেবী স্বরসতীর সমান গুণী কনৌজ রাজকন্যার প্রেমে যেমন পৃথ্বী পাগল হয়েছিল, ওদিকে বাহুবলি পৃথ্বীর প্রেমে রাধা , মীরার মতই যোগিনী হয়েছিল সংযুক্তা।
পূর্বেই বলেছি সভাকবি, বিশ্বস্ত সভাসদ , গুপ্তচর ছাড়া আমার আর পৃথ্বীর আরো একটি বিনিসুতোর সম্পর্ক ছিল। আমরা হরিহর আত্মা ছিলাম। জীবনে অতি ক্ষুদ্র তম বিষয়ও আমার নিকট পৃথ্বী গোপন করত না। তার কাছে সব সমস্যার মুশকিল আসন যেন আমি ছিলাম।আমারও সম অবস্থাই ছিল ।
পৃথ্বী নিজের ভাবনা কে মনের মাধুরী আর প্রেমের রঙ মিশিয়ে খুব সুন্দর প্রকাশ করতে জানত। কিন্তু তাকে লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারত না। অগত্যা আমাকেই শব্দের জাদুকরীতে সেই ভালোবাসায় আরো সুন্দর রামধনু অঙ্কন করতে হত।
নিদাঘ শেষে , পড়ন্ত সূর্যের শেষ প্রহরের রক্তিম আলোয় খোলা বাতায়নে পৃথ্বী তার প্রিয় পোষা চন্দনা পক্ষীকে স্কন্ধে নিয়ে প্রেমে জোয়ারে ভেসে তার ভালোবাসার কথা বলত, আমি প্রাণ ভরে লিখতাম। মনে মনে দেবী শাকমভরি কে কে বলতাম , ” হে মাতা তুমি এই দুই পবিত্র আত্মার প্রেমকে সার্থক কর।” এই সব প্রেম পত্র লিখতে আমি ততটাই উৎফুল্ল ও আনন্দিত যতটা ” পৃথ্বীরাজ রাসো” লিখতে হতাম।
তারা কেও কোনোদিন কাউকে দেখে নি। তবু কোন হৃদয়ের গহীন, গোপন টানে তারা একে অপরকে ভালোবেসে চলেছিল। দুজনের ই একটিই প্রিয় তোতা ছিল। যা দিয়ে দুজনে প্রেম পত্র আদান প্রদান করত।
সংযুক্তার এক দাসী ছিল। চাকোরী অনেকে তাকে মদনা ডাকত। মদনা একদিকে সখী, সেবিকা আবার প্রয়োজনে অসিচালনা ও অশ্বারোহণেও পটু ছিল। পৃথ্বীর সুরতা, বীরতায় প্রভাবিত ছিল। দুই সাম্রাজ্যের যখন বিবাদ চরমে তখন মদনা দিবারাত সংযুক্তা কে পৃথ্বীর নানান কাহিনী শোনাত। কৃষ্ণ নাম শুনে রানী মীরা যেরূপ কৃষ্ণ প্রেমে পাগল ছিলেন তেমনি রাজকন্যাও পৃথ্বীর প্রেমে রাধা হয়ে উঠল।
মদনার মুখেই রাজকুমারী সংযুক্তা মহারাজ পৃথ্বীরাজ চৌহানের রূপ, গুণ, যৌবন এবং বীরত্বের কথা শোনেন। দিনের পর দিন পৃথ্বীরাজের নানান বীরত্বব্যঞ্জক কাহিনী শুনে রাজকন্যার মনে পৃথ্বীরাজকে দেখার এক প্রবল বাসনা জাগরিত হয়।
এছাড়াও , পৃথ্বী রাজকন্যার হৃদয় সম্পূর্ন হরন করার জন্য সাম্রাজ্যের বিখ্যাত শিল্পী পান্না রায়কে কনৌজ এ পাঠান ।
দিল্লিশ্বর পৃথ্বীরাজ চৌহানের বিশেষ গুপ্তচর পান্না রায় কনৌজের রাজসভায় প্রবেশ করে রাজকুমারী সংযোগীতার সাথে সাক্ষাৎ করে প্রথমে রাজকুমারীকে মহারাজ পৃথ্বীরাজের সুশাসন সম্বন্ধে অবগত করলেন, এরপর পান্না তাঁকে নিজের হাতে অঙ্কিত দিল্লি অধিপতি পৃথ্বীরাজ চৌহানের একটি মর্মর তৈল চিত্র উপহার স্বরূপ প্রদান করলেন। সেই চিত্রে দিল্লিশ্বরের যৌবন আর দেহ সৌষ্ঠব প্রত্যক্ষ করে মনে মনে দিল্লিশ্বরের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়লেন কনৌজের রাজকুমারী।
নিজের শয়নকক্ষের শয্যায় পান্না রায়ের অঙ্কিত তৈল চিত্রটির দুহাতে আঁকড়ে ধরে একাগ্র চিত্তে বিমুগ্ধ ও নিস্পলক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে নীরবে বসে ছিলেন কান্যকুব্জের রাজকুমারী।
পান্না রায় নিজের আসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়িয়ে নীরবতা ভঙ্গ করে বিনম্র কণ্ঠে বলে উঠলেন, “ বেলা হল, এবারে আমাকে বিদায়ের অনুমতি দিন ।”
পান্নার কণ্ঠস্বর শ্রবণ করে কল্পনার জগৎ থেকে যেন বাস্তবে প্রত্যাবর্তন করলেন রাজকুমারী। তিনি বিমোহিত কণ্ঠে বললেন, “আপনার চিত্রের প্রশংসা করা আমার মতো সাধারণ রমণীর পক্ষে কখনোই সম্ভব নয় চিত্রকর। আমি শুধু এটুকুই বলতে পারি যে আপনার ঈশ্বরের বরপ্রাপ্ত জাদু তুলিকার স্পর্শে যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছেন দিল্লির মহারাজ।”
এরপর রাজকুমারীর ডাক শুনে রাজঅন্তঃপুরের জনাকয়েক পরিচারিকা এসে উপস্থিত হলেন শয়নকক্ষে। রাজকুমারী দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠলেন, “দিল্লি থেকে আগত মহান চিত্রকর পান্না রায় আজ থেকে কনৌজের রাজকুমারীর বিশেষ অতিথি। রাজপ্রাসাদের বিশেষ অতিথিকক্ষে চিত্রকরের বসবাসের ব্যবস্থা করো। উনি যতদিন কনৌজে অধিস্থান করবেন ততদিন যেন ওনার পরিচর্যা আর অতিথি সেবায় কোন ত্রুটি না হয়।”
রাজকুমারীর কয়েকজন প্রিয় সখী বা সেবাদাসী ছিল যেমন – বৈশালী, চকরী।
পান্নার বিদায়গ্রহণের কিছুক্ষণ পরেই রাজকুমারীর শয়নকক্ষে চঞ্চলা হরিণীর ন্যায় প্রবেশ করলেন দ্বিতীয় পর্বে বর্ণিত তাঁর প্রিয়তম সখী বৈশালী। বৈশালী নিঃশব্দে এসে উপস্থিত হলেন, একাগ্র চিত্তে মুগ্ধ নয়নে পান্না রায়ের অঙ্কিত দিল্লিশ্বরের চিত্রটি দেখতে থাকা রাজকুমারীর পশ্চাৎপ্রান্তে।
তারপর তিনি উৎসুক কণ্ঠে বলে উঠলেন, “মাননীয়া রাজকুমারী, শেষপর্যন্ত আমার আনা সুসংবাদটি ঠিকমত মিলল তো ?”
বৈশালীর কণ্ঠ শুনে চমকিত হয়ে রাজকুমারী চিত্র থেকে নিজের দৃষ্টি সরিয়ে, মাথানত করে আরক্তপূর্ণ মুখে ।।
বৈশালীর প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে রাজকুমারী রক্তিম মুখে নিজের দুহাতে বৈশালীকে আলিঙ্গনবদ্ধ করলেন।
রাজকুমারীর বিশেষ অতিথিরূপে কনৌজের রাজপ্রাসাদের রাজকীয় অতিথিশালায় বসবাস করে রাজকুমারীর অনুরোধ অনুযায়ী দিল্লি আর কনৌজের আরও নানান চিত্র অঙ্কন করে আর দিল্লির রাজকুমারীকে গোপনে দিল্লির অধিপতি মহারাজ পৃথ্বীরাজ চৌহানের বীরগাথা আর সুশাসনের আরও নানান অবর্ণিত কাহিনীর বর্ণনা করে তিন মাস অতিবাহিত করলেন শিল্পী পান্না রায়।
তিন মাস পর তিনি উপলব্ধি করলেন যে কার্যের জন্য তিনি কনৌজে এসেছিলেন তা সম্পূর্ণ হয়েছে। তাঁর ঐকান্তিক আর নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টায় কনৌজের রাজকুমারীর মনের অভ্যন্তরে দিল্লির মহারাজ পৃথ্বীরাজ চৌহানের প্রতি এক গহন প্রেম ও ভালবাসার মায়াজাল রচনা করতে সফল হয়েছেন তিনি।
এবারে তাঁর দিল্লি প্রত্যাবর্তন করবার সময় হয়েছে। দিল্লিতে ফিরে যাবার পূর্বে কেবল একটিমাত্র কর্মই অসমাপ্ত রয়েছে তাঁর। অবিলম্বে পূরণ করতে হবে সেই অসমাপ্ত কর্মটি।
দীর্ঘ তিন মাস ধরে নিজের চোখে দর্শন করা কনৌজের রাজকুমারীর অপার রূপ আর সৌন্দর্য নিজের তুলির সহয়তায় তৈল চিত্রে বন্দি করে মহারাজ পৃথ্বীরাজের সম্মুখে পেশ করতে হবে। রাজকুমারীর নতুন চিত্রটি দর্শন করলে অত্যন্ত আনন্দিত হবেন মহারাজ। এইভাবে পান্না নিজের রং তুলি নিয়ে শুরু করে দিলেন রাজকুমারী সংযুক্তার নয়া চিত্র অঙ্কনে।
ক্রমশঃ….
তথ্যঃ
Cynthia Talbot (2015). The Last Hindu Emperor: Prithviraj Cauhan and the Indian Past, 1200–2000