#যদিদং_হৃদয়
সে বহু বহু বহু কাল আগের কথা। সেটা সংহিতা যুগ বা ত্রেতা যুগ। মানব সমাজ বন্য জীবন থেকে বেরিয়ে এসে সভ্যতার সূর্যকে তখন সবে স্পর্শ করেছে। কিন্তু বন্য আদিমতাকে পরিত্যাগ করতে পারে নাই।
আত্মরক্ষার লড়াই তখন মানুষ করে চলেছে। ছোট ছোট দল থেকে বড় গোষ্ঠী তার থেকে কৌম গঠন হয়েচে।কিন্তু মনুষ্য জাতি গ্রাম , সমাজ গঠন ইত্যাদি করতে শেখে নাই। পরিবার ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে কিন্তু বিবাহ নামক সামাজিক রীতিকে কেহ গ্রহণ করে নাই। মনুষ্য ছিল বন্যজীবের ন্যায় বাঁধন ছাড়া।
বনের জীবেরা কভু বা নিজের সঙ্গীর সঙ্গে বেইমানি করত না কিন্তু মানুষ করত। মাতৃতান্ত্রিক পরিবার তো ছিল।কিন্তু স্ত্রী জাতিকে অনেক কাজ ই করতে হত যা তার হৃদয় বিরুদ্ধ হত। কোথাও গিয়ে পারিবারিক বন্ধন ক্ষুণ্ণ হচ্ছিল। সমাজ ব্যবস্থা বা পারিবারিক কাঠামো ভেঙে পড়ছিল।
পরিবর্তনের খুব দরকার ছিল। এ পরিবর্তনের গৈরব বহন করেছেন, উদ্দালক ঋষিপুত্র শ্বেতকেতু।
সংহিতা যুগে উদ্দালক নামে এক মহর্ষি ছিলেন দেশ ছিল পাঞ্চাল। এঁর প্রকৃত নাম আরুণি। পরে শিক্ষাগুরুর কাছ থেকে উদ্দালক নামপ্রাপ্ত হন।
তিনি ধৌম্য নামক ঋষির শিষ্য ছিলেন। গুরুগৃহে থাকার সময়, একবার গুরু তাঁকে ক্ষেতের আইল বাঁধার নির্দেশ দেন। বহু চেষ্টা করেও তিনি এই কাজে সফল হতে না পেরে, আইল বরাবর নিজের দেহ স্থাপন করে, ক্ষেতের জল রোধ করেন। পরে ধৌম্য আরুণিকে দীর্ঘক্ষণ না দেখে, ক্ষেতের কাছে এসে আরুণির নাম ধরে ডাকতে থাকেন। আরুণি গুরুর ডাক শুনে মাটি থেকে উঠে, গুরুর সামনে আসেন এবং সমুদয় ঘটনা বলেন। ধৌম্য আরুণির প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে বেদ ও সকল ধর্মশাস্ত্র প্রদান করেন। আইল থেকে উত্থিত হয়ে নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন বলে, তাঁর নামকরণ করেন উদ্দালক।
তাঁহার পুত্রের নাম ছিল শ্বেতকেতু। তবে এই শ্বেতকেতু, উদ্দালকের ঔরসে বা ক্ষেত্রে জন্মাননি। জন্ম ছিলেন পিতার এক শিষ্যের ঔরসে।
নদীর তীরে পর্ন কুটির। কুলকুল শব্দে নদী বহমান।পক্ষী কুজন, নদীর মৃদু বাতাসে দিগন্ত মুখরিত। শ্বেতকেতু পিতা-মাতার নিকট বসে বিশ্রাম গ্রহণ করছিলেন, এমন সময় এক অনাহুত অথিতি এসে তার জননীর হস্ত ধারণপূর্বক কহিলেন, আইস আমরা যাই। জননী যাবার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ না করে বিরোধিতা করলেন। তাতে ফল কিছু হল না।
ঋষিপুত্র পিতার সমক্ষেই মাতাকে বলপূর্বক (‘বলাৎ ইব’) নিয়ে যেতে দেখে সাতিশয় ক্রুদ্ধ হলেন। মহর্ষি উদ্দালকপুত্র শ্বেতকেতুকে তদবস্থ দেখে বললেন, ‘বৎস ক্রোধ কর না, ইহা নিত্য ধর্ম। এ ভূমন্ডল মধ্যে, সমস্ত প্রাণী অবারিত। পশু যে রকম ব্যবহার করে, প্রজাগণও স্ব স্ব বর্ণে সে রকম আচরণ করিয়া থাকে। সে অর্থে আমার উপর তোমার মাতার ও তোমার মাতার উপর আমার কোনো অধিকার নেই।”
ঋষিপুত্র পিতার বাক্য শ্রবণ করেও ক্ষান্ত হলেন না, প্রত্যুত পূর্বাপেক্ষা ক্রুদ্ধ হলেন। শুধু প্রতিকারের অপেক্ষায় থাকলেন।কিঞ্চিৎ বয়বৃদ্ধি হলে আরুণি তাঁর পুত্রকে বললেন, ‘শ্বেতকেতু, তুমি ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করে গুরুগৃহে বাস করো। আমাদের বংশে বেদ অধ্যয়ন না করে শুধু নামে মাত্র ব্রাহ্মণ হয়েছেন এমন কেউ নেই। (ছান্দোগ্য-৬/১/১)।। বারো বছর বয়সে শ্বেতকেতু গুরুগৃহে গেলেন। চব্বিশ বছর বয়স পর্যন্ত সেখানে থেকে সমস্ত বেদ অধ্যয়ন করে গম্ভীরচিত্ত, অবিনয়ী ও পাণ্ডিত্যের অহংকারে পূর্ণ হয়ে বাড়ি ফিরে এলেন।
ফিরে এসে তিনি বললেন ” আমি শ্বেতকেতু ব্রহ্মবাদী আমি আজ হতে সমাজ গঠনের নিমিত্ত বিবাহের নিয়ম করলাম”তিনি এই নিয়ম স্থাপন করে দিলেন যে, “অদ্যাবধি যে স্ত্রী পতিভিন্ন পুরুষান্তর সংসর্গ করিবে এবং যে পুরুষ কৌমারব্রহ্মচারিনী বা পতিব্রতা স্ত্রীকে পরিত্যাগ করিয়া অন্য স্ত্রীতে আসক্ত হইবে, ইহাদের উভয়কেই ভ্রূণহত্যা সদৃশ ঘোরতর পাপপঙ্কে লিপ্ত হইতে হইবে।”
(মহাভারত, আদিপর্ব, অধ্যায়: ১২২৷৷১/১২২/২৪৷৷ অনুবাদক: কালিপ্রসন্ন সিংহ)
(মহাভারত, আদিপর্ব, অধ্যায়: ১২২৷৷১/১২২/২৪৷৷ অনুবাদক: কালিপ্রসন্ন সিংহ)
শ্বেতকেতু সেই যুগে পক্ষপাতশুন্য অনুশাসনই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
যদিও পুরুষরা তাঁর বিধান মানতোনা। আর শ্বেতকেতু নিজে যেহেতু ক্ষেত্রজ পুত্র ছিলেন, তারও কোন পরিবর্তন করেননি।আর এই পরিবর্তনকে পরিশোধিত করেছিলেন, দেবগুরু বৃহস্পতির ভাইপো, উতথ্যের পুত্র দীর্ঘতমা।মনুষ্য সমাজে পরিবারের উদ্ভব হয়েছে জীবজনিত কারণে । বিবাহের মধ্য দিয়ে নারী পুরুষের সম্পর্ককে সামাজিক রূপ ও মর্যাদা দেওয়া হয়েছে আনেক পরে ।আদিম জন জাতির কাছে খাদ্য সংগ্রহ করাই ছিলো খুবই কঠিণ ব্যাপার। মূলত , পশু খাদ্যই ভক্ষ্ণ করতো তারা। তাই পশু শিকারের উদ্দেশ্যে তাদের যেতে হতো দূর থেকে দূরান্তে ।
এবং সেক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অসহায় ও রক্ষকহীন নারীকে একা পেয়ে অন্যকোনো পুরুষ বলপূর্বক অপহরণ করে নিয়ে গেলে রক্তপাত ও যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো । এরূপ পরিস্থিতি বর্জনের জন্যই মনুষ্য সমাজে বিয়ের মাধ্যমে নারী ও পুরুষের সম্পর্ককে সামাজিক স্বীকৃতি দান করা হয়েছে । বিখ্যাত নৃতত্ববিদ ওয়ের্স্টারমার্কের মতে –“ পরিবার গঠন করে স্ত্রী ও পুরুষ একত্রে বাস করা থেকেই বিবাহ প্রথার উদ্ভব হয়েছে, বিবাহ প্রথা থেকে পরিবারের সূচনা হয়নি।“
যদিও , পণ্ডিত সমাজেআজ একবাক্যে স্বীকৃত যে পরিবারের থেকেই বিবাহপ্রথার উদ্ভব , তবুও , বাখোফেন , মরগান প্রমুখনৃতত্ববিদ একদা একথা স্বীকার করতে চাননি ।
যাইহোক , স্মৃতি শাস্ত্রের বিখ্যাত গ্রন্থ “ মনুসংহিতায়” মোট আট প্রকার বিয়ের কথা উল্লেখ আছে। সেগুলো হলো , যথাঃ- ১) ব্রাহ্ম
২) আর্য
৩) প্রাজাপত্য
৪)আসুর
৫) গান্ধর্ব
৬) রাক্ষস
৭) দৈব
৮ ) পৈশাচ
বর্তমানে মনুষ্য সমাজে ব্রাহ্ম বিবাহই স্বীকৃত ও লক্ষণীয় । বিবাহের মাধ্যমে একজন নারী ও পুরুষ সারাজীবন একসাথে সুখ – দুঃখে থাকার প্রতিজ্ঞা করেন অগ্নিকে সাক্ষী রেখে ।
“ যদেতৎ হৃদয়ং তব তদস্তু হৃদয়ং মম
যদিদং হৃদয়ং মম, তদস্তু হৃদয়ং তব ‘’। অর্থাৎ তোমার এই হৃদয় আমার হোক আর আমার এই হৃদয়ও তোমার হোক।
২) আর্য
৩) প্রাজাপত্য
৪)আসুর
৫) গান্ধর্ব
৬) রাক্ষস
৭) দৈব
৮ ) পৈশাচ
বর্তমানে মনুষ্য সমাজে ব্রাহ্ম বিবাহই স্বীকৃত ও লক্ষণীয় । বিবাহের মাধ্যমে একজন নারী ও পুরুষ সারাজীবন একসাথে সুখ – দুঃখে থাকার প্রতিজ্ঞা করেন অগ্নিকে সাক্ষী রেখে ।
“ যদেতৎ হৃদয়ং তব তদস্তু হৃদয়ং মম
যদিদং হৃদয়ং মম, তদস্তু হৃদয়ং তব ‘’। অর্থাৎ তোমার এই হৃদয় আমার হোক আর আমার এই হৃদয়ও তোমার হোক।
বিবাহের সূচনা নিয়ে যেমন নানান মতবাদ আছে ,তেমনি কালে কালে বিয়ের রীতিনীতি ও আয়োজনেরক্রমধারায় পরির্বতন লক্ষণীয়। আজ থেকে একশো বছর আগে বিয়ে প্রচলিত ছিলো দুটোঅসমবয়সী নারী ও পুরুষের ভেতর।
সেক্ষেত্রে হয়তোকন্যার বয়স চার , পাত্রের বয়স পনেরো কিংবা আরোএকটু বেশী । আমাদের ঠাকুমা দিদিমার মুখে শোনা গল্পথেকেই বোঝা যায় সেই সময়ের বৈবাহিক পদ্ধতি । সেইসময়ে বিয়ের কণেকে সাজানো হতো লাল চেলিতে ,তবে বরের সাজ হতো বাঙালীর চির পরিচিত ধুতিতেই ।স্বর্ণালঙ্কারের প্রচলন যুগে যুগেই ছিলো।
যৌতুক প্রথা ছিলো বঙ্গদেশের বহু প্রাচীন প্রথা । শার্লি লিণ্ডেনবম পরিচালিত এক গবেষণায় জানা যায় ,বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতিছিলো কৃষি নির্ভর । আর বিবাহযোগ্য পাত্রের আয়েরউৎস তেমন ভালো ছিলোনা । অন্যদিকে বিবাহযোগ্যপাত্রী পাওয়া যেত হাতেগোণা । তাই সে সময়পাত্রপক্ষকে পাত্রীপক্ষকেই যৌতুক দিতে হতো । পরেঅবশ্য পরিবেশ ওঅর্থনীতির পরিবর্তন ঘটলে এইধারারও আমূল পরিবর্তন ঘটে ।
বঙ্গদেশে বিয়ের ছাপানো আমন্ত্রণ পত্রের প্রচলন উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি । আগে আমন্ত্রিতদের বাড়িতে সশরীরে গিয়ে তেল , হলুদ, পান, সুপারি হাতে দিয়ে আমন্ত্রণ জানাতে হতো । তাছাড়া , নিমন্ত্রিত মেয়েদের তাদের বাড়ি থেকে গাড়ী করে নিয়ে আসতে হতো এবং ভোজনের পর আবার তাদের গাড়িতে করেই পৌঁছিয়ে দিতে হতো ।
আর যেসব নিমন্ত্রিতরা দূর থেকে আসতেন , তাদের গাড়ী ভাড়া বাবদ কিছু অর্থ দিতে হতো কর্মকর্তাকে । প্রাচীন রীতিনুযায়ী হিন্দু বাঙ্গালী বিয়েতে পাত্র পাত্রী দেখা , লগ্নপত্র/ পাটীপত্র লেখার মতো প্রাথমিক দেখাশোনা পর্ব শেষ হওয়ার পরেই আসে নিমন্ত্রণ পর্ব ।
একেবারে প্রথম দিকের আমন্ত্রণ পত্র কেমন ছিলো তা জানা না গেলেও উনিশ শতকের শেষ ভাগ ও তার পরর্বতী সময়ের কয়েকটি বয়ান দেখলেই সেই সময়ের আমন্ত্রণ পত্র সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায় । উল্লেখ্য যে এই সময়ের আমন্ত্রণ পত্রের কোথাও পাত্র কিংবা পাত্রীর বংশ পরিচয় উল্লেখ থাকতো না।
বিবাহের শাস্ত্রীয় আচার ও মেয়েদের দ্বারা সম্পন্ন মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান সমূহ এখনও বজায় আছে বটে , কিন্তু বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে ভোজনের ব্যাপারে ।
আগে বিয়েতে ফলার ও ভাতের পরির্বতে লুচির চল ছিলো , এমনকি রান্নাবান্নার ক্ষেত্রেও বাড়ির গিন্নিদের পরির্বতে সেখানে আসে উড়িয়া বামুন । সামাজিক নিয়ম এবং জাতপাতের চলমান ধারাকে মাথায় রেখে স্বাভাবিক ভাবেই ব্রাহ্মণরাই অগ্রাধিকার পেতো। সবার প্রথমেই তাদেরকেই ভোজনে আহ্বান করা হতো ।
গৃহকর্তা কে অতিথিবর্গের সকলের সামনে গিয়ে বলতে হতো _____” আপনাদের মধ্যে যারা ব্রাহ্মণ আছেন , তাঁদের গাত্রোস্থান করতে আদেশ হউক”। পরিবেশনও সম্পন্ন হতো ব্রাহ্মণদের দ্বারা , ভোজনের শেষে তাদের দক্ষিণা দানের রেয়াজও ছিলো । খাওয়ানো হতো কর্মকর্তার বাড়িতেই।
মাটিতেই কুশাসন বিছিয়ে কলাপাতায় খাওয়ানো হতো । পাতার সামনে জলভর্তি মাটির গেলাস, দই ও ক্ষীর পরিবেশনের জন্য মাটির খুরি, যা আজ অদ্দৃশ্য থেকেও বেশি । খাদ্য তালিকায় থাকতো , লুচি, বেগুন ভাজা , ডাল , আলুর দম, মাছের কালিয়া এবং মিষ্টান্নের ভেতর, রসগোল্লা, মিহিদানা, লেডিকেনী ইত্যাদি । বাড়িতেই বসত ভিয়েন। মহিলাদের খাওয়ার জন্য ছিলো পৃথক পংক্তি। বর আসতো চতুর্দ্দোলায় চেপে , বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার পর কনে শ্বশুর বাড়ী যেতেন মহাপায়ার করে ।
লৌকিকতার ক্ষেত্রটিও ছিলো তাৎপর্যময়।আটআনা বা একটাকা দিয়ে মূলত তা সারা হতো। বিশিষ্টজনরা চারটাকা পর্যন্ত দিতেন। পরে টাকার জায়গায় বই আসে। তবে সবথেকে চমকপ্রদ যেটা ছিলো, সেগুলো আসলে “ কবিত্বপূর্ণ “ কাগজ। এগুলো হয় সোনালী রঙের কিংবা রুমালের ন্যায় এক প্রকারের কাগজের ওপর লাল কালি বা সোনার জলে ছাপা কবিতা , ছড়া বা বিবাহ সম্পর্কিত যৌতূক ।দুই পরিবারের মানদণ্ড ধার্য করা হতো এগুলোর উপর।কেননা এর মাধ্যমেই উপস্থিত স্বজনেরা বিচার করতেন কোন পরিবার কখানা উপহার বিলি করেছেন।
—তবুও বিবাহ , যার অক্ষরে অক্ষরে জড়িয়ে থাকে পবিত্র এক বন্ধন !
তথ্যঃ
বৃহদারন্যক উপনিষদ
মহাভারত ; বন পর্ব
ছন্দগ্য উপনিষদ
#শ্রী