ভারতের সেমিকন্ডাক্টর মিশন: ‘বিক্রম’ চিপ কি ভূ-রাজনীতির নতুন গেম চেঞ্জার?
বালু থেকে জন্ম নেওয়া নতুন বিশ্বশক্তি
এক টুকরো সাধারণ বালি। এই বালি থেকেই তৈরি হয় আধুনিক সভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান—সেমিকন্ডাক্টর চিপ। আজকের বিশ্বে সোনা বা তেলের চেয়েও মূল্যবান এই সিলিকন চিপ ছাড়া আমাদের স্মার্টফোন অচল, গাড়ি চলে না, এমনকি মঙ্গল অভিযানের মহাকাশযানও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। দীর্ঘদিন ধরে আমেরিকা, তাইওয়ান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মতো কয়েকটি দেশ এই বিলিয়ন ডলারের শিল্পে একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রেখেছিল। কিন্তু এখন এই ভূ-রাজনৈতিক খেলার মাঠে এক নতুন এবং অপ্রত্যাশিত প্রতিযোগী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ভারত।
ভারত সরকার শুধু চিপের ভোক্তা হয়ে থাকতে নারাজ; তাদের লক্ষ্য উৎপাদক হওয়া। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যখন বিশ্ব ৩ ন্যানোমিটারের মতো অত্যাধুনিক চিপ তৈরির প্রতিযোগিতায় মত্ত, তখন ভারত কেন ‘বিক্রম’ নামের ১৮০ ন্যানোমিটারের একটি চিপ তৈরি করে আলোচনায় এলো? এটি কি প্রযুক্তিগত দৌড়ে পিছিয়ে পড়া, নাকি এর আড়ালে লুকিয়ে আছে ভারতের এক সুগভীর কৌশলগত পরিকল্পনা?
ভারতের সেমিকন্ডাক্টর মিশন ভারতের অদ্ভুত কৌশল: কেন নির্ভরযোগ্যতা গতির চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ?
আপাতদৃষ্টিতে, ভারতের ১৮০ ন্যানোমিটার (nm) চিপ নিয়ে আসাটা বেশ অদ্ভুত মনে হতে পারে। যেখানে অ্যাপল বা ইন্টেলের মতো কোম্পানিগুলো তাদের ডিভাইসের জন্য ক্ষুদ্রতম এবং দ্রুততম চিপ তৈরি করছে, সেখানে ভারত একটি পুরোনো এবং তুলনামূলকভাবে বড় আকারের প্রযুক্তি বেছে নিয়েছে। এখানেই ভারতের মূল কৌশলটি লুকিয়ে আছে।
ভারতের সেমিকন্ডাক্টর মিশনের প্রাথমিক লক্ষ্য স্মার্টফোন বা ল্যাপটপের বাজার দখল করা নয়। তাদের প্রথম এবং প্রধান উদ্দেশ্য হলো দেশের কৌশলগত খাতগুলোতে (strategic sectors) আত্মনির্ভরতা অর্জন করা। এই খাতগুলো হলো:
- প্রতিরক্ষা (Defence): মিসাইল সিস্টেম, রাডার, যুদ্ধবিমান এবং অন্যান্য সামরিক সরঞ্জামে ব্যবহৃত চিপগুলোর ক্ষেত্রে গতির চেয়ে নির্ভরযোগ্যতা এবং স্থিতিশীলতা (stability) অনেক বেশি জরুরি।
- মহাকাশ গবেষণা (Space Research): স্যাটেলাইট, রকেট এবং মহাকাশযানে এমন চিপ প্রয়োজন যা চরম পরিস্থিতিতেও নির্ভুলভাবে কাজ করতে পারে। ‘বিক্রম’ চিপ এই প্রয়োজন মেটানোর জন্যই ডিজাইন করা হয়েছে।
- পারমাণবিক শক্তি (Nuclear Power): পারমাণবিক চুল্লি নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক্সে সামান্যতম ত্রুটিও ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটাতে পারে। এখানেও পরীক্ষিত এবং নির্ভরযোগ্য প্রযুক্তিই কাম্য।
‘বিক্রম’ চিপটি সম্পূর্ণভাবে ভারতেই ডিজাইন, উৎপাদন এবং টেস্টিং করা হয়েছে, যা “মেক ইন ইন্ডিয়া” উদ্যোগের একটি বড় সাফল্য। এর মাধ্যমে ভারত প্রমাণ করেছে যে, তারা এখন চিপ তৈরির পুরো প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে, যা দেশের জাতীয় নিরাপত্তা এবং কৌশলগত স্বাধীনতার জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
ভারতের সেমিকন্ডাক্টর মিশন ইকোসystem নির্মাণ: সরকারি বিনিয়োগ এবং বেসরকারি উদ্যোগ
একটি সফল সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি শুধু চিপ তৈরির কারখানার উপর নির্ভর করে না, এর জন্য প্রয়োজন একটি শক্তিশালী ইকোসিস্টেম। ভারত সরকার এই বাস্তবতা উপলব্ধি করে ৭৬,০০০ কোটি টাকার ‘প্রোডাকশন লিঙ্কড ইনসেনটিভ’ (PLI) স্কিম ঘোষণা করেছে, যার মূল লক্ষ্য দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করা।
এই উদ্যোগের ফলও মিলতে শুরু করেছে:
- টাটা ইলেকট্রনিক্স (Tata Electronics): গুজরাটে ভারতের প্রথম সেমিকন্ডাক্টর ফ্যাব্রিকেশন প্ল্যান্ট তৈরি করছে।
- মাইক্রোন টেকনোলজি (Micron Technology): মার্কিন এই চিপ জায়ান্ট ভারতে একটি অত্যাধুনিক মেমরি চিপ অ্যাসেম্বলি এবং টেস্টিং প্ল্যান্ট বানাচ্ছে।
- দেশীয় সংস্থা: সিজি পাওয়ার (CG Power) এবং কিয়েন্স টেকনোলজিসের (Kaynes Technologies) মতো ভারতীয় কোম্পানিগুলোও এই দৌড়ে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০২৭ সালের মধ্যে ভারত বিশ্বের শীর্ষ পাঁচটি চিপ প্যাকেজিং বাজারের একটি হতে পারে। এটি শুধু প্রযুক্তিগত সাফল্যই নয়, এর মাধ্যমে দেশে লক্ষ লক্ষ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং AI, EV, IoT, এবং 5G-এর মতো ভবিষ্যৎ প্রযুক্তিতে ভারতের নেতৃত্ব দেওয়ার পথ প্রশস্ত হবে।
ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট: চ্যালেঞ্জ এবং অপার সম্ভাবনা
ভারতের এই সেমিকন্ডাক্টর মিশন এমন এক সময়ে গতি পেয়েছে, যখন বিশ্ব এক তীব্র ‘চিপ যুদ্ধে’ (Chip War) লিপ্ত। আমেরিকা এবং চীনের মধ্যে প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের লড়াই বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা এখন চীনের উপর তাদের নির্ভরতা কমাতে চাইছে এবং একটি নির্ভরযোগ্য বিকল্প খুঁজছে।
ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা এবং বিশাল মেধাবী তরুণ প্রজন্মের কারণে ভারত সেই নির্ভরযোগ্য বিকল্প হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার এক সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছে।
তবে পথটি সহজ নয়। প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো হলো:
- প্রযুক্তি এবং খরচ: একটি অত্যাধুনিক লিথোগ্রাফি মেশিনের দাম কয়েক বিলিয়ন ডলার এবং এর প্রযুক্তি মূলত ডাচ কোম্পানি ASML-এর নিয়ন্ত্রণে।
- অবকাঠামো: একটি চিপ ফ্যাব্রিকেশন প্ল্যান্টের জন্য নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ এবং বিশুদ্ধ পানির প্রয়োজন, যা নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
এতসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, সুযোগগুলো অনেক বড়। ভারতের রয়েছে লক্ষ লক্ষ ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী এবং উদ্যোক্তা, যারা শুধু বিদেশি প্রযুক্তি গ্রহণ করবে না, বরং নিজেদের উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে বিশ্বকে নতুন পথ দেখাবে।
উপসংহার: স্বপ্ন নাকি বাস্তবতা?
ভারতের সেমিকন্ডাক্টর বিপ্লব শুধু একটি প্রযুক্তিগত প্রকল্প নয়; এটি একুশ শতকের ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্রে নিজের স্থান পাকা করার একটি সুচিন্তিত কৌশল। ‘বিক্রম’ চিপ হয়তো বিশ্বের দ্রুততম চিপ নয়, কিন্তু এটি ভারতের আত্মবিশ্বাস এবং আত্মনির্ভরতার প্রতীক। এক টুকরো বালি থেকে শুরু হওয়া এই যাত্রা হয়তো একদিন সত্যিই ভারতের ভবিষ্যৎ বদলে দেবে। প্রশ্ন এখন একটাই—এই দৌড়ে ভারত কি বিজয়ী হবে, নাকি কেবল স্বপ্ন দেখেই থেমে যাবে? সময়ই তার উত্তর দেবে। ভারতের সেমিকন্ডাক্টর মিশন ভারতের সেমিকন্ডাক্টর মিশন ভারতের সেমিকন্ডাক্টর মিশন ভারতের সেমিকন্ডাক্টর মিশন ভারতের সেমিকন্ডাক্টর মিশন