#আমি_অদৃশ্য_২
বন্ধু পৃথ্বী র জীবন নিয়ে লেখা আমার মহাকাব্য ” পৃথ্বীরাজ রাসো ” সম্পূর্ন করাই আমার জীবনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল। কিন্তু এছাড়াও আমার একটি বড় কাজ ছিল। পৃথ্বী বাল্য ও বিশ্বস্ত বন্ধু হিসাবে আমাকেই সেই কাজ দিয়েছিল। হ্যাঁ , আমি পৃথ্বীর খাস গুপ্তচর ছিলাম।
নানান ছদ্মবেশ ধারণ করে সাম্রাজ্য ও সাম্রাজ্যের বাইরে আমাকে ঘুরে বেড়াতে হত।কখনো রাজবেশে , কখনো বনিকের বেশে, কখনো ভিখারির বেশে , কখনো সন্ন্যাসীর বেশে, কখনো নাটকের দলে,কখনো গ্রাম্য লোক নৃত্য শিল্পী হয়ে ।
কখনো ঘোড়ায় করে, কখনো হেঁটে আমি রাজ্য পরিক্রমা করতাম। প্রজাদের সঙ্গে মিশে গিয়ে আমি তাদের খবর নিতাম। সৈন্য , বণিক বা কোনো উচ্চ জমিদার বংশীয় কেউ তাদের কষ্ট দিচ্ছে কিনা? কোনো শত্রু রাজ্যে প্রবেশ করেছে কিনা? সব খবর নিতাম।
শত্রুর রাজ্যেও আমার সমান প্রবাহমানতা ছিল। আমি হাওয়ার মত, নদীর মত শত্রুর সঙ্গেও মিশতে পারতাম। তাদের মধ্যে গিয়ে আমি সব গুপ্ত সংবাদ সংগ্রহ করতাম। শত্রু রাও আমার সামনে আলোচনা করত। তারা এটা জানত না যে আমার রূপে স্বয়ং পৃথ্বী তাদের গোপন আলোচনা শুনত।
দ্বাদশ শতাব্দীর সময়কালে ভারতবর্ষে দুটি সাম্রাজ্য খুব বিখ্যাত ছিল। একটি হল উত্তর ভারতের “চৌহান সাম্রাজ্য” যা ছিল দিল্লি , আজমেরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। অন্যটি হল “কনৌজ সাম্রাজ্য” । যা ঘেদয়াল বংশের অন্তর্গত ছিল। এর রাজা ছিলেন জয়চান্দ। দুটো রাজ্যই ছিল সে সময় শক্তিশালী, সমৃদ্ধশালী সাম্রাজ্য। দুটো সাম্রাজ্যের প্রজাই খুশি ছিল। দুই সাম্রাজ্যেই শিক্ষা , শিল্প, বাণিজ্য, চারুকলা ইত্যাদিতে বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল। সমস্যা একটাই ছিল। দুই সাম্রাজ্যই নিজ নিজ সীমানা বৃদ্ধির জন্য সচেষ্ট ছিল।
চৌহান বংশের রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহান। চৌহান বংশের এই রাজপুত রাজা ছিলেন দিল্লি এবং আজমীরের শাসক। বীর যোদ্ধা হিসেবে সুনাম ছিল রাজা পৃথ্বিরাজের। পৃথ্বী ছিলেন শব্দ ভেদী বান চালনায় এক মহারথী। তাঁর তরোয়াল হাজার হাজার যোদ্ধার শিরকে ভূমি দেখাতে সক্ষম ছিল। নায়িকা হচ্ছেন কনৌজের রাজা জয়চাঁদ এর কন্যা সংযুক্তা।
রূপকথার রাজকন্যাদের মতোই তার রূপ-সৌষ্ঠবের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল আশেপাশের বিভিন্ন রাজ্যে। তার রূপের গুনে সারা ভারত আমোদ করত। এবং যথারীতি খল ব্যক্তি ছিলেন সংযুক্তার বাবা অর্থাৎ রাজা জয়চাঁদ।
দিল্লি ও আজমীরের রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহানের তলোয়ার চালনা এবং তীরন্দাজির সুনাম ছিল ভারতবর্ষ জুড়ে, এমনকি ভারতবর্ষের বাইরেও সবাই তার প্রশংসা করত। কনৌজের রাজা জয়চাঁদ পৃথ্বীরাজ চৌহানের প্রশংসা একদমই সহ্য করতে পারতেন না। যেন-তেন প্রকারে পৃথ্বীরাজের ক্ষতি সাধনই তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। পারিবারিকভাবেও পৃথ্বীরাজ এবং জয়চাঁদ পরস্পরের আত্মীয় ছিলেন।
কনৌজের রাজা জয়চাঁদ রাঠোর পৃথ্বীরাজ চৌহানের প্রশংসা সহ্য করতে পারতেন না। যেন তেন প্রকারেন পৃথ্বীরাজের ক্ষতি সাধনই তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। পরিবারগত দিক থেকেও পৃথ্বীরাজ এবং জয়চাঁদ পরস্পরের আত্মীয় ছিলেন। আমি আমার পিতার নিকট শুনেছি জয়চাঁদের পূর্বপুরুষ দিল্লি আজমের সহ এক সুবিশাল অংশ পৃথ্বীর বংশ কে ছেড়ে দিয়েছিলেন। কেন ? সে উত্তর পাই নি… সেই কারণেও কনৌজ রাজের চৌহান দের উপর ভয়ানক আক্রোশ ছিল।
একদিন প্রখর তপ্ত দ্বিপ্রহরের চারিদিক যখন শিহরিত হচ্ছে প্রখর অগ্নি বানে, তৃষিত চাতক থেকে ঘুঘুর ছাতি ফেটে যাচ্ছে একটু জলের জন্য । প্রকৃতি যখন হাহাকার করছে একফোঁটা বৃষ্টির জন্যে উত্তপ্ত বালুকা ছুটে ছুটে আসছে। পায়রা গুলো গরমে নিজেদের বাঁচাতে ঘরের মধ্যে ঢুকেছে।
আমি রাজ প্রাসাদের বাতায়নের উপর থেকে দিগন্তের যেখানে মৃত্তিকা ও আকাশ একত্রিত হয়েছে সেখানে দেখলাম- ঘোড়ার খুলে উড়িয়ে তিনজন ব্যক্তি রাজপ্রাসাদের দিকে এগিয়ে আসছে ।
যেহেতু সাম্রাজ্যের ওপরে প্রথম থেকেই কনৌজ রা অত্যন্ত শত্রুতার সম্বন্ধ রাখছিল এবং অন্যদিকে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিমাংশে অসভ্য ম্লেচ্ছ জাতি আক্রমণ করেছিল ….সেহেতু আমি এবং রাজপ্রাসাদের প্রত্যেকটা সেনা ,প্রত্যেকটি রক্ষী দিবা রাত্রি সজাগ দৃষ্টিতে চারি দিকে নজর রাখতাম।
এছাড়াও সামরাজ্যের মধ্যে প্রশাসনিক , অস্ত্র, ও সৈন্য শক্তিকে আরো জোরদার করা হচ্ছে। এখন অস্ত্রগরে এমন কিন্তু ভয়ানক লৌহ অস্ত্র শত্রু নিপাতের জন্য তৈরি হচ্ছে যার খবর কেবল আমি আর বিশেষ গুপ্ত ব্যক্তি ব্যতীত কেবল রাজবাড়ীর কামার জানে।
তিনজন অজানা পথিকের ঘোড়া আরও কিছু নিকটবর্তী হলে আমি দেখলাম , তারা কনৌজ এর ধজা বহন করে এগিয়ে আসছে। অর্থাৎ এরা কনৌজের দুত ব্যতীত কেউ নয়। এমনিতেই দুই রাজায় ছত্তিশ কা আখরা ছিল। তার উপরে এই দুতের আগমন। এখন দেখার বিষয় এইটা ছিল যে কনৌজ এর দূত কি সংবাদ নিয়ে দিল্লির প্রাসাদের দিকে ধুলো ঝড়ের মত এগিয়ে আসছে।
রাজপ্রাসাদের প্রহরীরা প্রাসাদের সদর প্রবেশ পথেই তাদের রুখে দেয়। যদিও দূতের সঙ্গে এমন ব্যবহার করার নিয়ম ছিল না। তবুও দূত যেহেতু কনৌজের তাতে এমনটি করলেও ক্ষতি ছিল না। নানান নাশকতার আশঙ্কার তাদের থেকে করা যায়। যেহেতু দুই রাজাই পরম হিন্দু ছিলেন। তাই দুজনেই গৈরিক রং কেই প্রাধান্য দিতেন। আমাদের সেনাবাহিনীর মস্তক গৈরিক পাগ রঞ্জিত ছিল। কনৌজের দূত একটু ঘন জাফরান গৈরিক পোশাক পরিহিত। হাতে গৈরিক কাপড়ের পত্র । সাদা ও বাদামি রঙের ঘোড়া গুলো গৈরিক জড়ির সাজে সজ্জিত।
দূতদের চাল ঢাল দেখে মনে হচ্ছিল যে তারা যেন নিজেরাই রাজা। দম্ভে অহংকারে পা পড়ছিল না। চৌহান রক্ষীর দল এসে দূতদের প্রায় উলঙ্গ করে পরীক্ষা ও জিজ্ঞাসাবাদ করতে লাগল। সব সম্পূর্ন হলে তারা বাতায়নে আমার দিকে তাকাল।
বাতায়ন থেকে আমি তাদের অনুমতি দিলাম। দুতেরা প্রাসাদ অন্দরে প্রবেশের অনুমতি পেল। প্রবল রোষ প্রকাশ করে তারা পৃথ্বীর সভার দিকে পদ চালান করল। তখন নিচে এসে আমি তাদের পথ রোধ করলাম, ” মহারাজ ব্যস্ত। কি সংবাদ আমাকে বলুন?”
প্রবল রোষে দূত চিৎকার করে উঠল ” যা বলার কনৌজ রাজ আপনার মালিক কে বলতে বলছেন।আপনি তো চাকর।” বুজলাম গরমে ও অপমানে তাদের মাথা বড্ড বিগড়ে গেছে। আমি দাস দাসীদের তাদের আপ্যায়নের হুকুম দিয়ে পৃথ্বীর কক্ষে গেলাম।
দ্বি প্রহরিক আহার সমাপ্ত করে পৃথ্বী তখন অস্ত্রশালায় যাবার আয়োজন করছিল।আমি বাতায়ন থেকে পৃথ্বীর কক্ষে উপস্থিত হলাম।
” কনৌজ থেকে দূত এসেছে। তাদের সব পরীক্ষা নিরীক্ষা করে প্রাসাদে ঢোকার অনুমতি দিয়েছি।তোমায় একবার রাজসভায় যেতে হবে। তারা কিছু বলতে চায় শুধু তোমায়।”
” এই তপ্ত বেলায় দূত? আছা চল যাচ্ছি”
পৃথ্বী ও আমি কিয়দক্ষনের মধ্যে বাতায়নের সভায় উপস্থিত হলাম। সেনাপতি ও আরো কিছু প্রধান সেনাও সভায় উপস্থিত হলেন। প্রত্যেকেই দেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদগ্রীব। বিশ্রামের তুলনায় কূটনৈতিক ও যুদ্ধ আলোচনা একটু বেশি পছন্দ করেন তাই।
পৃথ্বী সিংহাসনে বসে দুতের উদ্দেশ্যে বললে ” ওহে কনৌজের দূতবৃন্দ কিবা সংবাদ এনেছ আমার জন্য তোমরা? “
কথা শুনে প্রধান দূত এগিয়ে এসে পৃথ্বীকে প্রায় ধমকানোর সুরে বলল ” শুনুন হে যুবক রাজা , দিল্লিতে একটা বীভৎস ঝড় আসবে আর সেই ঝড় রোখার ক্ষমতা পাথর থেকে শুরু করে লোহা বা আরো কঠিন কিছু , কোনো দেয়ালেরই হবে না।”
শুনে মনে হবে কনৌজ রাজ বোধয় তার নতুন আবহাওয়া দপ্তরের খবর পাঠিয়েছেন তার প্রিয় শত্রু পৃথ্বীকে। কিন্তু এত শুধু শব্দের খেলেছিল। পৃথ্বী কবি নয় কিন্তু জ্ঞানী ছিল, আমি কবি ছিলাম। দুজনেই বুঝলাম দূতের মাধ্যমে কনৌজ রাজ কি বলতে চেয়েছেন? যেকেউ শিক্ষিত এর অর্থ জলের মত বুঝবে।
দূত এদিকে ভাবল পৃথ্বী বা কেউই কিছু বোঝেনি। এই ভেবে প্রধান দূত মনে মনে প্রফুল্লিত বোধ করে মুচকি হাসতে লাগল।
দূতের ব্যবহার ও শব্দে পৃথ্বীর বড় ক্রোধ হল। তরওয়ালের খাপে হাত দিয়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আমার দিকে তাকাল সে। তারপর আমার চোখের দিকে দেখে নিজের ক্রোধ সংবরন করে হাহ হাহ রবে হেঁসে উঠল। আমিও হেঁসে উঠলাম । তারপর সব সভাসদ। হাঁসির শব্দ নির্জন তপ্ত দ্বিপ্রহরে দিগন্ত বৃস্তিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। দূত গুলো বেশ ঘাবড়ে গেল।
পৃথ্বী একজন সুরবীর রাজা ছিল। কোনো রাজার বশ্যতা স্বীকার করা তার ধাতে ছিল না। চাইলেই দূতকে বন্ধী বানিয়ে কনৌজ রাজকে বার্তা দিতে পারত। কিন্তু সেটা একজন বীরের শোভা দেয় না। হাঁসি থামিয়ে পৃথ্বী দূত কে বলল ” ওহে বুড়ো রাজার বোকা দূত যাও, গিয়ে তোমার বুড়ো রাজাকে বলল তার সঙ্গে যুদ্ধের ময়দানে দেখা হবে। পারলে এসে লড়তে বল।এখন এখান থেকে বিদায় নাও।”
সেনারা দূতদের ধরে নিয়ে রাজ্যের সীমানার বাইরে ছাড়তে গেল….
ক্রমশঃ
তথ্যঃ
Cynthia Talbot (2015). The Last Hindu Emperor: Prithviraj Cauhan and the Indian Past, 1200–2000